হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির খড়গ : আসামের এনআরসি এবং বাংলাদেশ
কিশোর শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক দাবীর আন্দোলনে ঢাকাসহ সারাদেশে তীব্র রাজনৈতিক উত্তেজনা ও অনিশ্চয়তা দেখা যাচ্ছিল,
কামরুল হাসান দর্পণ : বাংলাদেশের রাজনীতি ও আভ্যন্তরীন বিষয়ে বিদেশিদের হস্তক্ষেপের মতো ঘটনা বিশ্বের আর কোনো দেশে ঘটে কিনা জানা নাই। একটি দেশের রাজনীতি ও অর্থনীতি কিভাবে চলবে, তা তার একান্ত নিজস্ব ব্যাপার। এক্ষেত্রে যদি অন্য কেউ যেচে বলে এভাবে না ওভাবে চলতে হবে, তবে সে দেশের স্বাধীনভাবে চলার কোনো কারণ থাকতে পারে না। বাংলাদেশের রাজনীতি ও অর্থনীতিতে বিদেশিদের হস্তক্ষেপের ঘটনা নতুন নয়। স্বাধীনতার পর থেকেই চলে আসছে। সদ্য স্বাধীন হওয়া অর্থনৈতিকভাবে বিধ্বস্ত একটি দেশের জন্য বন্ধু প্রতিম দেশগুলোর সাহায্য-সহযোগিতা থাকা অস্বাভাবিক কিছু নয়। তবে তা যদি যুগের পর যুগ চলতে থাকে, তখন দেশটির নিজের পায়ে দাঁড়ানো বা আত্মমর্যাদা নিয়ে চলা কঠিন হয়ে পড়ে। এ থেকে বের হওয়ার জন্য যোগ্য নেতৃত্বের প্রয়োজন পড়ে। যে নেতৃত্ব দেশকে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে সম্মানজনক অবস্থানে নিয়ে যাবে। এ কাজটি করতে ব্যর্থ হলে, যারা বন্ধু হয়ে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয় বা দিয়েছে, তারা পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষভাবে কতৃর্ত্ব করতে শুরু করে। দুঃখের বিষয়, স্বাধীনতার ৪৬ বছরেও বাংলাদেশ বন্ধুরূপী বিদেশীদের পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষ কর্তৃত্ব থেকে বের হতে পারেনি। এ সময়ে যত সরকার ক্ষমতায় এসেছে, তাদের কেউই সুদৃঢ় নেতৃত্বের মাধ্যমে দেশকে স্বাবলম্বী করে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সমর্থ্য হয়নি। বরং বিদেশীদের সাহায্য-সহযোগিতার জন্য যেন তীর্থের কাকের মতো অপেক্ষারত। মুখে মুখে দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতির কথা বললেও, বিদেশী সহযোগিতা থেকে এতটুকু বের হতে পারেনি। বরং দেশের মানুষ দেখছে, অর্থনীতির ক্ষেত্রে বিদেশি দাতা সংস্থাগুলো তাদের প্রদেয় অর্থ কীভাবে ব্যয় করতে হবে তার দিক নির্দেশনা দিয়ে যাচ্ছে। ইউএনডিপি, বিশ্বব্যাংক, এডিবি, আইএমএফ, আইডিবিসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ও দাতাগোষ্ঠীর প্রচ্ছন্ন ও প্রত্যক্ষ চাপ রয়েছে। বিশ্বব্যাংক তো প্রতি পদে পদে আমাদের উপর খবরদারি করে চলেছে। আমাদের যেন কোনো উপায় নেই। তার কথা মানতেই হবে। পেটে খেলে পিঠে সইতে হবে-এমন দশার সৃষ্টি হয়েছে। অর্থনৈতিকভাবে উন্নতি করতে হলে এসব দাতা সংস্থার ঝুলিয়ে দেয়া রশি বেয়ে বেয়েই আমাদের উঠতে হবে। বিদেশিদের এমন অলিখিত ও অদৃশ্য খবরদারি বরাবরই আমাদের উপর রয়েছে। এ থেকে কবে মুক্ত হবো, তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। এটা সবাই জানে, বিশ্বব্যাংক এমন একটি প্রতিষ্ঠান, যার জন্মই হয়েছে দরিদ্র ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর উপর খবরদারি করার জন্য। দেশগুলোর উন্নতি ও অগ্রগতির চাবিকাঠি তার নিয়ন্ত্রণে। পুঁজিবাদি বিশ্বের অগ্রযাত্রাকালে ধনিক শ্রেণীর আধিপত্য ও সাম্রাজ্যবাদী মনোভাব দরিদ্র দেশগুলোর উপর ধরে রাখা এবং নিয়ন্ত্রণ করার লক্ষ্যেই ব্যাংকটির জন্ম দেয়া হয়। এতে এক ঢিলে দুই পাখি মারার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়। প্রথমত, দরিদ্র ও উন্নয়নশীল দেশগুলোকে অর্থনৈতিকভাবে এগুতে হলে যে অর্থের প্রয়োজন, তা ঋণস্বরূপ যোগান দেয়া। দ্বিতীয়ত, দেশগুলোর উপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা, যাতে তাদের কথার বাইরে টুঁ শব্দ করতে না পারে। তৃতীয় বিশ্বের দরিদ্র দেশগুলোর এছাড়া কোনো উপায়ও ছিল না। বাধ্য হয়ে তাদের সহায়তা নিতে হয়েছে এবং সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোর কথা শুনতে হয়েছে। এখনও অনেক দেশের অর্থনীতি ব্যাংকটির নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। অবশ্য ব্রাজিলসহ ল্যাটিন আমেরিকার অনেক দেশই বিশ্বব্যাংককে বিদায় জানিয়ে দিয়েছে। বলা যায়, এক প্রকার গলাধাক্কা দিয়েই বের করে দিয়েছে। আমাদের মতো দেশগুলো এখনও এ অবস্থায় উপনীত হতে পারেনি। বিশ্বব্যাংকের ঋণ এবং তার কথার উপর নির্ভর করে চলেছে। সাম্রাজ্যবাদী এই করতল থেকে আমরা কবে বের হবো, তা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না।
দুই.
বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, বিদেশি দাতা সংস্থা ও বিশ্বব্যাংকের খবরদারির মধ্যেই আমরা নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছি বলে দাবি করছি। আমাদের উপর বিদেশিদের যে বিশাল ঋণের বোঝা চেপে আছে, তা বহন করেই এ উন্নতি করেছি। বলা হয়, আমাদের দেশে বিদেশিদের যে ঋণ রয়েছে, মাথাপিছু তার পরিমাণ প্রায় পাঁচ হাজার টাকা। প্রতিটি মানুষ এই ঋণের বোঝা নিয়েই এগিয়ে চলেছে। বোঝাটি যদি না থাকত, তাহলে আমরা কোথায় গিয়ে দাঁড়াতাম, তা কেবল কল্পনাও করা যায় না। ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত বিশ্বে পরিণত হবো বলে যে দাবী করা হচ্ছে, তা অনেক আগেই হওয়া সম্ভব ছিল। বাস্তবতা হচ্ছে, এ বোঝা আমরা চাইলেই নামিয়ে দিতে পারি না। ২০৪১ সালের মধ্যে পারব কিনা, তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই। কারণ এ সময়ের মধ্যে সিন্দাবাদের ভূতের মতো আমাদের ঘাড়ে চেপে বসা দাতা সংস্থা ও বিশ্ব ব্যাংককে গলাধাক্কা দিয়ে বের করে দিতে পারব কিনা, তা নিয়ে সন্দেহের যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে। ’৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশকে উন্নত দেখে যাওয়ার সৌভাগ্য আমাদের অনেকেরই হবে না। ততদিনে অনেক মানুষই জীবিত থাকবে না। এ ধরনের কথা বলা মানুষের সামনে আশার ফানুস ঝুলিয়ে দেয়ার মতো। আমাদের সরকার ও বিরোধী দল এখন এ আশাবাদের রাজনীতি করছে। তারা ভিশন-মিশনের তত্ত¡ হাজির করছে। মানুষকে স্বপ্ন দেখাচ্ছে। বর্তমানে মানুষের যে দুঃখ-কষ্ট, তা গোচানোর কোনো নামগন্ধ নাই। মানুষের মধ্যে যে চরম হতাশা বিরাজ করছে, তা দূর করার পদক্ষেপ নাই। দেশের লাখ লাখ বেকারের কর্মসংস্থানের কোনো ব্যবস্থা হচ্ছে না। একের পর এক শিল্প কারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। বছরের পর বছর ধরে বিনিয়োগের যে চরম মন্দাবস্থ চলছে, তা কাটানোর কোনো উদ্যোগ নাই। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী ব্যাংকগুলোতে ২ লাখ ৭৭ হাজার কোটি টাকার বেশি অর্থ অলস পড়ে আছে। এ অর্থ কোনো কাজে আসছে না। বৈদেশিক রেমিট্যান্স আশঙ্কাজনক হারে কমে গেছে। বিদেশি ঋণের বোঝার নিচে অর্থনীতির এই যে বেহাল দশা চলছে, এ সমস্যা থেকে বের হওয়ার কোনো উদ্যোগই পরিলক্ষিত হচ্ছে না। কেবল দিনে দিনে বাড়ছে ঋণ। তবে সরকারের উন্নয়নের ফানুস উড়ানো থেমে নেই। কয়েক দিন পরপর সরকারের তরফ থেকে উন্নতির সূচকের তথ্য তুলে ধরা হচ্ছে। মাথাপিছু আয় ১৬০২ ডলার হয়েছে, জিডিপি ৭.২৪ শতাংশ হবে, ইত্যকার নানা পরিসংখ্যানের কথা বলা হচ্ছে। অর্থনীতির এসব সূচক বাড়লেই কি আর নামলেই কি-এ নিয়ে সাধারণ মানুষ তেমন মাথা ঘামায় না। আলোচনা করতেও শোনা যায় না। তাদের আলোচনার প্রয়োজনও নেই। কারণ তাদের দুর্গতি কেবল তারাই জানে। তারা জানে, জিনিসপত্রের দাম নিয়ন্ত্রণহীন। যে টাকা নিয়ে বাজারে যায়, তা দিয়ে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনতে পারে না। পকেট থেকে টাকা বের হয়ে যাচ্ছে, বাজারের ব্যাগ ভরছে না। তারা এটাও জানে, সরকার মানুষের পকেট ভরার চেয়ে উল্টো কীভাবে পকেট থেকে অর্থ বের করে নেয়া যায়, তার নানা ফন্দিফিকির করছে। এক ভ্যাট নিয়ে মানুষের পকেট কাটার আতঙ্কের মধ্যেই আরেক ফন্দি এঁটেছে। ইতোমধ্যে খবর বের হয়েছে, ব্যাংকে যাদের অর্থ জমা আছে সে জমা থেকে টাকা কেটে রাখা হবে। ২০ হাজার টাকা ব্যাংক থেকে উঠালে ২০০ টাকা দিতে হবে। একই পরিমাণ টাকা জমা দিলেও নাকি ২০০ টাকা কেটে রাখা হবে। এভাবে লাখ থেকে কোটি টাকা পর্যন্ত অর্থ কেটে রাখার হার নির্ধারণ করা হচ্ছে। অর্থাৎ ব্যাংকে টাকা রেখেও মানুষের শান্তি নেই। অথচ মানুষ ব্যাংকে অর্থ জমা রাখে কিছু লাভের মুখ দেখার আশায়। এখন দেখা যাচ্ছে, সেই লাভেও সরকার হাত দিতে যাচ্ছে। অন্যদিকে সামনে বাজেট আসছে। বলা বাহুল্য, বাজেট আসলেই মানুষের মধ্যে চরম আতঙ্ক দেখা দেয়। বাজেট মানেই তাদের উপর করের বোঝা চাপা। জিনিসপত্রের দাম হু হু করে বেড়ে যাওয়া। অর্থাৎ সাধারণ মানুষ এমন এক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মধ্যে পড়েছে যে, তাদের নিদারুণ টানাপড়েনের মধ্য দিয়ে জীবনযাপন করতে হচ্ছে। তাদেরকে গরিবী হালের দিকে ঠেলে দেয়া হচ্ছে। এর মধ্যে যদি সরকারের তরফ থেকে বলা হয়, দেশে উন্নয়নের নহর বয়ে যাচ্ছে, তবে তাদের অসহায় হয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলা ছাড়া কিছুই করার থাকছে না। সরকারের উন্নয়নের গর্ব পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, ফ্লাইওভারসহ বড় বড় ইট-পাথরের প্রকল্পগুলো তখন তাদের কাছে বড় বড় স্থাপনা ছাড়া কিছু মনে হয় না। তারা কেবল দেখছে, তাদের অর্থে গড়া এসব প্রকল্প ঠায় দাঁড়িয়ে আছে, তাদের টানাপড়েন সহজ করতে কোনো কাছে আসছে না। এসব উন্নয়নের যে প্রয়োজন নেই, তা নয়। তবে মানুষের জীবনযাত্রা স্বাভাবিক রাখার মধ্যে যদি এসব উন্নয়ন প্রকল্প করা হতো, তাহলে এগুলো নিয়ে তাদের উচ্ছ্বাসও থাকত প্রবল।
তিন.
আমাদের দেশের অর্থনীতিতে যেমন বিদেশিদের আধিপত্য রয়েছে, তেমনি রাজনীতেও রয়েছে। যে দল ক্ষমতায় থাকে তার বিদেশিদের তুষ্ট করে ক্ষমতায় থাকার প্রবণতা দীর্ঘ কাল ধরেই চলে আসছে। আবার বিরোধী দলকেও বিদেশীদের তুষ্ট করে ক্ষমতায় যেতে বেশ তৎপর দেখা যায়। বিষয়টি অনেকটা এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে, বিদেশিদের তুষ্ট না করে যেন ক্ষমতায় যাওয়া কঠিন। এর বাস্তব নজির দেশের মানুষ বহুবার দেখেছে। খুব বেশি দূরে না গিয়ে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের দিকে যদি দৃষ্টি দেয়া যায় তবে দেখা যাবে, সে নির্বাচনে কী নগ্নভাবেই না প্রতিবেশি ভারত ক্ষমতাসীন দলকে ক্ষমতায় রাখতে ভূমিকা রেখেছে। দেশটির পররাষ্ট্র সচিব নিজে এসে কাকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করাতে হবে, কাকে করাতে হবে না-তা প্রকাশ্যে ঠিক করে দিয়ে যান। বাংলাদেশের ইতিহাসে রাজনীতিতে এমন নগ্ন হস্তক্ষেপ আর কখনো ঘটার নজির নেই। এমনিতে ক্ষমতাসীন দল ও প্রধান বিরোধী দলের মথ্যে রাজনৈতিক সমঝোতার জন্য দূতিয়ালী করার জন্য বিদেশিদের আগমনের দৃশ্য মানুষ দেখেছে। দিনের পর দিন তারা উভয় দলের সাথে আলাপ-আলোচনা করে সমঝোতার চেষ্টা করেছেন। তারপর ব্যর্থ হয়ে চলে গেছেন। এ ধরনের দূতিয়ালী কাম্য না হলেও, অনিবার্য সংঘাত-সংঘর্ষ এড়াতে বন্ধুত্ব সুলভ আচরণ হিসেবে দেশের মানুষ তা মেনে নিয়েছে। আমরা প্রথম এ ধরনের দূতিয়ালীর দৃশ্য দেখি ১৯৯৪ সালে। সে সময় ক্ষমতাসীন দল বিএনপি ও বিরোধী দল আওয়ামী লীগের মধ্যে সংকট নিরসনে আলোচনা করার জন্য জাতিসংঘের মহাসচিবের বিশেষ দূত স্যার নিনিয়ান স্টিফেন বাংলাদেশে এসেছিলেন। তিনি উভয় দলের সাথে বেশ কয়েক দিন আলোচনা করে সমঝোতায় উপনীত করতে ব্যর্থ হন। তারপর ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে জাতিসংঘের মহাসচিবের বিশেষ দূত আর্জেন্টিনার কূটনীতিক অস্কার ফার্নান্দেজ রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে সমঝোতা সৃষ্টির লক্ষ্যে বাংলাদেশে আসেন। কয়েক দিনের আলাপ-আলোচনার পর তিনিও ব্যর্থ হয়ে চলে যান। জাতীয় নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক সংকট নিরসনে বিদেশিদের মাধ্যমে এ ধরনের উদ্যোগ দেখা গেছে। এসব উদ্যোগ একটি দেশের আভ্যন্তরীন রাজনীতিতে কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য এবং সম্মানের না হলেও, শান্তির জন্য দেশের মানুষ মেনে নিয়েছিল। অন্তত এ ভেবে মেনে নিয়েছিল, উদ্যোগটি জাতিসংঘের মাধ্যমেই হয়েছে। তবে যখন একটি দেশ সরাসরি দূত পাঠিয়ে কীভাবে নির্বাচন করতে হবে, তা এসে ঠিক করে দিয়ে যায়, তখন দেশের আত্মমর্যাদা বলে কিছু থাকে না। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে ভারত যে কাজটি করেছে, বোধকরি সচেতন ও দেশপ্রেমিক কোনো মানুষই তা ভালভাবে গ্রহণ করেনি। ভারতের এ ভূমিকাকে যারা স্বাগত জানিয়েছে তাদের বলতে শোনা যায়, বন্ধু রাষ্ট্র বলে সে তা করেছে। প্রশ্ন হচ্ছে, বন্ধু রাষ্ট্র মানে কি এই আমরা কীভাবে চলব, কী খাব, কী খাব না, তা তার পছন্দ মতো করতে হবে? আত্মমর্যাদাশীল কোনো রাষ্ট্র কি তা করতে পারে? এর ফলাফল কি ভাল হয়েছে? হয়নি। কারণ ভারতের এই একতরফা ভূমিকা বাংলাদেশের অন্যান্য বিদেশি বন্ধু রাষ্ট্রগুলো ভালভাবে নেয়নি। তারা নাখোশ হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ প্রভাবশালী অন্য দেশগুলোর কাছে বাংলাদেশ এখনও বিরাগভাজন হয়ে আছে। তারা স্পষ্টভাবেই ঐ নির্বাচনকে গ্রহণ করেনি। যার প্রতিক্রিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের জিএসপি সুবিধা স্থগিত হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের বিশাল শ্রমবাজারে শ্রমিক নেয়ার গতি কমে গেছে। আরও অন্যান্য সমস্যার মধ্য দিয়ে দেশকে চলতে হচ্ছে। এখন আগামী নির্বাচন নিয়ে বিদেশি বন্ধু রাষ্ট্রগুলো বেশ সরব হয়ে উঠেছে। তারা এখন থেকেই বলতে শুরু করেছে, আগামী নির্বাচন সব দলের অংশগ্রহণে অবাধ ও সুষ্ঠু দেখতে চায়। যে ভারত একটি বিতর্কিত নির্বাচন অনুষ্ঠানে সহায়তা ও সমর্থন দিয়েছে, সেই ভারতও আগামী নির্বাচন নিয়ে কথা বলেছে। বাংলাদেশে দেশটির হাইকমিশনার হর্ষ বর্ধন শ্রিংলা সম্প্রতি কূটনৈতিক সংবাদদাতাদের সংগঠন ডিকাব আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে স্পষ্ট করেই বলেছেন, বাংলাদেশের আভ্যন্তরীন রাজনীতি থেকে দূরে থাকবে ভারত। নির্বাচনের রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার সঙ্গেও যুক্ত হব না। তবে বাংলাদেশ চাইলে নির্বাচনে সহায়তা দেয়া হবে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশকে বলতে হবে কী ধরনের সহায়তা প্রয়োজন। পাঠক লক্ষ্য করুন, হাইকমিশনার শুরুতে সুন্দর সুন্দর কথা বলে শেষের দিকে বলেছেন সহায়তা করতে চান। অর্থাৎ শুরুতে কূটনৈতিক ভাষা প্রয়োগ করলেও শেষের দিকে এসে তা আর কূটনৈতিক বেড়াজালে থাকেনি। আসল কথা বলে ফেলেছেন। আগামী নির্বাচনে ভূমিকা রাখার খায়েশ পোষণ করেছেন। এর অর্থ বাংলাদেশের আভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করতে ভারত সদা প্রস্তুত। ভারত কি তার অন্য প্রতিবেশি চীন ও পাকিস্তানের ব্যাপারে এ ধরনের কথা বলতে পারত? কোনো দিনই পারত না। কারণ ঐসব দেশের আভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করার মতো হিম্মত ভারতের নেই। আমাদের দেশে পেরেছে এবং পারবে বলেই সে এ কথা বলেছে। অথচ আমরা বলতে পারছি না, আমাদের আভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও নির্বাচনের ব্যাপারে ভারত কেন, কোনো দেশেরই সহায়তার প্রয়োজন নেই। প্রয়োজন হলে আমরাই বলব। দুঃখের বিষয়, আমরা এ কথা বলতে পারছি না। পারছি না, রাজনৈতিক দলগুলোর ক্ষমতায় থাকা ও যাওয়ার লোভের কারণে। তারা চায় দেশের আত্মমর্যাদা থাকুক বা না থাকুক তাতে কিছু যায় আসে না, যে কোনো উপায়ে ক্ষমতায় থাকতে ও যেতে হবে। এমন এক আত্মমর্যাদাহীন রাজনৈতিক পরিবেশে দেশের মানুষ সুদীর্ঘকাল ধরেই বসবাস করে চলেছে।
চার.
আমরা উন্নয়নের জোয়ারে ভাসছি বলে সরকার যতই বলুক, তার সত্যিকারের কোনো ভিত নেই। আমরা অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে এখনও স্বাধীন হতে পারিনি। বন্ধুত্বের নামে বিদেশিদের কাছে অনেকটা বন্ধি হয়ে আছি। স্বনির্ভর ও আত্মমর্যাদাশীল জাতি হিসেবে অগ্রসর হতে পারিনি। যে দেশের অর্থনীতির বৃহদংশ বিদেশিদের আর্থিক সহায়তা এবং ক্ষমতাকামী দলগুলো বিদেশিদের সহায়তা ও পরামর্শের উপর নির্ভরশীল, সে দেশের আত্মমর্যাদা বলে কিছু থাকে না। আমরা এখন যতই উন্নতির কথা বলি না কেন, অর্থনীতিতে ইমার্জিং টাইগার বলে আখ্যায়িত হই না কেন, বিদেশিদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কর্তৃত্ব থেকে মুক্ত হতে না পারলে, তা গালভরা বুলিতে পরিণত হতে বাধ্য। মুক্ত বাজার অর্থনীতিতে আমাদের বন্ধু প্রয়োজন, কর্তৃত্ববাদীর প্রয়োজন নেই। ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগের জন্য পেশাদারি মনোভাব ও কূটনৈতিক বন্ধুত্বের পন্থা অবলম্বন করা বাঞ্চনীয়। এখানে ‘গিভ অ্যান্ড টেক’ নীতিকে প্রাধান্য দিতে হবে। নির্দিষ্ট কোনো দেশের উপর অতি নির্ভরশীল না হয়ে বিশ্বের অন্যান্য দেশের সাথে যোগাযোগ ও বাণিজ্য সম্প্রসারণ নীতি অবলম্বন করতে হবে। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বিদেশিদের সহায়তা ও হস্তক্ষেপ করার মতো পরিস্থিতি যাতে সৃষ্টি না হয়, এ ব্যাপারে সতর্ক থাকা দরকার। বিদেশিদের কোনো ধরনের সহায়তা ও হস্তক্ষেপ ছাড়া রাজনীতির সবচেয়ে বড় সমস্যা সমাধানের নজির আমাদের দেশে রয়েছে। স্বৈরাচার এরশাদের পতনের পর গণতন্ত্রের নবযাত্রাকালে আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো ঐকমত্য হয়ে যে অনন্য নজির স্থাপন করেছে, তা রাজনীতির মূল চেতনা হওয়া উচিত। এই দৃষ্টান্ত সামনে রেখে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সমঝোতা ও আন্তঃসম্পর্ক বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। নিজেদের সমস্যা নিজেরা সমাধানের উদ্যোগ নিলে বিদেশিরা যেমন হস্তক্ষেপের সুযোগ পাবে না, তেমনি রাজনৈতিকভাবে বিশ্বে মর্যাদাপূর্ণ একটি অবস্থান সৃষ্টি হবে।
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।