হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির খড়গ : আসামের এনআরসি এবং বাংলাদেশ
কিশোর শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক দাবীর আন্দোলনে ঢাকাসহ সারাদেশে তীব্র রাজনৈতিক উত্তেজনা ও অনিশ্চয়তা দেখা যাচ্ছিল,
মোহাম্মদ আবদুল গফুর : বর্ষ-পরিক্রমায় আমাদের কাছে আবার হাজির হয়েছে মাহে রমজান। এই মাসকে বিশ্বাসীদের জন্য সমাজ ও জীবন উন্নত করার প্রশিক্ষণের মাসও বলা যেতে পারে। কারণ এই মাসের সিয়াম সাধনা যথাযথভাবে পালন করলে মানুষের জীবন এমন এক মহান স্তরে উন্নীত হতে পারে, যার সুপ্রভাব সমাজের বৃহত্তর পর্যায়েও অনুভূত হতে বাধ্য।
সিয়াম শব্দ সওম-এর বহু বচন। সওমের অর্থ বিরত থাকা। ইসলামী পরিভাষায় সিয়ামে রমজানের অর্থ রমজান মাসে সুবেহ সাদেক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত মানুষের সর্ব প্রকার পানাহার, কামাচার হতে বিরত থাকা। যে সমস্ত পানাহার ও কামাচার অন্যান্য সময়ে বৈধ থাকে, যেমন হালাল খাদ্য গ্রহণ বা হালাল পানীয় পান, নিজ স্ত্রী সম্ভোগ, সেসব থেকেও রমজান মাসের নির্দিষ্ট সময়ে বিরত থাকাই সিয়ামে রমজানের দাবী।
সে নিরিখে সিয়ামে রমজানকে বৈশিষ্ট্যব্যঞ্জক প্রশিক্ষণ বলা যেতে পারে, যা রমজানের এক মাস ধরে পালন করতে হয়। আরেকটি কারণেও সিয়ামে রমজানের বৈশিষ্ট্য বিশেষ মর্যাদার দাবীদার। সিয়াম ছাড়া ধনী দরিদ্র নির্বিশেষে সকল মুসলমানের জন্য অবশ্য পালনীয় আরেকটি ইবাদত রয়েছে সালাত বা নামাজ। এই সালাত দুই, তিন বা চার রাকাআত হয়ে থাকে। এর দীর্ঘতম চার রাকাআত সালাত আদায় করতে সাধারণত কয়েক মিনিটের বেশী সময় লাগে না।
কিন্তু সিয়ামে রমজান? সুবেহ সাদেক থেকে শুরু করে সূর্যাস্ত পর্যন্ত এক একটি সওম বা রোজার মেয়াদ-কাল মওসুম ভেদে ষোল সতর ঘণ্টাও হয়ে থাকে। প্রতিদিন এত দীর্ঘ সময় সিয়াম আরোপিত বিধি-নিষেধ মেনে জীবন চালনা, তাও আবার পূরা এক মাস ধরে, এর গুরুত্বই আলাদা।
সিয়াম ছাড়া ইসলামে অন্যান্য যেসব ফরজ ইবাদত রয়েছে, তার মধ্যে রয়েছে সালাত, জাকাত, হজ্জ। এর প্রত্যেকটি পালন করা হয় প্রকাশ্যে। সালাত জামাতে আদায় করাই কাংখিত নিয়ম জাকাত আদায়েও সাধারণত জাকাত-দাতা ও জাকাত গ্রহণকারীর সংশ্লিষ্টতা প্রাসঙ্গিক বিবেচনা করা হয়। হজ্জ তো লক্ষ লক্ষ মানুষের উপস্থিতিতেই পালন করা হয়। কিন্তু সওম তথা রোজার ব্যাপারটা সম্পূর্ণ আলাদা। রোজা পালন করতে কোন ব্যক্তির যে দীর্ঘ ষোল, সতর ঘণ্টা সময় লাগে, তার মধ্যে তার এমন বহু সময় আসে, যখন সে সম্পূর্ণ একা থাকে বিধায় ইচ্ছা করলেই সে কিছু খেয়ে ক্ষুৎ-পিপাসার কষ্ট দূর করতে পারে। কিন্তু সে যে তা করে না, তার কারণ অন্য কোন মানুষ না দেখলেও সর্ব দ্রষ্টা আল্লাহ তায়ালা তা দেখছেন, এই বিশ্বাস থেকে। এ কারণেই একটি হাদীসে কুদসীতে এসেছে,আল্লাহ বলেছেন, রোজাদার রোজা পালন করে শুধু আমার জন্য। তাই রোজাদারের ছওয়াব (পুরস্কার) আমি নিজ হাতে দেব।
সাধারণত সিয়াম পালন বলতে বোঝা হয়, সুবেহ সাদেক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সময়-কালটা সমস্ত রকম পানাহার ও কামাচার থেকে বিরত থাকার নামই সওম বা রোজা। কিন্তু প্রকৃত পক্ষে এতটুকুতে সওমের পরিপূর্ণ দাবী আদায় হয় না। পানাহার ও কামাচার বর্জনের পাশাপাশি রোজাদারকে ইসলাম কর্তৃক সমস্ত রকম নিষিদ্ধ কাজও পরিহার করে চলতে হবে। যেমন পরনিন্দা বা গীবত। হাদিসে এসেছে : গীবতকারী একজন রোজাদার সম্পর্কে রসূলে করিম (সা:) বলেছিলেন, সে শুধু শুধুই ক্ষুৎ পিপাসায় কষ্ট করছে।
শুধু পরনিন্দা না গীবত নয়, ইসলাম যেসব কাজ নিষিদ্ধ করেছে, তার প্রতিটি কাজ থেকেই বিরত থাকতে হবে রোজাদারকে। যেমন অন্যের সাথে কলহ-কোন্দলে লিপ্ত হওয়া। মানুষ সাধারণত ক্ষুধার্ত থাকা অবস্থায় সামান্য কারণেই ক্রুদ্ধ হয়ে পড়ে। এজন্য ইংরেজীতে একটি কথা আছে : এ হাংরি ম্যান ইজ এ্যান এ্যাংরি ম্যান। অর্থাৎ ক্ষুধার্ত ব্যক্তি মাত্রই ক্রুদ্ধ ব্যক্তি। কিন্তু রোজাদারকে কিছুতেই ক্রুদ্ধ হওয়া চলবে না। কেউ গায়ে পড়ে তার সাথে ঝগড়া বাধাতে চেষ্টা করলেও তাকে সৌজন্য সহকারে বলে দিতে হবে : আমি রোজা রয়েছি।
এসবের কারণ সিয়ামের মূল লক্ষ্যই হচ্ছে ধৈর্যের প্রশিক্ষণ। আর যদি সেই ধৈর্যের পরীক্ষায়ই অকৃতকার্য হয়ে আমরা ক্রোধ নামক রিপুর প্রভাবে পড়ে ক্রুদ্ধ আচরণ করি, তাহলে সিয়ামের মূল শিক্ষার বিপরীত পথেই তো আমরা চললাম। এর দ্বারা সিয়ামের মহান শিক্ষার বিপরীত হয়ে গেলো আমাদের আচরণ।
শুধু ক্রোধ নয়, কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ,মদ, মাৎসর্য় প্রভৃতি ষড়রিপুর কোন রিপুর কাছেই প্রকৃত রোজাদার আত্মসমর্পণ করতে পারে না। অথচ রোজার মাসেও আমরা আমাদের সমাজে এইসব রিপুর কুপ্রভাব আমরা দেদার দেখতে পাই। এর মধ্যে দু একটার কথা এখানে উল্লেখ না করলেই নয়। রমাজন মাস এলেই এক শ্রেণীর ব্যবসায়ীর মধ্যে রোজাদারদের প্রয়োজনীয় বিভিন্ন পণ্যের মূল্য অস্বাভাবিক ভাবে বৃদ্ধি করতে দেখা যায়। রোজার মাসে রোজাদারদের প্রয়োজনীয় এসব পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি করে যেসব ব্যবসায়ী লোভ নামক রিপুর গোলামির খাতায় নাম লেখায় তারা কারা? তারা কিন্তু অধিকাংশই মুসলমান। এবং তারা অনেকে আনুষ্ঠানিকভাবে রোজাও পালন করেন।
এসব ঘটনা প্রমাণ করে আমরা সিয়াম বা রোজা আনুষ্ঠানিকভাবে পালন করলেও আমাদের মধ্যে সিয়াম পালনের মন-মানসিকতা সঠিকভাবে গড়ে উঠতে পারছেনা আমাদের জীবনে ষড়রিপুর কুপ্রভাবের কারণে। অথচ পবিত্র কুরআনুল করিমে সিয়ামের নির্দেশ-সম্পর্কিত আয়াতে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে : কুতেবা আলাইকুমুচ্ছিয়ামো কামা কুতেবা আলাল্লাজিনা মিন কাবলিকুম লায়াল্লাকুম তাত্বাকুন। অর্থাৎ তোমাদের উপর সিয়াম বিধিবদ্ধ করা হলো, যেমন করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর, যাতে তোমরা তাকওয়া অবলম্বন করতে পার।
সে নিরিখে দেখা যায় সিয়ামের মূল লক্ষ্য হলো তাকওয়ার অভ্যাস রপ্ত করা। তাকওয়া সম্পর্কে ধারণা দিতে গিয়ে হজরত উমর ফারুক (র:) বলেছেন : তোমাদের যদি কখনও কন্টকপূর্ণ পথ দিয়ে হাঁটতে হয়, তখন যেভাবে তোমাদের সাবধানে পথ চলতে হয়, সেটাই তাকওয়া। স্বাভাবিক কারণেই এখানে সবর বা ধৈর্যশীলতা একটি সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে। তাছাড়া এতে এমন অনেক কাজ থেকে বিরত থাকতে হয়, যা আপাতত আরামদায়ক ও প্রয়োজনীয় মনে হয়।
পার্থিব বিবেচনায় স্বাভাবিক দৈহিক চাহিদা পূরণে কামনীয় মনে হলেও আল্লাহর সন্তেুাষ্টি হাছিলের লক্ষ্যে এসব বর্জন করার ফলে কি সমাজের কোন ক্ষতি হয়? না, বরং এসব কাজের মাধ্যমে মানুষে মানুষে সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের আদর্শে সুন্দর সমাজ গড়ে তুলতে ইসলামের অন্যান্য বুনিয়াদী ইবাদতের মত সিয়ামে রমজানের মাধ্যমেও সহায়ক পরিবেশ গড়ে ওঠে। মাহে রমজানে ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে সকল মুসলমানদের সিয়াম পালনের মাধ্যমে ধনীরা দরিদ্রের ক্ষুৎ পিপাসায় কষ্ট পাওয়ার বেদনা অনুভব করতে পারে।
শুধু তাই নয়। সারা দিন রোজার শেষে এক সাথে ধনী দরিদ্র নির্বিশেষে যতবেশী লোক এক সাথে ইফতার করে তত বেশী ইফতার আয়োজকদের পুণ্য বৃদ্ধি পায়। এবং সাথে সাথে সমাজে ধনী-দরিদ্রের ভেদাভেদ দূর হয়ে ইসলামী সাম্য ভ্রাতৃত্বের আদর্শে সমাজ গড়ে ওঠার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়।
দু:খের বিষয় এ ব্যাপারেও আমরা সমাজে ইসলামের নির্দেশনার গুরুত্ব না দিয়ে পার্থিব সঠিক রাজনৈতিক স্বার্থে রমজান মাসে এমন সব ইফতার পার্টির আয়োজন করি, যাতে বেছে বেছে সমাজের নেতৃত্বে আসীন ব্যক্তিদের দাওয়াত দেয়া হয়। স্বাভাবিক কারণেই তার দ্বারা ইসলামের সাম্য-ভাতৃত্বের মহান আদর্শ সমাজ গড়ে তোলার কোন বিবেচনাই গুরুত্ব লাভ করে না।
ফল দাঁড়ায় এই যে, সিয়ামে রমজান যে মহান সম্ভাবনা নিয়ে আমাদের সামনে হাজির হয়, তার লক্ষ্য অপূরিতই থেকে যায়। সিয়ামে রমজানের মহান শিক্ষার পরিবর্তে আমাদের দেশে রমজান এলেই যেন এক শ্রেণীর লোভী ব্যবসায়ীদের অতিরিক্ত লোভ লালসা তৃপ্ত করার অবারিত সুযোগ এবং ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের সিয়াম পালনের জন্য প্রয়োজনীয় পণ্যের অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধির অভিযান শুরু হয়। এবারের মাহে রমজানে সিয়াম সাধনার মহান শিক্ষায় উদ্বুদ্ধ আমরা ব্যতিক্রমী চিত্র দেখতে পাব কি?
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।