Inqilab Logo

রোববার, ১৬ জুন ২০২৪, ০২ আষাঢ় ১৪৩১, ০৯ যিলহজ ১৪৪৫ হিজরী

বাংলাদেশের দরজায় নির্বাচনী করাঘাত ঐ দিকে গ্রিক দেবীর মূর্তি অপসারণ

| প্রকাশের সময় : ৩০ মে, ২০১৭, ১২:০০ এএম

মোবায়েদুর রহমান : ২০১৪ সালের জানুয়ারির পর ২০১৭ সালের জানুয়ারিও পার হয়ে গেল। দেখতে দেখতে আর কয়েকটি মাস। ২০১৮ সালের জানুয়ারিও পার হয়ে যাবে। তার পরেই শুরু হবে নির্বাচনী ডামাডোল। আসলে নির্বাচনী ডঙ্কা ইতোমধ্যেই বাজতে শুরু করেছে। সরকার যে নির্বাচনী দুন্দুভি বাজাচ্ছে সেটি মোটামুটি শোনা যাচ্ছে। শুনতে পাওয়াটাই স্বাভাবিক। কারণ সাধারণ নির্বাচনের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্যই হলো  ব্যাপক প্রচারণা। বলা বাহুল্য, নির্বাচনী প্রচারণা অনেক রকম হয়ে থাকে।  লিফলেট বিলি করা, পোস্টার মারা, দেওয়ালে লেখা, রিক্সা বা সিএনজিতে মাইক ফিট করে ভোট চাওয়া, মিছিল করা এবং বড় বড় জনসভা অনুষ্ঠান করা। এছাড়াও ডোর টু ডোর  কন্টাক্ট তো রয়েছেই। সরকারী দল  অর্থাৎ আওয়ামী লীগ বিভিন্ন জায়গায় যে নির্বাচনী প্রচারণা চালাচ্ছে সেটি মোটামুটি দৃশ্যমান। অবশ্য যারা ক্ষমতায় থাকে, তারা যদি ক্ষমতায় থেকে ইলেকশন করেন তাহলে ইলেকশন ক্যাম্পেইনের দিক থেকে তারা সব সময়ই আপার হ্যান্ডে থাকেন।
বিরোধী শিবির থেকে জানা গেল যে, তারাও বসে নাই। তবে সরকারের সাথে বিরোধী দলের নির্বাচনী প্রচারণার তফাৎটা হলো এই যে, সরকারী দল অর্থাৎ আওয়ামী লীগ সোজা সাপটা কথা বলে। যাকে আক্রমণ করতে হবে তার বিরুদ্ধে সরাসরি কথা বলে। বিএনপির অ্যাপ্রোচ ভিন্ন। তাদের পলিটিক্স অনেকটা আমেরিকার ডেমোক্র্যাট বা রিপাবলিকানদের মতো। অথবা তাদের পলিটিক্স ইংল্যান্ডের টোরী বা লেবার পার্টির মতো। ঐ সব দেশে সেøাগানবাজি তেমন একটা হয়না। ইলেকশনের আগেও রাস্তায় মাইক দিয়ে ঘোষণা করা হয় না,অথবা রাস্তা ঘাট বন্ধ করে জনসভা বা মিছিলও করা হয়না। বিএনপির নির্বাচনী প্রচারণা অনেকটা ইংল্যান্ড বা আমেরিকার মতো। চিল্লা পাল্লা নাই, হই হুল্স্থুলও নাই। তাই বিএনপি তথা বিরোধী দলের আওয়াজ সব ধরণের মানুষের কাছে পৌঁছায় না। বিএনপি প্র্যাক্টিকাল কাজের চেয়ে  থিয়োরিটিক্যাল কাজ বেশি করে।
যখন জানা গেল যে, প্রাক্তন নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ শেষ হতে যাচ্ছে তখন বিএনপির বড় বড় ব্রেন সব একত্রিত করা হয়। তারা দিনের পর দিন মাসের পর মাস প্রচুর গবেষণা করে, প্রচুর লেখা পড়া করে এবং প্রচুর রেফারেন্স ঘেঁটে নির্বাচন কমিশনের একটি রূপ রেখা দাঁড় করায়। তার পর সেটি ঘটা করে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে প্রচার করা হয়। সেটি প্রচার করার কয়েকদিন আগে বিএনপির দুই চারজন সিনিয়র নেতার সাথে আমার কথা বলার সুযোগ হয়েছিল। আমি তো তাদের দু একজনকে সরাসরি প্রশ্ন করেছিলাম, ইলেকশন কমিশন নিয়ে আপনারা যে গবেষণা করছেন সেটিতো পি এইচ ডি বা ডক্টরেট পাওয়ার মত ব্যাপার স্যাপার হচ্ছে। কিন্তু কি লাভ এতে? আপনাদের রূপরেখা যে মুহুর্তে ঘোষণা করবেন তার আধা ঘন্টার মধ্যেই আওয়ামী লীগ আপনাদের সেই রূপ রেখা প্রত্যাখ্যান করবে। কাজেই এগুলো হবে আপনাদের বেহুদা পন্ডশ্রম। আসলে বাস্তবে ঘটলও তাই। বেগম খালেদা জিয়া ইলেকশন কমিশনের রূপ রেখা ঘোষণা করার এক ঘন্টার মধ্যেই  আওয়ামী লীগ বিএনপির রূপ রেখাকে পত্র পাঠ নাকচ করে দেয়।
একই ফলাফল দেখা যায় বিএনপির ভিশন ২০৩০ এর ক্ষেত্রেও। যারা দেশের রাজনীতির খবরা খবর রাখার চেষ্টা করেন তারা জেনে যান যে, বিএনপি   ভিশন ২০৩০ নামক আরেকটি আর্থ সামাজিক ও রাজনৈতিক রূপ রেখা তৈরি করছে। এবারেও আমি হাই কমান্ডের দুই একজনের সাথে কথা বলি। এবং একই কথা বলি। এবারেও যথা পূর্বং তথা পরং। যে দেশের ১৬ কোটি মানুষের মধ্যে ১৪ কোটি মানুষই দেশ সমাজ এবং রাজনীতি নিয়ে মাথা ঘামান না সেখানে ইলেকশন কমিশনের রূপ রেখা বা ভিশন ২০৩০ অনেকটা স্বপ্ন বিলাসের মতো মনে হয়। এমন একটি অবস্থার পটভ‚মিতে আবার  আসছে সাধারণ নির্বাচন। নির্বাচনের পায়ের আওয়াজ যদিও অনেক দূর থেকে শোনা যাচ্ছে, তবুও যতই দিন যাচ্ছে ততই  সেই আওয়াজ সরব হচ্ছে।
আজ সকালেই একজন  নামকরা পলিটিসিয়ানের সাথে কথা হলো। তিনি বললেন,“বিএনপির উচিৎ ৪০ পৃষ্ঠার ভিশন বাদ দিয়ে ১০-১৫ পৃষ্ঠার ইলেকশন ম্যানিফেস্টো ঘোষণা করা। আমি এ পর্যন্ত ঐ ভিশন নিয়ে কোনো লেখা লিখিনি। কারণ  বড় বড় পলিটিক্যাল সাইন্টিস্ট বা ইকোনোমিস্টের দৃষ্টি কোণ থেকে এসব বিবেচনা করার পর্যায়ে বাংলাদেশ এখনো আসেনি। শেখ মুজিবুর রহমান ৬৬ সালে জুন মাসে ৬ দফা ঘোষণা করেন। যদিও অনুচ্ছেদ ছিল ৬টি, কিন্তু বাস্তবে সেখানে অনেক গুলি উপ অনুচ্ছেদ ছিল। এখন বিএনপিরও দরকার এই ধরণের একটি সংক্ষিপ্ত নির্বাচনী ওয়াদা।  ৫৪ সালে যুক্ত ফ্রন্ট দিয়েছিল ২১ দফা। ১৯৬৬ সালে শেখ মুজিব দিয়েছিলেন ৬ দফা। ১৯৬৯ সালে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ দিয়েছিল ১১ দফা। এগুলোর ওপরেই ছিল শেখ মুজিবের সংগ্রাম।
বিএনপি তথা বেগম জিয়ার এখন যেটি করা প্রয়োজন সেটি হলো, ঐ ধরণের কিছু নির্বাচনী ওয়াদা। সেখানে  কতগুলো বিষয় থাকতেই হবে। যেমন  কিছুই পাইনি কিন্তু ট্রানজিট দিয়েছি। কিছুই পাইনি , কিন্তু দুইটি সমুদ্র বন্দর দিয়েছি। কিছুই পাইনি, কিন্তু বাণিজ্য ঘাটতি হাজার হাজার কোটি টাকায় উন্নীত হয়েছে। কিছুই পাইনি, কিন্তু বাংলদেশীরা ভারতীয় বিএসএফের গুলিতে বেঘোরে প্রাণ হারাচ্ছে। এ গুলিই হলো ইস্যু। এ গুলি নিয়েই বিএনপির  মাঠ ঘাট চষে বেড়ানো উচিৎ।
\ দুই \
এই বিষয়টা নিয়ে  আরো কিছু লেখার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু এর মধ্যে একটি বিরাট ঘটনা ঘটলো। ফলে লেখাটি অর্ধ সমাপ্ত রেখেই  এদিকে ডাইভার্ট করতে হচ্ছে। গত বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত্রে সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণ থেকে গ্রিক দেবী থেমিসের মূর্তি অপসারণ করা হয়েছে। রাত ১২ টা থেকে অপসারণ কাজ শুরু হয়। ভোর রাত  চারটা সাড়ে  চারটার মধ্যে এই অপসারণ কাজ শেষ হয়। গত ডিসেম্বর মাসে রজনীর গভীর অন্ধকারে কে বা কারা  সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে এই মূর্তি বসায়। আবার  এই মে মাসের (২৬ তারিখে) কে বা কারা এই মূর্তি সরায়। যেমন রহস্যময় ভাবে এই মূর্তিটি বসানো হয়েছিল তেমনি রহস্যময় ভাবেই মূর্তিটি সরিয়ে ফেলা হয়েছে। কে বসালো বা কারা বসালো সে ব্যাপারে আমাদের যেমন  কোনো মাথা ব্যাথা নাই, তেমনি কে সরালো বা কারা সরালো সেটি নিয়েও আমাদের কোনো মাথা ব্যাথা নাই । মূর্তি সরানো হয়েছে, ব্যাস, মানুষ খুশি। বিভিন্ন ইসলামী দল এবং ব্যক্তিত্বরা মূর্তি অপসারণের জন্যে প্রধান মন্ত্রী এবং  প্রধান বিচার পতিকে অভিনন্দন জানিয়েছে। আমিও তাদের এই অভিনন্দন জানানোতে সানন্দে শরিক হচ্ছি।
ডিসেম্বর মাসের মাঝা মাঝি সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে যখন এই মূর্তিটি বসানো হয় তখন আমি দেশে ছিলাম না। বাংলাদেশ থেকে অনেক দূরে অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে বসে আমি এই সংবাদটি দেখতে পাই। তাৎক্ষণিক ভাবেই আমার মনে প্রশ্ন ওঠে, এই মূর্তিটি সুপ্রিম কোর্টে বসানোর কি আদৌ কোনো প্রয়োজন ছিল? আমি ব্রিটিশ আমল দেখিনি, কিন্তু পাকিস্তান আমল দেখেছি, আর দেখেছি বাংলাদেশ আমল। পাকিস্তান থেকে শুরু করে আজকের বাংলাদেশ- মাঝ খানে ৬৯ বছর । এই ৬৯ বছর সুপ্রিম কোর্টে ন্যায় বিচারের প্রতীক হিসাবে দাঁড়ি পাল্লার লোগোটি চমৎকার ভাবে শোভা পাচ্ছিল। ৬৯ বছর পর হঠাৎ করে এই লোগোটি অপসারণের কি প্রয়োজন পড়লো? পৃথিবীর অনেক দেশেই তো ন্যায় বিচারের প্রতীক হিসাবে দাঁড়ি পাল্লা শোভা পায়। তাহলে এমনকি  ঘটনা ঘটলো যে ৬৯ বছরের ঐতিহ্য মুহুর্তেই ধ্বংস করতে হলো?
\ তিন \
মূর্তি অপসারণের বিরুদ্ধে কয়েক জন মানুষ প্রতিবাদ করেছে। এদের সংখ্যা হাতে গোনা যায়। যারা দুই দিন ধরে প্রতিবাদ করেছে তাদের ছবি এবং নাম ধাম পত্রিকায় দেখলাম। আসলে  এরা সব মুখচেনা কমিউনিস্ট। সকলে মস্কো মার্কা কমিউনিস্ট। এরা ছাত্র ইউনিয়ন করে, সিপিবি করে এবং ভারতীয় সংস্কৃতির বন্দনা করে। লক্ষ্য করে দেখুন, প্রতিবাদকারীদের মধ্যে আওয়ামী লীগের কোনো নেতা কর্মী নাই, নাই  ছাত্রলীগ, শ্রমিক লীগ, যুবলীগের নেতা কর্মীও। বিএনপি জামায়াতে ইসলামী সহ কোনো ইসলামী ও জাতীয়তাবাদী দলেরও  নেতা কর্মী নাই। ঐ হাতে গোনা ১৫-২০ জন নেতা কর্মী নিয়ে কমিউনিস্টরা ব্যানার ও ফেস্টুন হাতে দাঁড়িয়ে থাকে। সরকার ওদেরকে সুযোগ দেয় বলেই হাসান ইমাম বা রোকেয়া প্রাচীর মতো ব্যক্তিরা দাঁড়িয়ে থাকে।
সরকারের প্রটেকশনের তলে থেকে এই ধরণের প্রতিবাদ বিক্ষোভ করাই যায়। সরকার  একবার সুযোগ দিক, বিএনপি এবং জামায়াতকে মাঠে নামতে দিক, দেখা যাবে কার সমর্থন  এবং শক্তি কত? যদি বিএনপি জামায়াতকে বাধা দেওয়া না হয় তাহলে মূর্তি অপসারণের দাবির সপক্ষে যারা মাঠে নামবেন তারা  ঢাকা শহরকে সয়লাব করে দিতে পারবেন। আমি আগেই এই কাজের জন্য সরকারকে অভিনন্দন জানিয়েছি। আমার কাছে এখানে আওয়ামী লীগ বা বিএনপি বড় কথা নয়। বড় কথা হলো মূর্তির ইস্যু। তাই সরকারকে অভিনন্দন জানিয়েছি। কিন্তু তার পরেও  একটি ছোট্ট খটকা রয়ে গেল। গত রবিবার ডেইলি স্টারের প্রথম পৃষ্ঠায় একটি খবর ছাপা হয়েছে। খবরের শিরোনাম হলো, ‘Lady Justice  reinstalled’’। খবরে বলা হয়েছে যে, ঐ মূর্তিটি সুপ্রিমকোর্ট এ্যানেক্স বিল্ডিংয়ের সামনে নাকি আবার বসানো হয়েছে। এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেছেন যে, কে বা কারা এটাকে এ্যানেক্স বিল্ডিংয়ের সামনে এনে বসালো  সে সম্পর্কে তিনি কিছুই জানেনা। তিনি আরো বলেন যে, প্রধান বিচারপতিও এ ব্যাপারে কিছুই জানেন না। ব্যাপারটা অনেকটা এরকম হলো যে সারা ঘর লেপে এসে দরজার কাছে কাঁদা ছিটানো হলো।
[email protected]



 

Show all comments
  • রাসেল ৩০ মে, ২০১৭, ২:৫৩ এএম says : 2
    গ্রিক দেবীর মূর্তি স্থানান্তর নয় এটা অপসারণ চাই।
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ