Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

রাজধানীজুড়ে খোঁড়াখুঁড়ি উন্নয়ন ভোগান্তিতে নগরবাসী

| প্রকাশের সময় : ২৪ মে, ২০১৭, ১২:০০ এএম

সায়ীদ আবদুল মালিক : রাজধানীজুড়ে চলছে খোঁড়াখুঁড়ির মহোৎসব। ঢাকা শহরের এমন কোন সড়ক বা অলিগলি নেই, যেখানে খোঁড়াখুঁড়ির কাজ চলছে না। এরমধ্যে দুয়েকটি সড়ক দিয়ে কোন রকম চলাফেরা করা গেলেও অনেক রাস্তাই এখন চলাচলের অনুপযুক্ত। সিটি কর্পোরেশন, মেট্টোরেল স্থাপনের কাজের জন্য, ওয়াসা, তিতাস, ডেসকোসহ বিভিন্ন সেবা সংস্থা প্রতিদিনই কোনো না কোনো সড়ক, অলিগলি খুঁড়ছে। আজ এই প্রতিষ্ঠান কাটছে তো কাল কাটছে আরেক প্রতিষ্ঠান। কাজ শেষ করে চলে যাওয়ার পর আরেক প্রতিষ্ঠান এসে নতুন করে খনন করছে রাস্তা।
বিশেষ করে মগবাজার, মালিবাগ ও মৌচাক এলাকার রাস্তার অবস্থা চোখে না দেখলে বিশ্বাস হবে না, কি করুন অবস্থা হয়ে আছে। ফ্লাইওভারের নির্মাণ কাজের ধীরগতি ও বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থার অপরিকল্পিত খোঁড়াখুঁড়ির কারণে ওই রাস্তা দিয়ে এখন যানবাহও জনসাধারণের চলাচল অনেকটা অসম্ভব হয়ে পড়েছে। সামান্য বৃষ্টিতেই কাদা পানিতে একাকার হয়ে কোথায় সমান রাস্তা আর কোথায় খানাখন্দক তা বুজার উপায় থাকে না। এতে প্রতিদিনই ঘটছে ছোট বড় দুর্ঘটনা। তুবুও মানুষ জীবনের ঝুকি নিয়ে এ রাস্তাদিয়ে যাতায়াত করছে।
রাজধানীর কাকরাইল মোড় থেকে ফকিরাপুল ও মতিঝিলের দিকের রাস্তায় স্কাউট ভবনের সামনে গত প্রায় এক বছর ধরে চলছে স্যুয়ারেজের পাইপ লাইন বসানোর কাজ। ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের তত্ত¡াবধায়নে গত বছর জুন মাস থেকে শুরু হওয়া এই কাজ যে কবে শেষ হবে তা সঠিক করে বলতে পরছে কেউ। গতকাল মঙ্গলবার সরেজমিন নাইটিঙ্গেল মোড়ে গিয়ে দেখা যায়, শ্রমিকেরা স্যুয়ারেজ লাইনের কাজ করছে। রাস্তার উপর পড়ে আছে ইট, বালু, কাঠ ও বাঁশসহ বিভিন্ন নির্মাণ সামগ্রী। যে কারণে রাস্তাটির প্রায় অর্ধেকের বেশি জায়গা দখল হয়ে আছে। রাজধানীর অত্যান্ত গুরুত্বপূর্ণ এ মোড়টি দিয়ে প্রতিদিন হাজার হাজার যানবাহন চলাচল করে থাকে। গত প্রায় একবছর এ রাস্তাটি দখল হয়ে থাকার কারণে চরম ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে এ রাস্তা দিয়ে চলাচলকারীরা। প্রতিদিন সকালে অফিস সময়ে ও সন্ধ্যায় অফিস ফেরৎ মানুষের এক আতংকের নাম এখন এই মোড়টি। এখান থেকে যানজট ছড়িয়ে পড়ে সারা শহরজুড়ে। যানজটের কারণে বিভিন্ন যানবাহ ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাড়িয়ে থাকতে রাস্তায়। নষ্ট হয় মানুষের হাজার হাজার কর্ম ঘণ্টা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান ইনকিলাবকে বলেন, মালিবাগ মৌচাকা ফ্লাইওভারের আশে পাশে আমাদের ১২ কিলোমিটার স্যুয়ারেজ লাইন বসানোর কাজ চলছে। যা শুরু হয়েছে গত বছর জুন মাস থেকে। এরমধ্যে নয় কিলোমিটার কাজ ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে। বাকি কাজ আগামী তিন মাসের মধ্যে শেষ হবে বলে আশা রাখি। তিনি বলেন, নাইটিঙ্গেলের সামনের কাজও আগামী এক সপ্তাহ ১০দিনের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে। এছাড়াও আমাদের উন্নয়ন প্রকল্পের কাজগুলো যতদ্রæত সম্ভব শেষ করার চেষ্টা করছি। নিয়ম অনুযায়ী কাজ করার জন্য ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলোকেও নিদের্শনা দেয়া আছে। যাতে নাগরিক দুর্ভোগ এড়ানো যায় সে বিষয়ে সকলকে সতর্ক করা আছে।
এ সমস্ত খোঁড়াখুঁড়ির ব্যপারে সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে সঠিক তদারকি না থাকার অভিযোগ উঠেছে। ঠিকাদাররেরা যে যেমন খেয়ালখুশি মত কাজ করছে। একটু বৃষ্টিতেই কাদা-পানিতে একাকার হয়ে রাস্তায় চলাচলের উপায় থাকে না। রাস্তার মাঝখানে যখন তখন বিকল হয়ে যাচ্ছে গাড়ি। প্রতিনিয়তই ছোট-বড় দুর্ঘটনা ঘটছে। অফিস আদালত মুখি মানুষ ও স্কুল মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা সকাল বেলায় ঘর থেকে বের হয়েই পড়ছে চরম ভোগান্তিতে। কোথায়ও অসহনিও যানজটে পড়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে আবার কোথায় যানবাহনেরে সঙ্কটে পড়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে ঘণ্টার পর ঘণ্ট। ইচ্ছা থাকলেও ময়লা, কাদা-পানি ও পিচ্ছিল রাস্তায় পায়ে হাটাও সম্ভব হয় না।
অন্যদিকে আবার রোদ উঠলে বাতাসে ধুলা-বালি উড়ে চোখ-মুখ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। নিশ্বাসের সাথে ধুলা-বালি নাক দিয়ে শরীরে প্রবেশ করে শ্বাসকষ্ট ও এজমাসহ নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে নগরবাসী। এ বিষয়ে জানতে চাইলে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের চর্ম ও যৌন বিভাগের সাবেক বিভাগীয় প্রধান ডা. আহম্মাদ আলী ইনকিলাবকে বলেন, বাতাসের সাথে মিশে থাকা ধূলা-বালী শ্বাসপ্রশ্বাসের সাথে মানুষের ফুসফুসে গিয়ে পৌঁছায়। এতে করে মানুষ কাশি, যক্ষা, শ্বাসকষ্ট ও এজমাসহ নানা জটিল কঠিন রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকে। যে কারণে মানুষের ফুসফুস অস্তে আস্তে কর্মক্ষম হয়ে পড়ে। যা মানুষকে ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে নিয়ে যায়।
রাজধানীর দুই সিটি কর্পোরেশনের বিভিন্ন সড়ক ও অলি-গলিতে বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থার উন্নয়ন কার্যক্রমের জন্য চলছে খোঁড়াখুঁড়ি। এছাড়ও ভাঙাচুরা রাস্তা মেরামতের কাজ করছে সিটি কর্পোরেশন। যে কারণে রাজধানীর প্রায় সবগুলো রাস্তাই এখন খোঁড়াখুঁড়ির কবলে পড়েছে। প্রতি বছর ৩১ মে’র মধ্যে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ির কাজ শেষ করার নির্দেশনা প্রধানমন্ত্রীর কার্যলয় থেকে থাকলেও এ বছর তা সম্ভব হবে না বলে জানা গেছে। কারণ ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন গত বছর যে কাজ শুরু করেছিলেন সে কাজও এখন পর্যন্ত শেষ করতে পারেননি। তার উপর এ বছরও তারা আরও প্রায় ৪/৫ শতাধীক সড়ক মেরামতের কাজ একসাথে ধরেছে। দুই সিটি কর্পোরেশন সূত্রে জানা গেছে, এ সব কাজ শেষ হতে আরও অন্তত ৫/৬ মাস সময় লেগে যেতে পারে।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকন ইনকিলাবকে বলেন, নগরবাসীর নাগরীক সেবা নিশ্চিত করার লক্ষ্যেইতো সিটি কর্পোরেশনকে উন্নয়নমূলক কাজ করতে হয়। এধরণের কাজ করতে গেলে কিছু সমস্যাতো হতেই পারে। এ জন্য নগরবাসীকেও কিছুটা ভোগান্তি সহ্য করতে হবে। উন্নয়ন কাজ চলা সময়ের ভোগান্তির জন্য দুঃখ প্রকাশ করে মেয়র নগরবাসীর সহযোগীতা কামনা করেন।
ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন সূত্রে জানা গেছে, চলতি শুকনো মৌসুমে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন বিভিন্ন সংস্থাকে ৮৮টি স্থানে সড়ক খোঁড়াখুঁড়ির অনুমতি দিয়েছে। এর মধ্যে মেট্রোরেলের পথে থাকা বিদ্যুতের লাইন অপসারণের কাজও রয়েছে।
খোঁড়াখুঁড়ির পূর্বশর্ত হলো প্রতিদিনের খনন করা অংশ বালু দিয়ে ভরাট করা, পর্যাপ্ত নিরাপত্তাবেষ্টনী থাকা, আড়াআড়ি খননের ক্ষেত্রে স্টিলের পাত দিয়ে গর্ত ঢেকে রাখা, সাইনবোর্ড টাঙিয়ে খননের উদ্দেশ্য, কাজ শুরু ও সমাপ্তির তারিখ প্রদর্শন করতে হবে। অনিবার্য না হলে খননকাজ শুধু রাতেই করতে হবে এবং সকাল হওয়ার আগে খনন করা মাটি বা পরিত্যক্ত নির্মাণসামগ্রী (রাবিশ) সরিয়ে নিতে হবে।
রাজধানীর মিরপুর, কল্যাণপুর, গাবতলী, গুলশান, রামপুরা, মগবাজার, মালিবাগ ও যাত্রাবাড়ী এলাকা ঘুরে কোথায়ও এসব শর্ত পালন করার কোনো দৃশ্য দেখা যায়নি। এমনকি সিটি কর্পোরেশন নিজে যেসব স্থানে নির্মাণকাজ চালাচ্ছে, সেসব স্থানেও শর্ত পূরণ হচ্ছে না। এতে গত প্রায় পাঁচ মাস ধরে রাজধানীর মানুষ যানজট আর ধুলার রাজ্যে বসবাস করছে।
দুই সিটি কর্পোরেশন সূত্র জানায়, অনুমতি পাওয়া সংস্থা বা ঠিকাদারের নির্ধারিত সময়ের মধ্যে খনন করা অংশ ভরাট করার কথা। এরপর সড়ক পিচ ঢালাই করে আগের অবস্থায় নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব সিটি কর্পোরেশনের।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা উত্তরের মেয়র আনিসুল হক বলেন, সিটি কর্পোরেশন বাদে যারা সড়ক খুঁড়ছে, তারাও সরকারি সংস্থা। প্রত্যেক সংস্থার নিজস্ব দায়িত্ব আছে। যাদের অনুমতি দেওয়া হয়েছে, তারা নিজেদের দায়িত্ব ঠিকমতো পালন করছে না। আর উত্তর সিটির অধীন কাজের ঠিকাদারেরা এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি নিয়ম মেনে কাজ করছেন। খুঁড়ে তোলা মাটি সব সময় দিনেরটা দিনে সরানো সম্ভব হয় না।
মেট্রোরেল প্রকল্পের আওতায় গত ২ নভেম্বর আগারগাঁও থেকে মিরপুর ১০ নম্বর গোলচত্বর পর্যন্ত প্রায় সোয়া তিন কিলোমিটার সড়কের দুপাশে পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ (পিজিসিবি) রাস্তা খননের কাজ শুরু করে। গতকাল দুপুরে দেখা যায়, মেট্রোরেল প্রকল্পের শেওড়াপাড়া থেকে কাজীপাড়া বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত সড়কের দুই পাশেই গর্ত খোঁড়া। নিরাপত্তাবেষ্টনী নেই। কোথাও কোথাও একটা করে বাঁশের খুঁটি দিয়ে সীমানা চিহ্নিত করার চেষ্টা করা হয়েছে। মানুষের এপার-ওপার হওয়ার জন্য বাঁশ-স্টিলের পাত ফেলা হয়েছে। গর্তের মাটি সড়কেই পড়ে আছে। যানবাহনের চাকার সঙ্গে ঘর্ষণের ফলে ধুলা হয়ে চারদিকে উড়ছে। আশপাশের ভবন-দোকানগুলো ধুলার রঙে ধূসর।
মিরপুর শ্যাড়ওয়া পাড়ার বাসিন্দা আমিনুর রহমান বলেন, সড়ক খোঁড়া হয়েছে ৫ ফুট কিন্তু যন্ত্রপাতি, মাটি, রাবিশ ফেলে সড়কের ১৫-২০ ফুট বন্ধ করে রাখা হয়েছে। উন্নয়ন হবে ভালো কথা, জনগণের চলাচল বন্ধ করা তো ঠিক নয়। দুর্ভোগের তো একটা সীমা আছে।
ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী সৈয়দ কুদরাতুল্লাহ বলেন, বিশেষ প্রয়োজনে সড়ক খননের অনুমোদন দেয় ওয়ানস্টপ সেল থেকে। তবে সেল থেকে এই দিকনির্দেশনাও দেওয়া হয়, খননের কারণে যেন জনদুর্ভোগ সৃষ্টি না হয়। ###



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ