Inqilab Logo

বৃহস্পতিবার, ০৪ জুলাই ২০২৪, ২০ আষাঢ় ১৪৩১, ২৭ যিলহজ ১৪৪৫ হিজরী

অ্যানোফিলিস, যক্ষা ও গুটি বসন্ত দূর হয়েছে : এডিস মশা ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া উচ্ছেদ হবে না কেন?

| প্রকাশের সময় : ২৩ মে, ২০১৭, ১২:০০ এএম

মোবায়েদুর রহমান : কোন ফ্রন্টেই ভালো খবর নেই। যেদিকেই তাকাই সেই দিকেই দেখি খারাপ খবর, মন খারাপ করা খবর। প্রথমে অসুখ বিসুখের ফ্রন্টের দিকেই দৃষ্টি দেওয়া দরকার। আজ যে দুটি অসুখ বাংলাদেশের মানুষকে প্রবলভাবে আলোড়িত করছে সেগুলো হলো  চিকুনগুনিয়া এবং ডেঙ্গু। আমার স্পষ্ট মনে আছে, মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশে প্রায় ঘরে ঘরে চোখ ওঠার রোগ মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়েছিল। দেখা গেল, ঐ অসুখটি এসেছে বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকা থেকে, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গ, আসাম এবং বিহার থেকে।  আমি সে সময় অর্থাৎ মুক্তিযুদ্ধকালে  আমার অবস্থান ছিল প্রধানত  আগরতলার কলেজ টিলায়। সেই সময় দেখতাম  আগরতলা তথা কলেজ টিলার বহু লোক চোখের রোগে আক্রান্ত হয়েছে। কয়েক দিনের মধ্যে দেখলাম চোখের ঐ রোগ মুক্তিযোদ্ধা এবং  শরণার্থী শিবিরকেও আক্রান্ত করেছে। ঐ অবস্থাতেই মুক্তিযোদ্ধারা বাংলাদেশে অপারেশন করতে আসতো। ওরা অপারেশন করে যখন ফিরে যেত তখন খবর পেতাম বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী অঞ্চলের মানুষদের মধ্যেও চোখের অসুুখ দ্রæত ছড়িয়ে পড়ছে।
তারপর দেশ স্বাধীন হলো। স্বাধীনতার পর প্রায় এক কোটি মানুষ আমরা দেশে ফিরে এলাম।  আমরা ফিরে আসার পরে দেখলাম চোখের ঐ অসুখ বাংলাদেশেও মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়েছে। তখন আমাদের এবং ডাক্তার সাহেবেদের এই ধারণার দৃঢ়মূল হলো যে, আমরা সীমান্তের ঐ পার থেকে চোখের অসুখ নিয়ে এসেছি। বাংলাদেশে কয়েকদিন অবস্থান করায় আমাদের চোখের অসুখের কারণে আমাদের আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব এবং গুণগ্রাহীদের মাঝে সেই অসুখটি ছড়িয়ে পড়ে।
ব্রিটিশ আমলের কথা বলতে পারবো না। কিন্তু পাকিস্তান আমলের প্রথম দিকের কথা আবছা মনে পড়ে। তখন দুটি মশার নাম শুনি। একটি হলো অ্যানোফিলিস মশা এবং আরেকটি হলো কিউলেক্স মশা। তখন লেখাপড়া বলতে গেলে শুরুই করিনি। তাই বাপ দাদারা  বা পাড়া প্রতিবেশীরা যা বলতেন তাই বিশ্বাস করতাম। সেই সময় সারাদেশে বিশেষ করে পূর্ব বাংলা বা পূর্ব পাকিস্তানে ম্যালেরিয়া জ্বর খুব দাপটের সাথে বিরাজ করছিলো। কিউলেক্স মশা নাকি আফ্রিকায় ছিলো। তাই ঐ মশার ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে বিশেষ কিছুই শুনতে পারিনি। তবে অনেক শিশু এবং কিশোরকে দেখতাম ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়ে হাড্ডিসার হয়ে গেছে। তখন সরকার ম্যালেরিয়া ইরানিগেশন প্রোগ্রাম নামে ম্যালেরিয়া উচ্ছেদের একটি ক্র্যাশ প্রোগ্রাম গ্রহণ করে। সেই সময় ম্যালেরিয়াকে একটি ডেডলি ডিজিস বলা হতো। শত শত লোক ম্যালেরিয়ায় মারা যেতো।
পাকিস্তানের সূচনা লগ্নে য²া বা ক্ষয় রোগ আর একটি ভয়াবহ রোগ ছিল। বলা হতো যে, যার হয়েছে য²া তার নাই রক্ষা। কিন্তু ম্যালেরিয়া এবং য²ার মতো অসুখগুলো নিয়ন্ত্রণে এলো। অথচ বাংলাদেশে মশা বাহিত রোগ থেকে এখনও নিস্তার নাই।
জেনারেল জিয়াউর রহমান যখন ক্ষমতায় আসে তখন মশা মারার জন্য দুই একটি ক্র্যাশ প্রোগ্রাম গ্রহণ করেন। তখন রাত করে হেলিকপ্টার দিয়ে মশার ঔষুধ ছিটানো হতো। হেলিকপ্টার দিয়ে মশার ঔষুধ ছিটানোর আগে সমগ্র ঢাকা মহানগরীতে রাতে বাস করা প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছিলো। তখন মানুষ বলত, ঘরের সাথে বারান্দা বা ব্যালকুনি রেখে লাভ কি। ব্যালকুনি রাখে সাধারণত পরিবারের ঘনিষ্ঠ জনদের সাথে গার্ডেন চেয়ারে এক সাথে গল্প গুজব করার জন্য। কিন্তু সেটি প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। কারণ ফ্যামিলি নিয়ে ব্যালকুনিতে বসলে ঝাঁকে ঝাঁকে মশা এসে পরিবারের সদস্যদের ওপর হামলে পড়তো।
অথচ, এই হেলিকপ্টার থেকে ঔষুধ ছিটানোর সেই ক্র্যাশ প্রোগ্রাম অবসান হলে দেখা যায় যে, পরিবারের  প্রিয়জনদের নিয়ে আবার ব্যালকুনিতে বসে চেয়ার পেতে আরাম-আয়েশে গল্পগুজব করা যাচ্ছে। অবশ্য এক শ্রেণির আতেল বলা শুরু করেন যে, এই হেলিকপ্টার থেকে ঔষুধ ছিটালে নাকি পরিবেশ বিপর্যয় সৃষ্টি হয়। এই  সব পরিবেশবিদদের প্রচন্ড চাপে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান হেলিকপ্টার থেকে ঔষুধ ছিটানো প্রোগ্রাম বন্ধ করতে বাধ্য হন।
\দুই\
তারপর বহু বছর অতিক্রম করে গেছে। বুড়িগঙ্গার সাদা পানি ময়লা আবর্জনায় কালো হয়ে গেছে। নদীর স্বচ্ছ পানি এখন পুঁতিগন্ধময় হয়ে পড়েছে। আগে একটা সময় ছিলো যখন ঢাকার মানুষের পানীয়  জলের অভাবের সিংহভাগ পূরণ করা হতো বুড়িগঙ্গার পানি ট্রিট করে। অর্থাৎ সেই পানি পরিশোধন করে। এখন ঐ পানি এতই খারাপ হয়ে গেছে যে, সেটা নাকি এখন ট্রিটমেন্টেরও অযোগ্য। এখন প্রধানত নির্ভর করতে হচ্ছে ভ‚গর্ভস্থ পানির ওপর। ঢাকায় কয়েক লাখ অ্যাপার্টমেন্ট তৈরি হয়েছে, আরো হাজার হাজার অ্যাপার্টমেন্ট তৈরি হওয়ার পথে। আগে নিমার্ণ করো হতো সর্বোচ্চ ৬ তলা ভবন। এখন আমার চোখের সামনেই কয়েকটি ২০ তলা ভবন ইতোমধ্যেই মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। এখন নাকি অনেকে ১০০ তলা ভবন নির্মাণেরও পরিকল্পনা করছে। এই যে লক্ষ লক্ষ অ্যাপার্টমেন্টে লক্ষ লক্ষ ফ্ল্যাটের পানির চাহিদা নিজস্ব উৎস থেকে পূরণ করা হচ্ছে এবং সেটা করতে গিয়ে তারা নিজেরাই ডিপ টিউবয়েল বসাচ্ছেন। তবুও রক্ষা যে পানির চাহিদা আংশিকভাবে হলেও মিটছে।
কিন্তু যারা একদিন পরিবেশ রক্ষার দোহাই দিয়ে জিয়াউর রহমানের মশার ঔষুধ ছিটানোর বাঞ্চাল করেছেন তারা আজ খামোশ কেন। সেই পাকিস্তান আমলের প্রথম দিকে আমি স্বপরিবারে বাস করতাম বৃহত্তর বগুড়া জেলায়। তখন এত সিটি কর্পোরেশন মেয়র বা বড় বড় পদাধিকারীর সংখ্যা এত ছিলো না। ফুটবলে যে মেশিন দিয়ে পাম্প দেয়া হয় তার চেয়ে বড় সাইজের পাম্প মেশিনের চেয়ে কিছুটা বড় সাইজের বেশ কয়েকটি পাম্প মেশিন কিনে পৌরকর্মীরা সেগুলো কাঁধে করে নিয়ে ঘুরে বেড়াতো এবং ড্রেনে ও নালা নর্দমায় ঔষুধ ছিটিয়ে বেড়াতো। এর ফলেই মফস্বল শহরের নাগরিকরাও  মোটামুটি আয়েশে রাতে স্বপরিবারে ঘুমাতে পারত।
\তিন\
কিন্তু তারপর কোথা থেকে কি যেন ঘটে গেল সাজানো ফুলের বনে ঝড় বয়ে গেল। হেমন্ত মূখার্জির সেই কালজয়ী গান, ‘কোনো এক গাঁয়ের বধুর কথা তোমায়  শোনাই শোন রূপ কথা নয় সে নয়।’ সেই  গাঁয়ের বধুর পেলব হাতের নরম ছোঁয়ায় কিষাণ-কৃষাণীর ঘর হাসি আর আনন্দে কলকলিয়ে উঠতো। অথচ সেই গ্রামে হানা দিল ডাকিনী-যোগিনীর দল। সলীল চৌধুরীর কথা ও সুরে এবং হেমন্ত মূখার্জির কণ্ঠে দেখুন সেই অভাগা গ্রামের পরবর্তি কাহিনী।
    গাঁয়ের বঁধুর শাঁখের ডাকে
    ল²ী এসে ভরে দিত
    গোলা সবার ঘরে ঘরে
    হায়রে কখন
    এল সমন
     অনাহারের বেশেতে
    সেই কাহিনী শোনাই শোনো।
    ডাকিনী যোগিনী
     এলো শত নাগিনী
    এলা পিশাচেরা এলো রে
    শত পাকে বাঁধিয়া
    নাচে তাথা তাথিয়া
    নাচে রে।
একই পরিস্থিতি বিরাজমান বাংলাদেশেও, অন্তত স্বাস্থ্য সেক্টরের একটি অংশে। আট দশ বছর আগে বাংলাদেশে হঠাৎ করে নতুন এক ধরনের জ্বরের প্রাদুর্ভাব ঘটে। প্রথমবার বেশ কয়েক জন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিসহ এই জ্বরে বেশ কয়েক ব্যক্তির প্রাণহানি ঘটে। অন্তত দুই ব্যক্তির কথা জানি যাদেরকে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে সিংগাপুর নেওয়া হয়। কিন্তু অভিজ্ঞতার অভাবের কারণে তাদেরকে একেবারে শেষ মুহুর্তে সেখানে নেওয়া হয়। হয়তো সেই কারণে তাদের বাঁচানো সম্ভব হয়নি। পরের বছর ডাক্তাররা অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করার ফলে মৃত্যুর সংখ্যা অনেক কমে যায়। ২০০৮ সালে আমার ডেঙ্গু হয়। আমি প্রথমে বুঝতে পারিনি আমার কোন ধরনের জ্বর হয়েছে। বার্ডেমের পরিচালক প্রফেসর আজাদ খান আমাকে দেখার পর আর কাল বিলম্ব না করে তার হাসপাতালে আমাকে ভর্তি করান এবং আমার সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করেন।
বছর দশ বারো আগে বাংলাদেশে এসেছে ডেঙ্গু। সেই ডেঙ্গু আবার দুই রকমের। একটি হলো ক্ল্যাসিকাল ডেঙ্গু আরেকটি হলো হেমোরেজিক ডেঙ্গু। অনেক গভীরে অনুসন্ধান করে জানা গেল যে, এই ডেঙ্গু এসেছে ইন্ডিয়া থেকে। ভারতীয় ডাক্তাররা ডেঙ্গুর চিকিৎসা সম্পর্কে অভিজ্ঞ। কিন্তু বাংলাদেশের ডাক্তাররা অভিজ্ঞ নয়। তাই ডেঙ্গুর চিকিৎসা সম্পর্কে অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য সর্ট ট্রেনিং কোর্সের প্রশিক্ষণ নেওয়ার জন্য ইন্ডিয়া পাঠানো হয়।
এবার  বাংলাদেশে শুরু হয়েছে এক নতুন উপদ্রব। এর নাম হলো চিকুনগুনিয়া। গত ১৭ তারিখ রাত আড়াইটায় আমি জ্বরে আক্রান্ত  হই। ভোর বেলা দেখি জ্বর ১০৩ ডিগ্রি। এমন একটি সময় যখন আমার হাতে গোনা অন্তত ৫ জন প্রফেসর আমেরিকা আছেন। এই  ৫ জনের মধ্যে একজনের অধীনে মেডিসিন সংক্রান্ত যাবতীয় অসুখ বিসুখে আমি তার স¥রণাপন্ন হই। তিনি না থাকায় আরেকটি মেডিকেল কলেজের মেডিসিন বিভাগীয় প্রধানের স¥রণাপন্ন হই। তিনি আমাকে ডেঙ্গু পরীক্ষা করতে দেন। যার এক বার ডেঙ্গু হয়েছিল তার সাধারণত দ্বিতীয় বার হয় না। তবুও ডাক্তারের নির্দেশ পেয়ে টেস্ট করতে হলো। যথারীতি টেস্ট রেজাল্ট নেগেটিভ। তখন তিনি আমাকে চিকুনগুনিয়া টেস্ট করতে দিলেন।
এই টেস্ট করতে গিয়ে হলো এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা। কোনো প্রাইভেট কিøনিকে এই টেস্ট হয় না। আর যদি তারা টেস্ট করে তাহলে ১৭ হাজার টাকা। সরকারি হাসপাতালে যদি ৪ দিনের মধ্যে টেস্ট করানো হয় তাহলে বিনা পয়সায় করা যায়। আমাকে একজন প্রভাবশালী প্রফেসর জানালেন যে আর মাস খানেক সময়ে কয়েকটি প্রাইভেট ক্লিনিকে চিকুনগুনিয়ার টেস্টের ব্যবস্থা করবেন। তবে ফি লাগবে যথারীতি ১৭ হাজার টাকা।
কিন্তু আরেকটি অসংগতি উল্লেখ না করে পারছি না। ঢাকার  মহাখালী বক্ষব্যাধি হাসপাতালে ¯িøপ টেস্ট বা নিদ্রা পরীক্ষা করা হয়। মাত্র ২ হাজার টাকায়। সেটি একটি প্রাইভেট ক্লিনিকে করা হয় ১২ হাজার টাকায়। অপর একটি হাসপাতালে করা হয় ১৪ হাজার টাকায়। অ্যানোফিলিস মশা উচ্ছেদ করা সম্ভব হয়েছে। যক্ষা র জীবাণু দূর করা সম্ভব হয়েছে। তাহলে ডেঙ্গু বা চিকুনগুনিয়ার বংশ নিপাত করা সম্ভব হবে না কেন? সংবাদপত্রে দুই একটি বিজ্ঞাপন ছাপিয়েই কি সরকার তার দায়িত্ব শেষ করছে?
[email protected]



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ