Inqilab Logo

শুক্রবার ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ৩০ কার্তিক ১৪৩১, ১২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

শ্রবণ প্রতিবন্ধীদের মুক্তির নাম বিএসএমএমইউ’র কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট

| প্রকাশের সময় : ২১ মে, ২০১৭, ১২:০০ এএম

স্টাফ রিপোর্টার : নটর ডেম কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলো খবির উদ্দিন। এতে তার স্বপ্ন পূরণ হলেও বেড়ে গিয়েছিলো দুশ্চিন্তা। কারণ, খবির তখন সম্পূর্ণ বধির। শৈশবকালে কানে সমস্যা ছিলো খবিরের। তবে কানে কিছুটা কম শুনলে বড় কোনো অসুবিধা হতো না। কিন্তু ২০০৩ সালে খবির যখন কলেজের ছাত্র তখনই ঘটে বিপর্যয়। হঠাৎ করে তার মারাত্মক জ্বর হয়। আর এই জ্বরের পর লোপ পায় তার শ্রবণশক্তি। মেধাবী খবির উদ্দিন সম্পূর্ণ শ্রবণ প্রতিবন্ধী হয়ে গেলেও দমে যাননি। কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েও তিনি লেখাপড়া চালিয়ে যেতে থাকেন। কৃতিত্বের সঙ্গে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে অনার্স ও মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন। কিন্তু তার স্বপ্ন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই এম.ফিল করবেন। প্রস্তুতি যখন শেষ তখন বাধা হয়ে দাঁড়ায় শ্রবণ প্রতিবন্ধীর বিষয়টি। একজন শ্রবণ প্রতিবন্ধীর পক্ষে গবেষণা কাজ (এম.ফিল) সম্ভব নয় বলে মনে করেন সংশ্লিষ্ট প্রায় সবাই। এম.ফিলে ভর্তি হতে না পেরে মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়েন খবির উদ্দিন। এক সময় তিনি জানতে পারেন, কানে কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট স্থাপনের মাধ্যমে সম্পূর্ণ বধির ব্যক্তিও শ্রবণের জগতে প্রবেশ করতে পারে। কিন্তু তাতে খরচ অনেক বেশী। সব মিলিয়ে প্রায় ১৭ লাখ টাকার মতো। কিন্তু তার অস্বচ্ছল পরিবারের পক্ষে এতো টাকা যোগাড় করা সম্ভব হয় না। একপর্যায়ে তিনি খবর পান, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) নাক কান ও গলা বিভাগে সম্পূর্ণ বধিরদের জন্য একটি চিকিৎসা কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। ‘ডেভেলপমেন্ট ফর কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট প্রোগ্রাম ইন বিএসএমএমইউ’ যেখানে শ্রবণ প্রতিবন্ধীদের কানে কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট স্থাপন করা হয়। আর এই ব্যয়বহুল চিকিৎসা কার্যক্রমটি দরিদ্রদের জন্য সম্পূর্ণ বিনামূল্যে দেয়া হয়।
বিষয়টি জেনে খবির উদ্দিন আবেদন করেন। তার কানে কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট স্থাপন করা হয়। ফিরে আসেন স্বাভাবিক জীবনে। শুধু তাই নয়, এই চিকিৎসার কারণেই তিনি সুযোগ পেয়েছেন এম.ফিল করার। খবির উদ্দিন আবার শব্দের জগতে প্রবেশ করে নতুন জীবন ফিরে পেয়েছেন। তিনি বলেন, আমি সরকারের কাছে এবং যারা এই কর্মসূচির সঙ্গে সম্পৃক্ত তাদের সবার কাছে কৃতজ্ঞ। শুধু এই খবির উদ্দিনই নয়, এ পর্যন্ত ১৪০ পিতা-মাতা শুনতে পাচ্ছেন প্রিয় সন্তানের মুখে মা-বাবা ডাক, ১২ জন শুনতে ও কথা বলতে পারছেন। আগামী জুন মাসের মধ্যে মধ্যে আরো ৫০ শ্রবণ প্রতিবন্ধীকে কোটি টাকার চিকিৎসাসেবা সম্পূর্ণ বিনামূল্যে দেয়া হবে বলে গতকাল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে ৫ম কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট সার্জারি বিষয়ক কর্মশালার উদ্বোধনীতে জানানো হয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ ডা. মিলন হলে ২ দিনব্যাপী এই অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে ছিলেন সমাজ কল্যাণ সচিব মো. জিল্লার রহমান। সভাপতিত্ব বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি প্রফেসর ডা. কামরুল হাসান খান। বিশেষ অতিথি ছিলেন প্রো-ভিসি (গবেষণা ও উন্নয়ন) ডা. মো. শহীদুল্লাহ সিকদার, কোষাধ্যক্ষ ডা. মোহাম্মদ আলী আসগর মোড়ল প্রমুখ। স্বাগত বক্তব্য রাখেন কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট কার্যক্রম-বিএসএমএমইউ-এর কর্মসূচী পরিচালক প্রফেসর ডা. মো. আবুল হাসনাত জোয়ারদার। শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন নাক কান গলা বিভাগের চেয়ারম্যান প্রফেসর ডা. বেলায়েত হোসেন সিদ্দিকী, ভারতের গঙ্গারাম হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. আশিষ কুমার লাহিড়ি ও অ্যাপোলো হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. ই সি বিনয় কুমার। অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন নাক কান গলা বিভাগের প্রফেসর ডা. এ এইচ এম জহুরুল হক সাচ্চু।
ডা. কামরুল হাসান খান বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মহানুভবতায় শ্রবণ প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সহায়তায় অন্যন্য সাধারণ মহতী সেবা চালু রয়েছে। অত্যন্ত দরিদ্র পরিবারের শ্রবণ প্রতিবন্ধী শিশুরাও লাখ লাখ টাকার চিকিৎসা সম্পূর্ণ বিনামূল্যে পাচ্ছে। এরফলে আজ ওই সকল শিশুরা শুনতে পারছে, কথা বলতে পারছে এবং তাঁদের মা-বাবার মুখে হাসি ফুটেছে। এসব শিশুরা আজ সমাজের বোঝা নয়। তিনি শ্রবণ প্রতিবন্ধী শিশুদের কক্লিয়ার ইমপ্লান্টে সহায়তা করার জন্য বিত্তশালীদের প্রতি আহŸান জানান।
ডা. মো. আবুল হাসনাত জোয়ারদার জানান, বধিরতা বাংলাদেশে একটি বড় ধরণের জনস্বাস্থ্য সমস্যা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে বাংলাদেশে বধিরতার হার শতকরা ৯ দশমিক ৬ ভাগ। দেশে প্রায় ১৬ লাখ মানুষ মারাত্মক ধরণের বধিরতার ভুগছেন-যদের সকলেই কক্লিয়ার ইমপ্লান্টের সম্ভাব্য প্রার্থী। বিশ্বজুড়ে প্রতি এক হাজার জনের মধ্যে দুইজন শিশু বধিরতা নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। সে হিসাবে বাংলাদেশে প্রতি বছর ২৬শ’ শিশু বধিরতা নিয়ে জম্মায় এবং প্রায় সমসংখ্যক জনগোষ্ঠী শ্রবণ শক্তি নিয়ে জম্মালেও তাঁদের জীবদ্দশায় কোন না কোন সময়ে বধিরে পরিণত হয়। যা শিশুর ভাষার বিকাশ এবং মানসিক বিকাশকে বাধাগ্রস্থ করে। পরিবার ও সমাজের বোঝা হয়ে থাকে। তাই একজন শ্রবণ প্রতিবন্ধীর দ্রæত শ্রবণ পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন।
সূত্র মতে, চিকিৎসা বিজ্ঞানের বিস্ময়কর আবিষ্কার কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট সার্জারী এখন বাংলাদেশেই হচ্ছে কিন্তু তা সীমিত পর্যায়ে রয়েছে। ২০০৫ সালের পূর্বে বাংলাদেশের হাতে গোনা তিন চারজন রোগী বিদেশে গিয়ে এই ইমপ্লান্ট সার্জারী করিয়েছেন। ২০১০ সাল পর্যন্ত দেশে ২৫ ইমপ্লান্ট সার্জারী হয়। বাংলাদেশে বর্তমান বাজারে একটি কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট -এর (ডিভাইস) মূল্য দশ থেকে বিশ লাখের মধ্যে পড়ে। এছাড়া সার্জারী, হেবিলিটিশন থেরোপী ও বিবিধ খরচের গড়ে কমপক্ষে আরো লক্ষাধিক টাকা ব্যয় হয়। এই ব্যয়বহুল চিকিৎসা সাধারণ মানুষের একেবারে নাগালের বাইরে ছিল। এছাড়া দেশে কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট টেকনোলজি সহজলভ্য ছিল না। এই প্রেক্ষিতে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় ডেভেলপমেন্ট অব কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট প্রোগ্রাম ইন বিএসএমএমইউ (১ম পর্যায়ে) নামে একটি কর্মসূচী গ্রহণ করে। এ পর্যন্ত সকল সার্জারী সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে। একই সঙ্গে অপারেশনও বিনামূল্যে করা হয়েছে। ইমপ্লান্ট গ্রহীতারা কানে শুনতে ও কথা বলতে সক্ষম হচ্ছে। অনুষ্ঠানে জানানো হয়, ইতিমধ্যে শিশুসহ ১৫২ জনের কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট সার্জারি সম্পন্ন হয়েছে। আরো ৫০ জনকে চলতি বছরের জুন মাসের মধ্যেই কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট বরাদ্দ দেয়া হবে।



 

Show all comments
  • Kazi samir ১২ ডিসেম্বর, ২০১৮, ৭:৪৩ পিএম says : 0
    আমি ছোটবেলা থেকে কানে কম শুনি। ডাক্তার বলিছে মেশিন ব্যবহার করতে।আমি কক্লিয়ার ইমপ্ল্যান্ট করলে ভালোভাবে শুনতে পারবো??
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ