হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির খড়গ : আসামের এনআরসি এবং বাংলাদেশ
কিশোর শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক দাবীর আন্দোলনে ঢাকাসহ সারাদেশে তীব্র রাজনৈতিক উত্তেজনা ও অনিশ্চয়তা দেখা যাচ্ছিল,
তৈমূর আলম খন্দকার : আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে রাজনীতির মাঠে উত্তেজনার পাশাপাশি রং মাখানো কথাবার্তার মাত্রা বৃদ্ধি করে দিয়েছে সরকারি দল। বিরোধী রাজনীতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে যে, প্রধানমন্ত্রী শূন্য হাতে ভারত থেকে ফিরে এসেছেন। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, তিনি বন্ধুত্বের জন্য গিয়েছিলেন, তা তিনি পেয়েছেন। ‘বন্ধুত্বকে’ যদি কিছু একটা ‘পাওয়া’ ধরি তবে প্রধানমন্ত্রী শূন্য হাতে ফিরেছেন এ কথা তিনি কেন মেনে নেবেন? তবে প্রশ্নটা হলো, বন্ধুত্বটা কি নিজের, না জাতির? যদি নিজের জন্য হয়ে থাকে তবে অন্য কথা। আর যদি জাতির জন্য এ বন্ধুত্ব হয়ে থাকে তাহলে বলতে হয়, দৃশ্যমান কিছু দেখা যাচ্ছে না।
বাংলাদেশের জন্মের পর পরই আমাদের ৫৭টি অভিন্ন নদীর মধ্যে ৫৪টির পানি ভারত লুটে নিচ্ছে। কোন প্রকার সমঝোতা ছাড়াই ভারত গঙ্গানদীর উপর ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণ করেছে। ১৯৭৫ সালে ২১ এপ্রিল থেকে ৩১ মে ৪১ দিনের জন্য পরীক্ষামূলকভাবে চালু করলেও ৪২ বছরে ফারাক্কার ৪১ দিন শেষ হয়নি। এর প্রভাবে বাংলাদেশের ভ‚-প্রকৃতি, আবহাওয়া, জলবায়ু, কৃষি, মৎস্য, জীববৈচিত্র্য ও নৌপরিবহন ব্যবস্থা ধ্বংসের সম্মুখীন। ভারত বাঁধের নিয়ন্ত্রণ গেট প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমে খুলে দিয়ে বাংলাদেশকে বন্যার পানিতে ভাসিয়ে সর্বনাশ করে দেয়। ১৯৯৬ সালে ৩০ বছরের জন্য গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তি হলেও বাংলাদেশ কোন পানি পাচ্ছে না।
১৯৭৬ সালের ১৬ মে মজলুম জননেতা মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী ফারাক্কা লংমার্চ করে ভারতের পানি লুটের বিরুদ্ধে জাতিকে সজাগ করেছেন। ১৯৭২ সাল থেকে বাংলাদেশ তিস্তাসহ ৫৪টি অভিন্ন নদ-নদীর পানি বঞ্চিত হয়ে হাহাকার করছে আর তিস্তার পানির জন্য দেনদরবার করছে। প্রধানমন্ত্রী সাম্প্রতিক ভারত সফরে তার সকল চাহিদা পূরণ করা সত্তে¡ও ভারত তিস্তাচুক্তি করেনি। জাতি হতাশ।
তিস্তার পানি চুক্তি নিয়ে যে ডাকঢোল পিটানো হয়েছে তা বন্ধুত্বের বিনিময়ে বিলীন হয়ে গেছে। তিস্তা একটি আন্তর্জাতিক নদী। সৃষ্টি হিমালয়ে, যবনিকা বঙ্গপোসাগরে। ভারত সরকার ও বাংলাদেশ সরকার সৃষ্টির পূর্বেই এর সৃষ্টি। ভারতবর্ষ যখন একক ছিল তখন থেকেই তিস্তা বহমান। দেশ ভাগের পর দু’টি রাষ্ট্রীয় সীমানা দিয়ে প্রবাহিত হওয়ার কারণে তিস্তা এখন আন্তর্জাতিক নদী। তিস্তার মতো আরো অনেক আন্তর্জাতিক নদী রয়েছে যা বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় সীমানা অতিক্রম করেছে। সেখানে কিন্তু এক রাষ্ট্র অন্য রাষ্ট্রকে উদ্দেশ্য করে বলেনি যে, ‘নদীতে পানি নাই, আমি কী করবো?’ এটা বন্ধুত্বের কথা নয় বরং আন্তর্জাতিক রীতির বরখেলাপ। ১৮১৪ সালে প্যারিস চুক্তি (Treaty of Paris) নদী, সাগর, মহাসাগরের বহমান পানির উপর ‘সাধারণ স্বাধীনতা’ ঘোষণা করেছে। এ স্বাধীনতার অর্থ হলো, বহমান কোনো নদী, সাগর, মহাসাগরের স্রোতধারার উপর কেউ প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারবে না। Treaty of Paris রং ১৮৫৬ মোতাবেক European Daube Commission এ মর্মে সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে, চলমান (Navigation) স্রোতধারার উপর কোনো বিবাদ চলবে না। RHINE নদী সম্পর্কে তারা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে যে, Rhine রং a resourceful river to germany and reparian States.. ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে বার্লিন কনফারেন্সে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে, আফ্রিকার বড় নদী CONGO এবং NIGER একাধিক রাষ্ট্র অতিক্রম করতে পারবে। ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে শান্তি চুক্তিতে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে, International Rivers equal treatment for all States as regards Navigation subject to condition and terms agreed upon.
বন্ধুত্বের সংজ্ঞা কী হতে পারে? একতরফা ভালোবাসার নাম বন্ধুত্ব নয়, বরং বোকার স্বর্গে বাস করার নামান্তর। বন্ধুত্ব হতে হবে দোতরফা, হোক তা যা কিছুর বিনিময়ে। প্রথমত: প্রাকৃতিক নিয়মে হিমালয় থেকে যার সৃষ্টি এবং গন্তব্যস্থল সমুদ্র থেকে মহাসমুদ্র সে পথকে রোধ করা প্রকৃতির উপর খবরদারী ভিন্ন কিছুই নয়। প্রকৃতির স্বাদ ভোগ করার অধিকার সকলের। সে অধিকারকে থামিয়ে দেয়ার নামই আধিপত্যবাদ, আগ্রাসনবাদ, যে অভিযোগে আমাদের বন্ধুরা অভিযুক্ত। এক দেশের বায়ু অন্যদেশে প্রবাহিত হচ্ছে, এক দেশের মেঘমালা অন্যদেশে বর্ষিত হচ্ছে। এ যদি আটকানো সম্ভব হতো যারা আগ্রাসন ও আধিপত্যবাদে বিশ্বাস করে তবে তারা তাই করতো। আন্তর্জাতিক নদীর পানি ব্যবহার সম্পর্কে যা বলা হয়েছে তা নিন্মরূপ:
It is a rule of International Law that no state is allowed to alter the natural conditions of the territory of a neighboring state. For this reason a state is not only forbiddent to stop or divert the flow of a river which runs from its own to a neighboring state, but likewise to make such use of the water of the river as either causes danger to the neighboring state or prevents it from making proper use of the flow the river on its part.
আন্তর্জাতিক আইন এ কথাই বলে যে, নদী প্রবাহকে রোধ বা এর পানি ব্যবহারে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থী। ১৯০৯ সালে আন্তর্জাতিক জয়েন্ট কমিশনের উদ্যোগ্যে আমেরিকা ও কানাডার সাথে সম্পাদিত চুক্তিতে বলা হয়, The state should notify the state affected and if that state object to it, it has to be settled by negotiation or arbitration which are mandatory অর্থাৎ কোনো রাষ্ট্রের কারণে যদি অন্যরাষ্ট্রের বহমান কোনো নদী ক্ষতিগ্রস্থ হয় মর্মে আপত্তি উপস্থাপিত হয় তবে পারস্পারিক আলোচনা, সমঝোতার মাধ্যমে অবশ্যই (MANDATORY) নিষ্পত্তি করতে হবে। যেখানে Arbitration এর প্রশ্ন উঠে সেখানে অবশ্যই একজন তৃতীয় পক্ষের মধ্যস্থতাকারী হিসেবে বৈঠকে উপস্থিত থাকতে হবে। অথচ ভারত ফারাক্কায় বাঁধ দিয়ে বাংলাদেশকে মরুভ‚মিতে পরিণত করার পদক্ষেপ নিয়েছে। তিস্তা সম্পর্কে তাদের মন্তব্য ‘ছেলে খেলার’ মতো, যা খেললেও চলে বা খেলা ভেঙ্গে দিলেও কোনো আপত্তি নাই। তিস্তার পানি কোনো দয়া দাক্ষিণ্যের ব্যাপার নয় বরং এটা বাংলাদেশের অধিকার। বন্ধুত্বের বিমিময়ে অধিকার বঞ্চিত বাংলাদেশকে বন্ধুত্বের জন্য আর কত মূল্য দিবে? পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর সর্বশেষ কথা ‘তিস্তার পানি বাংলাদেশকে দিলে শিলিগুড়ির লোকেরা জল পাবে না।’ গবেষক, বিশ্লেষকরা ইতোমধ্যে ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন যে, মিঠা পানি বা বিশুদ্ধ পানির হিস্যার জন্য ভবিষ্যতে রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে যুদ্ধ হতে পারে। এ ভবিষ্যদ্বাণী অমূলক হবে না যদি প্রকৃতিকে রোধ করার জন্য আগ্রাসনবাদ, আধিপত্যবাদ অব্যাহত থাকে।
তিস্তা থেকে পানি পাওয়া বা ভারত কর্তৃক তিস্তায় কোনো প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির প্রতিরোধে আন্তর্জাতিক কোনো পদক্ষেপ সরকার থেকে উদ্যোগ নেয়ার প্রস্তুতি দৃশ্যমান নয়। তবে রং মাখানো কথাবার্তা দিয়ে দুধের সাধ ঘোলে মিটানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। চুক্তি সম্পাদনে প্রধানমন্ত্রী মোদি ব্যর্থ হয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী বিরোধিতার কারণে। ভারতের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গির কারণে তিস্তা চুক্তি হয়নি, বরং ভারত তার পাওনা নিয়ে গেছে। ৭ থেকে ১০ এপ্রিল/২০১৭ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী কংগ্রেস নেত্রী সোনিয়া গান্ধীর সাথেও সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন। সোনিয়া গান্ধী স্পষ্টই বলেছেন যে, ভারতের সরকার পরিবর্তন হলেও বাংলাদেশ সম্পর্কে ভারতে দৃষ্টিভঙ্গির কোনো পরিবর্তন হবে না। কিন্তু এ চুক্তি নিয়ে সরকার ও সরকারি দোসরদের রং মাখানো কথাবার্তা জাতির সামনে ধূম্রজাল সৃষ্টি হয়ে এখন সন্দেহের দিকে এগুচ্ছে। গণপরিবহণ মালিক-শ্রমিকদের উদ্দেশ্যে লিফলেট বিতরণের সময় সরকারি দলের মুখপাত্র বলেছেন যে, চুক্তি লেখা সম্পন্ন হয়েগেছে, কিন্তু স্বাক্ষর বাকী আছে। সরকারের দোসর এক সময়ের স্বৈরাচার বর্তমানে গৃহপালিত বিরোধীদলের প্রধান এরশাদ পূর্বে বলেছেন যে, যেহেতু প্রধানমন্ত্রী চুক্তি করেছেন সেহেতু এ মর্মে তিনি কোনো কিছু বলবেন না। এখন বলছেন যে, শেখ হাসিনার সরকার আমলেই তিস্তা চুক্তি হবে। জাতীয় নেতাদের উচিৎ জাতির সামনে সঠিক তথ্য তুলে ধরা নতুবা এর দায়ভার তাদেরই ভোগ করতে হবে যারা রাজনৈতিক ফায়দা লাভের জন্য জাতীয় ইস্যুর উপর রং মাখানো বক্তব্য দিতে অভ্যস্থ হয়ে পড়েছেন।
বন্ধুত্ব যদি সংগতিপূর্ণ না হয় বা একজন আরেক জনের প্রতি সম্পূরক না হয় তবে সে বন্ধুত্ব হয়ে যায় ‘তেতো’; যদি না সে বন্ধুত্ব হয়ে থাকে সমগ্র জাতির পরিবর্তে কোটারী স্বার্থে। তিস্তা বহির্ভূত ২২টি সমঝোতা ও ৬টি চুক্তি জনগণের মধ্যে যে Perception সৃষ্টি করেছে তা অবশ্যই বাংলাদেশের পক্ষে সম্পাদনকারীদের পক্ষে যায় নাই, বরং বুমেরাং হয়েছে। ফলে জনগণের মনে প্রশ্ন, একি বন্ধুত্ব না মিসরীর ছুরি?
লেখক : কলামিস্ট ও বিএনপি’র চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।