Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

নিত্যপণ্য ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখতে হবে

| প্রকাশের সময় : ১৮ মে, ২০১৭, ১২:০০ এএম

আল ফাতাহ মামুন : পৃথিবীর অন্যসব দেশে মাহে রমজান এলে প্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্য মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখার প্রতিযোগিতা চলে। কীভাবে রোজাদারদের সেবা করা যায়, সাহারি ও ইফতারকে আরো বর্ণিল করা যায়- এসব কথা মাথায় রেখে ব্যবসায়ীরা নিত্যপণ্যের ওপর বিশেষ ছাড় দিয়ে থাকেন। ম্যধ্য ও নি¤œ আয়ের মানুষ রমজান এলে একটু সস্তিতে নিঃশ^াস ফেলে। এই মাসে সুন্দরভাবে চলার পরও কিছু সঞ্চয় করা যাবে, কিছু দান কর যাবে- এই ভেবে তাদের প্রশান্তি আরো বেড়ে যায়। এর ঠিক উল্টো চিত্র দেখা যায় বাংলাদেশে। এখানে রমজান যেন এক বিভিষীকার নাম। আমাদের মতো নি¤œ-মধ্য আয় ও উচ্চ-মধ্য আয়ের মানুষের জন্য মাহে রমজান এক বড় আতংক। রমজান মনেই অতিরিক্ত খরচ। অন্য মাসে কোনরকম চললেও রমজানে এসে হোঁচট খেতে হয় মাসের শুরুতেই। দেড়/দুই মাস আগে থেকেই বাড়তে থাকে নিত্যপণ্যের দাম। রমজান যত কাছে আসে বাজারের আগুন তত ছড়িয়ে পড়ে মানুষের ঘরে ঘরে। কত মানুষ যে গোপনে চোখের অশ্রæ ফেলে খোদার কাছে প্রার্থনা করেন- ‘হে আল্লাহ! এবারের রমজানটা স্ত্রী-সন্তান নিয়ে কোনরকম পার করার ব্যবস্থা করে দাও। এই অল্প টাকায় তুমি অনেক বরকত দিয়ে দাও। হে আল্লাহ!...’
এতক্ষণ যা বললাম, তা আমার বানানো কথা নয়, আবার মস্তিষ্কের অলীক কল্পনাও নয়। রমজানকে কেন্দ্র করে একদল অসাধু মুনাফাখোর ব্যবসায়ীর কারণে সুন্দর রমজানযাপন আমাদের মতো অল্প আয়ের মানুষের জন্য স্বপ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। আশেপাশের মানুষের দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকলেই বুঝা যাবে রমজানের আনন্দের চেয়ে বেদনার ছাপই বেশি গাঢ় তাদের চোখে-মুখে। এ বেদনা অন্য কিছু নয়, অসাধু ব্যবসায়ী কতৃক কৃত্রিমভাবে বাজার অস্থিতিশীল করার ফল। গত মাসের শেষের দিক থেকেই জাতীয় দৈনিকগুলো এ নিয়ে বিভিন্ন প্রতিবেদন প্রকাশ করা শুরু করেছে। ‘মাহে রমজানকে কেন্দ্র করে দ্রবমূল্যের ঊর্দ্ধগতি। লাগামহীন বাড়ছে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রবসামগ্রীর দাম। ছোলা-চিনির দাম লাগাম ছাড়া’- এসবই পবিত্র রমজান ও রমজানের আগে সংবাদ মাধ্যমের প্রধান প্রধান শিরোনাম। যদিও সরকারের পক্ষ থেকে বাজার তদারকি করার একটি কমিটি আছে, তবে ক্রেতা ও পাইকারি বিক্রেতারা বলছেন, ওই কমিটির ভ‚মিকা ও তত্ত¡াবধান সন্তোষজনক নয়। তাই প্রতিবারের মতো এবারও রমজান আসার দেড় মাস আগে থেকেই নিত্য প্রয়োজণীয় পণ্যের বাজার আগুন হয়ে আছে।  
পত্রপত্রিকায় বিভিন্ন সূত্রের উল্লেখ করে বলা হয়েছে, বিশ^বাজারে পণ্যের দাম কম হওয়া সত্তে¡ও আমাদের দেশের পাইকারী ও খুচরা বাজারে পণ্যের দাম বেশি রাখা হচ্ছে। শুধু তাই নয়। যেসব পণ্যের দাম ‘বিশ^বাজারে বেড়েছে’ অজুহাতে বাড়ানো হয়েছে, বিশ^বাজারে দাম কমার পরও ওই সব পণ্যের দাম দীর্ঘদিন দেশের বাজারে অপরিবর্তীত অর্থাৎ ‘না কমানো’ অবস্থাতেই আছে। উদাহরণ স্বরূপ সয়াবিন তেলের কথা বলা যায়। বিশ্ববাজারে গত বছরের অক্টোবরে অপরিশোধিত সয়াবিন তেলের দাম ছিল প্রতি মেট্রিক টন ৮৫৮ ডলার। দুই মাস না যেতেই আবারও দাম বেড়ে তা পৌঁছে যায় ৯১১ ডলারে (বিশ্বব্যাংকের তথ্যানুযায়ী)। বিশ্ববাজার থেকে অপরিশোধিত তেল এনে প্রক্রিয়াজাত করে বাজারজাত করার কারণে দেশে এই নিত্যপণ্যের দাম বাড়বে এটাই স্বাভাবিক। সে হিসেবে দেশের বাজারে এর প্রভাব পড়ে চলতি বছরের জানুয়ারি মাসের শেষদিকে। লিটারপ্রতি ন্যূনতম পাঁচ টাকা বাড়িয়ে দেয় বাজারজাতকারী কম্পানিগুলো। অল্প ক’দিন পরই বিশ্ববাজারে সয়াবিন তেলের দাম কমতে থাকে। ট্যারিফ কমিশনের আন্তর্জাতিক বাজার মনিটরিং সেলের তথ্যানুযায়ী, বর্তমানে বিশ্ববাজারে অপরিশোধিত সয়াবিন তেল প্রতি টন বিক্রি হচ্ছে ৮০০ ডলারে। বেশ কিছুদিন ধরেই এই দাম স্থিতিশীল পর্যায়ে রয়েছে। কিন্তু দেশের বাজারে সয়াবিন তেলের দাম কমানো হয়নি। সরকারি বাজার নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) বাজারদরের হালনাগাদ তথ্যে দেখা গেছে, প্রতি লিটার সয়াবিন তেল বিক্রি হচ্ছে সর্বোচ্চ ১০৬ টাকায়। গত বছরের একই সময়ে তা ছিল সর্বোচ্চ ৯৫ টাকা। অর্থাৎ এক বছরে দুই দফায় ১১.৩৫ শতাংশ দাম বাড়ানো হয়েছে। আর পাঁচ লিটারের ক্যানে এক বছরে দাম বেড়েছে ১৪.১২ শতাংশ।
তেলের চেয়ে চালের অবস্থা আরো ভয়াবহ। চলতি বছরের শুরু থেকেই চালের দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ার বিষয়টি বেশ আলোচনায় ওঠে আসে। দাম বেড়েছে কয়েক দফায়। এখনো তা বেড়েই চলেছে। প্রথম দফায় কোনো কারণ ছাড়াই ফেব্রæয়ারিতে কেজিপ্রতি দুই-তিন টাকা করে চালের দাম বাড়িয়ে দেয় ব্যবসায়ীরা। তারপর আরো একবার। অথচ ওই সময় চালের সরবরাহে কোনো প্রকার ঘাটতি ছিল না বলে ব্যবসায়ীরাই খাদ্য মন্ত্রণালয়কে জানায়। তথ্য মতে, সরকারকে চাপে রেখে ভারত থেকে চাল আমদানির (ভ্যাট ২৫ শতাংশ) সুবিধা গ্রহণ করাই ছিল বাজার অস্থিতিশীল করার মূল লক্ষ্য। চাল আমদানিতে আরোপিত শুল্ক প্রত্যাহারের জন্যই বারবার চাপ দিচ্ছিলো তারা। খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম চাল ব্যবসায়ীদের ডেকে দাম না বাড়াতে সতর্ক করে দিয়েছিলেন। কিন্তু ইতিমধ্যে দাম যে পর্যায়ে উঠে গেছে তা কমানোর কোনো নির্দেশ ব্যবসায়ীদের দেওয়া হয়নি। বর্তমানে মানভেদে খুচরা বাজারে চাল বিক্রি হচ্ছে ৪২ থেকে ৫৮ টাকা কেজি, যা গত বছরের একই সময়ে ছিল ৩২ থেকে ৩৪ টাকা।
এমনিভাবে প্রতিটি নিত্যপণ্য, শাকসবজি-তরিতরকারি থেকে শুরু করে সব কিছুর দাম হু হু করে বাড়িয়ে দিচ্ছে অসাধু ব্যবসায়ী চক্র। বৃষ্টি হলেও দাম বাড়ে। বৃষ্টি না হলেও দাম বাড়ে। গরম পড়লেও দাম বাড়ে। গরম না পড়লেও দাম বাড়ে। এমন এক পরিস্থিতি নিয়ে মাহে রমজানের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে দেশের মানুষ। যেভাবে জিনিসপত্রের দাম বেড়ে চলছে, যদি এতে লাগাম না দেওয়া যায় তবে সাধারণ মানুষের সুন্দর রমজানযাপন ও স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যহত হবে। তাই সরকার ও আইনশৃংখলা বাহিনীর কাছে অনুরোধ, দয়া করে বাজার তদারকির বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হোক। ব্যবসায়ীদের বলছি, আপনারাও অতি মুনাফার লোভ থেকে বেরিয়ে এসে সাধারণ মানুষের কথা ভাবুন। নিত্যপণ্য আমাদের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে রাখুন।  
লেখক :  প্রাবন্ধিক



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: নিত্যপণ্য

২৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন