হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির খড়গ : আসামের এনআরসি এবং বাংলাদেশ
কিশোর শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক দাবীর আন্দোলনে ঢাকাসহ সারাদেশে তীব্র রাজনৈতিক উত্তেজনা ও অনিশ্চয়তা দেখা যাচ্ছিল,
আফতাব চৌধুরী : গত বছরের হিসাব অনুসারে ডেনমার্ক পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী দেশ। মাথাপিছু আয়, আয়ুষ্কাল, পছন্দের চলাফেরা ইত্যাদি নিয়ে তারা গর্বিত। পৃথিবীর বড়ো গণতন্ত্রিক ভারত ১১৮ নম্বর, চীন ৮৩, পাকিস্তান ৯২, আমেরিকা ১৩, অস্ট্রেলিয়া ৯, ফিনল্যান্ডে ৫, নরওয়ে ৪ নম্বরে। ভয় পাওয়ার বিপরীত অবশ্য কিছুতেই খুশি থাকা নয়। ঠান্ডায় যদি ভয় পান, আইসল্যান্ডে ৩ নম্বর খুশি দেশ কখনওই খুব খুশি-খুশি মুখ করে ঘুরতে পারবেন না। তবে পছন্দের স্বাধীনতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ সেখানে কেউ ভয় দেখিয়ে আপনাকে দিয়ে অন্য কিছু করিয়ে থাকতে পারেন না। আর্থিক সক্ষমতার ব্যাপারটাও ফেলনা নয় চীনের আর্থিক সফল্যের পিছনে গণতন্ত্রের হাত নেই। সে দেশের তিয়েনানমেন স্কোয়ারের ঘটনা আর ঝলমলে বেজিং-সাংহাইয়ের সহাবস্থান হতে পারে ভেবে ভয় পাওয়া চলবে না।
আমেরিকাতে সমাপ্ত। ডানপন্থী মনে করেন ডেমোক্র্যাট মানেই শুধু খরচ বাড়ানোর পরিকল্পনা। দান-ধ্যান করে দক্ষিণ ইউরোপের দেশের মতো দেউলিয়া না হয়ে যেতে হয়। ডেমোক্র্যাটরা মনে করেন রিপাবলিকানরা সংস্কৃতিহীন নির্বোধ-এরা সরকারে গেলে গরিব প্রান্তিক মানুষদের খুব বিপদ। তবে এরা কাকে ভোট দেবেন সেটা নির্দিষ্ট, যারা নির্দিষ্ট রকম ডান বা বাম নন, বরং মধ্যপন্থী আর সম্ভবত মধ্যবিত্ত, তারা দু-পক্ষের কথাই মনোযোগ দিয়ে শোনেন। অতিরিক্ত দান করে দেশ দেউলিয়া হয়ে যাবে এটা কাম্য নয়, সব কিছু নির্ধারণ করবে বেসরকারি সংস্থা, এটাও তেমন পছন্দের নয়। অধিকাংশ গরিব দেশে বাজার ব্যবস্থা থেকে শুরু করে সরকারি মহলে অনেক প্রাতিষ্ঠানিক ত্রæটি-বিচ্যুতি থাকে। মধ্যবিত্তের ভয় পাওয়ার কারণও তাই যথেষ্ট। ব্যক্তিগত স্তরে, একজন প্রার্থীর দুটো বউ আছে, কিংবা সে অন্যায্য টু-পাইস আয় করেছে, এটাও মধ্যবিত্ত ভোটারের মধ্যবিত্ত মানসিকতায় অনর্থ বলে মনে হয়। আগে অবশ্য এগুলোর কয়েকটিকে মূল্যবোধ বলা হত আর নেতারাও এগুলো এড়িয়ে চলতেন; পরে জানা গেল একে মধ্যবিত্ত মানসিকতা বলা হয়। উপরি রোজগার না থাকলে নিজের কাছেই মুখ দেখানো যায় না। যে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সকলের সমান ভোটাধিকার সেখানে এই তিন ধরনের ভোটদাতার সংখ্যা তারতম্য নির্ধারণ করে দেবে আপনি ভোটের পরে ভয়ে ভয়ে থাকবেন নাকি নির্ভয়ে। এখানকার মতো হাতে না মারলেও অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক নীতি নির্ধারণ করে অন্যদের ভাতে মারার পদ্ধতি অনেক জায়গাতেই বিদ্যমান। বাংলাদেশের সংস্কৃতিতে উলাস, শোক প্রকাশ আর প্রতিশোধস্পহা সবই রান্নার মতো। অনেক তেল দিয়ে কড়া করে ভেজে তারপর অনেকক্ষণ সেদ্ধ করা। ফলে, এখানে রাজনৈতিক শত্রু হলে কী অবস্থা হতে পারে, তার আন্দাজ কিছু চলতি সময়েই পাওয়া যায়।
সরকারে যাঁরা আসবেন তাঁরা কেমন করে টাকা খরচ করবেন এটা করদাতার শিরপীড়া হতে পারে, যিনি কর দেন না তাঁর ভয়ের কিছু নেই। এ দেশে, অধিকাংশ মানুষকে প্রত্যক্ষ কর দিতে হয় না, সরকার এদের গরিব মনে করেন বলে। আর রাজস্ব চাই, তার জন্য মধ্যবিত্ত তো রয়েছেই। করদাতারা যদি এই গণতন্ত্রকে ভয় না-পায়, তা হলে ভয় কথাটা রয়েছে কেন? অন্য ভয়ের বিষয় হল যাদের ভোটব্যাঙ্কের সাহায্যে অনেক দিন আগে ঈদ বার্ষিকীতে তারাপদ রায়ের লেখা একটি সরস গল্পের কথা প্রথমে উল্লেখ করা যাক। নরেশ দত্ত চিড়িয়াখানায় গিয়ে প্রায় ঘটনাক্রমে এক অদ্ভুত ----আবিস্কার করেন। লোহার রেলিংয়ে কেডস্ পরে পা দিয়ে মারলে যে থম থম করে শব্দ হয় তাতে জেব্রারা ভয়ানক ভয় পাচ্ছে। পরে একদিন পরীক্ষা করে দেখলেন যে চামড়ার জুতো পরে ওই রকম শব্দ করলে কোনও ফল হয় না। চিড়িয়াখানাতেই আর এক দিন দেখলেন যে গ্রাম থেকে আসা একজন দর্শক কাঁধে ট্রানজিস্টও নিয়ে ঘুরছে আর তাতে তখন বিখ্যাত এক লোকসঙ্গীত শিল্পীর একটি গান বাজছে। লোকটি সিংহের খাঁচার কাছে যেতেই পশুরাজ ভয়ানক চমকে উঠে একেবারে খাঁচার কোণে সেঁধিয়ে গেল। এরপর নরেশবাবু গানটি টেপ রেকর্ডারে নিয়ে এসে সিংহের খাঁচার সামনে বহুবার বাজিয়েছেন। প্রত্যেকবারেই অব্যর্থ ফল হয়। সিংহ বা সিংহীরা ল্যাজ গুটিয়ে থর-থর করে কাঁপে। কলকাতায় সার্কাসের সিংহ খাঁচার বাইরে বেরিয়ে এসেছে, কিছুতেই ফেরত যাবে না। নরেশবাবু অব্যর্থ লোকসঙ্গীত বাজিয়ে সেটিকে খাঁচায় ফেরত পাঠালেন। কয়েক বছরের মধ্যে কাক থেকে ময়ুর; জলহস্তি থেকে ইঁদুর সবার ভয় পাওয়া নিয়ে গবেষণার পর এই স্বনামধন্য ভয়-বিশারদ মানুষটি খুঁজতে শুরু কররেন যে মানুষ কীসে ভয় পায়।
সব মানুষ এক বিষয়ে ভয় পায় না। পরিস্থিতি-পরিবেশ অনুসারেও ভয়ের বিষয় এবং কতটা ভয় পাচ্ছেন তার তারতম্য ঘটে। মানুষের এত রকম ভয় পাওয়ার বিষয় রয়েছে দেখে নরেশ বাবু ভীষণ উৎসাহিত হয়ে মানুষের ভয় নিয়ে সমীক্ষা শুরু করলেন। রাস্তায় যে-কোনো লোককে ধরেই উনি অনেক প্রশ্ন করতেন তার ভয় পাওয়ার বিষয় নিয়ে। শেষে দাঁড়াল যে মানুষ আর কিছুতে ভয় পাক না-পাক, সবাই নরেশবাবুকে ভয় পেত ভীষণ রকম আর তাঁকে দেখলেই দৌড়ে পালিয়ে যেত।
ভয় নিয়ে অনেক প্রশ্ন করলেও নরেশবাবু অবশ্য কোনও দিন জানতে চাননি যে মানুষ গণতন্ত্রকে ভয় পায় কি না। ছোটোদের পত্রিকায় প্রকাশিত গল্প কিনা, তাই জানার সুযোগ ছিল না। কিন্তু, অনেক গণতান্ত্রিক দেশে এই প্রশ্নটি নতুনবা করে আলোচিত হচ্ছে। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নেতা নির্বাচন থেকে বিলি-ব্যবস্থা সবার মনমতোই হয় না কখনওই। হাতের পাঁচটা আঙুল সমান নয়। কম বেশি হবেই। তবুও এতেই আস্থা বহু মানুষের, কারণ অতি বাম বা অতি-ডানপন্থী রাজনীতি পছন্দ করেন না বেশির ভাগই। যে দেশে এখনও গণতন্ত্র নেই, সেখানে কে কাকে ভয় পায় সেটা বোঝা একটু শক্ত, কারণ মানুষের ভয় পাওয়া নিয়ে সমীক্ষা করতে চাওয়াটাই একটা ভয়ের ব্যাপার। সমীক্ষক যদি প্রকাশ করে ফেলেন যে মানুষ তাকে ভয়ে ভয়ে বলছে যে তারা দেশের একনায়ক সরকারকেই ভয় পায় সবচেয়ে বেশি, কিংবা পলিটব্যুরোকে, তা হলে কর্তৃপক্ষ খুব অখুশি হন। অনেক ক্ষেত্রে এমনও হয়েছে যে সমীক্ষকের জেল হয়ে গিয়েছে, বাকি জীবন তিনি হয়তো জেলের কয়েদিদের সমীক্ষা করে কাটাচ্ছেন। তার উপর, আধা-গণতন্ত্র, আধা-মৌলবাদী দেশেও মানুষকে মেরে ফেলার প্রবণতা বেড়েছে সরকার-বিরোধী বা ধর্ম-বিরোধী কথা বললে। যারা এগুলো করে তাদের ভয় হল যে সরকার-বিরোধী কথা বললেই যদি সরকার ভেঙে পড়ে। ক্ষমতার অলিন্দে যাঁরা একবার যা হোক করে বসে পড়েছেন, তাঁরা সেখানে বাইরের লোককে ঢুকতে দিতে ভয় পান, যদি অপছন্দের কিছু বলে? গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্যে থেকেও যে এমনটা করা যায় তার উদাহরণ পশ্চিমবাংলায় গত তিন দশকে অনেক ঘটেছে। বহু মানুষ যে এতে অখুশি হন তা বলাই বাহুল্য।
তবে খুশি হওয়ার ব্যাপারটি স্বতন্ত্র। সব দেশের জন্য আজকাল হ্যাপিনেস ইনডেক্স পাওয়া যায়। এটা ধরেই রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতায় আসে, তাদের হাতে আঞ্চলিক ক্ষমতার রাশ দিয়ে দেওয়া। ক্ষমতার সঙ্গে আসে গুরুদায়িত্ব। যেহেতু শিক্ষার আলো এখনও সব স্তরে যথাযথ পৌঁছায়নি, কিন্তু কিছু স্তরে রাজনৈতিক ক্ষমতা ঢুকেছে ফলে ভয় দেখানোর রাজনীতিই নির্ধারক হচ্ছে আঞ্চলিক প্রাধান্যের। যাঁরা রাজনীতির সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত, তাঁরা এতে বেশি প্রভাবিত হন। তবে সাধারণ মধ্যবিত্তও এর কারণে খানিকটা বিচলিত হয়ে পড়েন। এক অভিনেত্রী সাক্ষাৎকারে একবার বললেন, মধ্যবিত্ত ভয়ানক দ্বিচারিতা করে। এঁরা যখন গাছের পাতায় রোদের ঝিকিমিকিটিকি অভিনয় করে মধ্যবিত্তের পয়সায় উচ্চবিত্ত হন, তখন তাদের দ্বিচারি বলে মনে হয় না। কিন্তু মধ্যবিত্ত যখন ঠিক করে যে আগের দলের মূল্যবোধ গিয়েছে, নতুন দলকে ভোট দেবে, তখন তাদের সুবিধাবাদী, দ্বিচারি বলে মনে হয় মধ্যবিত্ত শুধু টু-পাইস পাওয়ার আশায় ভোট দেয় না, শান্তি স্থিতি, সৌজন্য থাকবে সমাজে রাজনৈতিক দল এসে পারিবারিক ব্যাপারে মাথা গলাবে না, এই আশায় ভোট দেয়। এটাই বিশ্রী মধ্যবিত্ত মানসিকতা। টু-পাইসের আশায় যারা ভোট দেয় তারা দলে দলে রও বদলায় সুবিধামতো। দেশে মধ্যবিত্ত অনেক থাকলে কোনো সরকার অনেক দিন ক্ষমতায় থাকবে না, কারণ ক্ষমতা পেলেই দলের মূল্যবোধ নড়বড়ে হয়ে যায়। এটা সব পার্টি জানে, ফলে মধ্যবিত্ত মানসিকতার দোহাই দিয়ে এদের কোণঠাসা করে রাখার চেষ্টা করে।
গত তিরিশ বছরে কিছু শহুরে মধ্যবিত্তের নিজের প্রচেষ্টায় উপরে ওঠা আর বাকিদের আরও নীচের দিকে নেমে যাওয়া এমনকি ঢাকায় পাট গুটিয়ে মফসসলে চলে যাওয়া বা নীরব বসে থাকা এক ধরনের রাজনৈতিক শূন্যতার সৃষ্টি করেছে। যাঁরা অনেকেই প্রত্যক্ষ কর দেন না কিন্তু সরকারের কী পলিসি নেওয়া উচিত তা নির্ধারণ করতে স্রেফ সংখ্যায় বেশি হওয়ার কারণে, আর ভোট ব্যবস্থার বাইরে ক্ষমতা উপভোগ করেন, তাঁরা এই শূন্যতা পূরণ করেছেন। শহরে আইন অবমাননা কতটা মেনে নেওয়া যায়, প্রাতিষ্ঠানিক অসুবিধাগুলো কতটা থাকবে ইত্যাদি বিষয়ে গুটিয়ে যাওয়া মধ্যবিত্তের ভোটের মূল্য কতুটুকু? আগের সামাজিক পরিবেশের পরিবর্তন হয়েছে অনেকটাই, তবে অন্য ধরনের সমস্যাও সৃষ্টি হয়েছে এর সঙ্গে।
লেখক :সাংবাদিক-কলামিস্ট।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।