হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির খড়গ : আসামের এনআরসি এবং বাংলাদেশ
কিশোর শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক দাবীর আন্দোলনে ঢাকাসহ সারাদেশে তীব্র রাজনৈতিক উত্তেজনা ও অনিশ্চয়তা দেখা যাচ্ছিল,
মোবায়েদুর রহমান : কাশেম বিন আবু বাকার। সাম্প্রতিককালে উঠে আসা একটি নাম। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, বিশেষ করে ফেসবুক খুললেই এই নামটি চোখে পড়ছে। তিনি একজন কথাশিল্পী। ১৯৮৬ সাল থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত এই ২০ বছরে তার অন্তত ৮৫টি উপন্যাস এবং ১৫টি অন্যান্য ধরনের গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। এসব উপন্যাস হাজারে হাজারে নয়, লাখে লাখে কপি ছাপা হচ্ছে এবং লাখে লাখে কপি বিক্রিও হচ্ছে। তার সবচেয়ে জনপ্রিয় উপন্যাসের নাম ‘ফুটন্ত গোলাপ’। এটির নাকি ৩০টি সংস্করণ বেরিয়েছে। প্রথম কয়েকটি সংস্করণ ছাপা হয়েছে ৫ হাজার কপি করে। পরের সংস্করণগুলো ৩ হাজার কপি করে। একটি সাধারণ হিসাব ধরলেও এই বইটি প্রায় দেড় লাখ কপি বিক্রি হয়েছে। অন্যান্য বইয়েরও অসংখ্য সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে। ইতোমধ্যেই টেলিভিশন, পত্রপত্রিকা এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ সম্পর্কে যা বলা হচ্ছে সেখান থেকে দেখা যায় যে, শরৎচন্দ্র বা হুমায়ূন আহমেদেরও কোনো বইয়ের ৩০টি সংস্করণ প্রকাশিত হয়নি।
সবচেয়ে অবাক ব্যাপার হলো এই যে, এমন একজন অসাধারণ জনপ্রিয় লেখকের নাম শহুরে মানুষেরা, বিশেষ করে ঢাকার সুশীলসমাজ বা নাগরিক সমাজ কোনো দিন শোনেননি। এটিই হলো আমাদের সমাজের সবচেয়ে বড় প্যারাডক্স। এখন তাকে নিয়ে যেসব আলোচনা হচ্ছে সেসব আলোচনা থেকে জানা যায় যে, আন্তর্জাতিক বার্তা সংস্থা এএফপি কাশেম বিন আবু বাকারকে নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশের পর তোলপাড় শুরু হয়েছে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের আগ্রহের কেন্দ্রে পরিণত হয়েছেন তিনি।
যুক্তরাজ্যের শীর্ষ সংবাদমাধ্যম ডেইলি মেইল, মার্কিন সংবাদমাধ্যম ইয়াহু নিউজ, মধ্যপ্রাচ্যের আরব নিউজ, মালয়েশিয়ার দ্য স্টার ও মালয় মেইল, পাকিস্তানের দ্য ডন, ফ্রান্সের ফ্রান্স টোয়েন্টি ফোর ও রেডিও ফ্রান্স ইন্টারন্যাশনাল, হাঙ্গেরির হাঙ্গেরি টুডেসহ বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম ফলাও করে কাশেমকে নিয়ে ওই প্রতিবেদন ছেপেছে।
এএফপির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কাশেম বিন আবু বাকার ১৯৭০ দশকের শেষের দিকে কলম হাতে তুলে নেন। যেসব উপন্যাস ঢাকা থেকে বের হয় তার প্রায় সবগুলোতেই শহুরে অভিজাত সম্পদ্রায়ের ব্যক্তিগত, পারিবারিক বা গোষ্ঠীগত জীবনযাত্রার কথা লেখা থাকে। তখন কাশেম বিন আবু বাকার অনুভব করেন যে, শহুরে অ্যারিস্ট্রোক্র্যাটদের বাইরেও যারা আছেন, তাদের জীবনযাত্রা নিয়ে উপন্যাস লিখতে হবে। তিনি আরো অনুভব করেন যে, শহুরে অ্যারিস্ট্রোক্র্যাটদের ছেলে-মেয়েরা পোশাক-পরিচ্ছদ পরিধান এবং চলাফেরায় খুব উগ্র বা আপস্টার্ট। তাদের মধ্যে যদি ইসলামী ভাবধারা ও মূল্যবোধ জাগ্রত করা যায় তাহলে তারা পোশাক-পরিচ্ছদ ও আচরণে উগ্রতা এবং যৌন আবেদন পরিত্যাগ করতেও পারে। এই মহতী উদ্দেশ্য তরুণ ও যুবসমাজের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়ার জন্য তিনি কলম ধরেন।
১৯৭৮ সালে কাশেম তার প্রথম উপন্যাস ‘ফুটন্ত গোলাপ’ লেখেন। তবে ‘মোল্লার উপন্যাস বিক্রি হবে না’ বলে এটি প্রকাশকের নজর কাড়তে প্রায় এক দশক সময় লাগে। ওই প্রকাশকের কাছে মাত্র এক হাজার টাকায় এটির স্বত্বও বিক্রি করে দেন তিনি। এরপর ইসলামী মূল্যবোধকে সামনে রেখে কাশেমের লেখা একের পর এক প্রেমের উপন্যাস প্রকাশিত হতে থাকে। এসব উপন্যাস দ্রæতই তুমুল জনপ্রিয়তা অর্জন করে। লাখ লাখ পাঠকের হাতে হাতে ঘুরতে থাকে তার উপন্যাস।
এএফপিকে বাংলাদেশের সাংবাদিক কদরুদ্দিন শিশির বলেছেন, কাশেম বিন আবু বাকার এমন এক নতুন পাঠকগোষ্ঠীর কাছে পৌঁছেছেন, তার আগে যাদের অস্তিত্বের কথা কেউ ভাবেইনি।
তিনি আরো বলেন, গ্রাম এলাকায় তরুণ প্রেমিকরা তাদের প্রেমিকাকে সেরা উপহার হিসেবে কাশেমের উপন্যাস দিয়ে থাকে।
বলা হয় যে, কাশেমের উপন্যাস মাদ্রাসা বা ধর্মীয় আবাসিক স্কুলের ছাত্রদের কাছে তুমুল জনপ্রিয়। এর একটি ব্যাখ্যা এএফপির কাছে তুলে ধরেন সৈয়দ মাজহারুল পারভেজ। তিনি বলেন, তারা কাশেমের গল্পের সঙ্গে নিজেদের সম্পৃক্ত করতে পারে। আর এসবের কাহিনী বিন্যাস এবং ভাষাও তাদের কাছে আরামদায়ক মনে হয় বলে পারভেজের মত। এএফপি বলেছে, সেক্যুলার লেখকরা এমন এক দুনিয়ার গল্প বলেছে, যেখান থেকে বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষের প্রধান অংশ অর্থাৎ গ্রামীণ ও ধর্মীয় জীবনের অস্তিত্ব মুছে ফেলা হয়েছে। কাশেম এই শূন্যতার বিষয়টি অনুধাবন করে তার উপন্যাসের বাজার গড়ে তুলেছেন।
এএফপির ঐ রিপোর্ট মতে, কাশেমের এ প্রচেষ্টা থেকে নতুন প্রজন্মের অনেক বাংলাদেশী লেখক অনুপ্রাণিত হয়ে সমকালীন ‘ইসলামী উপন্যাস’ লিখে সাফল্যের পথ খুঁজে পেয়েছেন। তাদের মধ্যে আবদুস সালাম মিতুল, কাউসার আহমেদ এবং আবদুল আলিমের মতো লেখক উল্লেখযোগ্য।
\দুই\
গত শনিবার ঢাকার একটি জাতীয় বাংলা দৈনিকে কাশেম বিন আবু বাকারকে নিয়ে প্রায় দুই পৃষ্ঠার একটি ফিচার প্রকাশিত হয়েছে। ঐ ফিচারটি পড়ে এই লেখক সম্পর্কে অনেক কিছু জানা গেল। এছাড়া গত কয়েক দিন ধরে এ বিষয়ে ফেসবুক এবং ই-মেইলে অনেক কিছু আসছে। এসবের পর বাংলাদেশের একশ্রেণীর মিডিয়ার টনক নড়েছে। যেদিন আমি এই কলামটি লিখছি সেদিন অর্থাৎ রবিবার জানা গেল যে, দুই- তিনটি টেলিভিশন চ্যানেলও তার ওপর টকশো করেছে। ৭১ টেলিভিশন কাশেম বিন আবু বাকারের ওপর একটি টকশো করেছে। ঐ টকশোর উপস্থাপিকা আলোচনা প্রসঙ্গে জানান যে, কাশেম বিন আবু বাকারের ওপর তারা ধারাবাহিক আলোচনা করবেন। একটি ই-মেইল বার্তায় জানা যায় যে, এনটিভি টেলিভিশনের অনলাইনে এ বিষয়ে আলোচনা হয়েছে এবং কিছু লেখালেখি হয়েছে। এসব লেখকের একজন হলেন মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষ শক্তি বলে পরিচিত ঘরানার অধ্যাপক ও গবেষক আফসান চৌধুরী। তার লেখাটি সম্ভবত এ ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি আলোচনা অথবা বিতর্কের সৃষ্টি করেছে।
আফসান চৌধুরীর লেখাটি শুদ্ধ ভাষায় নয়, ঢাকাইয়া ভাষায়। তার লেখার অংশবিশেষ নিচে হুবহু উদ্ধৃত করছি। তার আগে পাঠক ভাইদের অবগতির জন্য জানাচ্ছি যে, এই লেখককে নিয়ে যেই মাত্র আলোচনা শুরু হয়েছে, সেই মাত্র একটি দল বের হয়েছে যারা তার বিরুদ্ধে বিশেষ ধরনের অপপ্রচারে মেতে উঠেছেন। কারণটি হলো, তার প্রতিটি উপন্যাসে রয়েছে ইসলামী আবহ। তিনি উপন্যাসের রোমান্টিক চরিত্র সৃষ্টি করেছেন সত্য, কিন্তু পাত্র-পাত্রীর রোমান্টিসিজমের মধ্য দিয়েও ইসলামের সত্য পথ অনুসরণ করার পরামর্শ দিয়েছেন। এটাতেই হয়তো ওদের গাত্র দাহ শুরু হয়েছে। কিন্তু গা-জ্বালা করলে কি হবে, ঐ সব অপপ্রচার দিয়ে তো তার জনপ্রিয়তায় ধস নামানো যাবে না।
হুমায়ূন আহমেদ যখন লেখালেখি শুরু করেন, যখন তার মাত্র কয়েকটি উপন্যাস বের হয়, তখন তার বিরুদ্ধে এই মর্মে অপপ্রচার চালানো হয় যে, তার লেখায় কোনো মেসেজ নেই। তিনি নেহাত টাকা কামাই করার জন্য লিখছেন। তার লেখা বাণিজ্যিক উপাদানে পরিপূর্ণ। এ ধরনের প্রচারণা হুমায়ূন আহম্মেদের জনপ্রিয়তাকে ঠেকাতে পারেনি। বরং দেখা গেছে, শরৎ চন্দ্রের পর হুমায়ূন আহম্মেদ ছিলেন বাংলার সবচেয়ে জনপ্রিয় লেখক। আর যারা কাশেম বিন আবু বাকারের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে সমালোচনা করেন তাদের হাটে হাঁড়ি ভেঙে দিয়েছেন আফসান চৌধুরী।
\তিন\
আমরা এখন আফসান চৌধুরীর মন্তব্যের অংশবিশেষ নিচে হুবহু উদ্ধৃত করছি। তার লেখার শিরোনাম, ‘রবীন্দ্রনাথ শ্যাষ, এহন কাসেম্মার যুগ’।
তিনি বলেছেন, ‘কাশেম বিন আবু বাকারকে নিয়ে সেক্যুলারদের কলিজা জ্বলেপুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে। গত ক’দিন ধরে চোখের পানি আর নাকের পানি এক করে ফেলছে তারা। ‘ভদ্দরলোক ভাই ও বোনেরা, আপনাগো বই কেউ পড়ে না। আপনারা নিজেরাও পড়েন না, কেনা তো দূরের কথা। আপনারা পয়সা দিয়া সমালোচনা লেখান। উপ-সচিবরে তেল মাইরা পুরস্কার নেওয়ার চেষ্টা করেন। রেস্টুরেন্টে বইয়া আড্ডা দেন, মদ খান, প্রেম আর পরকীয়া করেন। আর শেখ হাসিনারে প্রশংসা কইরা ভাবেন যে, উনিই আপনাগো রক্ষা করব। আপনারা হেফাজত আর কওমি মাদ্রাসারে সমানে গালি দিতাছেন। অবশ্য রইয়া-সইয়া। কারণ আপা যদি চেইত্যা যায়, সেই ভয়ও আছে।
২. চাকরি, সুবিধা, ফ্ল্যাট, অনুষ্ঠানে দাওয়াত, সফর, বিভিন্ন পুরস্কারের পেছনে দৌড়াইতে দৌড়াইতে ভুইল্লাই গেছিলেন যে আপনাগো পায়ের নিচে কোনো মাটি নাই। যেইডা ভাসে পানিতে, হেইডারে কচুরিপানা কয়। কাশেম বিন আবু বাকারকে এত যে গালি দিতাছেন দরজা-জানালা খুইলা, একবার কি ভাবছেন, আপনারা হগলে মিল্লা যত বই লিখছেন তার বিক্রি কাশেম্মার একখান বইয়ের থন কম বিক্রি। পালান ভাই সাবরা। আপনাগো দিন শ্যাষ। মাইন্না লন, বাংলা সাহিত্যে সবচেয়ে বড় বাস্তবতা হইতাছে কাশেম বিন আবু বাকার। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চেয়ে সাধারণ মানুষগো কাছে তার দাম বেশি। হুঁশ কইরা হিসাব কইরেন।
৩. তা ভাই ভদ্দর লোকগণ, একটা কাশেম বিন আবু বাকারের লাহান বই লিখা দ্যাখেন তো, একশ’ বই বিক্রি করতে পারবেন কি না। আপনারা তো পুলিশের পাহারা না হইলে সাংস্কৃতিক বিপ্লব করতে পারেন না। আপনারা বুড়া কাশেমের সাথে লইড়া একবার দেহান পাবলিকরে।
৪. আসল কথা হইল, আপনারা হইতাছেন শহরের মধ্যবিত্ত ভদ্দরনোক। রবীন্দ্র-জীবনানন্দ শ্রেণির পার্টি। আপনাগো লেহায় যেই সব উহ! আহ! আহে হেগুলা গাও-গ্রামের মুরখ্য মানুষ পড়তে চায় না। যেহানে আপনারা নিজেরাই পড়তে চান না, হেরা পড়ব ক্যান? কাশেম্মা হেই মানুষগো জন্য লিখতাছে, হেগো ভাষায়, হেগো চিন্তায়, হেগো সুখ-দুঃখ, আশা-আকাক্সক্ষা লইয়া। হেরা পড়ছে, খুশি হইছে। আপনাগো এত লাগে ক্যান?
কাশেম্মা কইছে কখনো, আমারে বাংলা একাডেমি পুরস্কার দেন? আপনারা কন, আপনারা চান, হেয় চায় না। হের পাবলিক আছে, আপনাগো নাই। এই জন্য এত কষ্ট হইতাছে?
এককাঠি মাইরা তারে কেউ কেউ জামাতি বানাইছেন, হেফাজতি বানাইছেন। ফেসবুকে সুবহানাল্লা প্রচুর কিছু লিখছেন গালি দিয়া। হেয় লিখছে? ফেসবুকের বাইরেও যে দুনিয়া, যেমন ধরেন গার্মেন্টসের আপারা। যারা তার বই পড়ে, তাগো কিছু আসে যায় না আপনার পোস্টে।
৫. আপনাগোর সিলসিলা কলকাতার ভদ্দরনোকের সিলসিলা, সুনীল-হুমায়ূনের সিলসিলা, শহরের মানুষগো সিলসিলা। ওই সিলসিলার এহন জানাজা হইতাছে। শুনতে পাইতাছেন? আর যেই মানুষটা ওই জানাজায় ইমামতি করতাছে, হের নাম কাশেম বিন আবু বাকার।
শেষ কথা চটি লইয়া। আমগো দেশের বেশির ভাগ মানুষ বিশেষ কইরা ভদ্দরলোকেরা ইন্টারনেটে গিয়া কী দ্যাখেন হেইডা জানেন না? হের নাম পর্নো, ঘণ্টার পর ঘণ্টা পর্নো দ্যাহেন, তাতে কোনো অসুবিধা নাই? আপনাগো কী নামে ডাকুম। রবীন্দ্রনাথের যুগের শেষ হইছে। এহন কাশেম্মার যুগ। সালাম দেন।’
যারা কাশেম বিন আবু বাকারের বিরুদ্ধে বিষোদগার শুরু করেছেন তারা আফসান চৌধুরীর ওপরের মন্তব্যটি পড়লে হয়তো সহি রাস্তা দেখতেও পারেন। কারণ আফসান চৌধুরী তো তাদের ঘরানারই লোক।
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।