Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ধীরগতি ও জটিলতায় ‘বে-টার্মিনাল’

চট্টগ্রাম বন্দর সম্প্রসারণে বৃহৎ অবকাঠামো পতেঙ্গায়

| প্রকাশের সময় : ১ মে, ২০১৭, ১২:০০ এএম

শফিউল আলম : পতেঙ্গায় ‘বে-টার্মিনাল’ নির্মাণ প্রকল্পের বাস্তবায়ন কাজ চলছে অতি ধীরগতিতে। পদে পদে সৃষ্টি হচ্ছে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা। চট্টগ্রাম বন্দর সম্প্রসারণে লক্ষ্যে পরিপূরক হিসেবে এ যাবত সর্ববৃহৎ অবকাঠামো তথা দেশের প্রধান সমুদ্র বন্দরের নতুন ও যুগোপযোগী বন্দর হতে যাচ্ছে ‘বে-টার্মিনাল’। চট্টগ্রাম বন্দরে কন্টেইনারসহ খোলা সাধারণ পণ্য এবং জাহাজবহর হ্যান্ডলিংয়ের ধারণক্ষমতা অতিক্রম করে গেছে। এ অবস্থায় বে-টার্মিনালকে অগ্রাধিকার প্রকল্প হিসেবে দেখছে বন্দর কর্তৃপক্ষ ও ব্যবহারকারীরা। বিগত ৭ ডিসেম্বর ’১৫ইং প্রকল্পের চিহ্নিত ভূমি অধিগ্রহণের জন্য বন্দরকে অনাপত্তি পত্র দেয় চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ)। তা সত্তে¡ও ভূমি সম্পর্কিত একের পর এক সৃষ্ট জটিলতায় এর বাস্তবায়ন কাজ এগুচ্ছে না। সময়মতো প্রকল্পটি যদি বাস্তবায়িত না হয় চট্টগ্রাম বন্দরে জাহাজ ও পণ্যসামগ্রী ধারণ এবং ওঠানামা সামাল দেয়ার মতো অবকাঠামোর শেষটুকুও আর থাকবে না।
বে-টার্মিনাল নির্মাণের ক্ষেত্রে কারিগরি সমীক্ষা পরিচালনা প্রায় সম্পন্ন করেছে জার্মানীর হামবুর্গ বন্দরের এইচপিসি শেলহর্ন-কেএস কনসালটেন্ট জেভি। গত ১৭ আগস্ট ’১৬ইং চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সাথে চুক্তির পর ইতোমধ্যে সাগর-উপকূলভাগের হাইড্রোগ্রাফি সমীক্ষা চালিয়ে আসছে। জার্মান প্রতিষ্ঠানটির বিশেষজ্ঞরা সম্প্রতি চট্টগ্রাম বন্দরের শীর্ষ কর্মকর্তাদের কাছে পেশকৃত সমীক্ষার প্রাথমিক তথ্য-উপাত্তে সেখানে নতুন সমুদ্র বন্দর স্থাপনের ক্ষেত্রে প্রাকৃতিকভাবেই টেকনিক্যাল সুবিধাদির বিদ্যমান থাকার সাথে ব্যাপক অর্থনৈতিক সম্ভাবনার কথা জানান। শিগগিরই পূর্ণাঙ্গ সমীক্ষা প্রতিবেদন দাখিলের পর এর ভিত্তিতে বে-টার্মিনালের ডিজাইন চূড়ান্ত করা হবে। বর্তমানে ‘বে-টার্মিনাল’ প্রকল্পটি এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে জটিলতার প্রধান দিক হচ্ছে সরকারি ভূমির অধিগ্রহণ ব্যয়। সরকারের খাস খতিয়ানভুক্ত সাড়ে ৮ শ’ একর ভূমি অধিগ্রহণ করতে প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকার ব্যয়ের হিসাব এসেছে। কিন্তু বন্দর কর্তৃপক্ষ বলছে, এত বিশাল অংকের ব্যয় মেটানো সম্ভব নয়। তাই সরকারের কাছ থেকে প্রতীকী মূল্য ধার্য করে ভূমি বরাদ্দের আবেদন জানানো হয়েছে। অন্যথায় বিপুল অংকের টাকায় ভূমি কিনতে বন্দর কর্তৃপক্ষ অপারগতার কথা জানায়। পতেঙ্গা-হালিশহর এলাকায় বঙ্গোপসাগরের কিনারায়  জেগে ওঠা চর ও এর সাথে লাগোয়া চ্যানেলকে ঘিরে বন্দর কর্তৃপক্ষ স¤প্রসারিত বন্দর ‘বে-টার্মিনাল’ নির্মাণ করতে চাইছে। এ প্রকল্পের জন্য ৯০৭ একর ভূমি চিহ্নিত করা হয়েছে। এরমধ্যে ৭০ একর ব্যক্তিমালিকানার। বাদবাকি ভূমি সরকারের খাস খতিয়ানভুক্ত অকৃষি জমি। ব্যক্তিমালিকানার ভূমি বন্দর কর্তৃপক্ষ ব্যয় মিটিয়ে অধিগ্রহণ করতে প্রস্তুতি নিয়েছে। কিন্তু সরকারি মালিকানার সাড়ে ৮শ’ একর ভূমি সরকারের পক্ষ থেকেই হ্রাসকৃত প্রতীকী মূল্যে বরাদ্দ পাওয়ার জন্য আন্তঃমন্ত্রণালয় পর্যায়ে বন্দর কর্তৃপক্ষ চেষ্টা করছে। জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রকল্প তথা নতুন বন্দর অবকাঠামো বাস্তবায়নের স্বার্থে এ বিষয়ে ভূমি প্রশাসন ইতিবাচক সাড়া দেবে বলেও আশা করা হচ্ছে।
চিটাগাং চেম্বার সভাপতি মাহবুবুল আলম এ বিষয়ে বলেছেন, চট্টগ্রাম বন্দর সম্প্রসারণের প্রয়োজনে ফার্স্ট ট্র্যাক প্রকল্প হিসেবে বে-টার্মিনালের দ্রæত বাস্তবায়নে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। এর পাশাপাশি আরও কন্টেইনার টার্মিনাল, ইয়ার্ডসহ অবকাঠামো তৈরি ও ভারী অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি সংগ্রহ করে দেশের প্রধান বন্দরের সক্ষমতা বাড়াতে হবে।       
এদিকে প্রকল্পস্থলের ভূমির একটি বড় অংশ বন বিভাগের হওয়ায় ভূমি হস্তান্তরের ক্ষেত্রে ‘ডি-রিজার্ভেশন’ প্রয়োজন হবে। ‘বে-টার্মিনাল’ প্রকল্পের জন্য সিডিএ’র অনাপত্তি পাওয়া মোট ৯০৬ দশমিক ৪২ একর ভূমির মধ্যে উত্তর পতেঙ্গা ও দক্ষিণ হালিশহরে অবস্থিত ৪৬৪ দশমিক ৭৫ একর ভূমি বন বিভাগ কর্তৃক সংরক্ষিত এলাকা। যা ২০১৪ সালের ৫ জুন গেজেট এবং বন আইনের ৬ ধারায় ইস্তেহার জারি হয়। এই ভূমির অধিগ্রহণ প্রক্রিয়ার বিষয়ে জেলা প্রশাসনের এলএ শাখা বন বিভাগের মতামত জানতে চাইলে চট্টগ্রাম উপকূলীয় বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা তার প্রতিবেদনে জানান, বে-টার্মিনালের জন্য প্রস্তাবিত উত্তর পতেঙ্গা ও দক্ষিণ হালিশহর এলাকার ৪৬৫ একর ভূমি রিজার্ভ ফরেস্ট। তাই ডি রিজার্ভেশন ব্যতিরেকে এই ভূমি হস্তান্তরের সুযোগ নেই। তবে বন্দর সূত্র সেই ভূমির বিষয়ে বন বিভাগের খতিয়ান সংগ্রহের কথা জানিয়ে বলেছে, সেখানে তাদের কোন জায়গা নেই। কোন বনও নেই।  
বর্তমান চট্টগ্রাম বন্দর অবকাঠামোর কাছেই বঙ্গোপসাগর উপকূলে পতেঙ্গা-হালিশহরে বড় আকারের জাহাজ ভিড়ার উপযোগী গভীরতা (চ্যানেলের ড্রাফট) রয়েছে। পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকতের খেজুরতলার বিপরীত থেকে কাট্টলী পর্যন্ত অংশে পলি জমে ১২ কিলোমিটার দীর্ঘ একটি চর সৃষ্টি হয়েছে। সাগর থেকে গত আড়াই-তিন দশকে ক্রমে জেগে উঠে এই ভূমি। সেখানেই বে-টার্মিনাল নির্মাণ করবে বন্দর কর্তৃপক্ষ। যেখানে চট্টগ্রাম বন্দরের অপারেশনাল এরিয়ার আয়তন ৩৩৫ একর, বে-টার্মিনাল প্রকল্পস্থলের আয়তন বর্তমানে তার তিনগুণের কাছাকাছি। এই চর ও উপকূলের মাঝামাঝি ৮শ’ মিটার প্রশস্ত জায়গায় জাহাজ চলাচলের পথ বা চ্যানেল তৈরি হয়ে আছে। এর গভীরতা ৬ থেকে ৯ মিটার পর্যন্ত। ড্রেজিং করে ১২ মিটার পর্যন্ত ড্রাফটের যেকোন দৈর্ঘ্যরে ৩০-৩৫টি জাহাজ একযোগে ভিড়ানো সম্ভব হবে। বর্তমানে চট্টগ্রাম বন্দরে যেখানে সর্বোচ্চ ১৮শ’ টিইইউএস কন্টেইনারবাহী ফিডার জাহাজ ভিড়তে পারে, বে-টার্মিনালে ৫ হাজার কন্টেইনারবাহী আরো বড় জাহাজ ভিড়তে সক্ষম হবে। আবার খোলা পণ্যবাহী বড় জাহাজও ভিড়তে পারবে। চট্টগ্রাম বন্দরে এখন সর্বোচ্চ ৯.৫ মিটার ড্রাফটের এবং ১৯০ মিটার পর্যন্ত লম্বা জাহাজ ভিড়তে পারে। তাও জাহাজের আসা-যাওয়া জোয়ারের সময়ের উপর নির্ভর। এই প্রাকৃতিক সুবিধাকে বন্দর শিপিং বিশেষজ্ঞরা মহান আল্লাহর অপার দান হিসেবে উল্লেখ করেন। সেখানেই গড়ে উঠবে চট্টগ্রাম বন্দরের পরিপূরক উন্নত অবকাঠামো ‘বে-টার্মিনাল’ অর্থাৎ বর্ধিত সমুদ্র বন্দর। সেখানে জোয়ার ও ভাটায় ২৪ ঘণ্টা সময়ই জাহাজ চলাচল, ভিড়ানো ও ঘোরানো সম্ভব হবে।    
বন্দর কর্তৃপক্ষ সূত্র জানায়, ভূমি অধিগ্রহণের জটিলতা নিরসন হলে আগামী ৫ বছরে বে-টার্মিনালের ভৌত অবকাঠামো নির্মাণ করা হবে। প্রথম দিকে দু’টি ডলফিন টাইপ জেটি নির্মাণ করে কয়লা এবং সিমেন্ট শিল্পের কাঁচামাল ক্লিংকার খালাস কাজ শুরু করা হবে। বন্দর কর্তৃপক্ষের মুনাফালব্ধ নিজস্ব তহবিল থেকে অর্থায়নে বে-টার্মিনালের ভৌত ও কারিগরি অবকাঠামো নির্মাণে প্রাথমিকভাবে প্রায় ২২ হাজার কোটি টাকা ব্যয় প্রাক্কলন করা হয়েছে।   
এদিকে চট্টগ্রাম বন্দরে পণ্য ও জাহাজ হ্যান্ডলিংয়ের চাপ, চাহিদা ধারণসীমা ছাড়িয়ে যাওয়ার কারণেই বে-টার্মিনাল স্থাপন জরুরি হয়ে পড়েছে। প্রধান এ সমুদ্র বন্দরে বার্ষিক ১৫ শতাংশ হারে পণ্য হ্যান্ডলিং চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে। গতবছর ৭ কোটি ৭২ লাখ ৫৫ হাজার ৭৩১ মেট্রিক টন পণ্য এবং ২৩ লাখ ৪৬ হাজার ৯০৯ টিইইউএস কন্টেইনার ওঠানামা হয়। ২০১৫ সালে বন্দরে জাহাজ ভিড়ে ২ হাজার ৭০৯টি। ২০১৬ সালে জাহাজের সংখ্যা ৩০৫টি বেড়ে দাঁড়ায় ৩ হাজার ১৪টিতে। আঙ্কটাড নীতিমালা অনুযায়ী যে কোনো সমুদ্র বন্দরে স্বাচ্ছন্দ্যের সাথে কর্মকান্ড পরিচালনার জন্য বিদ্যমান অবকাঠামোর অন্তত ৩০ শতাংশ জায়গা খালি রাখতে হয়। কিন্তু চট্টগ্রাম বন্দরে ইত্যেমধ্যে সবক্ষেত্রে ধারণক্ষমতা ছাড়িয়ে গেছে। এতে করে বেসামাল জটের মুখে পড়ছে বন্দর। দেশের ৮৫ ভাগ আমদানি-রফতানি চট্টগ্রাম বন্দর দিয়েই সম্পন্ন হয়। শিপিং পোর্ট সার্কেলের অভিজ্ঞজনেরা মনে করেন, বে-টার্মিনাল নির্মিত হলে আগামী অন্তত ৫০ থেকে ৭০ বছর চট্টগ্রাম বন্দর পূর্ণ সক্ষমতা বজায় রেখে সার্ভিস দিতে পারবে। অন্যথায় শিপিং পোর্ট বাণিজ্যে বিশ্বায়নের অগ্রসরমান ধারা থেকে পিছিয়ে পড়বে দেশ।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: চট্টগ্রাম বন্দর

১৪ আগস্ট, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ