Inqilab Logo

শক্রবার ০৯ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ কার্তিক ১৪৩১, ০৬ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

শিশুর নিরাপত্তা ও রাষ্ট্রের দায়িত্ব

প্রকাশের সময় : ৪ মার্চ, ২০১৬, ১২:০০ এএম

মুহাম্মদ আবদুল কাহহার
গণমাধ্যমের খবরগুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, প্রায় প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও শিশু নির্যাতন, ধর্ষণ, অপরহরণ ও হত্যা করার সংবাদ প্রকাশ হচ্ছে। শিশুদের যেসব অপরাধে নির্যাতন ও হত্যা করা হয়েছে বা হচ্ছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- খিলক্ষেতের নাজিম উদ্দীনকে কবুতর চুরির অপবাদে হত্যা, সিলেটের সামিউল আলম রাজনকে চুরির অপবাদে হত্যা, মোবাইল চুরির অপবাদসহ সামান্য কারণে শিশুদের হত্যা করা হয়। ঘাতকদের নির্যাতনের বিবরণ শুনলে যে কোন সুস্থ মানুষের মাঝে মানসিক অসুস্থতা শুরু হয়। খুলনার টুটপাড়ার গ্যারেজকর্মী রাকিবকে মোটরসাইকেলে হাওয়া দেয়ার কম্প্রেসার মেশিন দিয়ে পেটে হাওয়া দিলে নাড়িভুঁড়ি, মলদ্বার ও মূত্রথলি ফেটে তার মৃত্যু হয়। হবিগঞ্জে একই সাথে চার শিশুকে নির্মমভাবে হত্যা করে মাটির নিচে পুঁতে রাখা হয়েছিল। নেশার টাকার জন্য সাভারের ধামরাইয়ে শিশু ইমরান ও শাকিলকে অপহরণের ঘটনা ঘটে। কেরানিগঞ্জের আবদুল্লাহকে অপহরণের পর মুক্তিপণের টাকা নিয়েও তাকে হত্যা করে হাত-পা বেঁধে তার লাশ একটি ড্রামের ভেতরে ভরে ঘরের মেঝেতে লুকিয়ে রাখা হয়। রংপুরের রওনক নিখোঁজ হওয়ার দু’মাস পর মিঠাপুকুরে তার লাশ ভেসে ওঠে। চাঁদপুরের হাজীগঞ্জের কঙ্গাইশ গ্রামের পাল পুকুরিয়ায় চুরির অপরাধ এনে তিনটি শিশুকে খড়ের গাদায় ৫ ঘণ্টা বেঁধে রাখা হয়। রাজশাহীর পবা উপজেলার বাগসারা গ্রামে মোবাইল ফোন চুরির অভিযোগ এনে দুই শিশুকে নির্যাতন করা হয়। রাজধানীর বনশ্রীতে ভাই-বোন হত্যার ঘটনায় দায়ী হিসেবে মা-বাবাকেই সন্দেহ করছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এভাবে দেশে গত দেড় মাসে ৪৭ শিশুকে হত্যা করা হয়েছে। এসব হত্যাকা-ের ঘটনা প্রমাণ করে দেশ কেমন চলছে!
যে শিশুর বিরুদ্ধে চুরির অভিযোগ এনে নির্যাতন করতে করতে হত্যা করা হলো, অথচ পুলিশের তদন্তে বেরিয়ে এলো সে চোর নয়। নির্যাতনের সময় বারবার কসম কেটে বলেছে আমি চুরি করিনি। কিন্তু শিশুটির কথা কেউ বিশ্বাস করলো না। তাকে জীবন দিয়েই প্রমাণ করতে হলো সে চোর নয়। শিশুর বিরুদ্ধে খুব সহজেই যে অপবাদ আনা যায়, সেটি হলো চুরি। মানুষ প্রাথমিকভাবে মনে করে শিশুটি হয়তো চুরি করেছে। এই মিথ্যাচারের বয়ান দিয়েই শিশুদের নির্যাতন করা হয়। এসব হত্যাকা-ের রহস্য উদঘাটনে যারা কাজ করছেন কিংবা দেশ পরিচালনা করছেন ন্যায় বিচারের স্বার্থে তারা একবার হলেও ভেবে দেখবেন রাজন ও তানভীর মোহাম্মদ তকীর মতো সন্তানটি যদি আপনার-আমার হতো তাহলে আমরা কী ব্যবস্থা নিতাম! নিজেদের কী বলে বুঝ দিতাম। প্রত্যেকটি নির্যাতন, অপহরণ ও হত্যার যেন সুষ্ঠু বিচার হয় সে বিষয়টি নিশ্চিত করা দরকার। তা না-হলে অপরাধ প্রতিনিয়ত বাড়তেই থাকবে।
শিশু অধিকার ফোরামের তথ্য মতে, চলতি বছরের জানুয়ারিতে ২৯ শিশুকে হত্যা করা হয়েছে। এছাড়া ২০১৫ সালে ২৯২ শিশুকে হত্যা ও ৫২১ শিশু ধর্ষণের শিকার এবং  ২৪০ শিশুকে অপহরণ করা হয়। তাদের মধ্যে ১৬৭ শিশুকে জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে। মৃত অবস্থায় উদ্ধার করা হয় ৪০ জনকে। বাকিদের কোনো খোঁজ নেই। ২০১৪ সালে ৩৬৬ জন শিশুকে হত্যা ও ১৯৯ জন শিশুকে ধর্ষণ করা হয়েছে। ২০১৩ সালে ২১৮ জন ও ২০১২ সালে ২০৯ জন শিশুকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। শুধু পেশাদার খুনি নয়, অনেকে মা-বাবা ও আত্মীয়-স্বজনদের হাতেও প্রাণ হারিয়েছে। শুধু ২০১৫ সালের প্রথম ছয় মাসেই মা-বাবার হাতে খুন হয়েছে ২৭ শিশু। এর মধ্যে মায়ের হাতে খুন হয়েছে ১৩ শিশু ও বাবার হাতে খুন হয়েছে ১৪ শিশু।
শিশুরা কারো শত্রু নয়। শিশুদের সাথে কারো দ্বন্দ্ব থাকারও কথা নয়। দেশের সর্বত্র শিশুরা দুর্বৃত্তদের টার্গেটে পরিণত হয়েছে। তার কারণ, এতে ঝুঁকি কম থাকে। শিশুরা প্রতিবাদ করতে পারে না। প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে না বলে শিশু হত্যা বেড়ে চলছে। মানুষের মুখে একটাই রব-শুধুই নিরাপত্তার অভাব। এ দেশে সন্তান মায়ের গর্ভে থাকালীন কথিত সোনার(?) ছেলেদের ছোড়া বুলেট শরীরে বহন করে পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করতে হয়। জন্মের পরে হাসপাতাল থেকে নবজাতক চুরি করার ভয় তাড়িয়ে বেড়ায় স্বজনদের। সন্তানটি একটু বেড়ে উঠলেই তাকে অপহরণ করার ভয়। এভাবে করে সন্তানটি যতই বড় হয় আতঙ্কের মাত্রা ধীরে ধীরে যেন বাড়তে থাকে। অপহরণের ভয়ে সন্তানকে বিদ্যালয়ে পাঠিয়ে মা স্বস্তি পায় না। সারাক্ষণ দুশ্চিন্তায় কাটাতে হয়। স্কুল-কলেজ-মাদরাসায় পড়লে কারণে-অকারণে রাজনৈতিক মামলার আসামি হতে হয়। এভাবে আর চলবে কতকাল? সামান্য কারণে হত্যাকা- ঘটে যায়। এমন পরিস্থিতিকে কোনোভাবেই ভালো যায় না। দীর্ঘ সময় পার হলেও প্রশাসন প্রকৃত অপরাধীদের গ্রেফতার করতে ব্যর্থ হচ্ছে। প্রতিটি শিশুর জীবনের নিরাপত্তা দেয়ার পাশাপাশি প্রকৃত অপরাধীদের সনাক্ত করে বড় ধরনের শাস্তি দেয়া রাষ্ট্রের দায়িত্ব। অথচ এসব জনসম্পৃক্ত বিষয়ে রাজনীতিবিদদের তেমন তৎপর ভূমিকা নিতে দেখা যায় না। গড়িমসি, গাফলতি এবং আদালতে মামলার জট থাকায় বছরের পর বছর মামলাগুলো ঝুলে আছে। ২০১১ সাল থেকে ২০১৫ সালের অক্টোবর পর্যন্ত নারী ও শিশু নির্যাতনের চার হাজার ৬৮ মামলার ৩০ ভাগই শিশু নির্যাতন মামলা। কটা মামলায় ন্যায় বিচার হয়েছে?  সে হিসেব কারো কাছে মিলছে না।
গত ১৭ আগস্ট ঢাকার হাজারীবাগের গণকটুলী এলাকায় মোবাইল চুরির অভযোগ তুলে মো. রাজা (১৬) নামে এক শিশুকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। ওই দিনই ঘাতক প্রভাবশালী ছাত্র সংগঠনের থানা সভাপতি র‌্যাবের হাতে আটক হন। এরপর সেই ছাত্রনেতা বন্দুক যুদ্ধে নিহত হলে এলাকায় স্বস্তি ফিরে আসে। বর্তমানে সেই এলাকাটির মানুষ কিছুটা স্বস্তিতে বসবাস করছে। মানবাধিকার সংগঠনগুলো র‌্যাবের ক্রস ফায়ার ও বন্দুক যুদ্ধের বিষয়ে নানা প্রশ্ন তুললেও বর্ণিত ঘটনায় সাধারণ মানুষ কিছুটা হলেও স্বস্তিতে নিঃশ্বাস ফেলছেন। এই ঘটনা প্রমাণ করে, সারাদেশে যারা শিশু হত্যার সাথে জড়িত তারা যদি ন্যায়বিচারের আওতায় আসতো তাহলে শিশু নির্যাতন, ধর্ষণ, অপহরণ ও হত্যা বন্ধ হয়ে আসত।
সামাজিক অসচেতনা, স্বার্থপরতা, পরকীয়াসহ পারিবারিক দ্বন্দ্ব ও বাবা-মায়ের সম্পদের প্রতি ঘাতকের লোভ-লালসা এবং বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণে শিশু হত্যা বেড়েই চলছে। একটি আই-ফোনের লোভে কিংবা পশুবিত্ত চরিত্রের শিকার হয়ে যে শিশুটি প্রাণ হারোলো তার কী অপরাধ? একের পর এক শিশুকে হত্যা করা হচ্ছে। নিত্য নতুন অভিযোগ এনে শাসনের নামে পৈচাশিকভাবে নির্যাতন করে মনের ক্ষোভ পূরণ করা হয়! কবে বন্ধ হবে এই বর্বরতা তা  হয়তো কেউ জানে না। জনসচেতনতা তৈরিতে সবার সমন্বিত উদ্যোগের প্রয়োজন রয়েছে। ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার স্বার্থে সরকারকে জনগণের পাশে থাকা উচিত। সময়মত দু’মুঠো খাবার আর নিরাপদে থাকার মতো সুযোগ পেলেই সাধারণ তুষ্ট। এক শ্রেণির মানুষ অপরাধ করতে করতে পশু চরিত্রের হয়ে যায়। ফলে সে যা ইচ্ছা তাই করতে থাকে। পশু চরিত্রের এই মানুষগুলোকে শাস্তি দেয়া না হলে সে সমাজের শাসকশ্রেণিও ভালো মানুষগুলোকেও এর জন্য জবাবদিহী করতে হবে।
হে শিশু নির্যতনকারী ঘাতক! তোমাকে বলছি, খুব সামান্য একটি বিষয়ে শিশুকে গাছের সাথে বেঁধে, ঝুলিয়ে, পিটিয়ে বিভিন্নভাবে নির্যাতন করে হাত পা ভেঙ্গে দিয়ে কীভাবে তুমি নির্যাতন করলে? জন্মদাতা বাবাকে ভুলে তোমাকে বাবা বলে ডাকলো তবুও তুমি নির্যাতন চালিয়ে গেলে! বাব-মা সম্পদশালী বলে তুমি অবুঝ শিশুকে খেলার মাঠ থেকে অপহরণ করে নিয়ে চাহিদানুযায়ী টাকা পাওনি বলে ফুলের মতো একটি শিশুকে খুঁচিয়ে খুচিয়ে আঘাত করে শেষে শ্বাসরোধ করে হত্যা করতে পারলে! তোমার হৃদয়টি একবারও কেঁপে উঠলো না? তুমি কি মানুষ? না, আসলে তুমি মানুষ নও। তুমি মানুষ নামের পশু!
সর্বোপরি, অপরাধ কমিয়ে আনা কিংবা অপরাধীকে দমনে সরকারের আইনশৃঙ্খলাবাহিনীকে আরো তৎপর হতে হবে। একই সাথে সাধারণ মানুষের উচিত প্রতিটি ক্ষেত্রে সরকারকে পরামর্শ ও জনশক্তি ব্যয় করে সহায়তা প্রদান করা। অপরাধীদের চিহ্নিত ও আটক করতে তথ্য দিয়ে আইনশৃঙ্খলাবাহিনীকে সহযোগিতা করা উচিত। উদ্দেশ্য একটাই-অপরাধ কমিয়ে আনা। তাই প্রত্যেকের অবস্থান থেকে মানবিক দায়বদ্ধতার পরিচয় দিয়ে জনকল্যাণে কাজ করা উচিত। সন্তান হারা মা-বাবার কান্নায় ভারি হয়ে আছে পরিবেশ। আমরা এই পরিস্থিতি থেকে মুক্তি চাই। প্রতিটি মানুষের মাঝে নৈতিক মূল্যবোধ জাগ্রত থাকুক। মনুষত্বের বিকাশ ঘটুক। নিষ্পাপ শিশুদের ওপর সর্বপ্রকার জুলুম, নির্যাতন বন্ধ হোকÑএটাই প্রার্থনা।
লেখক : শিক্ষক ও কলামিস্ট

[email protected]



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: শিশুর নিরাপত্তা ও রাষ্ট্রের দায়িত্ব
আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ