Inqilab Logo

সোমবার, ০৮ জুলাই ২০২৪, ২৪ আষাঢ় ১৪৩১, ০১ মুহাররম ১৪৪৬ হিজরী

গ্রাম থেকে মেট্রিক পাস করে খুলনা শহরের চিকিৎসক

| প্রকাশের সময় : ২৪ এপ্রিল, ২০১৭, ১২:০০ এএম

আশরাফুল ইসলাম নূর, খুলনা থেকে : তেরখাদায় গ্রামের স্কুল থেকে মেট্রিক পাস করে রুটি-রুজির অন্বেষণে খুলনা শহরে আসেন কৃষ্ণ গোপাল দাস। কিছুদিন এদিক-সেদিক ঘোরাফেরার পর সিদ্ধান্ত নেন ডাক্তারি করবেন। খুলে বসেন ‘সিটি ডেন্টাল’; তিনি হয়ে যান ডেন্টিস্ট। খুলনা ওয়াসা ভবনের দ্বিতীয় তলার ৯ নম্বর কক্ষে সকাল ১০টা থেকে দুপুর ২টা, আবার বিকেল ৫টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত নিরলস রোগী দেখেন তিনি। চেম্বারে নিজের নামের সামনে ডা: শব্দটি মুছে ফেলেছেন তিনি। এ প্রতিবেদকের সামনে ৫০০ টাকা ভিজিটে রোগী দেখেছেন তিনি।
এত অল্প পড়াশুনা করে কীভাবে ডাক্তারি করছেন? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বললেন, ‘আমরা এই ধরনের কিছু লোক এই করে খাচ্ছি। আমি এটা করছি ১৯৮৫ সাল থেকে। এই করে খাচ্ছি, এখন বয়স হয়ে গেছে। এখন তো রিকশাও চালাতে পারব না! আমি অন্য কোনো চাকরিও করতে পারব না। বা অন্য কোনো কর্মও আমি করতে পারব না। আমার এখন ৫৭ বছর বয়স; এখন আমরা কি করে খাবো?’ (বক্তব্যের রেকর্ড রয়েছে)।
শুধু ডা: কৃষ্ণ গোপাল দাস নন, গত দু’সপ্তাহে খুলনা শহরে অন্তত ২৫ থেকে ৩০ জন ডাক্তারের খোঁজ পাওয়া গেছে, যাদের চিকিৎসা শাস্ত্রে যথাযথ বিদ্যা নেই। আবার এমবিবিএস পাস করেছেন; কিন্তু নির্ধারিত বিষয়ে পারদর্শী সনদ না থাকলেও রোগী ধরতে ওইসব রোগের বিশেষজ্ঞ পরিচয় দিচ্ছেন অনেকেই। সর্বশেষ ২০১৪ সালের ২০ আগস্ট র‌্যাব-৬ অভিযান চালিয়েছে সাতজন ভুয়া ডাক্তারকে গ্রেফতার করে ভ্রাম্যমাণ আদালতে জেল-জরিমানা করেছিল। অভিযানে দÐপ্রাপ্ত ও পলাতক সেসকল ভুয়া চিকিৎসকরা এখন পুরোদমে ফিরে এসেছেন পেশায়। চিকিৎসার নামে রোগীর জীবন নিয়ে খেলার ছলে অর্থ আদায়কারী ডাক্তার নামধারীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার দাবি সংশ্লিষ্টদের।
ডা: জিএম মৃধা। পূর্ণ নাম ডা: মো. গোলাম মাসুদ মৃধা; চর্ম, যৌন, কুষ্ঠ ও এলার্জি রোগের বিশেষজ্ঞ এই ডাক্তারের চিকিৎসা বিদ্যার সনদসমূহ হলোÑ বিএমবিবিএস (এএস) ঢাকা, এমডি (চর্ম ও যৌন) ঢাকা, পিএইচডি (এএম) কুষ্ঠ রোগ-ইন্ডিয়া এবং ডিইউএমএস (অনস্টাডি) বিইউএমসি। নগরীর শান্তিধাম মোড়ের ডা: ওয়াহেদ মেমোরিয়াল স্কিন কেয়ার সেন্টার, তার নিজের ক্লিনিক। ঢাকাস্থ বাংলাদেশ কম্বাইন্ড মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল থেকে তিনি এমবিবিএস (এএস) পাস করেছেন। পাশের চেম্বারেই বসেন তার সহধর্মিণী ওরাল অ্যান্ড ডেন্টাল সার্জন ডা: আসমা রহমান শশী; বিডিএস ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ২০১৪ সালের ২০ আগস্ট ভুয়া চিকিৎসক হিসেবে র‌্যাব-৬ তার চেম্বারে অভিযান চালায়। ওই সময় তিনি পালিয়ে ঢাকায় চলে যান। সেখানে তিনি উচ্চ আদালতে তার সনদপত্রের পক্ষে রিট করেন। প্রায় দু’বছর ধরে চলা মামলায় আদালত তাদের পক্ষে রায় দিয়েছেন বলে তিনি দাবি করেন। বাংলাদেশ মেডিক্যাল কাউন্সিলের কোনো রেজিস্ট্রেশন না থাকলেও নিয়মিত রোগী দেখছেন তিনি।
নগরীর শিপইয়ার্ড মেইন রোডস্থ আল-আমিন স্কুলের পাশে আরাফাত হসপিটাল অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মালিক ডা: কামরুজ্জামান ডিএমএফ পাস করেই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক। রূপসা এলাকার গ্রাম্যচিকিৎসক থেকেই তার এ উন্নতি। ২০০৫ সালে বাংলাদেশ গেøাবাল ইনস্টিটিউট থেকে ডিপ্লোমা শেষ করে বের হয়েছেন বলে দাবি করেছেন তিনি। প্রথমদিকে তিনি রূপসায় ড্যাপস্ হসপিটাল অ্যান্ড ডায়গনস্টিক সেন্টারে চাকরি শুরু করেন। এর কিছুদিনের মধ্যেই তিনি প্রেসক্রিপশন এবং ভিজিডিং কার্ডে এমবিবিএস, এম ঢাকা ব্যবহার করেন। বর্তমানে তিনি নিজেই ক্লিনিক খুলেছেন। ক্লিনিকে তার কক্ষের বাইরে নেমপ্লেটে মেডিসিন ও সার্জারি বিশেষজ্ঞ উল্লেখ করা।
এমবিবিএস সনদ এবং চিকিৎসা পদ্ধতি নিয়ে তার সাথে কথা হলে তিনি বলেন, ‘আমি বাংলাদেশ গেøাবাল ইনস্টিটিউট থেকে এমবিবিএস ডিপ্লোমা কোর্স করে বের হয়েছি। সার্টিফিকেট দিয়েছে সেই প্রতিষ্ঠান। এর মূল্য না থাকলে সরকার তাহলে কেন সেইসব প্রতিষ্ঠান চালুর অনুমতি দিয়েছে? আমার বিরুদ্ধে অপপ্রচার ছড়ানো হচ্ছে। শত্রæরাই আমার পেছনে লেগে রয়েছে। ডেপুটি সিভিল সার্জন ডা: মঈন উদ্দিন মোল্লাও আমার ক্লিনিকে প্রাকটিস করেন। আমি সরকারি লোকজন নিয়ে চলাফেরা করি। তারা তো কোনো বিষয় নিয়ে মাথা ঘামায় না, তাহলে আপনাদের (সাংবাদিকদের) এসব বিষয় নিয়ে মাথা ব্যথা কেন?”
কামরুজ্জামানের চিকিৎসার বিষয় নিয়ে খুলনার সিভিল সার্জন ডা: এ এস এম আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ‘আমি ওই হাসপাতালে অভিযান পরিচালনার জন্য একাধিকবার গিয়েও তাকে পাইনি। কিভাবে যেন তিনি যাওয়ার খবর পেয়ে পালিয়ে যান।’ ডেপুটি সিভিল সার্জনের প্রাকটিসের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সে বিষয়টি আমার জানা নেই।
এসব ভুয়া ডাক্তাররা দীর্ঘদিন ধরেই প্রশাসনের নাকের ডগাতেই মানুষের সাথে চিকিৎসার নামে প্রতারণা করে এলেও কেউ কিছুই বলছে না। এ ছাড়া এমবিবিএস পাস বিএমডিসির রেজিস্ট্র্রেশনও রয়েছে; তবে কোনো বিশেষ বিষয়ের শাস্ত্রের পারদর্শী সনদ নেই, কিন্তু বিশেষজ্ঞ যোগ করছেন নগরীর বহু চিকিৎসক। বিএমএ খুলনার সাবেক একজন সভাপতিও চর্ম রোগ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ না হয়ে চর্ম বিশেষজ্ঞ পিএইচডি ডিগ্রি ব্যবহার করেন। শুধু তিনি নন; এমন সংখ্যাও প্রায় অর্ধশত।
এসব চিকিৎসকদের বিষয়ে খুলনা সিভিল সার্জন আব্দুর রাজ্জাক বলেন, এত ভুয়া ডাক্তারের বিষয়ে আমার জানা নেই। আমি অবশ্যই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবো। বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশেন (বিএমএ) খুলনার সভাপতি ডা: বাহারুল আলম বলেন, এরা দেশের শত্রæ। প্রশাসনের উচিত তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া। র‌্যাব-৬ এর পরিচালক অতিরিক্ত পুলিশ সুপার খোন্দকার রফিকুল ইসলাম বলেন, বিষয়টি নিয়ে কাজ চলছে। যে কোনো সময় অভিযান চালানো হবে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ