Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ফরিদপুর পৌরসভার পয়ঃ ও স্যুয়ারেজ বর্জ্যে দূষিত কুমার নদ

| প্রকাশের সময় : ২২ এপ্রিল, ২০১৭, ১২:০০ এএম

ফরিদপুর জেলা সংবাদদাতা : ফরিদপুর পৌরসভার পয়ঃ ও স্যুয়ারেজ বর্জ্য নিষ্কাশন এবং নিত্যদিনের ময়লা আবর্জনা ফেলার কারণে মারাত্মক দূষিত হচ্ছে কুমার নদ। শহরের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত একমাত্র এই নদটি দিন দিন ভয়ঙ্করভাবে দূষিত হয়ে পড়ায় জীববৈচিত্র ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পাশাপাশি জীবাণুু ও পানিবাহিত বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
প্রায় ৭৩ কিলোমিটার বিস্তৃত কুমার নদ ফরিদপুরে এসে অম্বিকাপুর হতে বাখুÐা পর্যন্ত প্রবাহিত হয়েছে শহরের মধ্য দিয়ে। ফরিদপুর শহরের পানির সবচেয়ে বড় উৎস এই নদ। এটি ফরিদপুর শহরবাসীর কাছে অক্সিজেন ভাÐার হিসেবেও সমাদৃত। নিত্যদিনের গোসল, রান্নাবান্না, কাপড় চোপড় ধোয়া, বিভিন্ন কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে কুমার নদের পানি। মাছ চাষ এবং কৃষি জমিতে সেচ দেয়ার জন্যও এ নদের গুরুত্ব অপরিসীম। অথচ এ কুমার নদ দূষণে কর্তৃপক্ষের তরফ হতেই চলছে নানা আয়োজন। কুমার নদের দুই পাশে অবস্থিত তিতুমীর বাজার ও হাজী শরীয়তুল্লা বাজার এলাকার আশপাশে এ নদীর দূষণ চরম আকার ধারণ করেছে।
তিতুমীর বাজার সংলগ্ন শিবমন্দির এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, বাজারের সব ময়লা কুমার নদ ও নদ সংলগ্ন পাড়ে ফেলা হচ্ছে। শিবমন্দিরের উত্তর পাশে পৌরসভার ড্রেন দিয়ে পয়ঃ বর্জ্য এসে পড়ছে নদে। শিবমন্দিরের দক্ষিণ পাশে বাঁধানো ঘাটলার পাশে বাজারের যাবতীয় বর্জ ফেলা হচ্ছে। শরিয়তুল্লাহ বাজারের মাছ বাজার, মুরগি বাজার ও কসাই পট্টি যাবতীয় পয়ঃবর্জ্য ও আবর্জনা প্রতিদিন অবাধে ফেলা হচ্ছে নদে। আলিমুজ্জামান বেইলি ব্রিজের নিচে গড়ে উঠেছে ময়লার ভাগাড়। দুর্গন্ধে নিঃশ্বাস নেয়া কষ্টসাধ্য। কয়েক মিনিট সেখানে দাঁড়িয়ে থাকাও দুষ্কর। এর মধ্যেই মানুষ গোসল করছে।
প্রতিদিন শহরের অসংখ্য মানুষ এ নদে গোসল করে। দূষিত পানিতে গোসল করে গায়ে চুলকানি হয়েছে অনেকের। মাঝে মধ্যে নদে মাছ মরে ভেসে উঠতে দেখা যায়। নদ এবং নদের পাড়ে ময়লা আবর্জনা পয়ঃবর্জ্য ফেলায় শহরবাসী সমস্যায় পড়ছে। এ ব্যাপারে পৌরসভা ও ব্যবসায়ীদের সাথে দেন দরবার করেও কোনো ফল হয়নি।
সরেজমিন দেখা গেছে, তিতুমীর বাজার, লালন বস্তি, রথখোলা, পূর্ব খাবাসপুর শেষ মাথা ও চর কমলাপুর এলাকাসহ বিভিন্ন এলাকার পৌরসভা নির্মিত বড় আকারের ড্রেন দিয়ে শহরের যাবতীয় নোঙরা ও আবর্জনাযুক্ত বর্জ্য পানি নদীতে ফেলা হচ্ছে। পৌরসভার অনেক অধিবাসীর স্যুয়ারেজ লাইনের সংযোগ সরাসরি পৌরসভার ড্রেনের সাথে যুক্ত থাকায় প্রতিনিয়ত ময়লা আবর্জনার সাথে পয়ঃ বর্জ্য এসে মিশছে নদে।
২০১৪ সালের এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর সময়কালে ফরিদপুর পৌরসভা ও একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা যৌথভাবে ২৫ হাজার হাউস হোল্ডারের মধ্যে থেকে ৮০০ হাউস হোল্ডারের সেফটিক ট্যাংকের উপর জরিপ করে। ওই জরিপ থেকে দেখা যায়, বাসাবাড়ির ৪৫ ভাগ পরিবার কখনই সেফটিক ট্যাংক পরিষ্কার করেনি। এর মধ্যে ৫৬ ভাগ পরিবারের স্যুয়ারেজ লাইন সরাসরি পৌরসভার নর্দমার সাথে যুক্ত করে দেয়া রয়েছে। ওই সময় অফিস ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে জরিপ করে দেখা গেছে, ১৯ ভাগ প্রতিষ্ঠান কখনই সেফটি ট্যাংক পরিষ্কার করেনি। এই ১৯ ভাগ প্রতিষ্ঠানের সেফটি ট্যাংকের সংযোগ সরাসরি পৌরসভার নর্দমার সাথে যুক্ত করে দেয়া হয়েছে। বহুতল ভবনসহ বিভিন্ন বাসাবাড়ির সেফটি ট্যাংকির সাথে পৌরসভার পানি নিষ্কাশনের ড্রেনের অবৈধ সংযোগ রয়েছে।
ফরিদপুর পৌরসভার বড় তিনটি নর্দমার মুখ থেকে পানি সংগ্রহ করে খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পুর-কৌশল বিভাগে পরীক্ষা করে দেখা গছে, ওই পানিতে অস্বাভাবিক মাত্রায় বিওডি (জৈব দূষণ) ও ফোকাল পলিফর্র্ম (অজৈব দূষণ) রয়েছে। পানিতে বিওডি বা জৈব দূষণ বেশি থাকার অর্থ হলোÑ অক্সিজেনের মাত্রা কমে যাওয়া। এর ফলে এই পানিতে মাছ ও শৈবাল জাতীয় জলজ প্রাণী ও উদ্ভিদ হ্রাস পায় এবং পানি শুদ্ধকরণের জন্য ভালো ব্যাকটেরিয়া জন্মাতে পারে না। ফলে পানির স্বাভাবিক বিশুদ্ধ হওয়ার প্রক্রিয়া নষ্ট হয়ে যায়।
ফরিদপুরের সিভিল সার্জন ডা. অরুণ কান্তি বিশ্বাস বলেন, নদের পানিতে বিওডি, ফোকাল পলিফর্র্ম মাত্রা বেশি হওয়ায় কুমার নদের পানি দূষিত হয়ে গেছে। নদর্মার পানি সরাসরি নদে ফেলা হচ্ছে। এটি কঠোরভাবে বন্ধ করতে হবে। পাশাপাশি নদীতে বাঁধ দিয়ে মাছ শিকার বন্ধ করাসহ নদের স্বাভাবিক চলাচল অব্যাহত রাখতে হবে।
ফরিদপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী সুলতান মাহমুদ, পৌরসভার নর্দমা সংযোগ সরাসরি নদের সাথে হতে পারে না। নর্দমার পানি শোধন করে ফেলা যেতে পারে। কিন্তু তা না করে পৌরসভা সরাসরি নর্দমার পানি নদীতে ফেলছে।
ফরিদপুর পৌরসভার মেয়র শেখ মাহাতাব আলী বলেন, আমরা উপায়হীন হয়ে নর্দমার পানি নদে ফেলতে বাধ্য হচ্ছি। তবে আমাদের পরিকল্পনা আছে নর্দমার মুখে আলাদা রিজারভার নির্মাণ করে পানি রিফাইন করার। তিনি বলেন, পয়ঃবর্জ্যরে সমস্যার স্থায়ী সমাধানের জন্য ফরিদপুর পৌরসভা ও বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা প্রাকটিক্যাল অ্যাকশনের যৌথ উদ্যোগে বিল অ্যান্ড মেরিন্ডা গেট ফাউন্ডেশন ও ইউকে এইডের অর্থিক সহায়তায় ‘পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ ফর সানট্রেবল সøাজ ম্যানেজমেন্ট সার্ভিসেস ইন ফরিদপুর, বাংলাদেশ’ প্রকল্পের আওতায় বৈজ্ঞানিক ভাবে পয়ঃবর্জ্য ব্যবস্থাপনার উদ্যোগ নিয়েছে। তিনি বলেন, যে সব গ্রাহক স্যুয়েরেজের সংযোগ সরাসরি পৌরসভার নর্দমার সাথে যুক্ত করে দিয়েছেন, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
ফরিদপুর জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী নূর আহমেদ বলেন, নাগরিক বা পৌরসভার কোনো স্যুয়েরেজ বা নর্দমার সংযোগ সরাসরি কোনো নদে, বা খাল বা উন্মুক্ত জলাশয়ে যুক্ত করার নিয়ম নেই। যতদ্রæত সম্ভব পৌরসভা ও পৌরবাসীকে এ সংযোগগুলো অপসারণ করে নিতে হবে। পরিবেশ দূষণ ও জনস্বাস্থের জন্য কোনো হুমকি আমরা মেনে নিতে পারি না।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ