Inqilab Logo

বুধবার ১৩ নভেম্বর ২০২৪, ২৯ কার্তিক ১৪৩১, ১১ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

হুন্ডি বন্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে

| প্রকাশের সময় : ২২ এপ্রিল, ২০১৭, ১২:০০ এএম

আফতাব চৌধুরী : হুন্ডি একটি অবৈধ ব্যবসা। এ ব্যবসা দেশের অর্থনীতির ওপর মারাত্মক চাপ সৃষ্টি করে চলেছে দীর্ঘদিন থেকে। সরকার হুন্ডি ব্যবসা বন্ধ করতে ইতোমধ্যে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। কিছুটা হলেও হুন্ডি বন্ধে কড়াকড়ি আরোপ করা হচ্ছে। যারা এ অবৈধ ব্যবসায় জড়িত তারা কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নয়। এ অবৈধ কাজে জড়িতদের দেশের প্রচলিত আইনে বিচার হওয়া উচিত। তবে ঢালাওভাবে হুন্ডি ব্যবসায়ীরা বা বিশেষ কোনো গ্রুপের লোকজন এ ব্যবসায় জড়িত তা বলা সমীচীন নয়। যেমন- ট্রাভেল এজেন্ট, মানি চেঞ্জারস ব্যবসায়ী। সকলেই নিজ নিজ লাইসেন্স, অফিস, লোকজন নিয়ে ব্যবসা করছেন। তাদের এসব ব্যবসার সঙ্গে জড়িত আছেন হাজার হাজার মানুষ। তাদের আয়ে চলছে সংসার। এ ব্যবসা বেকার সমস্যা সমাধানে কিছুটা হলেও অবদান রেখে চলেছে। এসব ব্যবসায়ীর মধ্যে কেউ কেউ হয়তো হুন্ডি ব্যবসার সাথে জড়িত থাকতে পারেন। যদি থেকে থাকেন তবে তাদের ব্যাপারে নিরপেক্ষ তদন্ত করে শাস্তির ব্যবস্থা করা হোক, এটা দেশের প্রতিটি সচেতন নাগরিকের মতো আমাদেরও প্রত্যাশা।
দেশ-বিদেশে অবস্থানরত কিছু অসৎ লোক হুন্ডি ব্যবসা করে দেশের অর্থনীতির প্রভূত ক্ষতিসাধন করে চলেছে। হুন্ডি বন্ধে এবং দেশে বৈদেশিক মুদ্রা আগমন যাতে বৃদ্ধি পায় সে উদ্দেশ্য সামনে রেখে আমার দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতার আলোকে কিছু সুচিন্তিত পরামর্শ এ লেখার মাধ্যমে সরকার বরাবরে পেশ করছি।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর এর অর্থনৈতিক অবস্থা নাজুক ছিল। তখন দেশের একমাত্র ভরসা ছিল স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি ঋণ ও ধনী দেশের সাহায্য। অবশ্য মুষ্টিমেয় কিছু লোক বিদেশে কর্মরত ছিল তাদের দ্বারা অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা হুন্ডি হয়ে দেশে আসত। যোগাযোগের মাধ্যম ছিল অত্যন্ত দুর্বল। ধনী ও উন্নত দেশের সঙ্গে ব্যাংকিং লেনদেন প্রায় ছিলই না। দেশে বৈধ পথে বৈদেশিক মুদ্রা না আসার ফলে বৈদেশিক মুদ্রা ভান্ডার প্রায় শূন্যের কোঠায় গিয়ে পৌঁছে ছিল। বৈদেশিক মুদ্রা বৈধ পথে আসার লক্ষ্যে সরকার তখন দেশের অর্থনীতিবিদদের নিয়ে আলাপ-আলোচনা করে তাদের পরামর্শক্রমে ‘ওয়েজ আনার্স স্কিম’ চালু করেন। অর্থনীতিবিদদের এ সিদ্ধান্তে বিভিন্ন ক্ষেত্র ও পর্যায়ে তৎপরতা শুরু হয় এবং দেশে বৈদেশিক মুদ্রার আগমন বাড়তে থাকে। এ স্কিম চালু করার ফলে বিদেশে কর্মরত প্রবাসীরা ভীষণ উৎসাহ ও উদ্দীপনা নিয়ে দেশে বৈদেশিক মুদ্রা পাঠাতে শুরু করেন। বৈদেশিক মুদ্রার ভান্ডার ক্রমশ সমৃদ্ধ হতে থাকে। বিপরীতে হুন্ডি ব্যবসার দাপট কমতে থাকে।
এদিকে বেকারত্ব থেকে মুক্তি পেতেও আয়ের উৎস সন্ধানে বিপুলসংখ্যক লোক আমেরিকা, যুক্তরাজ্য, সৌদি আরব, কুয়েত, মালয়েশিয়া, মালদ্বীপ, লিবিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যেতে শুরু করেন। তাদের হাড়ভাঙা পরিশ্রমের ফলে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রার দেশে আগমন শুরু হয়। এসময় দেশে বৈদেশিক মুদ্রা ড্রাফট/চেক ইত্যাদি প্রবাসীদের পোষ্য বা বেনিফিসিয়ারীরা দেশে কয়েকটি নির্ধারিত ব্যাংক শাখায় তাদের হিসাবে জমা দিয়ে সুবিধামতো সময়ে বিক্রয় করতে পারতেন। এ ছাড়া কিছু বৈধ লাইসেন্সধারী বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবসার সাথে জড়িত ছিলেন। তাদের মাধ্যমে ব্যাংকে নিলাম পদ্ধতি চালু ছিল। প্রতিদিন নিলামে বৈদেশিক মুদ্রার বাজার দর উঠানামা করত। এতে একদিকে প্রবাসীদের বেনিফিসিয়ারিরা তাদের বৈদেশিক মুদ্রা ব্যাংকে নিজ অ্যাকাউন্টে জমা রেখে সুবিধামতো সময় বিক্রয় করতে পারতেন, অন্যদিকে ব্যাংক ফ্লোরে নিলামেও বিক্রয় করার সুবিধা ছিল। বৈদেশিক মুদ্রা দেশে এভাবে বেশি করে আসার ফলে দেশের অর্থ ভান্ডার সমৃদ্ধ হতে থাকে। উন্নয়নমূলক কাজে সরকার এ মুদ্রার ব্যবহার করতে পারত। এ ছাড়া বেশ কিছু শিক্ষিত যুবক এ ব্যবসাতে খেটে তাদের পরিবার-পরিজন নিয়ে সুখে-শান্তিতে দিন কাটাতে পারতেন। সেভাবেই সরকার প্রবর্তিত ‘ওয়েজ আনার্স স্কিম’ দেশ-বিদেশে জনপ্রিয়তা লাভ করে। মানুষের আগ্রহও ক্রমশ এ স্কিমে বাড়তে থাকে।
কিন্তু পরবর্তী পর্যায়ে এক অশুভ চক্র এ সহজ প্রথার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু করে। তারা হুন্ডি ব্যবসায়ীদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে এ স্কিম বন্ধের পাঁয়তারা শুরু করে দেয়। তাদের উদ্দেশ্য ছিল ‘ওয়েজ আনার্স স্কিম’ বন্ধ হয়ে গেলে হুন্ডি ব্যবসা চলবে জোরেশোরে। হলোও তাই। পরবর্তী পর্যায়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের এক বিজ্ঞপ্তি মারফত পূর্বে সহজভাবে প্রবর্তিত প্রথা বন্ধ করা হয়। এর ফলে দেশে বৈদেশিক মুদ্রার আগমন কমতে থাকে। হুন্ডি ব্যবসায়ীরা বিদেশে তাদের এজেন্টদের মাধ্যমে বর্ধিত মূল্যে বৈদেশিক মুদ্রা ক্রয় করতে থাকে। সরকার পাউন্ড/ডলারসহ সকল বৈদেশিক মুদ্রার মূল্য নির্ধারণ করে দেয়ায় প্রবাসীরা এ পথে অর্থাৎ ব্যাংক মারফত বৈদেশিক মুদ্রা না পাঠিয়ে হুন্ডি ব্যবসায়ীদের দ্বারস্থ হতে থাকে। এতে তারা একদিকে যেমন বৈদেশিক মুদ্রার দাম বেশি পেতে থাকে অন্যদিকে কোনো জটিলতা ছাড়াই দেশে স্বল্পসময়ে হুন্ডি ব্যবসায়ীরা প্রবাসীদের পোষ্যদের টাকা বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দিতে শুরু করে। হুন্ডি ব্যবসায়ীরা অত্যন্ত তৎপর হয়ে যায়, দেশ বঞ্চিত হতে থাকে কোটি কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা হতে। তারা দেশের সরকার নীতি-নির্ধারক বা ব্যাংকের সঙ্গে প্রতিযোগিতামূলক মনোভাব নিয়ে বিদেশে কর্মরতদের প্রতি পাউন্ড/ডলারের মূল্য সরকার নির্ধারিত মূল্য হতে ৩/৪ টাকা বেশি দিতে থাকে। সহজে বাড়িতে টাকা পৌঁছে দেয়ারও গ্যারান্টি দিতে থাকে প্রবাসী ও তাদের পোষ্যদের। এতে প্রবাসীরা সরকারি জটিলতা ও পদ্ধতি এড়ানোর জন্যে হুন্ডি পদ্ধতিকেই গ্রহণ করতে শুরু করেন। অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা যায়, বিদেশের যে সমস্ত শহরে বাংলাদেশিদের অবস্থান বেশি সেসব স্থানে তারা ব্যাংকের মতোই বুথ খুলে বৈদেশিক মুদ্রা বাংলাদেশিদের কাছ থেকে নিয়ে তার বিপরীতে সাংকেতিক চিহ্ন সম্বলিত ‘টুকা’ ইস্যু করছে। এ টুকাই বাংলাদেশে তাদের টাকা পাওয়ার নিশ্চয়তা প্রদানের নিদর্শন। ইদানীং দেশের কোনো কোনো বেসরকারি ব্যাংক সরাসরিভাবে হুন্ডি ব্যবসার সাথে জড়িত রয়েছে বলে বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যাচ্ছে। এ অবৈধ ব্যবসার ফলে একশ্রেণীর ব্যাংক কর্মকর্তা, হুন্ডি ব্যবসায়ী ও সরকারি কোনো কোনো এজেন্সির লোকজন লাভবান হলেও অস্বীকার করা যাবে না যে, এতে দেশের প্রভ‚ত ক্ষতি হচ্ছে। দেশ ও জাতি হাজারো কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
দেশের অর্থনীতিকে চাঙ্গা রাখতে এবং মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা যাতে বেশি করে বৈধ পথে দেশে আসে সে উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে ‘ওয়েজ আনার্স স্কিম’ চালু করার জন্য দেশের বিভিন্ন শিল্প ও বণিক সমিতি বৈধ মুদ্রা ব্যবসায়ী সংগঠনসহ নানা সংগঠন সরকার বরাবরে প্রস্তাব পেশ করেছে। পাউন্ড/ডলারসহ সকল ধরনের বৈদেশিক মুদ্রা খোলাবাজারে ক্রয়-বিক্রয়ের এবং হুন্ডি ব্যবসা বন্ধের জন্য তারা কয়েকটি সুচিন্তিত ও সুনির্দিষ্ট সুপারিশ বাংলাদেশ ব্যাংকসহ অর্থ মন্ত্রণালয়ে দিয়ে থাকলেও এ ব্যাপারে কোনো ব্যবস্থা আজও গৃহীত হয়নি। সুপারিশের মধ্যে রয়েছেÑ (১) প্রবাসীদের প্রেরিত বৈদেশিক মুদ্রা বেসরকারি পর্যায়ে অন্যান্য দ্রব্যের ন্যায় খোলাবাজারে কয়েকটি নির্ধারিত ব্যাংক শাখার মাধ্যমে ফ্লোরে ক্রয়/বিক্রয় এবং উচ্চমূল্যে নিলামের ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তন। (২) একই সাথে ব্যাংকের এফসি অ্যাকাউন্টে বৈদেশিক মুদ্রা জমা রাখা এবং অ্যাকাউন্ট হোল্ডার বা বেনিফিসিয়ারিদের যে কোনো সময়ে তা বিক্রয়ের সুবিধা প্রদান। (৩) এলসি খোলার জন্য আমদানিকারকদের মাধ্যমে দেশের এক ব্যাংক হতে অন্য ব্যাংকে ফান্ড ড্রাফট মারফত ট্রান্সফারের ব্যবস্থাকরণ। (৪) শুধু ডলার/পাউন্ড নয়, অন্যান্য বৈদেশিক মুদ্রা যেমন রিয়াল, দিরহাম, কুয়েতি দিনারসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন মুদ্রা লেনদেন সহজকরণ এবং ব্যাংকে জমা দেয়ার ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ। (৫) প্রকৃত মুদ্রা ব্যবসায়ীদের মধ্য হতে যাচাই-বাচাই করে মানি চেঞ্জিং লাইসেন্স প্রদান এবং তাদের দ্বারা সংগৃহীত সব ধরনের মুদ্রা সংশ্লিষ্ট ব্যাংকে জমা নেয়ার ব্যবস্থা। উল্লেখ্য, বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশ থাকা সত্তে¡ও বেশির ভাগ ব্যাংকই মানি চেঞ্জারদের নিকট হতে বৈদেশিক মুদ্রা জমা নিতে অনিচ্ছা ভাব পোষণ করে। এতে বৈধ মুদ্রা ব্যবসায়ীদের এসব মুদ্রা নিয়ে নানা সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। আবার যেহেতু পাউন্ড/ডলার ছাড়া অন্য বৈদেশিক মুদ্রা ব্যাংকে জমা রাখা হয় না তাই মুদ্রা ব্যবসায়ীরা এসব মুদ্রা ক্রয় না করার ফলে হুন্ডি হয়ে বিদেশে পাচার হওয়ার খবরাখবর পত্রপত্রিকায় প্রায় প্রকাশিত হয়ে থাকে।
বৈধভাবে বৈদেশিক মুদ্রার ব্যবসা করার জন্য বেশ কিছু লাইসেন্স ইতোমধ্যে ইস্যু করা হয়েছে। এ প্রক্রিয়াকে আরো গতিশীল করার পাশাপাশি বৈধভাবে দেশের বৈদেশিক মুদ্রা প্রেরণে উৎসাহিত করার জন্য বিভিন্ন দেশে প্রতিনিধি দল প্রেরণ এবং এ ব্যাপারে সচেতনতা সৃষ্টির প্রয়াস চালানো দরকার। এ ব্যাপারে বিদেশে কর্মরত বাংলাদেশি দূতাবাসকেও তৎপর হওয়া উচিত।
হুন্ডি ব্যবসা বন্ধ করতে এবং দেশে বৈধ পথে বৈদেশিক মুদ্রার আগমন বাড়াতে অবিলম্বে ‘ওয়েজ আনার্স স্কিম’ পুনঃপ্রবর্তনের ব্যাপারে সরকারি সিদ্ধান্তের আর গড়িমসি করা উচিত নয় বলে অভিজ্ঞমহল মত প্রকাশ করছেন।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট।



 

Show all comments
  • nadim ২২ এপ্রিল, ২০১৭, ৩:১২ এএম says : 0
    এখানে আপনি আপনার মন্তব্য করতে পারেন.we want sand money legal way. but their is no Bangladeshi bank in South Africa. gov't should understand we are in at overseas for money income not for visit. those hundi trades they got hassling free money tanasparing system. if gov't give us those kind service delivery properly we going enjoy sanding ramittence to Bangladesh.
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ