Inqilab Logo

বুধবার ২০ নভেম্বর ২০২৪, ০৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ভারতের কাছ থেকে কী পেলাম আর তাকে কী দিলাম

| প্রকাশের সময় : ২১ এপ্রিল, ২০১৭, ১২:০০ এএম

কামরুল হাসান দর্পণ : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের পর বাংলাদেশ কী পেল আর ভারত কী পেল, এ নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে শুরু করে বুদ্ধিজীবী মহলে তুমুল তর্ক-বিতর্ক চলছে। সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে কোনো রাখঢাক না করে ভারত সফর প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, আমরা শুধু বন্ধুত্ব চেয়েছি। বন্ধুত্ব পেয়েছি। এমন বক্তব্যের মাধ্যমেই এক ধরনের তুষ্টি প্রকাশ করা হয়েছে। এ কথার এ অর্থও হতে পারে, তাহলে কি ভারত এতদিন আমাদের বন্ধু ছিল না? আমরা যে কথায় কথায় বন্ধুরাষ্ট্র বলে মুখে ফেনা তুলে ফেলতাম, তা কেবল আমরাই দাবি করতাম, ভারত মনে করত না? কেবল একটি সফরের মধ্য দিয়ে ভারতের কাছ থেকে বন্ধুত্বের স্বীকৃতি পেলাম? কেউ যদি এমন প্রশ্ন তোলে, তবে তা অযৌক্তিক মনে হওয়ার কথা নয়। আর আমরা এ বন্ধুত্ব পেলাম ভারতের যা যা চাওয়ার, তার সব পূরণ করে দিয়ে। এটাও মনে হতে পারে, আমরা খুব ধনী, ভারত খুব দরিদ্র। শুধু বন্ধুত্বের কারণে দরিদ্র বন্ধুর পাশে ধনী বন্ধু দাঁড়িয়েছে। এক্ষেত্রে কোনো স্বার্থ নয়, বন্ধুত্বই মূল। বলাবাহুল্য, ব্যক্তিগত জীবনে বন্ধু, বন্ধুর পাশে নিঃস্বার্থভাবে দাঁড়াতে পারে। এটা মানবিক একটি গুণ। তবে যখন দুটি দেশের মধ্যে বন্ধুত্বের প্রশ্ন আসে, তখন স্বার্থ ছাড়া কোনোভাবেই বন্ধুত্ব হয় না। এক্ষেত্রে পারস্পরিক লেনদেন থাকতে হয়। আমরা দেখছি, ভারতের সাথে আমরা নিঃস্বার্থ বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিয়েছি। সে তার প্রয়োজনীয় বিষয় যেভাবে চেয়েছে, সেভাবে আমরা দিয়ে দিয়েছি। অথচ ধনী-দরিদ্র যেমনই হোক, বন্ধুত্ব কখনো একতরফা হয় না। ধনী বন্ধু অনেক দিতে পারলেও, গরিব বন্ধু একেবারে কিছু দেয় না, তা দেখা যায় না। ভারত আমাদের এমনই গরিব বন্ধু যে, সে কিছু দেয়া দূরে থাক, দেয়ার মতো ইচ্ছাটুকুও পোষণ করে না। অথচ আমরা ভারতের কাছে এমন কোনো আবদার করিনি, যা সে দিতে পারে না বা পারবে না। আমরা তার সাধ্যের মধ্যেই আমাদের ন্যায্য পাওনাটুকু চেয়েছিলাম। এক তিস্তা নদীর পানি। আন্তর্জাতিক এ নদীতে আমাদেরও অংশ আছে। সে আমাদের অংশটুকুও দিতে ইচ্ছুক নয়। এতই কার্পণ্য তার। এমন কার্পণ্য নিয়ে কি বন্ধুত্ব হয়? শুধু তিস্তার পানি নয়, আরও অনেক কিছুই আমাদের চাওয়ার ছিল। সেসব চাওয়া পাত্তাই পায়নি। ফলে আমাদের ভাগ্যে জুটেছে কেবল শুষ্ক বন্ধুত্ব। এতেই যেন আমাদের সরকার মহাখুশি। অনেকে তো ভারতের কাছ থেকে কিছু চাইতেও লজ্জাবোধ করে। তারা মনে করে, আর কি চাই! ভারত আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে সাহায্য করেছে। এ ঋণ শোধ করতেই তো আমাদের জনম পার করে দেয়া উচিত! আর ভারত যে আমাদের বন্ধুত্বের স্বীকৃতি দিয়েছে, এটাই তো যথেষ্ট।
দুই.
ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদির চমক দেয়ার এক ধরনের প্রবণতা রয়েছে। তার এই চমকের শুরু ক্ষমতায় আসার পর চীন, মঙ্গোলিয়া সফরের মধ্য দিয়ে। দেখা গেছে, আলাপ-আলোচনা শেষে চীনের প্রেসিডেন্টের সাথে হঠাৎ করেই সেলফি তুলতে দাঁড়িয়ে গেছেন। মঙ্গোলিয়ার প্রেসিডেন্টের সাথে বরফের পাহাড়ের চূড়ায় গিয়েও সেলফি তুলেছেন। মোদির এই সেলফি ম্যানিয়াকে তখন অনেকে সেলফি ডিপ্লোমেসি হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন। এরপর আফগানিস্তান সফর শেষে দেশে ফেরার পথে হুট করেই তিনি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের বাসায় গিয়ে হাজির হন। তার বৃদ্ধ মায়ের সাথে দেখা করেন। এরকম চমক মোদি প্রায়ই দিয়ে থাকেন। আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারত সফরে বিমান বন্দরে নামলে মোদি সব প্রোটোকল ভেঙে নিজে স্বাগত জানাতে হাজির হয়েছিলেন। এটাও চমক হিসেবে সবার কাছে পরিচিতি পায়। আমাদের প্রধানমন্ত্রীকে ভারত খুবই সম্মান দিয়েছে। এমন কোনো আয়োজন নেই, তার সম্মানে করা হয়নি। বিষয়টি অনেকটা এরকম, গরিব বন্ধুর বাড়িতে ধনী বন্ধু উপস্থিত হলে যেমন সে অবাক ও বিস্মিত হয়, কোথায় বসতে দেবে, কীভাবে খিদমত করবে তা নিয়ে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে তেমন। দেশের মানুষ ভারতের এই মেহমানদারির অসীম আন্তরিকতা দেখেছে। খুশিও হয়েছে। তবে এই মেহমানদারির পেছনে যে কী লুকিয়ে ছিল, তা সর্বমোট ২২টি চুক্তি করার পর বোঝা গেছে। আসলে এই মেহমানদারির মাধ্যমে যে অনেক কঠিন কিছুও সহজ ও সরল করে ফেলা যায়, ভারত তা ঠিক ঠিক দেখিয়ে দিয়েছে। কারো কাছ থেকে কিছু নিতে গেলে যে সবসময় ধমকে কাজ হয় না, মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে বুঝিয়ে-শুনিয়ে, আদর-যত্ম করে নিতে হয়, ভারত তা-ই করেছে। আমাদের দেশে গ্রামে-গঞ্জে প্রভাবশালী দুষ্টু কিছু মানুষের যখন গরিবের এক খন্ড জমির ওপর নজর পড়ে, তখন সে শুরুতে গরিব মানুষটিকে নরম সুরে কথা বলে তা তার কাছ থেকে নিতে চায়। তাতে কাজ হয়ে গেলে আর শক্ত পথে এগোয় না। গরিব রাজি না হলে গরম পথে ও শক্তি প্রয়োগ করে তা দখল করে নেয়। এসব দৃশ্য আমরা সিনেমার পর্দায় অহরহ দেখে থাকি। ভারতকে অবশ্য গরম হতে হয়নি। কারণ আমাদের সরকারের মনোভাব তো এমন যে, ভারত কিছু চাইলে না করতে পারে না। বিনয়ে নুয়ে পড়ে। কাজেই গরম কথা বলার দরকার হয় না। ভারত তার চির চালাকির অতি প্রদর্শনীর মাধ্যমে তা আদায় করে নিয়েছে। তার যে অসাধারণ অতিথিপরায়ণতা, তার মধ্যেই এই চালাকি লুকিয়ে ছিল। সফরকালে আমরা মোদিকে অত্যন্ত উৎফুল্ল দেখেছি। তার বডি ল্যাংগুয়েজে বেশ চাঞ্চল্য লক্ষ করা যায়। তিনি খুশি হবেনই না বা কেন! যা চাইলে সহজে পাওয়া যায়, তাতে কে খুশি না হয়! সঙ্গত কারণে মোদিও অত্যন্ত খুশি হয়েছেন। বলা যায়, তিনি হাসতে হাসতে তার চাওয়া এবং পাওয়ার কাজটি সেরে ফেলেছেন। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে অন্যতম প্রধান দাবি তিস্তা চুক্তির কথা বলা হলে, তিনি বেশ জোর দিয়ে বলেছেন, হবে। আমাদের দুই দেশের সরকার থাকতে থাকতেই হবে। অর্থাৎ বাংলাদেশের কপালে পূর্বের মতোই আশ্বাস জুটেছে। এর আগেও ভারতের পক্ষ থেকে এমন হবে হবে বলা হয়েছিল। বাংলাদেশের তিস্তা শুকিয়ে খাক হয়ে গেলেও তা আর হয়নি। তার এক উসিলা পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী রাজি হচ্ছেন না। এবারের সফরে তিস্তার পানি নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী নতুন এক ফর্মুলা দিলেন। তিনি পশ্চিমবঙ্গের ছোট ছোট নদীর পানি তিস্তায় ঢেলে পানি দেয়ার প্রস্তাব করলেন। অর্থাৎ তিনি তিস্তার যে প্রবহমান পানি তা দিতে রাজি নন। ফলে তিস্তা চুক্তি যে হবে, তা এখন সুদূরপরাহত হয়ে গেল। আবার তিনি পানির পরিবর্তে বাংলাদেশকে বিদ্যুৎ দেয়ার প্রস্তাব করেছেন। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর এ ধরনের কথাবার্তা থেকে বাংলাদেশের কারো বুঝতে বাকি থাকে না যে, অদূর ভবিষ্যতে তিস্তা চুক্তি হবে, এমন নিশ্চয়তা নেই। এ থেকে সহজেই প্রতীয়মান হয়, ভারত সফরে বাংলাদেশের প্রাপ্তির খাতা শূন্যই পড়ে রইল। আর ভারত পেল তার ষোলআনা।
তিন.
ভারত সফরের প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি নিয়ে আমাদের দেশের বিশ্লেষকদের মধ্যে তুমুল তর্ক-বিতর্ক হয়েছে। এক শ্রেণীর বিশ্লেষক ইনিয়ে-বিনিয়ে বলেছেন, একেবারে যে কিছু পায়নি, তা নয়। পেয়েছে। কী পেয়েছে, তা তারা সুস্পষ্ট করে বলতে পারেননি। তাদের এক কথা, বন্ধুত্বের মাধ্যমেই ভারতের কাছ থেকে স্বার্থ আদায় করে নিতে হবে। অর্থাৎ বন্ধুত্বকেই তারা প্রাপ্তি মনে করছেন। তবে বাংলাদেশের জীবন-মরণের সাথে যেসব সমস্যা জড়িয়ে আছে, বিষয়গুলো সযতনে এড়িয়ে যাচ্ছেন। তিস্তা চুক্তি নিয়ে ভারতের মতোই তাদের মুখ থেকে আশাবাদের কথা শোনা গেছে। তারা বারবার অতীতে ফিরে গেছেন। ভারত থেকে বাংলাদেশ অতীতে কী পেয়েছে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে সে কথাই তুলে ধরেছেন। মুক্তিযুদ্ধের সহযোগিতা, সীমান্ত চুক্তির কথা বারবার বলেছেন। ভাবটা এমন, ভারত মুক্তিযুদ্ধে আমাদের সহযোগিতা করেছে, কাজেই তার কাছ থেকে আর কী আশা করা যেতে পারে! এখন নিজেদের ক্ষতি করে হলেও তার ঋণ শোধ করতে হবে। সীমান্তে আমাদের মানুষকে পাখির মতো গুলি করে মারলেও তাদের কাছে তেমন কিছু মনে হচ্ছে না। পানিতে শুকিয়ে মারলেও তা তারা মেনে নিতে রাজি। তারা ভারতের প্রতি কৃতজ্ঞতায় এতটাই নুয়ে রয়েছেন যে, ভারত তার ইচ্ছামতো যা খুশি তা করলেও তাতে দোষের কিছু দেখছেন না। প্রশ্ন হচ্ছে, ভারত বাংলাদেশকে আর কত বঞ্চিত করলে তাদের টনক নড়বে? নাকি তারা চাচ্ছেন, বাংলাদেশ ভারতের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়–ক। এ ধরনের অভিব্যক্তি বা আচরণ কি কোনো স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশের সচেতন শ্রেণী করতে পারে? আমরা লক্ষ করেছি, বাংলাদেশের সাথে ভারতের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট যে কোনো চুক্তির ব্যাপারে বাংলাদেশের মানুষ প্রতিবাদ করে, ক্ষুব্ধতা প্রকাশ করে। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো সোচ্চার হয়ে ওঠে। ভারতের প্রতি কৃতজ্ঞতায় নুয়ে পড়া তথাকথিত বিশ্লেষকরা বিবেচনায় নিতে চান না, কেন, কোন যুক্তিতে মানুষ এই বিরোধিতা করছে। সরকারও এসব বিরোধিতার কোনো তোয়াক্কা করছে না। ভাবছে না, যে চুক্তি নিয়ে বিরোধের সৃষ্টি হয়েছে, তা করা উচিত হবে কিনা। বরং বিরোধী দলের সাথে দোষারোপের রাজনীতিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। অতীতে বিরোধী দল এই করেছে, সেই করেছে- এসব কথা বলে তার করা চুক্তি জায়েজ করার চেষ্টা করছে। বিষয়টি এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে, অতীতে ক্ষমতায় থাকতে যারা ভুল করেছে, তাদের মতো আমরাও ভুল করব। অথচ স্বাভাবিক বিষয় হচ্ছে, ভুলের পুনরাবৃত্তি না করা। সেদিকে না গিয়ে কেবল দোষারোপের পন্থা অবলম্বন করা হয়েছে। দেশের স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট বিষয় বিসর্জন দেয়া নিয়ে এ ধরনের রাজনীতি শুধু দুঃখজনক নয়, দুর্ভাগ্যজনকও বটে। অথচ যে কোনো চুক্তির আগে দলমত নির্বিশেষে সকলকে কনভিন্স করে করা সরকারের দায়িত্ব। চুক্তি কেন করতে হবে, এতে আমাদের কী স্বার্থ রয়েছে- এসব পরিষ্কারভাবে নিজ থেকে দেশের মানুষের সামনে তুলে ধরা। দুঃখের বিষয়, তার কিছুই সরকারের পক্ষ থেকে করা হয়নি। তর্কের খাতিরে যদি ধরে নেয়া হয়, চুক্তি দেশের স্বার্থের জন্য ভালো, তারপরও তা জনগণের সামনে তুলে ধরা উচিত। তা না করে যদি লুকোচুরির আশ্রয় নেয়া হয়, তবে যত ভালো চুক্তিই হোক না কেন, তাতে সন্দেহের উদ্রেক হবেই। হ্যাঁ, চুক্তির আগে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে কী কী বিষয়ে চুক্তি হচ্ছে তার ‘হেড লাইন’ তুলে ধরা হয়েছে। চুক্তির ভেতরে কী কী বিষয় আছে, তার পূর্ণ বিবরণ প্রকাশ করা হয়নি। বিশেষ করে যে সামরিক সহযোগিতামূলক চুক্তি হয়েছে, তার বিস্তারিত বিবরণ এখনও প্রকাশ করা হয়নি। এ চুক্তিটি অত্যন্ত স্পর্শকাতর। অনেক আগে থেকেই তা নিয়ে দেশের বিশ্লেষকরা কথা বলে আসছেন। এ চুক্তির প্রয়োজনীয়তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। মত দিয়েছেন, এ ধরনের চুক্তি দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের প্রতি হুমকি হতে পারে। এ চুক্তি কোনোভাবেই করা সমীচীন হবে না। তারা এ কথাও বলেছেন, এ চুক্তি না করলে আমাদের কোনো ক্ষতি হবে না। এর প্রয়োজন নেই। এতে শুধু ভারতেরই লাভ। ভারত তার নিজ স্বার্থে এবং আধিপত্য বজায় রাখতে চুক্তি করতে চাচ্ছে। সরকার এসব কথা আমলে নেয়নি। ভারতের ইচ্ছা মোতাবেকই চুক্তি সম্পাদন করেছে। দেশের মানুষ ভারতকে ট্রানজিটের নামে করিডোর দেয়া, বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে তার উত্তর-পূর্ব রাজ্যসমূহে মাত্র ১৯২ টাকা মাশুলে পণ্য আনা-নেয়া করার বিষয়েও আপত্তি জানিয়েছিল। তাদের আপত্তি যে যথাযথ ছিল, তা এখন টের পাওয়া যাচ্ছে। এসব সুযোগ-সুবিধা কেবল ভারতই পাচ্ছে। নতুন চুক্তির যখন বাস্তবায়ন শুরু হবে, তখন এর সুবিধাও যে ভারত পাবে, তাতে সন্দেহ নেই। অর্থাৎ ভারত আমাদের ব্যবহার করে তার সব স্বার্থই হাসিল করে নিচ্ছে। আমরা আমাদের ন্যায্য পাওনার কিছুই পাচ্ছি না, পাব কিনা জানি না।
চার.
ভারতের বন্ধুত্বের প্রতি নুয়ে পড়া একশ্রেণীর বিশ্লেষকের হিসাব-নিকাশের সাথে যারা সত্যিকার অর্থে বাংলাদেশের স্বার্থ নিয়ে চিন্তা করেন, তাদের হিসাব-নিকাশের মধ্যে বিস্তর পার্থক্য বরাবরই রয়েছে। সাধারণ দৃষ্টিকোণ থেকেও যদি ভারতের কাছ থেকে বাংলাদেশের পাওয়ার হিসাব করা হয়, তবে দেখা যাবে বাংলাদেশের হিসাবের খাতা শূন্য। ভারতের বিশ্লেষকরাই বলেছেন, ভারত বাংলাদেশের কাছ থেকে অনেক পেয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এবারের সফরের আগে ভারতের সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক জয়দীপ মজুমদার তার এক লেখায় লিখেছেন, ‘ভারতকে সহায়তা করার জন্য শেখ হাসিনা তার যা করার তার চেয়েও বেশি করেছেন। ভূমিবেষ্টিত ভারতের উত্তরাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে প্রয়োজনীয় পণ্য পরিবহনের জন্য বাংলাদেশ খুবই স্বল্প মাশুলে ট্রানজিট সুবিধা দিয়েছে। তিনি তার দেশে উত্তর-পূর্ব ভারতের বিভিন্ন সন্ত্রাসী গোষ্ঠীকে আশ্রয় দেওয়া বন্ধ করেছেন, এমনকি এসব গোষ্ঠীর নেতাদের আটক করে ভারতীয় এজেন্সিগুলোর হাতে তুলে দেওয়ার কাজও করেছেন। দেশের মধ্যে বিরোধী রাজনৈতিক দল ও ভারতবিরোধী ইসলামপন্থি দলগুলোর কঠোর সমালোচনা উপেক্ষা করেই শেখ হাসিনা এ কাজটি করেছেন।’ জয়দীপ মজুমদারের এই বিশ্লেষণ থেকে বুঝতে বাকি থাকে না, আমরা ভারতকে কী দিয়েছি আর ভারত আমাদের কী দিয়েছে। বিশ্লেষণে বাংলাদেশ কী পেল, তা উল্লেখ করার প্রয়োজনীয়তা তিনি বোধ করেননি। অবশ্য পেলে নিশ্চয়ই তিনি সাড়ম্বরে উল্লেখ করতেন। বন্ধুত্বের এমন ভারসাম্যহীন সম্পর্ক পৃথিবীর আর কোনো দেশের মধ্যে আছে কিনা জানা নেই। বাংলাদেশের মানুষ অতিথিপরায়ণ ও বন্ধুবৎসল। তবে তারা নিজেদের অধিকারের ক্ষেত্রে সচেতন। অধিকার আদায়ে জীবন দিতেও দ্বিধা করে না। কোনো অন্যায়ের কাছে মাথা নত করেনি। শাসকগোষ্ঠী যতই দমাতে চেয়েছে, জনগণের প্রতিবাদ ততই শানিত হয়েছে। ৫২ থেকে অদ্যাবধি আমরা তা দেখছি। জনগণ যা করেছে বা করছে তা দেশের স্বার্থের জন্যই করছে। পরিতাপের বিষয়, ক্ষমতাসীনরা যেন জনগণের এই সেন্টিমেন্ট বুঝতে অক্ষম। তারা নিজেদের স্বার্থে জনগণের বিরোধিতা সত্তে¡ও ভারতের সাথে দেশের স্বার্থহীন চুক্তি করে চলেছে। যে বন্ধুত্ব অর্জনের কথা বলা হচ্ছে, এ বন্ধুত্ব যে এক সময় জনগণের জন্য অত্যন্ত গ্লানিকর হয়ে উঠবে, তা বুঝতে হয়তো খুব বেশি সময় লাগবে না।
[email protected]



 

Show all comments
  • মিলটন ২১ এপ্রিল, ২০১৭, ৫:৫০ এএম says : 0
    লাভের চেয়ে লস বেশী
    Total Reply(0) Reply
  • ২১ এপ্রিল, ২০১৭, ৩:৫০ পিএম says : 0
    মন্তব্য করে কি লাভ .....................
    Total Reply(0) Reply
  • -কামাল উদ্দিন ২১ এপ্রিল, ২০১৭, ১১:৪৩ পিএম says : 1
    টাইমস অব ইন্ডিয়া ৭ সেপ্টেম্বর ২০১১ শিরোনাম করেছিল,‘মনমোহন সিং,শেখ হাসিনা পুট অ্যাসাইড তিস্তা বিহাইন্ড,ফিক্স বাউন্ডারি’,যার মানে হচ্ছে, মনমোহন সিং এবং শেখ হাসিনা তিস্তাকে সরিয়ে রেখে সীমান্ত ঠিক করলেন।মনমোহন সিং তিস্তা নিয়ে আলোচনা এগোনো তো দূরের সীমান্ত চুক্তিও তাঁর পার্লামেন্টে অনুমোদন করাতে পারেননি।চার দশক আগের চুক্তি সেটি শেষ পর্যন্ত ২০১৫-তে ভারতীয় সংসদ অনুমোদন করল।‘ভূ-সীমান্তের পাশাপাশি নদীতেও আমাদের অংশীদারত্ব আছে।এসব নদী আমাদের জনগণ এবং তাঁদের জীবনযাত্রাকে বাঁচিয়ে রেখেছে। যে নদীটি সবচেয়ে বেশি মনোযোগ আকর্ষণ করেছে সেটি হচ্ছে তিস্তা।অনেক প্রত্যাশা তিস্তার পানি নিয়ে,কিন্তু তা ভেস্তে গেল।মোদি-হাসিনা বৈঠকে,দ্বিপক্ষীয় আনুষ্ঠানিকতা এবং সম্মত সমঝোতা স্মারক ও চুক্তি মিলিয়ে ২২টি দলিল স্বাক্ষরিত হলেও তিস্তা অমীমাংসিত থেকে গেল। এবারও প্রতিশ্রুতি।প্রধানমন্ত্রী বন্ধুত্ব পাননি, পেয়েছে আতিথিয়তা।
    Total Reply(0) Reply
  • S. Anwar ২৫ এপ্রিল, ২০১৭, ২:২৭ পিএম says : 0
    দিয়েছি আমার ........., পেয়েছি কেবল ঘোড়ার ডিম।
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ