Inqilab Logo

শনিবার, ২৯ জুন ২০২৪, ১৫ আষাঢ় ১৪৩১, ২২ যিলহজ ১৪৪৫ হিজরী

আধুনিকতার ছোঁয়ায় হারিয়ে যাওয়া ঝুলন্ত পাঙ্খার গল্প

| প্রকাশের সময় : ১৯ এপ্রিল, ২০১৭, ১২:০০ এএম

মো. খলিল সিকদার, রূপগঞ্জ, (নারায়ণগঞ্জ) থেকে : নারায়ণগঞ্জ জেলার রূপগঞ্জ উপজেলার ঐতিহ্য ও ইতিহাসের সাক্ষী মুড়াপাড়ার জমিদার বাড়ির ভবন, পুরনো স্থাপনা ও আসবাবপত্রাদির মাঝে যেন খুঁজে পাওয়া যায় সেই দু’শ বছরের পুরনো নানা স্মৃতি। প্রাচীন সভ্যতার নানা নিদর্শন ও দিনলিপিতে অংশ নেয়া নানা শ্রেণি-পেশার মানুষের মাঝে কালের বিবর্তে ও আধুনিকতার ছোঁয়ায় বেশ পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। এসব পেশা ও আসবাবপত্রাদির পরিবর্তনের মাঝে একটি হলো পাঙ্খা ও পাঙ্খাকুলি। এক সময় বিলাসিদের বাড়ি-ঘর ও সরকারি অফিস-আদালতে গরম হাওয়া দূরীকরণে ঝুলন্ত পাঙ্খা থাকত। আবার তা চালনা করার জন্য পাঙ্খাকুলিদের আনাগোনা ছিল বেশ। ফলে এ পাঙ্খা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহকারী কুলিদের মৌসুমি কর্মসংস্থান যেমন ছিল নি¤œ আয়ের দরিদ্র শ্রেণীর মানুষের জীবিকা নির্বাহের পথ। তেমনি সরকারি অফিস-আদালত, জমিদার বাড়ি, রাজা, উজির ও নাজির বাড়ির স্থায়ী কর্মসংস্থান ব্যবস্থা ছিল চোখে পড়ার মতো। তারা সরকারি সুযোগ- সুবিধা সারা বছর পেত অন্য আমলাদের মতোই। তাই গরমের অসহনীয়তা মুছনে এ পাঙ্খার বিকল্প কিছু ছিল না। তবে দরিদ্র ঘরনাদের হাতের তৈরি তালপাতার পাখা, খেজুর পাতার পাটি ও কাপড়ের তৈরিকৃত স্থানীয় হস্তশিল্পীদের পাখা আজো গ্রাম-বাংলায় ও শহুরে পরিবেশে দেখা মেলে। তবে ঝুলন্ত পাঙ্খা সাধারণত দেখা মেলে না। তৎকালীন ঢাকা জেলার নারায়ণগঞ্জ মহকুমা বর্তমান রূপগঞ্জের তৎকালীন জমিদার বাবু রাম রতন ব্যনার্জি ও বাবু আশুতোষ ব্যানার্জির বাড়িটিতে যা বর্তমান মুড়াপাড়া বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের অফিস কক্ষে আজো এক ঝুলন্ত পাখা শোভা পাচ্ছে। যা দেখলেই যেন মনে পরে অতীতের নানা স্মৃতি বিজড়িত কাহিনী। সূত্রে জানা যায়, এশিয়াটিক সোসাইটি ২০০৩ পাঙ্খা আবিষ্কার কৃতিত্ব মোগল রাজাদের দেয়া হয়েছে। তবে ইতিহাস বলছে ভিন্ন কথা। বাংলায় এ পাঙ্খার প্রচলন শুরু হয় এ জমিদার বাড়ি এলাকা থেকেই। তৎকালীন জমিদার গরমের তীব্রতা থেকে বাঁচতে মৌসুমি কুলি নিয়োগ করতেন। কুলিদের মাসিক বেতন হিসেবে দেয়া হতো মাত্র ৪ রুপি। তবে সে সময়ের ৪ রুপি পর্যাপ্ত না থাকায় দুবেলা পেটপুরে ভাত খাওয়ার শর্তজুড়ে দেয়া ছিল পাঙ্খাকুলিদের বাড়তি আবদার। ধারণা করা হয়, এ পাঙ্খার প্রচলন প্রথমে বণিক শ্রেণীর অট্টালিকায় শোভা পেত। বণিক পরিবারের রাতের শীতলী ঘুম উপহার দেয়ার জন্য এ পেশায় নিয়োজিত কুলিরা বিশেষ পদ্ধতিতে ঘরের বাইরে থেকে পাঙ্খার সূতা ধরে টানতো। এতে পালা করে কুলিরা কাজ করত। দিনের বেলায় এক পক্ষ পাঙ্খা চালনা করলে রাতের বেলায় তা অন্যপক্ষ টানতো। ঘরের আকার ও ছাদের উচ্চতা অনুসারে পাঙ্খার আকার ছোট কিংবা বড় হতো। জনপদের বসার স্থানে রাখা হতো এ পাঙ্খা। তবে এর আয়তন থাকতো বেশ। এ পাঙ্খা ব্যবহারের জন্য আলাদা কুলিদের দেখা যেত না। যার যার প্রয়োজনে এ তা নাড়ানো হতো গায়ে শীতল বাতাস পেতে। আবার বণিক শ্রেণীরা পাঙ্খা কুলিদের রাতে জাগিয়ে রাখার জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণের কুকুর পালন করতেন। একটু ঘুমিয়ে গেলেই ঘেউ ঘেউ শব্দের কুলির ঘুম ভাঙ্গাত। এমনি নানা নির্দয় কাহিনীর সাথে সাথে পাঙ্খা কুলিদের অতীত সুখ-স্মৃতিও কম নয়। ব্রিটিশ আমলে ইংরেজদের গরমের তীব্রতা থেকে রক্ষা দেয়ায় খুশি হলেই নানা স্বর্ণমুদ্রা ও মানিক্য উপহার পেতেন তারা। তাদের সংসারের জন্য বাড়তি উপঢৌকন পেতেন। ফলে সুখের সংসারে তাদের বসবাসের কথাও শোনা যায়। শুধু কি তাই; তাদের পাঙ্খা চালনায় মনিব মনোমুগ্ধ হলে হাতিতে চড়িয়ে নেয়া হতো দূরদেশে। বণিক ও বিলাসীদের ভ্রমণ সঙ্গী হিসেবে এমনকি তাদের সাথে সরাব পান করে অমৃতস্বাদের ভাগ বসাতেন তারা। দেখতেন বাইজি নাচ ও ঢোলের তালে তালে শারীরিক কসরতেও অংশ নিতেন তারা। অতীত যাই বলুক না কেন; সম্প্রতি স্বাধীনতা পরবর্তী ও পূর্ববর্তী রূপগঞ্জের মুড়াপাড়া জমিদার বাড়িটিতে থাকা এ পাখাটি নেড়ে এক সময়ের বিটিভিতে প্রচারিত জনপ্রিয় ধারাবাহিক নাটক “অয়ময়”-এ বিশিষ্ট অভিনেতা ড. এনামুল হক বিশেষ ভঙ্গিমা প্রকাশ করে পান জাতীয় পুরস্কার। জনপ্রিয় কিংবদন্তী নায়ক রাজ রাজ্জাক তার প্রথম অভিনীত চলচ্চিত্র “বেহুলা সুন্দরী” এখান থেকেই শুরু করেন। এ সময় এ পাখাটি নিয়ে বেশকিছু ডায়ালগ প্রচার হয় তার। স্থানীয় সাংবাদিক মাহবুব আলম প্রিয় বলেন, প্রতœত্বত্ত¡ বিভাগ এসব স্থাপনা রক্ষায় দায়িত্ব না নেয়ায় রূপগঞ্জের ঐতিহ্য বহনকারী এ মুড়াপাড়া জমিদার বাড়িতে এ ঝুলন্ত পাখার ন্যায় বহু পুরনো আসবাবসহ বহু মূল্যবান বস্তু অযতœ অবহেলায় পড়ে আছে। এ ভবনের নানা বিষয়ে নির্ধারিত ইতিহাস রক্ষায় এ প্রতিষ্ঠানের সংরক্ষণাগার না থাকায় দর্শনার্থীরা হতাশ হয়ে ফিরেন। এ বিষয়ে রূপগঞ্জ প্রেসক্লাবের সভাপতি, গবেষক ও কলামিস্ট মীর আব্দুল আলীম জানান, মুড়াপাড়া জমিদার বাড়িটি রূপগঞ্জের পরিচয় বহন করে। তবে এ ভবনের পাখাটির অতীত ইতিহাস লিপিবদ্ধ না থাকায় লোকমুখের উপর নির্ভর করতে হয়। সঠিক ইতিহাস সংরক্ষণে নেই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের নজরদারি। তাদের অযতœ ও অবহেলায় পড়ে থাকে এ ভবনের নানা পুরাকীর্তি। এহেন নানা সমস্যার মাঝেই ইতিহাস হয়ে রয়ে যাওয়া এ পাখাটির সংরক্ষণের দাবি জানান তিনি। এখানকার শিক্ষার্থী ও সুশীল সমাজের দাবিও এমন বলে মনে করেন তিনি। এ বিষয়ে বর্তমান মুড়াপাড়া বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ অধ্যক্ষ গোলাম মোস্তফা বলেন, সরকারিভাবে এ পাঙ্খা ও মূল ভবন রক্ষায় প্রতœতত্ত¡ বিভাগ উদ্যোগ নিয়ে ইতিহাস সংরক্ষণে সহায়ক হবে। তবে তার কাছে এসব বিষয়ে লিখিত কোনো তথ্য না থাকায় ভবনের বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কোনো তথ্য জানেন না বলে হতাশা প্রকাশ করেন।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ