Inqilab Logo

রোববার ০৩ নভেম্বর ২০২৪, ১৮ কার্তিক ১৪৩১, ৩০ রবিউস সানী ১৪৪৬ হিজরি

মংলা-ঘাষিয়াখালী চ্যানেলে প্যাডেল জাহাজ চলাচল বন্ধ

দুই রাষ্ট্রীয় সংস্থার পরস্পরবিরোধী দাবি

| প্রকাশের সময় : ১৮ এপ্রিল, ২০১৭, ১২:০০ এএম

সরকারের রাজস্ব তহবিল থেকে ব্যয় হয়েছে ২শ’ কোটি টাকা
নাছিম উল আলম : প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে প্রায় ২শ’ কোটি টাকা ব্যয়ে পুনঃখনন করে ‘বাংলার সুয়েজ খাল’ খ্যাত ‘মোংলা-ঘাষিয়াখালী চ্যানেল’টি চালু করা হলেও বিআইডবিøউটিসি’র ব্যয় সাশ্রয়ী প্যাডেল নৌযান সে নৌপথে চলাচল নিয়ে পরস্পর দোষারোপের পালায় সংস্থাটির যাত্রীবাহী সেক্টরে লোকসানের বোঝা ক্রমশ বাড়ছে। ঘাষিয়াখালী চ্যানেলটি চালু হওয়ায় নৌ পরিবহনমন্ত্রীর নির্দেশে গত নভেম্বরে রাষ্ট্রীয় জাহাজ চলাচল প্রতিষ্ঠান বিআইডবিøউটিসি সপ্তাহে একদিন ঢাকা-বরিশাল-মোংলা-খুলনা নৌপথে যাত্রীবাহী স্টিমার সার্ভিসটি চালু করে। শুরুতে সংস্থার স্ক্রু-হুইল নৌযান ‘এমভি মধুমতি’র সাহায্যে সার্ভিসটি চালু করা হলেও কথা ছিল জানুয়ারির মধ্যে ব্যয় সাশ্রয়ী প্যাডেল-হুইল নৌযান ঐ রুটে যাত্রী পরিবহন করবে। কিন্তু সদ্য খননকৃত মোংলা-ঘাষিয়াখালী চ্যানেলটির প্রশস্ততা ও নব্যতা সংকটের কথা বলে সংস্থাটি প্যাডেল জাহাজ চালাতে পারছে না বলে জানিয়েছে। ফলে স্বেতহস্তি খ্যাত স্ক্রু-হুইল নৌযান এমভি মধুমতি ও এমভি বাঙালি খুলনা পর্যন্ত পাঠাতে গিয়ে প্রতি ট্রিপে সংস্থার লোকসান হচ্ছে সাড়ে ৩ লাখ থেকে ৪ লাখ টাকা পর্যন্ত। এসব নৌযানে জ্বালানি ব্যয় প্যাডেল জাহাজগুলোর আড়াই গুণেরও বেশি।
তবে বিআইডবিøউটিএ’র ড্রেজিং এবং নৌপথ সংরক্ষণ ও পরিচালন পরিদপ্তরের দায়িত্বশীল মহলের মতে, মংলা-ঘাষিয়াখালী নৌপথে অভ্যন্তরীণ রুটের যে কোনো ধরনের নৌযান চলাচলে কোনো সমস্যা নেই। বর্তমানে ভাটার সময় চ্যানেলটিতে ১০ ফুটেরও বেশি গভীরতা থাকছে। পাশাপাশি চ্যানেলটির প্রশস্ততা সর্বনিম্নে ১২০ ফুট থেকে ৩শ’ ফুট পর্যন্ত। তাদের মতে গত নভেম্বরের পরে দশ থেকে ১৪ ফুট গভীরতার প্রায় ১৮ হাজার পণ্য ও জ্বালানিবাহী নৌযান চ্যানেলটি অতিক্রম করেছে। একই সময়ে ৬ ফুট থেকে ৮ ফুট গভীরতার আরো প্রায় ৩৫ হাজার নৌযান চ্যানেলটি ব্যবহার করে।
তবে বিআইডবিøউটিসি’র মেরিন পরিদপ্তরের দায়িত্বশীল সূত্রের মতে, মংলা-ঘাষিয়াখালী চ্যানেলটির বাঁশতলী এলাকায় লুপ কাটিং করে সংক্ষিপ্ত চ্যানেল তৈরি করায় সেখানে যে বাঁকটি তৈরি হয়েছে, তা প্যাডেল জাহাজের জন্য যথেষ্ট ঝুঁকিপূর্ণ। তাদের মতে, স্ক্রু-হুইল নৌযানগুলোর প্রশস্ততা ৪৮-৫৫ ফুটের মধ্যে। কিন্তু প্যাডেল জাহাজগুলো ৬৫ ফুট প্রশস্ত। ফলে এসব নৌযানের বাঁক নিতে বেশি জায়গা প্রয়োজন। অপ্রশস্ত ঐ বাঁকের কারণেই প্যাডেল জাহাজগুলোর পক্ষে চ্যানেলটি অতিক্রম ঝুঁকিপূর্ণ।
তবে বিআইডবিøউটিএ’র মতে ঐ একই নৌপথের ‘গাবখান চ্যানেলটি’ আরো সরু এবং কয়েকটি স্থানে তা ভাটার সময় বেশি সংকীর্ণ হলেও বিআইডবিøউটিসি’র প্যাডেল জাহাজগুলো অনায়াসে তা অতিক্রম করছে প্রতিদিন। কর্তৃপক্ষের মতে ‘এর পরেও কোনো সমস্যা হলে আমাদের জানালে আমরা সেভাবে ড্রেজিং করে চানেলটি আরো প্রশস্ত করে দিব’। পর্যাপ্ত ড্রেজার এখনো মোংলা-ঘাষিয়াখালী চ্যানেলে নিয়মিত সংরক্ষণ ড্রেজিং করছে বলেও জানিয়েছেন বিআইডবিøউটি-এর ড্রেজিং ইউনিটের ঊর্ধ্বতন মহল।
তবে বিষয়টি নিয়ে একাধিক ওয়াকিবাহাল মহল থেকে ভিন্ন মতও পাওয়া গেছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক সূত্র জানিয়েছে, ২০১৪ ও ২০১৫তে প্রায় ৫৬ কোটি টাকা ব্যয়ে বিআইডবিøউটিসি’র জন্য যে দুটি যাত্রীবাহী নৌযান তৈরি হয়, তার জ্বালানি ব্যয় ঘণ্টায় প্রায় ২শ’ লিটার বলে দেখান হয়। অপরদিকে সংস্থার হাতে থাকা ৪টি প্যাডেল জাহাজের জ্বালানি ব্যয় ঘণ্টায় ৮৫ লিটার থেকে ৯৫ লিটারের মধ্যে। কিন্তু নতুন নৌযান দুটির এ বাড়তি জ্বালানি ব্যয়ের মধ্যে একটি বড় মাপের চুরি হচ্ছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। আর এ চুরি অব্যাহত রাখতেই সংস্থাটির একটি সংঘবদ্ধ চক্র যে কোনোভাবেই ব্যয় সাশ্রয়ী প্যাডেল জাহাজগুলোর পরিবর্তে ব্যয়বহুল নতুন নৌযানগুলো পরিচালনে আগ্রহী।
এক হিসেবে জানা গেছে ২০১৪-এর ৯ এপ্রিল ‘এমভি বাঙালি’ ও ২০১৫-এর মে মাসে ‘এমভি মধুমতি’ নামের দুটি নৌযান বাণিজ্যিক পরিচালনে যুক্ত হবার পরে গত ডিসেম্বর পর্যন্ত এসব নৌযানে লোকসানের পরিমাণ ছিল প্রায় ৮ কোটি টাকা। এর পরেও এসব নৌযান পরিচালনের স্বার্থেই প্যাডেল জাহাজগুলোর নিয়মিত মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণে উদাসীন সংস্থাটির কারিগরি পরিদফতর। গত প্রায় ৭ মাস ধরে সংস্থাটির সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য প্যাডেল জাহাজ ‘পিএস অস্ট্রিচ’কে বসিয়ে রাখা হয়েছে মেরামতের নামে। এর মধ্যে সাড়ে ৩ মাস ডকইয়ার্ডে বসিয়ে রাখা হলেও নৌযানটির উপরি কাঠামোর কোনো মেরামত কাজে হাত দেয়া হয়নি। অনেক টালবাহানার পরে গত সপ্তাহেই নৌযানটি ডকিং করা হয়েছে। অপরদিকে ‘পিএস লেপচা’ ও ‘পিএস টার্ন’এর সার্ভে সনদ নেই। এসব নৌযানের ভেতর ও বহিরাবরণ মেরামতসহ রং করা জরুরি হলেও সেসব কাজে দায়িত্বশীলরা যথেষ্ট অমনযোগী বলেও অভিযোগ রয়েছে।
উল্লেখ্য, ১৯৭৭ সালে ড্রেজিং করে মোংলা-ঘাষিয়াখালী চ্যানেলটি চালু করার ফলে খুলনা ও নওয়াপাড়া নদী বন্দরসহ সমুদ্র বন্দর মংলার নৌযোগাযোগ সহজতর হয়। কিন্তু দীর্ঘদিন সংরক্ষণ ড্রেজিং না করায় ২০১১-এর শুষ্ক মওশুমের শুরুতে নাব্যতা হারিয়ে চ্যানেলটি বন্ধ হয়ে যায়। এমনকি ঐ সময় ভরা বর্ষা মওশুমে চ্যানেলটির গভীরতা পূর্ণ জোয়ারে ১.৩৭ মিটার এবং বুড়িডাঙ্গা ও রামপাল শোলে সর্বনিম্ন গভীরতা ০.৪৬ মিটারে নেমে আসে। ফলে কোনো অবস্থাতেই মোংলা এবং খুলনার বিশাল পণ্য ও জ্বলানিবাহী নৌযানগুলো এ চ্যানেলটি অতিক্রম করতে না পারায় সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে বিকল্প চ্যানেল চালু করা হয়। কিন্তু এতে করে মংলা ও খুলনার সাথে দূরত্ব প্রায় ৫০ কিলোমিটার বেড়ে যায়। পাশাপাশি বিশ্ব ঐতিহ্যের সুন্দরবনের পরিবেশ, প্রতিবেশসহ জীববৈচিত্র্যের ওপর মারাত্মক বিরূপ প্রভাব পড়ে। এমনকি একই কারণে ঢাকা-বরিশাল-খুলনা যাত্রীবাহী রকেট-স্টিমার সার্ভিসটিও বন্ধ হয়ে মোড়েরগঞ্জ পর্যন্ত সিমিত করা হয়।
তবে বিষয়টি নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর উদ্বেগের মধ্যেই মোংলাÑঘাশিয়াখালী চ্যানেলটি ‘দেশের গুরুত্বপূর্ণ ২৪টি নৌপথ খনন প্রকল্প’ভুক্ত করা হয়। ঐ প্রকল্পের আওতায় বিআইডবিøউটিএ’র নিজস্ব ড্রেজার ছাড়াও পানি উন্নয়ন বোর্ড থেকে ভাড়া করা ড্রেজারের সাথে চীনা ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান দিয়ে গত দু বছরে ২কোটি ৮ লাখ ঘন মিটার পলি অপসারণ করে চ্যানেলটি চালু করা হয়েছে। গত ২৭ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আনুষ্ঠানিকভাবে পুনঃখননকৃত এ চ্যানেলটির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। এর মধ্যে প্রকল্প খাতে প্রায় ১.২০ কোটি ঘন মিটার পলি অপসারণ করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন বিআইডবিউটিএ’র প্রধান প্রকৌশলী-ড্রেজিং আবদুল মতিন। ভবিষ্যতে যাতে সারা বছরই মংলা-ঘাষিয়াখালী চ্যানেলটি সচল থাকে সে লক্ষে বিআইডবিøউটিএ’র সার্বক্ষণিক নজরদারিসহ নিয়মিত সংরক্ষণ ড্রেজিংও চালু রাখা হয়েছে বলে জানিয়েছেন তিনি। তবে বিআইডবিøউটিসি’র প্যাডেল জাহাজ পরিচালনে কোনো ধরনের সমস্যা হলে তা কর্তৃপক্ষকে জানালে সে অনুযায়ী যে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণে কর্তৃপক্ষ প্রস্তুত রয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রধান প্রকৌশলী।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ