হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির খড়গ : আসামের এনআরসি এবং বাংলাদেশ
কিশোর শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক দাবীর আন্দোলনে ঢাকাসহ সারাদেশে তীব্র রাজনৈতিক উত্তেজনা ও অনিশ্চয়তা দেখা যাচ্ছিল,
মোবায়েদুর রহমান : সাম্প্রতিককালের দুটি বড় ঘটনার একটি হলো প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর, আরেকটি হলো কওমি মাদ্রাসার সনদ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে হেফাজতে ইসলামের তথা হেফাজতের আমির আল্লামা শফীর সমঝোতা। দুটি বিষয়কে সাব ডিভাইড করলে ৬টি বিষয় দাঁড়ায়। একটি কলামের মধ্যে ৬টি বিষয় লিখতে গেলে কোনোটার প্রতি সুবিচার করা যাবে না। তাই ২/৩টি বিষয় নিয়ে আজ আলোচনা করব। প্রথমটি হলো হেফাজতের সাথে প্রধানমন্ত্রীর সমঝোতা।
কয়েক দিন আগে মিডিয়ার মাধ্যমে খবর প্রচারিত হয় যে, কওমি মাদ্রাসার সর্বোচ্চ ডিগ্রিকে সরকার স্বীকৃতি দিয়েছে এবং মাস্টার্স ডিগ্রির সমপর্যায়ে নিয়ে এসেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কওমি মাদ্রাসার সর্বোচ্চ স্তর দাওরায়ে হাদিসকে মাস্টার্স ডিগ্রির সমমান দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। এই স্বীকৃতির ফলে ইসলামিক স্টাডিজে এবং আরবি বিষয়ে এমএ ডিগ্রি পাবেন কওমি মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা।
প্রধানমন্ত্রী গত মঙ্গলবার রাতে গণভবনে কওমি মাদ্রাসার আলেম-ওলামার সঙ্গে এক বৈঠকে এই স্বীকৃতি প্রদান করেন। কওমি মাদ্রাসার স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য বজায় রেখে এবং ভারতের দারুল উলুম দেওবন্দের মূলনীতিকে ভিত্তি করে এই সমমান দেওয়া হলো বলেও তিনি জানান। প্রধানমন্ত্রী আলেমদের উদ্দেশে বলেন, ‘প্রথমে একটা প্রজ্ঞাপন হবে। তারপর আপনারা যেভাবে চান সব কিছু মিলিয়ে একটা আইনি ভিত্তি দেওয়া হবে।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের সুপ্রিম কোর্টের সামনে গ্রিক দেবী থেমিসের এক মূর্তি লাগানো হয়েছে। সত্য কথা বলতে কি, আমি নিজেও এটা পছন্দ করিনি। কারণ, গ্রিক দেবী থেমিসের মূর্তি আমাদের এখানে কেন আসবে। এটা তো আমাদের দেশে আসার কথা না। আর গ্রিকদের পোশাক ছিল এক রকম, সেখানে মূর্তি বানিয়ে তাকে আবার শাড়িও পরিয়ে দেয়া হয়েছে। এটাও একটা হাস্যকর ব্যাপার করা হয়েছে।’ শেখ হাসিনা আরও বলেন, ‘এটা কেন করা হলো, কারা করল, কীভাবে করল আমি জানি না। ইতোমধ্যেই আমাদের প্রধান বিচারপতিকে আমি এ খবরটা দিয়েছি এবং খুব শিগগিরই আমি ওনার সঙ্গে এ বিষয় নিয়ে বসব। আলোচনা করব এবং আমি নিজেও ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, এটা এখানে থাকা উচিত নয়।
প্রধানমন্ত্রীর এ ঘোষণার পর মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। যারা তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন তারা আওয়ামী ঘরানার হলেও তারা আওয়ামী লীগের লোক নয়। তারা আওয়ামী লীগে অনুপ্রবেশকারী অথবা আওয়ামী লীগের ঘাড়ে বন্দুক রেখে শিকার করার অভিলাষী সুযোগসন্ধানী। তারা প্রধানমন্ত্রীর সমালোচনা করতে গিয়ে শুধু কওমি মাদ্রাসার সর্বোচ্চ ডিগ্রির স্বীকৃতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেননি, ধান ভানতে শিবের গীতের মতো অন্য সব প্রসঙ্গও টেনে এনেছেন। তারা বার বার বলছেন, সরকার হেফাজতের সাথে আপস করেছেন এবং ধর্মের কতগুলো ক্ষেত্রে হেফাজতের ডিক্টেশনে কাজ করছে। যারা সরকারের সমালোচনা করছেন তাদের মধ্যে সরকারের তিনজন মন্ত্রীও রয়েছেন। তারা হলেনÑ ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি বিমানমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন, জাসদের একাংশের সভাপতি তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু এবং সংস্কৃতিমন্ত্রী বিশিষ্ট অভিনেতা আসাদুজ্জামান নূর। আওয়ামী ঘরানার আর যারা সমালোচনার ব্যান্ডওয়াগনে যোগ দিয়েছেন তারা হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির নেতা মুনতাসীর মামুন, বিশিষ্ট লেখিকা সেলিনা হোসেন, বাম ঘরানার সাংস্কৃতিক নেতা নাসির উদ্দিন ইউসুফ, এনজিও নেত্রী এবং ত্বত্তাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী, সাংবাদিক আবুল মোমেন প্রমুখ।
একটি জাতীয় দৈনিক প্রধান শিরোনাম দিয়েছে ‘রাজনীতিতে অশনি সংকেত’। গত ১৩ এপ্রিল বৃহস্পতিবার প্রথম পৃষ্ঠার প্রধান সংবাদ হিসেবে প্রকাশিত এ খবরে বলা হয়েছে, হেফাজতে ইসলামের দাবি ও চাপের মুখে স্কুলের পাঠ্যবইয়ে বিতর্কিত সংশোধন থেকে এই অশনি সংকেতের শুরু। এরপর সুপ্রিম কোর্টের সামনের স্থাপত্য অপসারণের জন্য হেফাজতের কর্মসূচি ঘোষণা, বাংলা নববর্ষ পয়লা বৈশাখ উদ্যাপন নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি, চট্টগ্রামে দেয়ালের আলপনা পোড়া মবিল দিয়ে ঢেকে দেওয়া এবং হেফাজতে ইসলামের নেতাদের সঙ্গে গণভবনে প্রধানমন্ত্রীর বৈঠকে শর্তহীনভাবে কওমি মাদ্রাসাকে স্বীকৃতি দেওয়ায় অশনি সংকেত ঘনীভূত হয়েছে। ২০১৩ সালে সরকারবিরোধী ঢাকা ঘেরাও কর্মসূচি দিয়ে দেশের ইতিহাসে এক বড় ধরনের অস্থিরতা সৃষ্টির জন্য দায়ী হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে সরকারের আপসরফায় দেশের রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিজীবী মহলে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে।
\ দুই \
বিমানমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন বলেছেন, ‘সরকারের এসব কাজ গণতান্ত্রিক চেতনাবোধ ক্ষতিগ্রস্ত করবে’। সরকারের একজন পূর্ণাঙ্গ মন্ত্রী হয়ে সরকার সম্পর্কে এ ধরনের মন্তব্য করা যায় কিনা সেটি ভেবে দেখার বিষয়। তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু বলেছেন, রাজাকার জামায়াত ও তেঁতুল হুজুর গোষ্ঠী এ দেশের আলেম-ওলামার প্রতিনিধিত্ব করে না, যেমনটি জঙ্গিরা প্রতিনিধিত্ব করে না ইসলামের। আল্লামা শফীকে তথ্যমন্ত্রী ইনু ‘তেঁতুল হুজুর’ বলেছেন। অতীতেও তিনি বলেছেন। কিন্তু এখন কি তিনি আর সেটা বলতে পারেন? তার প্রধানমন্ত্রী যেখানে আল্লামা শফীর সাথে বৈঠক করে এই স্বীকৃতি দিয়েছেন এবং স্বীকৃতির সপক্ষে সরকারি প্রজ্ঞাপনও জারি করেছেন সেখানে তিনি কি এখন সেই আল্লামা শফীকে ব্যঙ্গ করতে পারেন?
সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর বলেন, নিরাপত্তার নামে নববর্ষের অনুষ্ঠান কাটছাঁট করা হলো কেন, সেটা আমার বোধগম্য নয়। বইমেলা সাড়ে ৮টা পর্যন্ত খোলা ছিল, বাণিজ্য মেলা রাত ১০টা পর্যন্ত চলেছে। রাতে নাটক হচ্ছে, সিনেমা চলছে, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হচ্ছে। তাহলে বর্ষবরণের অনুষ্ঠান কেন ৫টার মধ্যে শেষ করতে হবে? এটা তো একটা লড়াই। অন্ধকারের বিরুদ্ধে, অপশক্তির বিরুদ্ধে লড়াই। এ কথা সত্য, আমাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কাজ করছে এবং এ দায়িত্ব তাদের একার নয়। কিন্তু আমাদের মানে সংস্কৃতি কর্মী ও সাধারণ মানুষকে ঘরে পাঠিয়ে দিয়ে কাকে তারা রাস্তায় রাখতে চাইছে? মানুষ তো লড়াই করতে চায়।
নিরাপত্তার নামে নববর্ষের অনুষ্ঠান কাটছাঁট করা হলো কেন, বর্ষবরণের অনুষ্ঠান কেন ৫টার মধ্যে শেষ করতে হবেÑ ইত্যাকার প্রশ্ন অভিনেতা ও মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর কাকে প্রশ্ন করছেন? তিনি নিজেই তো এসব বিষয়ের মন্ত্রী। তিনি প্রতিমন্ত্রী নন, তিনি পূর্ণাঙ্গ মন্ত্রী। তার অগোচরে কি এসব নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে? যদি তাই হয়, তাহলে তার এসব উক্তির অর্থ কি দাঁড়ায়, তিনি সেটি ভেবে কি দেখেছেন? তিনি আরো প্রশ্ন করেছেন, ‘আমাদের’ মানে সংস্কৃতি কর্মী ও সাধারণ মানুষকে ঘরে পাঠিয়ে দিয়ে কাকে তারা রাস্তায় রাখতে চাইছে? মানুষ তো লড়াই করতে চায়। নূর সাহেব তো আওয়ামী লীগ করেন, সংস্কৃতি কর্মী বলতে তিনি যাদেরকে বোঝাচ্ছেন তারাও তো তার ভাষায় ‘আমাদের’ অর্থাৎ আওয়ামী ঘরানার। তাদেরকে ঘরে পাঠিয়ে তারই সরকার কাদেরকে রাস্তায় নামাতে চায় সেই প্রশ্ন তিনি করেন কীভাবে? এ তো দেখছি ঘরের মধ্যে ঘর।
নাসির উদ্দিন ইউসুফ আওয়ামী শক্তির বলেই সাংস্কৃতিক অঙ্গনে বলীয়ান এক ব্যক্তি। তিনিও প্রশ্ন তুলেছেন, কওমি মাদ্রাসার সনদকে স্বীকৃতি দেওয়ার ফলে নাকি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার আলোকে যে শিক্ষা ব্যবস্থার কথা বলা হচ্ছিল সেখান থেকে নাকি সরে আসা হলো। কে বা কারা সরে এলো? তার কথায় সরকার। এখন যা হলো সেটি তার ভাষায়, আধুনিক ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্র হবে না। তিনি আরো বলেছেন, সুপ্রিম কোর্টের সামনে থেকে ভাস্কর্য অপসারণের যে বক্তব্য এসেছে তার সঙ্গে নাকি তারা একমত নন। ভাস্কর্য অপসারণের এ বক্তব্যটি কে দিয়েছেন? দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তাহলে তারা প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের বিরোধিতা করছেন। এগুলো করে কি আওয়ামী ঘরানায় থাকা যায়? নাকি আওয়ামী ঘরানা তাদেরকে রাখতে পারেন? তিনি বর্ষবরণ অনুষ্ঠান নিয়েও কথা বলেছেন।
মুনতাসীর মামুন ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির একজন বড় নেতা। সম্ভবত শাহরিয়ার কবিরের পর তিনি দুই নম্বর নেতা। কওমি মাদ্রাসার সনদকে স্বীকৃতি দান করাকে পক্ষপাতিত্ব বলে তিনি মনে করেন। আর এই পক্ষপাতিত্ব সংবিধান পরিপন্থী বলেও তিনি মনে করেন। মুনতাসীর মামুনের অভিযোগ বড় সাংঘাতিক। আওয়ামী ছাতার তলে বসে এসব বক্তব্য দেওয়া হচ্ছে কেমন করে সেটি আমাদের বোধগম্য নয়।
সেলিনা হোসেন আওয়ামী জামানাতেই সাহিত্যে বিশেষ পুরস্কার পেয়েছেন। তিনি বলেছেন, টেক্সট বুকে কারিকুলাম পরিবর্তন করা হয়েছে নাকি অশুভ শক্তির প্রভাবে। পরিবর্তনটি করেছে কারা? বাংলাদেশের মানুষ বেকুব নয় যে অশুভ শক্তি বলতে তিনি কাদেরকে বুঝিয়েছেন সেটি তারা বোঝে না। কিন্তু তিনিই বলুন, ওই অশুভ শক্তি কি এসে কারিকুলাম পরিবর্তনের ফাইলে সই করেছে? তারা কি সংশোধিত পাঠ্যবই নিজেরাই ছাপিয়েছে? নিরাপত্তার নামে নাকি সংস্কৃতিকে ঘরে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। এসব বিষয়ে বিবৃতি না দিয়ে তিনি তাদের সাথে কথা বলছেন না কেন যারা এসব নির্দেশ দিয়েছেন এবং সেসব নির্দেশ কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করছেন?
তত্ত¡াবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরীও একই স্বরে কথা বলেছেন। আমরা ওই তিন মন্ত্রী এবং উপরে উল্লিখিত নাগরিক সমাজের সদস্যদের বলতে চাই যে, আপনারা গাছেরও খাবেন আবার তলারও খাবেন সেটি হবে না।
আসল কথা হলো, এসব বক্তব্য যারা দিচ্ছেন তাদেরকে টেলিভিশন এবং পত্র-পত্রিকা ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে প্রচার করে। মিছিলে এরা ৩০০ লোকও জোগাড় করতে পারে না। তবে একটি কাজ তারা খুব ভালো পারে। সেটি হলো আওয়ামী লীগের কাঁধে বন্দুক রেখে শিকার করা। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী তার কাঁধে বন্দুক রাখতে দেননি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবও দেননি। জনগণ আশা করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার পিতা এবং সোহরাওয়ার্দীকে অনুসরণ করে তার কাঁধে বন্দুক রাখার আর সুযোগ দেবেন না।
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।