বিএনপির মানববন্ধন আজ, পাল্টা কর্মসূচি আওয়ামী লীগ
সারা দেশের মহানগর ও জেলা পর্যায়ে আজ মানববন্ধন করবে বিএনপি ও তার মিত্ররা। আর এ
বিএনপিসহ মূল বিরোধী জোট এখনো সিদ্ধান্তহীনতায়
বিশেষ সংবাদদাতা: বছরাধিককাল পরে অনুষ্ঠেয় বরিশাল সিটি করপোরেশনের নির্বাচন নিয়ে প্রাক প্রস্তুতি গ্রহণ করছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও তার জোট। ইতোমধ্যে মহানগর আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে মেয়র প্রার্থী হিসেবে সাদেক আবদুল্লাহর নাম চূড়ান্ত করে কেন্দ্রে প্রস্তাবাকারে প্রেরণেরও সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এমনকি কাকতালীয়ভাবে মহানগর আওয়ামী লীগের সভায় এ নাম প্রস্তাব করেছেন সাবেক মেয়র মরহুম শওকত হোসেন হিরণের স্ত্রী ও সদর আসনের এমপি জেবুন্নেসা আফরোজ।
মহানগর আওয়ামী লীগের কার্যকরী কমিটির এক সভায় নগরীর ৩০টি ওয়ার্ডে সাংগঠনিক কার্যক্রম শক্তিশালী করাসহ সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ১০৪টি ভোট কেন্দ্রকে নিয়ে একেকটি ইউনিট কমিটি গঠনেরও সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
দীর্ঘদিন বরিশাল মহানগর আওয়ামী লীগের মধ্যে যে অন্তর্কলহ অব্যাহত ছিল, তাকে মুছে ফেলে সামনে এগিয়ে যাবার প্রত্যয় এখন দলীয় নেতৃবৃন্দের মধ্যেও। ২০০৮-এর সিটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগে প্রার্থী হিসেবে শওকত হোসেন হিরণ প্রায় ৬৭৫ ভোটের ব্যবধানে তৎকালীন নির্দল প্রার্থী শরফুদ্দিন সান্টুকে পরাজিত করে মেয়র নির্বাচিত হন। প্রধান বিরোধীদল বিএনপি ঐ নির্বাচন বয়কট করে। ২০০৯-এর শুরুতে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় এলে পরবর্তী পাঁচটি বছর শওকত হোসন হিরণ প্রায় চাহিদামাফিক রাষ্ট্রীয় তহবিলের যোগান লাভ করেন। ফলে তিনি এ নগরীর উন্নয়নে অনেক দৃশ্যমান কাজও করেছেন। তবে অনেক অবকাঠামোর গুণগতমান নিয়ে প্রশ্নও ওঠে। তবুও তিনি এ মহানগরীর অবয়বকে অনেকটাই পাল্টে দেন।
কিন্তু এর পরও ২০১৩-এর জুনে বরিশাল সিটি করপোরেশনের তৃতীয় নির্বাচনে বিএনপিসহ বিরোধী দলীয় প্রার্থী আহসান হাবীব কামালের কাছে মহাজোট প্রার্থী শওকত হোসেন হিরণ ১৭ হাজারেরও বেশী ভোটে পরাজিত হন। সেসময় ঐ পরাজয়ের জন্য হিরণ ও তার অনুসারীরা সরাসরি জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সাবেক চীফ হুইপ আবুল হাসনাত আবদুল্লাহকে দায়ী করেন। এমনকি মহানগর আওয়ামী লীগের ব্যানারে নগরীতে মিছিল করে আবুল হাসনাতের বিরুদ্ধে শ্লোগানও দেয়া হয়। নগরীর দেয়ালে দেয়ালে পোষ্টারও সাঁটা হয়। পরবর্তীতে ২০১৪-এর প্রতিদ্ব›িদ্বতাহীন বিতর্কিত জাতীয় নির্বাচনে বরিশাল সদর আসন থেকে হিরণ দলীয় প্রার্থী হিসেবে বিনা প্রতিদ্ব›িদ্বতায় নির্বাচিত হন। ফলে ১৯৭৩-এর পরে প্রথমবারের মত বরিশাল সদর আসনটি আওয়ামী লীগের হাতে আসে। যদিও ঐ নির্বাচনে তাকে ভোট যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে হয়নি।
কিন্তু মাত্র ১৫ মাসের মাথায় ২০১৫-এর ৯ এপ্রিল শওকত হোসেন হিরণের অকাল মৃত্যুর পরে সহধর্মিণী জেবুন্নেসা আফরোজ দলীয় মনোনয়ন পেয়ে আরেকটি ভোটার বিহীন নির্বাচনে বরিশাল সদর আসনের এমপি হন। তবে হিরণের সময়কাল থেকে বরিশাল মহানগরীতে আওয়ামী লীগের যে দু’টি ধারা স্পষ্ট ছিল তা অব্যাহত থাকে। রাজনৈতিক কোন ধারণা না থাকায় এক পর্যায়ে সদর আসনের এমপি মহানগর আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতার দ্বারাই পরিচালিত হন।
ইতোমধ্যে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাবেক চীফ হুইপ আবুল হাসনাত আবদুল্লাহ’র জেষ্ঠ পুত্র সাদেক আবদুল্লাহ বরিশাল মহানগরীর রাজনীতিতে ক্রমান্বয়ে নিজস্ব একটি অবস্থান তৈরী করে নেন। নিজস্ব অনুসারীসহ একটি আলাদা বলয় তৈরী করতেও সক্ষম হন তিনি। অপরদিকে হিরণের অনুসারী বলে পরিচিত কতিপয় ছাত্রলীগ ও যুবলীগ নেতা তাদের নিজস্ব কর্মকান্ডে দলকে যথেষ্ট বিব্রতকর অবস্থায় ফেলেন এ নগরীতে। চাঁদাবাজী ও টেন্ডারবাজী থেকে শুরু করে সব ধরনের অনৈতিক কর্মকান্ডে জড়িয়ে এসব কথিত নেতা বরিশাল মহানগরীতে শাসক দলকে যথেষ্ট বেকায়দায় ফেলেন। এর মূল কারণ ছিল বরিশালে ‘অভিভাবকবিহীন আওয়ামী লীগ ও তার অংগ সংগঠন’।
এ অবস্থার মধ্যেই মাস কয়েক আগে বরিশাল মহানগর আওয়ামী লীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করে কেন্দ্র। এক সময়ের সভাপতি এ্যাডভোকেট গোলাম আব্বাস চৌধুরী দুলাল ও এ্যাডভোকেট একেএম জাহাঙ্গীরকে সম্পাদক করে গঠিত ঐ কমিটিতে এক নম্বর যুগ্ম সম্পাদক করা হয় সাদেক আবদুল্লাহ’কে। জেবুন্নেসা আফরোজ-এমপি ঐ নির্বাহী কমিটির সদস্য। এমনকি কাউন্সিলের মাধ্যমে গঠিত কমিটির সাধারণ সম্পাদক আফজালুল করিমকে পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে সহ-সভাপতির পদ দেয়া হয়।
পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠনের পরেই সভাপতি দুলাল ও সম্পাদক জাহাঙ্গীর সাদেক আবদুল্লাহকে নিয়ে মহানগরীর ৩০টি ওয়ার্ড কমিটি গঠন সহ সাংগঠনিক শক্তি বৃদ্ধির লক্ষ্যে কাজ শুরু করেছেন। ইতোমধ্যে নগরীর অধিকাংশ ওয়ার্ড কমিটি গঠন বা পুনরুজ্জীবিত হয়েছে। পাশাপাশি হিরণের অনুসারী গ্রæপটি ক্রমান্বয়ে দুর্বল হয়ে পড়ছে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল। আর এরই মধ্যে খোদ জেবুন্নেসা আফরোজ-এমপি দলীয় সভায় ‘মরহুম শওকত হোসেন হিরণের অসমাপ্ত কাজ সম্পন্ন করার জন্য’ আগামী বছরের সিটি নির্বাচনে মেয়র পদে দলীয় প্রার্থী হিসেবে সাদেক আবদুল্লাহর নাম প্রস্তাব করেছন। যা অনেকের কাছেই যথেষ্ট বিস্ময়কর ও আকস্মিক হলেও নিজস্ব ও অনুসারীদের অবস্থান ধরে রাখার জন্য ‘ভদ্রোচিত আত্মসমর্পণ’ বলে মনে করছেন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল। তবে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটি শেষ পর্যন্ত কাকে মেয়র পদে মনোনয়ন দেয় সেজন্য অপেক্ষা করতে হবে আরো দীর্ঘ সময়।
তবে বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচনের দেড় বছর আগেই আওয়ামী লীগের মাঠ পর্যায় থেকে দলীয় প্রার্থী মনোনয়ন দেয়া হলেও যথেষ্ট বিব্রতকর অবস্থায় রয়েছে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি। এখানে মেয়র পদে ২০০২সালে উত্তারাধিকার সূত্রে অধুনালুপ্ত পৌরসভার চেয়ারম্যান হিসেব আহসান হাবীব কামাল দায়িত্বলাভ করলেও ২০০৩-এর প্রথম সিটি নির্বাচনে দল মেয়র পদে মনোনয়ন দিয়েছিল সদর আসনের এমপি মুজিবুর রহমান সারোয়ারকে। ১/১১সরকার গঠনের পরে সারোয়ার কারারুদ্ধ হয়ে জেল জুলুম নির্যাতনের মধ্যেই ২০০৮-এর সিটি নির্বাচনে দলীয় সিদ্ধান্তে তিনি অংশ নেননি। ঐ নির্বাচনে কামাল স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে অংশ নিলেও পরাজিত হন।
তবে ২০১৩-এর জুনের তৃতীয় সিটি নির্বাচনে দল কামালকে মনোনয়ন দেয়ায় তার পেছনে সারোয়ার সহ সর্বস্তরের নেতাকর্মীরা কাজ করেন। কামাল বিজয়ী হলেও গত সাড়ে ৩বছরে খুব একটা সফলতা লাভ করতে পারেননি নগরীর উন্নয়নে। এর পেছনে সাবেক নগর পরিষদের রেখে যাওয়া ১৫৪ কোটি টাকার দায় দেনা সহ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের তিন মাসের বকেয়া বেতন-ভাতার সাথে মাথাভারী নগর প্রশাসনের বিষয়টিকে দায়ী করছেন তিনি। পাশাপাশি বর্তমান নগর প্রশাসন ক্ষমতা লাভের পরে সরকারী থোক বরাদ্দ হ্রাস করার বিষয়টিকেও দায়ী করেন সিটি মেয়র। সিটি করপোরেশনের কতিপয় রাজনৈতিক কর্মকর্তার অসহোযোগিতামূলক কর্মকান্ডও নগর ভবনে অস্থিরতা সৃষ্টি করছে।
তবে নিজ দলের ভেতরেও কামালের অবস্থান যথেষ্ট নরবরে। তিনি বর্তমানে দলীয় কোন পদে নেই। দলীয় কোন কর্মকান্ডে অংশ নিতে তাকে দেখা যায় না। এক্ষত্রে তার দাবী তিনি দলের সাথেই আছেন। তবে সময়ের অভাবে দলীয় কার্মকান্ডে অংশ নিতে পারেন না। পাশাপাশি দলীয় কর্মকান্ডে অংশ নিলে মামলা ও জেল-জুলুমের বিষয়টিও তিনি ঘনিষ্ঠজনদের অঘোষিতভাবে জানিয়েছেন। ফলে ইতোমধ্যে দলের বিভিন্নস্তরের নেতা-কর্মীদের সাথে কামালের কিছুটা দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে বলেও মনে করছেন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল।
তবে প্রকাশ্যে আগামী বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচন নিয়ে তেমন কোন তৎপরতা বিএনপিসহ জোটের মধ্যে না থাকলেও এক্ষেত্রে ভেতরে ভেতরে বেশ কয়েকজন প্রস্তুতি শুরু করেছেন বলে জানা গেছে। সে ক্ষেত্রে সাবেক মেয়র ও কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব মুজিবুর রহমান সারোয়ারের নাম আলোচনায় আসছে সবার আগে। এর পরেই আসছে আরো দুজনের নাম। যাদের মধ্যে বরিশাল দক্ষিণ জেলা সভাপতি এবাদুল হক চান ও বরিশাল বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক বিলকিস জাহান শিরিন-এর নামও উঠতে শুরু করেছে। এদের সকলেই বরিশাল মহানগরবাসীর কাছে পরিচিত হলেও বিজয়ের বিষয়ে লক্ষ্য স্থির করেই দলীয় হাই কমান্ড সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল।
সা¤প্রতিক কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিজয়ী হবার পরে বিএনপি’র মধ্যে হতাশা কাটিয়ে এক ধরনের অস্থার মনোভাব তৈরী হতে শুরু করেছে বলেও মনে করছেন মহলটি। তবে সব কিছু বিবেচনায় নিয়ে আগাম প্রার্থী বাছাই করে তাকে মাঠ পর্যায়ে কজ করার সুযোগ দেয়া সহ সাংগঠনিকভাবে মাঠে নামার কোন বিকল্প নেই বলে মনে করছেন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল। তবে বিএনপি অতীতে তা কখনোই করেনি বলেও মনে করছেন মহলটি।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।