হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির খড়গ : আসামের এনআরসি এবং বাংলাদেশ
কিশোর শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক দাবীর আন্দোলনে ঢাকাসহ সারাদেশে তীব্র রাজনৈতিক উত্তেজনা ও অনিশ্চয়তা দেখা যাচ্ছিল,
আফতাব চৌধুরী : মধ্যবিত্ত সমাজের কথা বলছি। মানবজাতির মধ্যে এই সমাজটি একেবারেই অর্বাচীন। সামন্ততন্ত্র ও জমিদারতন্ত্র যখন ক্রমশ ভেঙে পড়তে শুরু করে তখন থেকেই বিস্তার লাভ করতে থাকে মধ্যবিত্ত সমাজ। এ সমাজটা একেবারেই নতুন। একসময় বিত্ত-নিরিখে মানুষের ছিল দুটো ভাগ-উচ্চবিত্ত ও নিম্নবিত্ত। এই পোশাকি নামের আড়ালে ধনী ও গরিব শব্দ দুটো আত্মগোপন করেছিল বহুদিন। বাংলাদেশে মধ্যবিত্ত সমাজের উদ্ভব ঘটে ইংরেজ আধিপত্য বিস্তারের পর। সমাজে এখন জাতপাতের বালাই আগের থেকে কমেছে কিন্তু উপার্জনশীলতার ভিত্তিতে রয়ে গেছে উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত। সমাজ গঠনের পর অনেকগুলো স্তর পেরিয়ে এসেছি আমরা। সমাজ পরিবর্তনের এক বিশেষ স্তরে এসে পৌঁছানোর পরও আমরা বলতে পারি না- এটাই সমাজ বিকাশের শেষ স্তর। তবে এই বিকাশের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ভারত ও পাকিস্তানে অনেক ‘শ্রেণীর’ মানুষের মধ্যে মধ্যবিত্তের ভূমিকা যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য যে-বিষয়ে দ্বিমত থাকার কথা নয়।
আমাদের এ অঞ্চলে যখন ইংরেজ শাসন ব্যবস্থায় গ্রামীণ কৃষিব্যবস্থা ও গ্রামকেন্দ্রিক শিল্পব্যবস্থা ভেঙে পড়ে তখন জমিদার ও উচ্চবিত্ত সমাজের সিংহভাগ মানুষ গ্রাম ছেড়ে শহরে বাস করতে শুরু করে। কেউ গ্রামের জমিদারি বিক্রি করে দিয়ে, আবার কেউ শহরে বাস করে নতুন জমিদারি কিনে সমাজে নতুনভাবে প্রতিষ্ঠিত থাকে। এই শ্রেণীই প্রধানত শহরকেন্দ্রিক মানসিকতা ও বৈভবের সাথে পাল্লা দেওয়ার প্রতিযোগিতায় মেতে উঠে। ফলে কিছুদিনের মধ্যে তাঁদের অনেকেই আর্থিক সংগতি হারায়, কিন্তু তাঁদের প্রাচীন ঐতিহ্য তারা অসম্পূর্ণ তা ভুলে যেতে পায় না। আর এক শ্রেণীর মানুষ যাঁরা নতুন শহরকেন্দ্রিক সভ্যতায় আর্থিক দিক দিয়ে সংগতিসম্পন্ন হয়ে উঠে তাঁরা সমাজে নিজেদের একটা মর্যাদা আদায়ের লক্ষ্যে চেষ্টিত হয়। এঁরা না-জমিদার, না-প্রজা, এঁরা মধ্যবিত্ত। এঁদের মধ্য থেকেই একসময় অনেকেই নেতৃত্ব দেন ‘ভুখা মিছিলে’। বিষয়টা একটু পরিষ্কারভাবে তুলে ধরা যাক।
আমরা সর্বহারা মানুষের বিপ্লবের কথা শুনেছি এবং অনেকে প্রত্যক্ষ করেছি তার রূপ। এই বিপ্লব-ভাবনার উদ্ভব ও প্রচার-প্রসারের ক্ষেত্রে মধ্যবিত্তের ভূমিকা ছিল বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। বিপ্লবের পুরোভাগে ছিল এই সমাজ। যেসব মানুষের ঘরে রুটি-সবজি অথবা ডাল-ভাতের সংস্থান আছে তাদের ‘ভুখা মিছিলে’ শামিল হওয়ার প্রয়োজন নেই। সেই অর্থে মধ্যবিত্ত সমাজের অথবা পেছনে শামিল হওয়ার তাগিদ অনুভব না-করলেও কোনো ক্ষতি ছিল না। কিন্তু যে বিপ্লব ও মিছিল না-হলে সাম্যবাদী ভাবনাকে বাস্তবায়িত করা যেত না, সেই বিশেষ ‘পাবন-ভাবনা’ উঠে এলো মধ্যবিত্ত মানুষের মস্তিষ্ক থেকে। এই মধ্যবিত্ত সমাজের কিছু মানুষ মানব-সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়ায় শামিল হয়। ভুখা মানুষের ‘পেটের জোগাড়’ করার তাগিদ অতঃপর ভুখা মানুষের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রইল না।
‘ক্ষুধিতেরে অন্নদান সেবা’, মহৎ কাজ সন্দেহ নেই। এই কাজে সক্রিয় অংশগ্রহণ চিরকালীন মানবকল্যাণ ভাবনা থেকে সজ্ঞাত। এই কাজে সাফল্য লাভের জন্যে বিপ্লবের পথই অনিবার্য মনে হয় মধ্যবিত্ত সমাজের কিছু মানুষের। তাই প্রথম পদক্ষেপেই প্রতিনিধি-স্থানীয় মধ্যবিত্তরা দরিদ্র, অভুক্ত মানুষকে শোনায় প্রতিষ্ঠানবিরোধী ‘মহাসত্য’ মন্ত্র। বিপ্লব শুরু হয়, শুরু হয় প্রচন্ড তান্ডব। সে ইতিহাসের সাক্ষী আমরা-যাঁরা এখন সত্তরের কোঠায়।
প্রথমে মধ্যবিত্ত সমাজের মানুষ ছিলেন উপদ্রবহীন জীবনযাপনে অভ্যস্ত। এঁদের অনেকেই সরকারি চাকরি করে, শিক্ষকতার ‘পবিত্র’ দায়িত্ব নিয়ে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করার দায়িত্বে ছিলেন অবিচল। নিম্নবিত্তরা শুধু নয়, উচ্চবিত্তরাও এঁদের রুচিশীলতায় ছিল শ্রদ্ধাবান। কিন্তু মধ্যবিত্তদের মধ্য থেকে এমন কিছু নর-নারী বেরিয়ে আসে যাঁরা প্রকৃত অর্থেই প্রগতিপন্থী। উপদ্রবহীন জীবনযাপন নয়, সমাজ-উন্নয়নমূলক কর্মকান্ডে জীবন সঁপে দেওয়াই ছিল এঁদের ব্রত। এঁদের সৃষ্টিশীল কাজে সমাজ আরো গতিশীল হয়। এঁরাই ধীরে ধীরে দেশীয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করতে থাকে এবং অনতিবিলম্বে এই মধ্যবিত্ত শ্রেণীই জাতীয় রাজনীতির প্রধান চালক-শক্তিতে পরিণত হয়। পরবর্তী সময়ে এই শ্রেণী শুধু জাতীয় সমাজব্যবস্থায় নয়, সমগ্র বিশ্বসমাজ ব্যবস্থায় নিজেদের তুলে ধরতে সমর্থ হয়।
কিন্তু একথা এখন বলতে বঁাঁধে, এই মধ্যবিত্ত সমাজ কিন্তু সুস্থ চিন্তার প্রধান ধারক ও বাহক হয়ে উঠলেও সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সর্বদা সাফল্য অর্জন করতে পারেনি। সাম্যবাদী ভাবনার ফলে মধ্যবিত্তের প্রথম পদক্ষেপেই শুরু হয় ‘প্রতিষ্ঠান’ বিরোধী ‘পবিত্র’ তান্ডব-সব কিছু ভেঙেচুর রাশিয়ার বিপ্লবীরা জারতন্ত্রের ধারক ও বাহকদের বিনাশ সাধন করে ঠিকই, কিন্তু তাঁরা প্রধান প্রধান প্রাতিষ্ঠানিক সরকারি সম্পত্তিগুলো রক্ষা করে ‘স্কোয়াড’ গঠন করে, আগ্নেয়াস্ত্র হাতে দিনরাত পাহারা দিয়ে। কারণ সেগুলো সবই জাতীয় সম্পদ। বঙ্গভূমে মধ্যবিত্তের বিপ্লব-চিন্তায় ও কর্মে এই ব্যাপারটা ছিল দূর অস্ত।
মধ্যবিত্তের মস্তিষ্কপ্রসূত ‘বিপ্লবের’পরবর্তী পদক্ষেপে আরম্ভ হয় ‘রেলগাড়ি, রাস্তা বন্ধ, ‘চাককা জ্যাম, ‘মানছি না, মানবো না, ‘জবাব দাও’ নিপাত যাক’, ‘মালিকের কালো হাত ভেঙে দাও, গুঁড়িয়ে দাও’, ‘জুলুমবাজি চলবে না, চলবে না’ ইত্যাদি হরেক রকমের শ্লোগান। এর সাথেই মধ্যবিত্ত মদতে আমদানি হয় ‘ঘেরাও’ ‘জনরোষ,’ ‘গণপিটুনি’, মানবশৃঙ্খল’। সঙ্গে হরতাল, ধর্মঘট, মিটিং, মিছিল, সমাবেশ। কাজের সময় কমাতে হবে, বেতন বৃদ্ধি করতে হবে, বোনাস দিতে হবে, প্রতিটি কলকারখানায় ইউনিয়ন গড়ার অধিকার দিতে হবে ইত্যাদি দাবি উঠাতে আরম্ভ করে সর্বত্র, সর্বস্তরে। এসবের মধ্যে যে ‘ঐতিহাসিক ভুল’ একেবারেই ছিল না, এমন নয়। তবে সে সময় মধ্যবিত্ত নেতৃত্বে আরো জোর দিতে পারত উৎপাদিত পণ্যের গুণমান কিংবা পরিমাণ অথবা অফিসে অফিসে সেবা দানের উৎকর্ষ বৃদ্ধির ক্ষেত্রে। মধ্যবিত্তের নেতৃত্বাধীন আন্দোলনের আশাতিরিক্ত ফল পাওয়া যায় অচিরেই। ‘বিপ্লবের’ বিশেষ প্লাবণে ভাসে দেশ। আন্দোলনে আন্দোলিত হয় শ্রমজীবী মানুষ।
একে একে ঢাকা থেকে গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ পর্যন্ত গগনচুম্বী চিমনিগুলো দিয়ে কালো ধোঁয়া বেরোনো বন্ধ হয়, কলের সিটি বাজা বন্ধ হয়। মালিক, শিল্পপতি, উদ্যোগপতিরা ধর্মঘট, ঘেরাও, প্রহারে এমনকি নিহত পর্যন্ত হয়ে এ অঞ্চল ছেড়ে অন্যত্র আস্তানা গড়েন। দেশের যে যে অঞ্চলে অনুকূল বাতাবরণ আছে, অর্থাৎ যেখানে নেই কোনো জঙ্গি আন্দোলন, আইনশৃঙ্খলার অবনতি, অনুকূল রাজনৈতিক পরিবেশ, সরকারি সহায়তা সেখানেই শিল্প উদ্যোগে জোয়ার আসে। মালিকের সাথে শ্রমজীবী মানুষেরও ডাল-রুটির সংস্থান হয়।
এই সময়ে দেশের মধ্যবিত্তের অবস্থা যে কতখানি নিচে নেমে গিয়েছিল তার প্রত্যক্ষদর্শী ছিলাম আমরা। লক্ষ লক্ষ মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়ে। এরপর আসে কর্মহীনতার প্রবল চাপ। কর্মসংস্কৃতির প্রশ্নটাই তখন অবান্তর। তাই বোধহয় এক সময় শ্লোগান ওঠে, ‘কর্মসংস্কৃতি ফিরিয়ে আনতে হবে।’
এতসব কিছুর পরেও বলতে বাধ্য হচ্ছি, এই মধ্যবিত্তরাই ‘গঠনমূলক’ কাজে এগিয়ে এসেছে বারবার। এখন আর কম্পিউটার তাদের কাছে কর্মসংস্থান বিনাশকারী অশুভ শক্তি নয়, বিশ্বব্যাঙ্ক অচ্ছুত নয়, দেশি-বিদেশে পুঁজি নিয়োগ এখন করজোড়ে স্বাগত। কিন্তু বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বিদেশিরা পুঁজি খাটাতে এদেশে ভয় পাচ্ছে। এ ভয়-ভীতি সরাতেই হবে।
ভুল ও ব্যর্থতা সত্তে¡ও ধনতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার ভাঙন ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে মধ্যবিত্তের ভূমিকা আশ্চর্যজনক। এই মধ্যবিত্ত শ্রেণী সমাজের সুষ্ঠু চিন্তার ধারক ও বাহক ছিল এই সেদিনও। এঁদের হাতেই স্থিতি লাভ ঘটে সমাজের ঐতিহ্য। এই শ্রেণী থেকেই উঠে আসে এমন নর-নারী যাঁরা অনেক সময় শ্লথ সামাজিক সংস্কারের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে সমাজকে পরিশুদ্ধ করেছেন। কিন্তু আজ? আজ এই মধ্যবিত্ত সমাজ ভুগতে শুরু করেছে অস্তিত্ব সংকটে। সময়, সভ্যতা-দুয়েরই পরিবর্তন হয়েছে। দ্রুত পাল্টে যাওয়া সমাজব্যবস্থায় প্রযুক্তি ভীষণভাবে রেখাপাত করেছে। সামাজিক ক্ষেত্রে গ্রথিত মধ্যবিত্ত মানুষ ক্রমশ হয়ে উঠেছে আত্মকেন্দ্রিক আর এখান থেকেই শুরু হয়েছে মধ্যবিত্ত মানুষের পাল্টে যাওয়ার পালা, সংকট দেখা দিয়েছে অস্তিত্ব রক্ষায়। বর্তমানে মধ্যবিত্ত সমাজের মূল বাঁধনটাই অনেকটা শিথিল হয়ে গেছে একান্নবর্তী পরিবারের ভাঙনে। এই ভাঙন মধ্যবিত্ত মানুষের মেরুদন্ড গুঁড়িয়ে দিয়েছে। নগরকেন্দ্রিক সভ্যতার সাথে তাল মেলাতে গিয়ে তাঁরা একক পরিবার নিয়ে বাঁচতে চেয়েছে। ফলে যা হওয়ার তা-ই হয়েছে। সম্মিলিত ঐতিহ্য, সংস্কার, রীতি-নীতি থেকে তাঁরা ক্রমশ দূরে সরে গেছে। বেশিরভাগ মধ্যবিত্ত পরিবার হয়েছে ‘মাইক্রোস্কোপিক’। এতে নিজস্ব সংস্কার ও ঐতিহ্যের বুনিয়াদ শিথিল হয়েছে। ক্রমশ তাঁরা পরম্ব ঐতিহ্যে রীতি অনুকরণ করতেই ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। এতে নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি, পোশাক-পরিচ্ছদের প্রতি তাঁদের অনীহা বৃদ্ধি পেয়েছে। আজ নয়, কয়েক দশক আগে থেকেই তাঁরা মধ্যবিত্তের গন্ডি অতিক্রম করে উচ্চবিত্তের স্তর স্পর্শ করার প্রতিযোগিতায় নিজেদের সমস্ত শক্তিকে ব্যয় করেছেন। সমাজের বাণিজ্যিক মোড়ক এক্ষেত্রে তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের প্রধান সহায়ক হয়ে দাঁড়িয়েছে, বিশ্ববিপ্লবের রণাঙ্গনে মধ্যবিত্তরা এখন আর সামনে নয়। সমাজ বিপ্লবের আবেগপ্রবাহ যে শুধু স্তিমিত তাই নয়, জন্ম নিয়েছে পণ্যলোভী সমাজের আত্মসর্বস্বতার আবহ। মধ্যবিত্তের মনে এখন আবেগের বদলে উপযোগিতা জায়গা করে নিয়েছে। প্রতিবিপ্লবের মাধ্যমে ফিরে এসেছে পুঁজিবাদ। মধ্যবিত্তের কাক্সিক্ষত সমাজবাদ গড়ে উঠেনি, কমিউনিস্ট আন্দোলনেও দেখা দিয়েছে এক বিশ্বজোড়া সংকট। কোনো গভীর অসুখের কবলে এখন যেন মধ্যবিত্ত সমাজ। দুর্জয়, দুর্মর, আশাবাদী ছাড়া মধ্যবিত্ত সমাজের কোনো নরনারীই আজ আর সমাজ বিপ্লবের স্বপ্ন দেখে না। হ্যাঁ, দ্বিতীয় শিল্পবিপ্লব একটা আছে বটে, কিন্তু তাও ‘তথাকথিত’ বিশেষণে বিশেষায়িত। এই বিপ্লবের (?) ছোঁয়ায় মধ্যবিত্ত (?)
সমাজে এখন অক্টোবর বিপ্লব আর চীনের লংমার্চ প্রসঙ্গ চাপা পড়ে যায়। শোনা যায় না দিয়েন বিয়েন ফু আর চে গুয়েভারার আত্মদানের কথা। এই বদলে যাওয়া পরিবেশে এখন মধ্যবিত্তোত্তীর্ণের ঘরে দামি মোবাইল, বিদেশি প্রসাধন, রঙিন টিভি, ফ্রিজ, ওয়াশিং মেশিন, ওয়ার্ডরোব, টু-হুইলার, ফোর হুইলার, এয়ার কন্ডিশনার, আইনক্স, হোম থিয়েটার। এই মধ্যবিত্তের গন্ডি উত্তীর্ণ মানুষগুলো এখন ধনীর তৈরি শপিংমলে তাঁদের শেষ কড়িটুকু পরানের কড়ি না- রেখেই খরচ করে ফেলেন। ধনীরা এঁদের টাকাই এখন দেশি-বিদেশি ব্যাঙ্কে গচ্ছিত রাখে। লুপ্তপ্রায় মধ্যবিত্তের গন্ডি যাঁরা অতিক্রম করে আর্থিক দিক দিয়ে সচ্ছল তাঁরা এখন ভোগবিলাসে শুধু লালায়িত নয়, মত্ত ও ব্যস্ত। বেতনের একটা বড় অংশ তাঁরা ব্যয় করছে অভিজাত রেস্তোরাঁয় নানা সুখাদ্যের স্বাদ গ্রহণের জন্যে।
তাহলে এই ‘না-মধ্যবিত্তের’ অবক্ষয় কি সুনিশ্চিত? হ্যাঁ, যে পরিবর্তনের জোয়ারে এঁরা গা ভাসিয়েছে তাতে এঁদের মধ্যে ক্ষয়রোগ বাসা বেঁধেছে। যে মধ্যবিত্ত সমাজ এক সময় সামাজিক অপরাধমূলক কার্যকলাপ থেকে নিজেদের দূরে রাখত উত্তরসূরিসহ তাঁদেরই অবশিষ্টাংশ আজ বেশি বেশি করে দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ছে। রঙিন স্বপ্নের নেশায় বুঁদ হয়ে তাঁরা আজ অন্ধ পতঙ্গের মতো চরম সর্বনাশের দিকে ছুটে চলেছে। জালিয়াতিসহ নানা দুর্নীতি থেকে তাঁরা আজ নিজেদের দূরে রাখতে পারছে না। অতিরিক্ত আত্মকেন্দ্রিকতা ক্রমশ কেড়ে নিচ্ছে তাঁদের প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর। নিজের দেশের ঐতিহ্য, ভাষা, সংস্কৃতির প্রতি আস্থার পরিবর্তে তাঁদের মধ্যে দেখা যাচ্ছে এ সবের প্রতি তাচ্ছিল্যের মনোভাব। সস্তা জনপ্রিয়তার প্রতি তাঁরা এখন আকৃষ্ট হয়েছে। এমনকি নিজেদের পূর্বসূরির প্রতি টানটাও তাঁরা সহজে ভুলে যেতে পারছে। যে মধ্যবিত্ত শ্রেণী এক সময় একান্নবর্তী পরিবারকে আশ্রয় করে বেঁচে থাকত তাঁরাই আজ দ্বিধাহীনভাবে তাঁদের বৃদ্ধ বাবা-মাকে পরিবারের বাইরে অবাঞ্ছিতের মতো ফেলে দিচ্ছে। অনেক শিক্ষিত ছেলেমেয়েদের কাছে আজ মা-বাবারা অবহেলিত, উপেক্ষিত। তাঁরা এখন আত্মসমালোচনার বদলে পরসমালোচনায়, অসম প্রতিযোগিতায় ও আত্মসুখে মত্ত। আসলে এ তো এক ধরনের আত্মহত্যা। এই অগ্নিদাহে নানাভাবে ইন্ধন জোগাচ্ছে বাণিজ্যিক স্বার্থকেন্দ্রিক গণমাধ্যমগুলো। সুতরাং সেদিন আর খুব দূরে নয় যখন সমাজে থাকবে কেবল দুটি শ্রেণী-নিম্নবিত্ত ও উচ্চবিত্ত। আর এটাই তো বড় ধরনের সামাজিক সংকট। জানি, পরিবর্তনশীল সমাজে ভাঙাগড়া অবশ্যম্ভাবী। কিন্তু যেখানে শুধুই ভাঙন সেখানে সমাজ মানুষ্যের মধ্যে ভারসাম্য বজায় থাকবে কী করে? নীরবে অথচ নিশ্চিতভাবে ভেঙেছে ও ভাঙছে মূলবোধ, সংস্কৃতি ভাবধারা ও ঐতিহ্য।
লেখক : সাংবাদিক-কলামিস্ট।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।