Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

চুরি যাচ্ছে মাটি, ঘুষ না দিলে পানি পাচ্ছে না কৃষক

কমিটিকে ম্যানেজ করে দখল হচ্ছে খাল

| প্রকাশের সময় : ১৬ এপ্রিল, ২০১৭, ১২:০০ এএম

খলিল সিকদার, রূপগঞ্জ (নারায়ণগঞ্জ) থেকে : নারায়ণগঞ্জ জেলার উত্তর রূপগঞ্জ ও গাজীপুর জেলার কালীগঞ্জ থানার তুমুলিয়া ও নাগরী ইউনিয়নের ২২৭০ হেক্টর কৃষি জমির পানি সেচ সুবিধা ও বন্যা নিয়ন্ত্রণকল্পে একটি সøুইসগেট স্থাপন করা হয় ১৯৮৬ সালে। এ সøুইসগেটটি কালীগঞ্জ-উত্তর রূপগঞ্জ সেচ প্রকল্প হিসেবে পরিচিত। প্রকল্পটিতে স্থানীয় কৃষকেরা উক্ত জমিতে ধানসহ বিভিন্ন সব্জির চাষ করে গ্রামীণ অর্থনীতিতে সুফল পাচ্ছে। তবে সম্প্রতি প্রভাবশালী ও ভ‚মিদস্যুদের মাধ্যমে কৃষকের সোনা ফলা খ্যাত এ অঞ্চলের দুফসলি জমিতে সময়মত পানি না পেয়ে হতাশা প্রকাশ করছেন তারা। অন্যদিকে পানি সরবরাহকারী কমিটিতে ম্যানেজ করে পাউবোর খাল ও এর আশপাশ সরকারী জমির মাটি কাটার ধুম পড়েছে। স্থানীয় প্রভাবশালীরা একে একে জনবহুল এলাকায় পাকা স্থাপনা নির্মাণ করে দখল বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছে। প্রথমে প্রভাবশালীর অর্থ ব্যয়ে পাউবোর খালের উপর পাকা স্থাপনা গড়ে এগুলো স্থানীয় নিরীহ ব্যবসায়ীদের কাছে ভাড়া দিচ্ছে। এসব ভাড়ার বড় একটি অংশ প্রভাবশালীদের পকেটে রেখে বাকি টাকা দিচ্ছে পাউবো কর্মকর্তা ও কতিপয় কর্মচারীদের। এসব অর্থের ভাগবাটোয়ারা কাজে রয়েছে পানি সরবরাহকারী কমিটির সভাপতি ও তাদের নিয়ন্ত্রিত একটি প্রভাবশালী গোষ্ঠী। সরেজমিন দেখা যায়, প্রকল্পটির উপ-বিভাগীয় নির্বাহী প্রকৌশলীর কার্যালয়টিতে তালাবদ্ধ রয়েছে। এসব বিষয়ে কার্যালয়ের দায়িত্বরত পাম্প অপারেটর বিল্লাল হোসেন বলেন, এ বিভাগের স্যারকে তিনি কতদিন আগে অফিস করেছেন তা জানেন না। তবে মুঠোফোনে বিভিন্ন কাজের খোঁজখবর নেন বলে দাবী করেন তিনি। প্রকল্পটিতে দেখা যায়, কর্মচারী ছায়েদ আলী, সিভিল কর্মচারী আলী আহমদ, প্রহরী আলতাফ চৌকিদার তাদের দায়িত্বে থাকা কাজগুলো তদারকি করছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক সূত্র জানায়, এ বিভাগে মোট ১৪জন কর্মচারী রয়েছে। তাদের কেউই নিয়মিত অফিস করেন না। এমনকি প্রকল্পটির বিভাগীয় প্রকৌশলী সিভিল বিভাগের এসডি আশরাফুজ্জামান, ল্যান্ড বিভাগের প্রকৌশলী এনায়েত করীম, নির্বাহী প্রকৌশলী আবুল হোসেনসহ কোন ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষই এ প্রকল্পে নিয়মিত অফিস করেন না। তবে এনায়েত করীম সপ্তাহে মঙ্গল ও বুধবার মাঝে মাঝে আসেন বলে জানান তারা। এদিকে দায়িত্বরত কর্মকর্তারা নিয়মিত প্রকল্পে না আসার সুযোগে পানি সরবরাহ কমিটির সভাপতি মোবারক হোসেন, সার্ভেয়ার মোস্তফা কামালসহ একটি চক্র স্থানীয় প্রভাবশালীদের সাথে গোপন আঁতাত করে গড়ে তুলেছেন শক্তিশালী সিন্ডিকেট। এ সিন্ডিকেটকে নিয়মিত টাকা না দিলে কৃষকের ক্ষেতে পানি আসে না সময়মতো। আর তাতে ফসল উৎপাদন ব্যাহত হয় বলে রয়েছে অভিযোগ। সম্প্রতি উক্ত কমিটির সদস্যরা আগলা গ্রাম এলাকায় স্থানীয় দাউদপুর ইউপি চেয়ারম্যান নুরুল ইসলাম জাহাঙ্গির মাষ্টারের নির্দেশে খালের উপর বাঁধ দিয়ে পানি আটকিয়ে দেয়। কারণ হিসেবে জানা যায়, আগলা গ্রামের কৃষকরা তাদের পানির বিল দিতে দেরি করেছেন। তবে এ বিল নিয়মিত বিলের চারগুণ বলে জানা গেছে। পরে গ্রামবাসীর প্রতিরোধের মুখে বাঁধটি খুলে দিতে বাধ্য হয় এই অসাধু সিন্ডিকেট। সূত্র আরো জানায়, পানি সরবরাহ কমিটির লোলুপ বৈশিষ্ট্যে স্থানীয় কৃষকের মাথায় হাত পাড়েছে। তাদের চাহিদা মাফিক টাকা না দিলেই বন্ধ করা হয় সেই এলাকার পানি সরবরাহ। আবার ফসল নষ্টের হুমকি দিয়ে আদায় করা হয় অর্থ। কখনো অতিরিক্ত পানি ছেড়ে দিয়ে ফসলের ক্ষতি করতেও দ্বিধাবোধ করেন না এ চক্রটি। অন্যদিকে এসব অপকর্মের জন্য স্থানীয় কৃষকরা দায়ী করছেন বড় কর্তারা নিয়মিত অফিস না করাকে। তারা দাবী করেন, বড় কর্তারা প্রকল্প কার্যালয়ে অফিস করলে স্থানীয় কৃষকের সুখ দুঃখ জেনে ব্যবস্থা নিতে পারতো। তা না করে উক্ত কর্তারা নরসিংদী সেচপকল্পে বসেই পরিচালনা করেন রূপগঞ্জ-কালীগঞ্জ সেচপ্রকল্প। অন্যদিকে পাউবোর অধীনে খালগুলোর উপর যত্রতত্র স্থাপন করা হয়েছে কালভার্ট। যার বেশিরভাগেরই অনুমোদন নেই পাউবো কর্তৃপক্ষের। একই খালের একোয়ার করা জমিতেই পাকা স্থাপনা নির্মাণ করে দখলে নিয়েছে স্থানীয় প্রভাবশালীরা। খৈসাইর এলাকায় দেখা যায়, সাত্তার আলীর নির্মাণ করা একটি পাকা স্থাপনা খালের উপর করা হয়েছে। বেলদী বাজার এলাকা থেকে শুরু করে খৈসাইর, দাউদপুর, কামালকাটি, কলিঙ্গা, দড়িসোমসহ প্রায় ১০টি অনুমোদনহীন বাজারে পাউবোর খালের উপর নির্মাণ করা হয়েছে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। ফলে এসব এলাকার ফসলি জমিতে পানি সেচ কাজের বিঘœ ঘটছে। তাই সময়মত ভাল ফলন পাচ্ছেন না কৃষক। কেউ কেউ নিয়ম না মেনে চাষাবাদ করতে অভ্যস্থ হয়ে পড়ছেন পানির অভাবে। ফলে কাক্সিক্ষত ফলন না পেয়ে কৃষি কাজ ছেড়ে দিতে বাধ্য হচ্ছেন অনেকে। স্থানীয় জমি মালিকরা ফসল ফলিয়ে লাভবান না হওয়ায় অতি দরিদ্রদের মাঝে বর্গা হিসেবে দিয়েছেন। আবার কেউ কেউ রেহান দিয়ে ও কৃষি কাজের ইতি টানছেন। রোহিলা এলাকার কৃষক অজুফা বেগম বলেন, খালের পানির আশায় থাকলেও ফসল নষ্ট হয়ে যায়। তাই তিনি ব্যক্তিগতভাগে স্যালুমেশিনের সাহায্যে পুকুর থেকে পানি তুলে সেচকাজ করেন। এভাবে বাধ্য হয়ে স্থানীয় কৃষকরা বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণ করছেন। এসব বিষয়ে অভিযুক্ত পানি সরবরাহকারী কমিটির সভাপতি মোবারক হোসেন বলেন, স্থানীয় কৃষকের জমিতে নিয়মিক সেচ দেয়া হচ্ছে। এসব পানি যেন ঠিকমত পাওয়া যায় তা তদারকি করা হচ্ছে। তবে স্যারেরা এখানে অফিস না করায় কৃষকের অনেক সমস্যা নিয়ে কথা বলা ও পরামর্শ নেয়া যাচ্ছে না। এ সময় কৃষকের কাছ থেকে নিয়ম মেনেই টাকা আদায় করেন বলে দাবী করেন তিনি। এ বিষয়ে নির্বাহী প্রকৌশলী (ল্যান্ড) এনায়েত করীম বলেন, পাম্প বিকল, বিদ্যুৎ সরাবরাহে বিঘœসহ কৃষকের দাবী পূরণে কিছু হিমশিম খেতে হয় জনবলের অভাবে। খাল দখলসহ বিভিন্ন সমস্যার সমাধান সরেজমিন গিয়েই সমাধা করে থাকি। তবে নরসিংদী সেচ প্রকল্পটিতে অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করতে হয় তাই সেখানে (রূপগঞ্জে) নিয়মিত অফিস করা সম্ভব হয় না। তবে নিয়মিত অফিস করার বিধান রয়েছে বলে স্বীকার করেন তিনি। এ সময় তিনি আরো বলেন, অবৈধ দখলদার, মাটি চুরিসহ নানা অপকর্মের বিষয়ে একটি তালিকা করা হয়েছে। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে কালীগঞ্জ ও রূপগঞ্জ থানায় পৃথক পৃথক মামলা করা হয়েছে। অনেককে নোটিশ করা হয়েছে বলেও জানান তিনি। তবে স্থানীয় প্রভাবশালীদের দৌরাত্ম্যে কিছুটা সমস্যা হচ্ছে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ