Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

আন্তঃরাষ্ট্রীয় ও ধর্মীয় সম্পর্কের ভূ-রাজনীতি এবং বন্ধুত্বের বহতা নদী

| প্রকাশের সময় : ১২ এপ্রিল, ২০১৭, ১২:০০ এএম

জামালউদ্দিন বারী : এই মুহূর্তে দেশের রাজনীতি এবং গণমাধ্যমের প্রধান আলোচ্য বিষয় হচ্ছে প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরে প্রাপ্তি ও অপ্রাপ্তির হিসাব-নিকাশ। ভৌগোলিকভাবে, ঐতিহাসিকভাবে ভারত-বাংলাদেশ একই উপমহাদেশে অবস্থিত হওয়ায় দুই দেশের রাজনৈতিক মানচিত্র যা-ই হোক নদী, পাহাড়, সমুদ্র ও বনভূমির মতো বিষয়গুলোতে বহু বছরের একটি অবিচ্ছেদ্য প্রাকৃতিক মেলবন্ধন বিদ্যমান। ভূ-রাজনৈতিক কারণে আমরা আমাদের সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়ার সম্মুখীন হতে পারি। নিরাপত্তা ও রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক বিবেচনায় আমাদের বন্দর, নৌপথ, সড়কপথ, রেলপথ ব্যবহার প্রতিবেশীদের জন্য নিষিদ্ধ করতে পারি, অথবা প্রতিবেশীদের নিষেধাজ্ঞার সম্মুখীন হতে পারি; কিন্তু নদী, পাহাড়, সমুদ্র ও বনভূমির অখন্ড ইকোলজিতে হাত দিতে গেলে শান্তি, স্থিতি ও নিরাপত্তার প্রশ্নে বড় ধরনের বিপর্যয় নেমে আসার আশঙ্কা থাকে। রাষ্ট্র আয়তনে বড় বা ছোট হতে পারে। রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ও সামরিক দিক থেকে দুর্বল বা সবল হতে পারে। তবে দুটি প্রতিবেশী রাষ্ট্রের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক গড়ে উঠতে হয় সার্বভৌম সমতার ভিত্তিতে। গত হাজার বছরের ইতিহাসে আঞ্চলিক আধিপত্য ও আন্তর্জাতিক ঔপনিবেশিক শক্তির কারণে রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্বের নীতি নানাভাবে লঙ্ঘিত হলেও বিংশ শতকের দুটি মহাযুদ্ধের বিভীষিকাময় অভিজ্ঞতা এবং বিশ্ব সম্প্রদায়ের সদিচ্ছার প্রতিফলন হিসেবে জাতিসংঘের মতো আন্তর্জাতিক সংস্থা গঠনের মধ্য দিয়ে সেই বাস্তবতা এক নতুন রূপ নিয়েছে। রাজনৈতিক বিশ্ববীক্ষা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাষ্ট্র ও নৃগোষ্ঠীগুলোর স্বকীয় বৈশিষ্ট্য ধারণ করে নিজেদের সামাজিক-রাজনৈতিক অস্তিত্ব নিয়ে টিকে থাকার অধিকারের স্বীকৃতি দিয়েছে। দ্বিজাতিত্বত্তের ভিত্তিতে ঊনিশশ’ সাতচল্লিশে উপমহাদেশ ভেঙে ভারত পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম যেমন একটি অনিবার্য ঐতিহাসিক বাস্তবতা, তেমনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতাও উপমহাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের এক অনিবার্য বাস্তবতা। মূলত ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবের ভেতরই স্বাধীন বাংলাদেশের বীজ নিহিত ছিল। সেই বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য আমাদের একটি রক্তাক্ত মুক্তিযুদ্ধের পথ পাড়ি দিতে হয়েছে। বিশ্বের অন্য যে কোনো জাতি-রাষ্ট্রের চেয়ে বাংলাদেশের জনগণকে অনেক বেশি রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক সংগ্রাম ও ত্যাগের মূল্য গুনতে হয়েছে। জনসংখ্যা ও জনগণের সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ বিশ্বের প্রথম ১০ স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্রের অন্যতম। যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিপন্ন করার বা কেনা-বেচার চিন্তা করছেন তারা হীনমন্যতা এবং ভ্রান্তির ঘোরে বসবাস করছেন। যে দেশের মানুষ রক্ত দিয়ে রাষ্ট্র নির্মাণ করতে জানে, সে দেশের মানুষ কোনো ক্ষমতালিপ্সু রাজনৈতিক শক্তির স্বাধীনতা বিকিয়ে দেয়ার কোনো দুরভিসন্ধি মেনে নেবে না।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চার দিনের ভারত সফরের প্রথম দিনে ভারতীয় পত্রিকা ‘দি হিন্দু’ বাংলাদেশি প্রধানমন্ত্রীর অপিনিয়ন হিসেবে একটি নিবন্ধ প্রকাশ করে। প্রকাশিত নিবন্ধটি অবলম্বনে গত ৮ এপ্রিল ইনকিলাবে একটি পর্যালোচনা প্রকাশিত হয়- ‘বন্ধুত্ব বহতা নদীর মতো’ শিরোনামে। নাতিদীর্ঘ নিবন্ধের শেষে শেখ হাসিনা লিখেছেন, নোবেল বিজয়ী মেক্সিকান কবি অক্টাভিও পাজ বলেছেন, ‘ফ্রেন্ডশিপ ইজ অ্যা রিভার’ আর বাংলাদেশ-ভারত বন্ধুত্বের প্রশ্নে শেখ হাসিনা লিখেছেন- ‘ফ্রেন্ডশিপ ইজ অ্যা ফলোয়িং রিভার, ফুল উইথ জেনারোসিটি’। মেক্সিকোর সাথে স্বাধীন ভারতের ক‚টনৈতিক সম্পর্কের সূচনায় ১৯৫১ সালে অক্টাভিও পাজ প্যারিস থেকে ভারতে এসেছিলেন মেক্সিকো অ্যাম্বাসিতে ক‚টনৈতিক চাকরি নিয়ে। একটি সম্পূর্ণ ভিন্ন সামাজিক রাজনৈতিক পরিবেশে দায়িত্ব পালনকালে ভারতকে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করেছিলেন তিনি। তার ‘ইন লাইট অব ইন্ডিয়া’ গ্রন্থে ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি, সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য, হিন্দু-মুসলমানের ধর্মীয় মিথস্ক্রিয়া ও দ্বা›িদ্বক বিষয়গুলোকে নিজস্ব পর্যবেক্ষণ হিসেবে তুলে ধরতে চেয়েছেন পাজ। ভারত সম্পর্কে পাজ’র দর্শন শুধুমাত্র ভারতীয় রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক দর্শনেই আবদ্ধ থাকার কোনো কারণ নেই। কেননা তিনি পঞ্চাশের দশক থেকে ষাটের দশকের শেষ পর্যন্ত ভারত ছাড়াও পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও শ্রীলঙ্কায় দায়িত্ব পালন করেন। অন্য মহাদেশ থেকে এসে তিনি নির্মোহ চিত্তে ভারতীয় উপমহাদেশের সামগ্রিক সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক জীবনের গ্রন্থিগুলোকে নিবিড়ভাবে প্রত্যক্ষ করেছেন। ১৯৯০ সালে সাহিত্যে নোবেল বিজয়ী অক্টাভিও পাজ ১৯৯৮ সালের ১৯ এপ্রিল ৮৪ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করার আগের বছর ১৯৯৭ সালে নিউ ইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় ‘ইন লাইট অব ইন্ডিয়া’র একটি রিভিউ প্রকাশিত হয়েছিল। রিভিউটি লিখেছিলেন, ‘দ্য গোল্ডেন অরিওল : অ্যা টু হান্ড্রেড ইয়ার হিস্টোরি অব অ্যান ইংলিশ ফ্যামিলি ইন ইন্ডিয়া’ গ্রন্থের লেখক রেলিগ ট্রেভেলিয়ন। রেলিগ ট্রেভেলিয়ন ভারতের আন্দামানে জন্মগ্রহণকারী একজন বৃটিশ লেখক। তিনি প্রথম জীবনে বৃটিশ সেনাবাহিনীর সদস্য হিসেবে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে আলজেরিয়া ও ইতালিতে গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা পালন করেন। ট্রেভেলিয়ন নিউ ইয়র্ক টাইমস-এ প্রকাশিত ইন লাইট অব ইন্ডিয়া’র রিভিউর শিরোনাম দিয়েছিলেন- ‘ওয়ান নেশন আন্ডার মেনি গডস’। ভারতীয় সমাজদর্শন নিয়ে লিখতে গেলে এখানে বহুত্ববাদী সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক মেলবন্ধনই প্রগাঢ় রূপে উঠে আসতে বাধ্য। তবে অক্টাভিও পাজ মূলত হিন্দু ও মুসলমানের আধ্যাত্মিক ও রাজনৈতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রগুলোকেই তার লেখায় তুলে ধরেছেন। ইন লাইট অব ইন্ডিয়া ছাড়াও ১৯৫২ থেকে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ কর্ম ও রাজনৈতিক জীবনের অভিজ্ঞতার নির্যাসে লেখা কাব্যগ্রন্থ ‘অ্যা টেল অব টু গার্ডেনস’-এ ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক বাস্তবতাই তুলে ধরেছেন অক্টাভিও পাজ। তার লেখায় ভারতে ধর্মীয় বর্ণবাদ, সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মনিরপেক্ষতা, রাম, আল্লাহ, মথুরা, আমির খসরু, হুমায়ুনের কবর, লোদি গার্ডেন, ব্যাপ্টিজমের সামাজিক প্রভাব, হেরাতের শান্তিময়তা ইত্যাদি বিষয় উঠে এসেছে।
‘বন্ধুত্ব বহতা নদীর মতো’, এটি বন্ধুত্বের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার ক্ষেত্রে যতটা সত্য তার চেয়েও বেশি সত্য আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে। আর রাষ্ট্র যদি হয় নিকটতম প্রতিবেশী এবং একই ভৌগোলিক বাস্তবতার অংশ তাহলে তো কোনো কথাই নেই। পাহাড় চূড়ার হীমবাহে জন্ম নিয়ে ধীরে ধীরে মালভূমি, সমতল ও উপত্যকা পেরিয়ে সমুদ্রে মিশে যাওয়াই প্রায় প্রতিটি মৌলিক নদীর সাধারণ চিত্র। গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র, সিন্ধু, নীল, আমাজান, টাইগ্রিস, ইউফ্রেটিস, রাইন, দানিউবসহ সারা বিশ্বের শত শত নদী আছে যেসব রাষ্ট্রীয় রাজনৈতিক বিভাজন সত্তে¡ও অভিন্ন নদী হিসেবে যৌথ অধিকারের মধ্য দিয়ে শত শত বছর ধরে নির্বিঘেœ বয়ে চলেছে। আফ্রিকার এগারটি দেশের ওপর দিয়ে নীলনদ প্রবাহিত হচ্ছে, ইউরোপের অর্ধডজন দেশের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে রাইন। এসব দেশের মধ্যে নানা ধরনের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক বিরোধ থাকলেও কোনো দেশ এককভাবে কোনো আন্তর্জাতিক নদীতে বাঁধ দিয়ে এর প্রবাহকে রুদ্ধ করে দেয়ার এমন নজির সৃষ্টি করেনি যা করেছে ভারত। পদ্মার মতো, তিস্তার মতো বড় বড় নদীকে উজানে বাঁধ দিয়ে অববাহিকাকে মরুভ‚মিতে পরিণত করার মতো নজির ভারত ছাড়া বিশ্বের কোনো রাষ্ট্রের নেই। পাহাড় থেকে উৎপত্তি হয়ে সমুদ্রে বিলীন হওয়াই নদীর পূর্ণতা। এর ব্যত্যয় হলে এক সময় প্রতিবেশগত ও প্রাকৃতিক বিপর্যয় নেমে আসে। দ্বিপক্ষীয় বা বহুপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে বহতা নদীর উপমা এ কারণেই প্রাসঙ্গিকভাবেই উঠে আসে। প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরে শুধুমাত্র তিস্তা নয়, বাংলাদেশের ৫৪টি অভিন্ন নদীর পানির স্বাভাবিক প্রবাহ এবং বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষের ন্যায্য হিস্যার দাবি যথার্থভাবে উঠে আসবে এটাই ছিল প্রত্যাশিত। দেশবাসীর সে প্রত্যাশা আবারো হতাশায় রূপ নিয়েছে। ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরের আগেই বাংলাদেশ ভারতের জন্য সম্ভাব্য অনেক কিছুই দিতে শুরু করেছিল। এ কারণে ২০১১ সালে মনমোহন সিংয়ের সফরের সময়ই তিস্তা চুক্তি সম্পাদনের সমূহ সম্ভাবনাকে বিবেচনায় এনেছিল পুরো জাতি। সে সময় যথাশীঘ্র তিস্তা চুক্তির আশ্বাস দেয়া হয়েছিল ভারতের তরফ থেকে। এরপর ভারতে ক্ষমতার পালাবদলের পর বাংলাদেশের কাছে ভারতের প্রত্যাশিত প্রায় সবকিছুই না চাইতেই দিয়ে দিয়েছে আমাদের সরকার। আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে অভিন্ন আন্তর্জাতিক নদীর ওপর কোনো দেশ এককভাবে বাঁধ নির্মাণ করতেই পারে না। অভিন্ন নদীর পানির ওপর বাংলাদেশের মতো প্রতিবেশী রাষ্ট্রের জনগণের ন্যায্য হিস্যা অগ্রাহ্য করে ভারত বাংলাদেশের সাথে প্রগাঢ় বন্ধুত্বের দাবি করছে শুধুমাত্র যেন বাংলাদেশের পক্ষ থেকে একতরফা ছাড় দেয়ার মানদন্ডেই। আর এই বন্ধুত্বের নিদর্শনে বাংলাদেশের সব নদনদী শুকিয়ে গাঙ্গেয় বদ্বীপ অঞ্চলে মরুকরণ প্রক্রিয়া দেখা দেয়ার পরও আমরা দেশের অবকাঠামোগত সামর্থ্য, অর্থনৈতিক স্বার্থ ও সামগ্রিক নিরাপত্তাব্যবস্থার মতো ইস্যুগুলোকে পাশ কাটিয়ে ভারতকে নামমাত্র মাশুলে নৌ-স্থল ও রেল ট্রানজিট সুবিধা দিয়ে দিচ্ছি। ভারতে গিয়ে বার বার সেখানকার নেতাদের পদ্মার ইলিশ খাওয়াচ্ছি আর তাদেরকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি ‘বন্ধুত্ব বহতা নদীর মতো’। জেনেরোসিটি বা মহত্ব ও উদারতা শুধু বাংলাদেশই দেখাতে পেরেছে, বিনিময়ে বাংলাদেশ পেয়েছে সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়ায় নিষ্পাপ কিশোরীর ঝুলন্ত লাশ, ভারতীয় অস্ত্র ও মাদকের আগ্রাসন আর পদ্মা, যমুনা, তিস্তার বুকে ধু-ধু বালুচর।
অক্টাভিও পাজ যখন উপমহাদেশে কূটনৈতিক দায়িত্ব পালন করেছিলেন এবং সে অভিজ্ঞতার আলোকে কবিতা ও গদ্য রচনা করেছিলেন তখন বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটির জন্ম হয়নি। শিবসেনা ও আরএসএসের মতো উগ্রবাদী রাজনৈতিক সংগঠনের জন্ম গত শতকের ত্রিশের দশকে হলেও তখনো ভারতে হিন্দু জাতীয়তাবাদের এমন উত্থান ঘটেনি। গঙ্গা ও তিস্তা নদীর ওপর ফারাক্কা বা গজলডোবা বাঁধ তৈরি হয়নি। সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া কিংবা সীমান্তরক্ষীদের গুলিতে শত শত মানুষের মৃত্যুর ঘটনা ঘটেনি। গো-রক্ষার নামে হিন্দুত্ববাদীদের হাতে নির্বিচার মানুষ হত্যার ঘটনাও তখনো ঘটেনি। রামের মাইথোলজিকে কেন্দ্র করে ৫০০ বছরের ঐতিহাসিক ও প্রত্মতাত্তি¡ক গুরুত্বের পাশাপাশি রাষ্ট্র হিসেবে ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতা এবং হিন্দু-মুসলমানের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের ঐতিহ্যে কুঠারাঘাত করে বাবরি মসজিদের মতো স্থাপনা গুঁড়িয়ে দেয়ার মতো ঘটনা ঘটেনি। শোনা যাচ্ছে, ওরা এমনকি তাজমহলও গুঁড়িয়ে দিতে চায়। একবিংশ শতকে এসে ভারত যখন একটি আন্তর্জাতিক পরাশক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে চাইছে ঠিক তখন ভারতে হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক ক্ষমতার পালে হাওয়া লেগেছে। আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চার দিনের রাষ্ট্রীয় সফরে দিল্লিতে অবস্থান করার সময় গত ৯ এপ্রিল ভারতের হিন্দুস্তান টাইমস পত্রিকায় পালৌমি ব্যানার্জির একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়, যার শিরোনাম ছিল- ‘হিন্দুইজম ভার্সাস হিন্দুত্ব : দ্য সার্চ অ্যান আইডিওলজি ইন টাইমস অব কাউ পলিটিক্স’। এ এক এমন দেশের এমন রাজনীতি যেখানে শত শত বছর ধরে সব ধর্মের মানুষই গরুর গোস্ত খেয়ে আসছে, যে দেশটি বিশ্বে গরুর গোস্ত রফতানিতে একনম্বর অবস্থান ধরে রেখেছে, সে দেশেই নাকি গরুর গোস্ত খাওয়ার অপরাধে পিটিয়ে মানুষ হত্যা করা হয়। পালৌমি ব্যানার্জি গো-রক্ষার নামে ভারতে হিন্দুত্ববাদীদের সাম্প্রতিক উন্মাদনার কিছু খন্ড চিত্র তুলে ধরার পাশাপাশি বিভিন্নজনের বক্তব্য ও উদ্ধৃতিসহ ভারতের ইতিহাসের হাজার বছরের ধারাবাহিকতা বিশ্লেষণ করে এই সিদ্ধান্ত উপস্থাপন করেছেন যে, হিন্দুইজম বা হিন্দু ধর্ম ও হিন্দুত্ব মোটেও এক বিষয় নয়। যে রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘ (আরএসএস) হিন্দু ধর্ম রক্ষাকে তাদের প্রধান রাজনৈতিক দর্শন হিসেবে গ্রহণ করেছিল। তারা এখন ‘গো-রক্ষা’কেই ধর্ম রক্ষা হিসেবে গ্রহণ করে শুধু তৎপরতা নয়, রীতিমতো তান্ডব চালাচ্ছে। যদিও বিজেপির শাসনামলে ভারত থেকে গো-মাংস রফতানী পূর্বের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেড়েছে। এমনকি ভারতের শীর্ষ গরুর মাংস রফতানিকারকদের প্রায় সকলেই হিন্দু ধর্মাবলম্বী। ভারতীয় হিস্টোরিয়ান হর্বনস মুখিয়ার মতে, ধর্মের নামে ওরা উন্মাদনা ছড়ালেও আসলে রাজনৈতিক হিন্দুত্বে হিন্দু ধর্মের লৌকিক ও অন্তর্নিহিত দর্শনের বিপরীতে তাদের অবস্থান। গো-রক্ষার নামে তারা সংখ্যালঘু মুসলমানদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে। ‘দি মিথ অব দ্য হলি কাউ’ গ্রন্থের লেখক ভারতীয় ঐতিহাসিক ডিএন ঝা’র মতে হিন্দু ধর্ম হচ্ছে অনেকগুলো ধর্ম ও বিশ্বাস ও লোকাচারের সংমিশ্রণ। তিনি বলেন, কেরালা ও উত্তর-পূর্ব ভারতের গো-মাংসভোজীরাও হিন্দু। ডিএন ঝা এবং সমাজবিজ্ঞানী আশিষ নন্দির মতে, ভারতের কিছু কিছু অঞ্চলের (বিশেষ করে বাংলা ও মিথিলা বিহার) ব্রাহ্মণরা মাংসভোজি। কোনো কোনো অঞ্চলের ব্রাহ্মণের প্রাচীনকাল থেকেই গো-মাংস ভক্ষণের ইতিহাস আছে। ইসলাম বা খ্রিস্টানদের মতো হিন্দু ধর্মের কোনো একক ধর্মগ্রন্থ বা প্রচারক যেমন নেই, তেমনি হিন্দু ধর্মে তেত্রিশ কোটি দেবতার কথা বলা হলেও কোনো দেবতাকে না মেনেও যে কেউ হিন্দু থাকতে পারে। প্রাচীন ভারতের চার্বাক দর্শনের অনুসারীরা ছিল নাস্তিক। আবার হিন্দুদের মধ্যে নির্গুন সম্প্রদায় নামে একটি সম্প্রদায় আছে যারা নিরাকার ঈশ্বরের আরাধনা করে।
সাম্প্রতিক বিশ্ব রাজনীতি এবং আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ধর্মের নামে বেশি অশান্ত ও অস্থিতিশীল হয়ে পড়েছে। যদিও আইএসের মতো জঙ্গিবাদের সাথে ইসলামের কোনো সম্পর্ক নেই। হিন্দুত্ববাদের সাথে সত্যিকারের হিন্দু ধমের্র কোনো সম্পর্ক নেই বলে দাবি করছেন এসব বিষয়ের গবেষকরা। একইভাবে জুদাইজম বা ইহুদি ধর্মের সাথে জায়নবাদের কোনো সম্পর্ক নেই। নেতুরি কার্তা ইন্টারন্যাশাল নামের জেরুজালেমভিত্তিক একটি অর্থডক্স ইহুদি সংগঠনের ওয়েবসাইটের ব্যানারে লেখা রয়েছে- ‘জুইশ আর ইউনাইটেড এগেন্স্ট জায়নিজম’। জায়নবাদী রাজনৈতিক দর্শনের ভিত্তিতে ইজরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার অনেক আগে থেকেই নেতুরি কার্তাসহ আরো কয়েকটি সংগঠন জেরুজালেমে গড়ে উঠেছিল, সংগঠন অদ্যাবধি জায়নবাদী ইসরাইলকে মেনে নেয়নি। তারা সব সময়ই ইসরাইলের মানবাধিকার লঙ্ঘনসহ যুদ্ধবাদী সামরিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী ভ‚মিকা পালন করে চলেছে। চলতি মাসের প্রথমদিকে ফিলিস্তিনের পশ্চিমতীরে ইসরাইলের নতুন বসতি স্থাপনের বিরুদ্ধে মুসলমানদের সাথে প্রতিবাদ বিক্ষোভে যোগ দিয়েছিল কয়েক হাজার ইহুদি। তারা ইসরাইল ও ফিলিস্তিনের পতাকা হাতে ইসরাইলের আগ্রাসন বিরোধী শ্লোগান দেয়। বিক্ষোভে অংশগ্রহণকারী ইহুদিরা বলেন, আরবদের সাথে ইহুদিদের কোনো শত্রুতা নেই। তারা ইসরাইলের আগ্রাসন ও দখলদারিত্ব মেনে না নেয়ার দৃঢ় প্রত্যয়ের পাশাপাশি ফিলিস্তিন সমস্যার সুন্দর সমাধান ও আরবদের সাথে বন্ধুত্বের প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন, অন্যদিকে ভারতেও হিন্দু-মুসলমানরা হাজার বছর ধরে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান করে আসছে। ‘ভারতের মুসলমান শাসকরা চাইলে এখানে কোন হিন্দু থাকত না’, এটি কোনো মুসলমানের রাজনৈতিক বক্তব্য নয়। নিজেকে ইহুদি ব্রাহ্মণ পরিচয়দানকারী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভারত গবেষক শেলডন পোলক এ মন্তব্য করেছিলেন। হাজার বছরেও যে সম্প্রীতির বন্ধন নষ্ট হয়ে যায়নি রাজনৈতিক হিন্দুত্ববাদের কবলে পড়ে তা এখন নস্যাৎ হয়ে যেতে পারে না। জঙ্গিবাদ, জায়নবাদ ও উগ্র হিন্দুত্ববাদের বিরুদ্ধ শক্তিই বিশ্বে সংখ্যাগরিষ্ঠ।
[email protected]



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ