Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

হিলিতে চোরাচালানিদের ইচ্ছায় থামে ট্রেন

সক্রিয় শক্তিশালী সিন্ডিকেট : নেপথ্যে রাজনৈতিক প্রভাবশালীরা

| প্রকাশের সময় : ১১ এপ্রিল, ২০১৭, ১২:০০ এএম

নূরুল ইসলাম, পার্বতীপুর (দিনাজপুর) থেকে ফিরে : ৫ এপ্রিল বুধবার বিকালের ঘটনা। জয়পুরহাট থেকে ছেড়ে পার্বতীপুরের দিকে ছুটছে আন্তঃনগর নীলসাগর এক্সপ্রেস। পাঁচবিবি স্টেশন পেরিয়ে সীমান্তবর্তী হিলি স্টেশন পার হতেই ৩টা ৪৭ মিনিটে হঠাৎ থেমে গেল ট্রেনটি। চোরাচালানীরা শিকল টেনে ট্রেনটি থামিয়ে দিয়েছে। রেললাইনের মাত্র কয়েক হাত দূরেই সীমান্ত পিলার। পিলারঘেঁষে দাঁড়িয়ে সশস্ত্র বিএসএফ সদস্য। নীল সাগর দাঁড়ানোর সাথে সাথে এপাড়ে অবস্থানরত বিজিবি’র সদস্যরাও এদিক-ওদিক ছুটোছুটি শুরু করলেন। ট্রেনে অবস্থানরত রেল পুলিশ সদস্যরাও বাঁশি ফুকিয়ে সতর্ক অবস্থান নিলেন। বেশ কিছুক্ষণ চললো তাদের ছুটোছুটি ও তল্লাশি অভিযান। ট্রেনে ডিউটিরত এএসআই বিশ্বনাথ জানালেন, সীমান্ত পেরিয়ে একজন চোরাচালানি উঠেছে ট্রেনে। তাকে খোঁজা হচ্ছে। ৫/৬ মিনিট অবস্থানের পর ট্রেনটি আবার ছেড়ে দিল। চোরাচালানির সন্ধান আর পাওয়া গেল না। দিনাজপুর জেলার হিলি সীমান্তে প্রতিদিনই এমন ঘটনা ঘটে। শিকল টেনে ট্রেন থামিয়ে চোরাচালানিরা ট্রেনে উঠে গা-ঢাকা দেয়। তাদের সাথে থাকে ভারতীয় মালামাল। এর মধ্যে ভারতীয় কাপড়, মসলা ও ফেনসিডিলই বেশি থাকে। যারা এই রুটে নিয়মিত চলাচল করেন তাদের অভিযোগ, রেলওয়ে পুলিশ ও নিরাপত্তাবাহিনীর সাথে সমঝোতা করেই চোরাচালানিরা ভারতীয় অবৈধ মালামাল নিয়ে ট্রেনে ওঠে। বিশেষ করে ফেনসিডিল বহনের ক্ষেত্রে তারা আগে থেকেই পুলিশের সাথে যোগাযোগ করে রাখে। তবে রেল পুলিশের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তার দাবি, বেশ কিছুদিন ধরে ট্রেনে চোরাচালান খুব একটা হচ্ছে না। লাল-সবুজ কোচের ট্রেন চালু হওয়ার পর থেকে ট্রেনে যাতে চোরাচালানিরা উঠতে না পারে সে জন্য দরজা বন্ধ রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে। সরেজমিনে দেখা গেছে, চোরাচালানিরা রেললাইনঘেঁষা সীমান্ত পেরিয়ে ট্রেনে যাতে না উঠতে পারে সে জন্য হিলি স্টেশন থেকে বিরামপুরের দিকে রেল লাইনের পাশে বেশ কয়েকটি বিজিবি চৌকি স্থাপন করা হয়েছে। কিন্তু তারপরেও চোরচালানিদের ঠেকানো যাচ্ছে না।
জয়পুরহাট শহর থেকে ১৮ কিলোমিটার দূরে দিনাজপুরের হিলি সীমান্ত চেকপোস্ট। বাংলাদেশ ও ভারতের পণ্য আমদানি-রপ্তানির জন্য এখানে গড়ে উঠেছে স্থলবন্দর। প্রতিদিন এই চেকপোস্ট দিয়ে বৈধ-অবৈধভাবে পণ্য আনা-নেয়া হচ্ছে। যেগুলো ট্রেনের মাধ্যমে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ছে। অভিযোগ রয়েছে, এ সীমান্ত দিয়ে বৈধতার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি পণ্য প্রবেশ করে অবৈধভাবে। আসছে মাদক, অস্ত্র থেকে শুরু করে ওষুধ, কাপড়, মসলাসহ যাবতীয় পণ্য। জানা গেছে, আইন-শৃঙ্খলাবাহিনীসহ প্রভাবশালীদের ম্যানেজ করে এখানকার চোরাচালানিদের সিন্ডিকেট খুবই শক্তিশালী।
স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা গেছে, হিলি স্টেশনে শত শত নারী-পুরুষ পিঠে ও পেটে ভারতীয় মালামাল নিয়ে আন্তঃনগর ট্রেনে উঠে পড়ে। দুরে দাঁড়িয়ে পুলিশ সেই দৃশ্য দেখে। সীমান্তবর্তী হিলি স্টেশনে আন্তঃনগর ট্রেন দাঁড়ানোর নিয়ম না থাকলেও চোরাচালানিরা শিকল টেনে প্রায় সব ট্রেনই থামিয়ে দেয়। নাম প্রকাশ না করার শর্তে হিলি স্টেশনের একজন কর্মচারী বলেন, মাত্র তিনটি ট্রেন এখানে যাত্রাবিরতির শিডিউল থাকলেও অন্য ট্রেনগুলো আউটার সিগন্যালে থামিয়ে অবৈধ মালামাল পাচার করা হয়। যা নিয়ন্ত্রণ করে চোরাচালানি সিন্ডিকেট।
রেলওয়ে পুলিশের দাবি, এখন চোরাচালানিদের তৎপরতা আগের তুলনায় কমেছে। কিন্তু বাস্তবে তার প্রমাণ মেলেনি। বরং গত ৫ এপ্রিল বুধবার ঢাকা থেকে দিনাজপুর যাওয়ার সময় বিলাসবহুল আন্তঃনগর ট্রেন নীল সাগরও থামিয়ে দিয়েছে চোরাচালানিরা। ওই ট্রেনের কয়েকজন যাত্রী জানান, হিলি স্টেশনের অদূরে ভারতের অভ্যন্তর থেকে প্রতিদিন অবৈধপথে ভারতীয় জিরা, কসমেটিকস, কাপড়, ওষুধ, বিভিন্ন ধরনের মাদক, এমনকি অস্ত্রও দেশে প্রবেশ করছে। আর এসবই হচ্ছে বিজিবি, পুলিশ, জিআরপি, কাস্টমস, আনসারসহ স্থানীয় প্রভাবশালীদের ম্যানেজ করে।
জানা গেছে, চোরাচালান হিলি ও পার্শ্ববর্তী এলাকার বহু মানুষের ভাগ্য বদলে দিয়েছে। এক সময় যাদের দিন কেটেছে অনাহারে-অর্ধাহারে, এখন তারাই সীমান্তে অবৈধ মালামাল পাচারের ব্যবসা করে হয়ে গেছে বিত্তশালী। যাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো দিনাজপুরের হাকিমপুর উপজেলার মধ্য বাসুদেবপুর গ্রামের জামাল উদ্দিন, রেজাউল হক, মোহাম্মদ আলী খান, জহুরুল ইসলাম, শামিম, আমিনুল, রুবেল, মিশনপাড়ার নাহিদ শেখ, উত্তর বাসুদেবপুরের টগর মল্লিক, বাবু মল্লিক, হিলি ফকিরপাড়ার নয়ন আলী, ধরন্দার আজমল, দক্ষিণ বাসুদেবপুরের রফিকুল ইসলাম, হিলি মুন্সিপাড়ার সাজ্জাদ, রেল কলোনির লোকমান, সোলেমান, পাঁচবিবির রামচন্দ্রপুর গ্রামের নওশাদ আলী, রতনপুরের বাবুল মিয়া, চেঁচরার ইসমাইল, হাকিমপুরের নন্দিপুর গ্রামের আলম হোসেন, ইউনুছ আলী, মাহবুব হোসেন ও ডাঙ্গাপাড়া মংলা এলাকার খবির উদ্দিন এবং ভারতের হাঁড়িপুকুরের মাহবুবুল আলম। ঘুরে-ফিরে এদের সিন্ডিকেটের সদস্যরাই চোরাচালানের সাথে জড়িত। এদের পেছনে রয়েছে শক্তিশালী গডফাদার-রাজনৈতিকভাবে যারা বড় ক্ষমতাধর।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ