Inqilab Logo

সোমবার ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

দখল ও দূষণে বিষাক্ত হচ্ছে শীতলক্ষ্যার পানি

| প্রকাশের সময় : ১১ এপ্রিল, ২০১৭, ১২:০০ এএম

খলিল সিকদার, রূপগঞ্জ (নারায়ণগঞ্জ) থেকে : রূপগঞ্জ উপজেলার শীতলক্ষ্যা নদীতে জাহাজ ও ড্রেজার রাখার কারণে রাস্তা- ঘাটের মতো জলপথেও সৃষ্টি হচ্ছে জট। নদীর মাঝে জাহাজ রাখার কারণে ঘটছে নিত্যনৈমিত্তিক দুর্ঘটনা। বিভিন্ন কোম্পানির জাহাজ নদীতে রাখার ফলে নদীর বেশিরভাগ অংশই দখল হয়ে যাচ্ছে। এতে করে নদী দিয়ে অন্যান্য জাহাজ, নৌকা, স্টিমার, ভলগেট, চলাচল করতে সমস্যা হচ্ছে। অনেক সময় ঘটছে বিভিন্ন ধরনের মারাত্মক দুর্ঘটনা। মালামাল উঠানো নামানোর জন্য নদীর কিনারে জেটি বানিয়ে নদীর ভাগ দখল করে রেখেছে। রূপগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদীতে ৪০-৫০টি স্থানে ড্রেজিং প্রকল্প গড়ে উঠেছে। সরকারদলীয় কয়েকটি প্রভাবশালী সংগঠন নদীতে এ ড্রেজার ব্যবসা গড়ে তুলেছে। নদীতে বছরের পর বছর ধরে ড্রেজার রেখে নদী দখল করে রাখা হচ্ছে। কোম্পানিগুলো নিয়ম না মেনে নদীর মাঝে জাহাজ রাখছে। নদী কিনারা দখল করেই ডকইয়ার্ডগুলো গড়ে তুলেছে বেশকয়েকটি প্রভাবশালী সিন্ডিকেট। শুধু তাই নয়, এসকল শিল্পকারখানার বর্জ্য পানিতে মিশে গিয়ে পানিকে দূষিত করছে। বর্তমানে ভয়াবহ দূষণ আর দখলের কবলে পড়েছে ঐতিহ্যবাহী শীতলক্ষ্যা নদী। এক সময় এ নদীর পানি বোতলজাত হয়ে বিদেশে পাঠানো হতো। অথচ বর্তমান সময়ে এ নদীর পানি বিদেশে পাঠানো তো দূরের কথা এ নদীর পানি এখন ব্যবহারের অনুপোযোগী হয়ে পড়েছে। অনুসন্ধানে জানা যায়, শীতলক্ষ্যা দূষণের জন্য দায়ী শিল্প-কারখানাগুলোর বেশির ভাগেরই বর্জ্য পরিশোধনাগার (ইটিপি) নেই। বড় কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের ইটিপি থাকলেও অনেক সময়ই তা বন্ধ থাকে বলে জানা গেছে। পরিশোধন ছাড়াই শিল্পবর্জ্যগুলো গিয়ে মিশে যাচ্ছে শীতলক্ষ্যার পানিতে। নদী ঘিরে এমন অনেক কারখানা গড়ে উঠেছে, যেগুলোর পরিবেশের কোনো ধরনের পরিবেশ ছাড়পত্র নেই। আবার যেসব কারখানার অবস্থান নদী থেকে দূরে, বর্জ্য নিষ্কাশন কাজে তারা ব্যবহার করছে বিভিন্ন ধরনের সরকারি খাল-বিল। ফলে এসকল প্রতিষ্ঠানের বর্জ্যও এসে মিশে যাচ্ছে শীতলক্ষ্যায়। এছাড়া অভিযোগ রয়েছে, বেশকয়েকটি শিল্প-কারখানার বিষাক্ত বর্জ্য ফেলে নদীকে দূষিত করছে। এতে করে শীতলক্ষা নদীর পানি বিষাক্ত হয়ে যাচ্ছে। এই বিষাক্ত পানি ফসলি জমিতে গিয়ে ফসল নষ্ট করায় ক্ষতিগ্রস্ত হতে হচ্ছে কৃষকদের। বিভিন্ন শিল্প-প্রতিষ্ঠানে বর্জ্য শোধনাগার না থাকায় দূষিত বর্জ্য নিক্ষেপ করা হচ্ছে শীতলক্ষ্যা, বালু নদীতে। ফলে কেমিক্যাল মিশ্রিত বর্জ্য পানিতে মিশে শীতলক্ষ্যা, বালু নদীর পানি দূষিত হয়ে পড়েছে। নদীর পানির রং বদলে গেছে। বিভিন্ন পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছে শীতলক্ষ্যা, বালু নদীর পানি ব্যবহারকারী মানুষ। দিন দিন নদীর পানি দূষিত হয়ে পড়ায় তা মানুষের ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। দূষিত বর্জ্যে নদীর মাছ মরে যাচ্ছে। বালু, শীতলক্ষ্যা নদীতে আর আগের মতো মাছ নেই। জানা যায়, রূপগঞ্জের বিভিন্ন স্থানে অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা অর্ধশতাধিক কল-কারখানার দূষিত বর্জ্য রাসায়নিক কেমিক্যাল মিশ্রিত পানি ছোট খাল-বিল, শীতলক্ষ্যা, বালু নদীতে নিষ্কাশনের ফলে নষ্ট হচ্ছে জমির উর্বরতা। দূষিত পানির কারণে দুর্গন্ধময়, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে। এডিবির এক সমীক্ষা রিপোর্টে শীতলক্ষ্যা নদীর পানিকে ব্যবহারের অযোগ্য বলা হয়েছে। পানিতে ন্যূনতম দশমিক শূন্য ছয় ভাগ অক্সিজেন থাকার কথা। অথচ শীতলক্ষ্যা নদীর পানিতে অক্সিজেনের পরিমাণ দশমিক শূন্য চার ভাগের কম। ক্ষতিকারক পদার্থের অস্তিত্ব কোনো কোনো ক্ষেত্রে ১০ গুণ পাওয়া গেছে। এক সময়ে শীতলক্ষ্যা, বালু ও মেঘনা নদীর পানি ছিল স্বচ্ছ পরিষ্কার টলমলে। এসব নদীতে মিঠা পানিতে অনেক জাতের মাছ পাওয়া যেত। এখন জেলেরা আগের মতো মাছ পাচ্ছেন না। পানি দূষিত হয়ে মাছ বিলুপ্ত হচ্ছে। নদীগুলোর দু’ধারে বসবাসকারী জনসাধারণ দূষিত পানিতে বিভিন্ন রকম পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। শিশুসহ বিভিন্ন বয়সের নারী-পুরুষ প্রতিদিন রূপগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ও ক্লিনিকে ভর্তি হচ্ছে বলে চিকিৎসকদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে। দূষিত বর্জ্য জমে বালু, শীতলক্ষ্যা নদী নাব্য হারাচ্ছে। যার ফলে জমির উৎপাদন বন্ধের উপক্রম হয়েছে এবং ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন কৃষকরা। রূপগঞ্জের চনপাড়া এলাকার জেলে আজাহার আলী বলেন, বংশানুক্রমে আমরা নদী থেকে মাছ ধরে আসছি। গত ২/৩ বছর ধরে নদীতে আর তেমন মাছ পাচ্ছি না। বালু, শীতলক্ষ্যা নদীর পানি দূষিত হয়ে মাছ বিলুপ্তি হচ্ছে। পানি পচে দুর্গন্ধময় হয়ে পড়েছে। রং বদলে হয়ে পড়েছে ব্যবহারের অযোগ্য। রূপগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন এলাকার জনগণ দূষণের হাত থেকে মুক্তি পেতে চায়। তাই তাদের দাবি শিল্প-কারখানার মালিকদের বর্জ্য শোধনাগার স্থাপন করতে হবে। পাশাপাশি সরকারকেও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। নাম প্রকাশে অনুচ্ছুক এক জাহাজ চালক জানান, বেশকয়েকটি কোম্পানির জাহাজ নদীর মাঝে রাখার কারণে নদীতে অন্যান্য জাহাজ চলাচল করতে পারছে না। নদীর মাঝে জাহাজ রাখায় জাহাজ নিয়ে চলাচল করা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ছে। এতে করে প্রতিদিনই বিভিন্ন ধরনের দুর্ঘটনা ঘটছে। কোম্পানিগুলো বিআইডবিøউটি-এর কাছ থেকে নদীর কিনারা থেকে জাহাজ থেকে মালামাল উঠানামা করার অনুমোদন নেওয়া থাকলেও নদীর মাঝে জাহাজ রাখার কোনো ধরনের অনুমোদন নেয়া হয়নি। শিক্ষার্থীরা জানান, প্রতিদিন তাদেরকে নদী পার হয়ে স্কুলে যেতে হয়। পারাপার হওয়ার সময় নদীর পানির পচা দুর্গন্ধে তাদের স্কুলে যাওয়ার আগ্রহ নষ্ট হয়ে যায়। বিভিন্ন শিল্প-কারখানার বর্জ্য নদীতে ফেলার কারণেই পানি থেকে দুর্গন্ধ বের হচ্ছে। এতে করে পরিবেশ মারাত্মকভাবে দূষিত হচ্ছে। নারায়ণগঞ্জ বিআইডবিøউটিএ’র যুগ্ম পরিচালক আরিফ হোসেন বলেন, এর আগেও আমরা শীতলক্ষ্যা নদীর দুই তীরে গড়ে উঠা শিল্প-প্রতিষ্ঠানগুলোতে চিঠি দিয়েছি। যাতে তারা তাদের মালবাহী কার্গো বা জাহাজগুলো নিজস্ব জেটি বা নিরাপদ স্থানে রাখা হয় এবং কোনো প্রকার নৌযান চলাচলে বাধার সৃষ্টি না হয়। যদি আইন ভঙ্গ করা হয়, তাহলে ব্যবস্থা নেয়া হবে। এব্যপারে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ফারহানা ইসলাম বলেন, বিষয়টি আমাদের জানা নেই। যেহেতু জেনেছি, প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে ঊর্ধŸতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হবে।

 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ