হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির খড়গ : আসামের এনআরসি এবং বাংলাদেশ
কিশোর শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক দাবীর আন্দোলনে ঢাকাসহ সারাদেশে তীব্র রাজনৈতিক উত্তেজনা ও অনিশ্চয়তা দেখা যাচ্ছিল,
মোবায়েদুর রহমান : ভারতের কাছে বাংলাদেশের গুরুত্ব, বিগত সাত বছর চার মাসে দৃশ্যপটের পরিবর্তন, বর্তমান সরকার কর্তৃক ভারতের অনেক চাহিদা পূরণ, বাংলাদেশের প্রতি চীনের বিশাল অর্থনৈতিক সাহায্যের প্যাকেজ এবং সবশেষে চীন থেকে বাংলাদেশের দুটি সাবমেরিন ক্রয়- এসব নিয়ে কথা বলেছেন ভারতের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস এম কৃষ্ণা। ২০১০ সালের জানুয়ারিতে যখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শেষবার রাষ্ট্রীয় সফরে ভারত গিয়েছিলেন, তখন এই এস এম কৃষ্ণাই ছিলেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। সেই এস এম কৃষ্ণা রঞ্জন বসু নামক দিল্লির এক সাংবাদিককে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সফরের পূর্বাহ্নে এক সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। সেই সাক্ষাৎকারটি আবার ঢাকার একটি বাংলা পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। মি. কৃষ্ণার বর্তমান বয়স ৮৪ বছর। সাড়ে সাত বছর আগে তিনি যখন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন, তখন তার বয়স ছিল ৭৭ বছর। তখন ভারতের ক্ষমতায় ছিল কংগ্রেস এবং প্রধানমন্ত্রী ছিলেন ড. মনমোহন সিং। ওই সাক্ষাৎকারে মি. কৃষ্ণা দাবি করেছেন যে, আজ অর্থাৎ ২০১৭ সালে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক যতখানি ঘনিষ্ঠ তার ভিত্তি রচনা করেছে কংগ্রেস সরকার। এই ভিত্তি রচনায় তিনি অতীব গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা পালন করেছেন বলেও তিনি দাবি করেন। এখন আর তিনি কংগ্রেসে নেই। জীবনের এই পড়ন্ত বেলায় তিনি বিজেপিতে জয়েন করেছেন। এখন বিজেপি করলেও তিনি স্বীকার করেন যে, বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক যে সলিড ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে আছে সেটি এককভাবে কংগ্রেসের অবদান। যেসব কারণে বাংলা-ভারত সম্পর্ক কল্পনাতীতভাবে ঘনিষ্ঠ সেসব কারণও ভারতের এই সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী বর্ণনা করেছেন। সেগুলো হলো : (১) ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে বিরাজমান চার দশকের পুরাতন স্থলসীমান্ত সমস্যার অত্যন্ত মসৃণ সমাধান। সকলকে অবাক করে দিয়ে ওই সমাধান ফর্মুলার বিরুদ্ধে ভারতের জাতীয় পার্লামেন্টে একটি ভোটও পড়েনি।
দ্বিতীয়ত, আন্তর্জাতিক সালিশির মাধ্যমে ভারত-বাংলাদেশ তাদের সমুদ্রসীমা নিয়ে বিরোধও মিটিয়ে ফেলেছে কোনও তিক্ততা ছাড়াই।
তৃতীয়ত, উলফা নেতা অনুপ চেটিয়া ২০১০ সালে বাংলাদেশের জেলে বন্দি ছিলেন। তাকে ভারতের হাতে তুলে দেওয়ার পর আসামের বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতাদের সঙ্গে সরকারের শান্তি আলোচনা চলছে জোরকদমে। দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে সশস্ত্র তৎপরতা একেবারেই স্তিমিত আর সেখানেও সৌজন্যে বাংলাদেশ সরকার। চতুর্থত, সাত বছর আগে বাংলাদেশে লোডশেডিং পরিস্থিতি ছিল ভয়াবহ। কিন্তু এখন পশ্চিমবঙ্গের ভেড়ামারা বা ত্রিপুরার পালাটানা থেকেও বিদ্যুৎ আসছে, পরিস্থিতি অনেক সহনীয়। আর এই পালাটানা বিদ্যুৎকেন্দ্রের সব ভারী সরঞ্জামও গেছে আশুগঞ্জ নদীবন্দর দিয়েই, যার জন্য ভারত বাংলাদেশের কাছে খুবই কৃতজ্ঞ। পঞ্চমত, নীরব বিপ্লবই ঘটে গেছে দুই দেশের কানেক্টিভিটি খাতে। ত্রিপুরার মানুষ কোনও দিন ভাবতেই পারেনি যে, আগরতলা থেকে সরাসরি বাসে ঢাকা হয়ে কলকাতা পাড়ি দিতে পারবেন। অথচ সেটা এখন বাস্তব। ঢাকা থেকে পণ্যবাহী ট্রাক মাল নিয়ে ভারতে ঢুকে মাল খালাস করছে দিল্লির কনটেইনার টার্মিনালে। এটাও বাস্তব। ষষ্ঠত, ২০১৪ সালের অক্টোবরে বর্ধমানের খাগড়াগড়ে বিস্ফোরণের পরই প্রথম সামনে আসে জামা’আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) জঙ্গিরা কতটা শিকড় বিছিয়েছে ভারতের ভেতরেও। জঙ্গিবাদ দমনে ঢাকা-দিল্লির যৌথ তৎপরতা তুঙ্গে উঠেছে তারপর থেকেই। জেএমবি-নব্য জেএমবি বা আইএস, যে নামেই তাদের ডাকা হোক না কেন, তাদের দমনে দুই দেশই কাজ করছে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে।
এমন উদাহরণ আরও অজস্র, আর এর সবই কিন্তু ঘটেছে মাঝের এই সাত বছরের মধ্যে। তিস্তা নিয়ে অপ্রাপ্তির অস্বস্তি নিশ্চয় আছে, কিন্তু তাতে এই অর্জনগুলোর গুরুত্ব খাটো হয়নি বলেই দিল্লির ক‚টনীতিকদের অভিমত। আর সে কারণেই ঢাকায় নিযুক্ত ভারতের সাবেক হাইকমিশনার বীণা সিক্রি বলছেন, ‘গত এক দশকে ভারতের সঙ্গে এমন ঘনিষ্ঠ সহযোগিতার উদাহরণ আপনি আর কোনও দেশে পাবেন না। সে কারণেই বাংলাদেশ সরকারের প্রতি দিল্লির মনোভাবও আমূল পাল্টে গেছে। দিল্লি এখন এটা আন্তরিকভাবে স্বীকার করে যে, ‘দিস ইজ আ ভেরি স্পেশাল রিলেশনশিপ!’
বীণা সিক্রি এমন একটা সময় ঢাকায় রাষ্ট্রদূত ছিলেন যখন বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকার ক্ষমতায়, আর ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কও ছিল তলানিতে। ফলে সেখান থেকে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে এই নাটকীয় পটপরিবর্তনটা তাই আরও বেশি করে চোখে লাগে। বাংলাদেশ যে এখন আর শুধু বন্ধু নয়, ভারতের স্ট্র্যাটেজিক ও ইকোনমিক পার্টনারও হয়ে উঠেছে সেটাও নানা উদাহরণ দিয়ে দেখিয়ে দেন তিনি।
মি. কৃষ্ণা বলেন, ভারতের প্রতি শেখ হাসিনা সরকারের এই দৃষ্টিভঙ্গি যে কতটা ‘সলিড’, তার প্রমাণ হলো, বছর তিনেক আগে দিল্লিতে ক্ষমতার পালাবদলের পর যখন নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে বিজেপি সরকার ক্ষমতায় আসে তারপরও সেই সম্পর্কে ক্রমাগত উন্নতি হয়েছে। অনেকে ভেবেছিলেন, কংগ্রেস বা তাদের ‘ফার্স্ট ফ্যামিলি’ গান্ধী পরিবারের সঙ্গে শেখ হাসিনার যেমন পারিবারিক ও ব্যক্তিগত ঘনিষ্ঠতা, তাতে বিজেপি ক্ষমতায় এলে দুই দেশের সম্পর্ক হোঁচট খেতে পারে। কিন্তু সেই ধারণা ভুল প্রমাণ করে দিল্লি প্রমাণ করে দিয়েছে, ঢাকার সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে সেটা কোনও ফ্যাক্টরই নয়। শেখ হাসিনা ও নরেন্দ্র মোদির মধ্যে ব্যক্তিগত সমীকরণও খুব অল্প সময়ের মধ্যে অনন্য উচ্চতায় পৌঁছেছে। ফলে সোয়া সাত বছর আগে দিল্লিতে এসে রাজধানীর এক পাঁচতারা হোটেলে যিনি চেক ইন করেছিলেন, আর এবার দিল্লির রাষ্ট্রপতি ভবনে যিনি ‘প্রিয় প্রণব দাদা’র আতিথ্য গ্রহণ করছেন দিল্লির চোখে সেই দুই শেখ হাসিনা মোটেও এক নন।
সাবেক এই পররাষ্ট্রমন্ত্রী রাখঢাক না করে বলেন, সাত বছর আগের শেখ হাসিনার কাছে ভারতের প্রধান আশা ছিল ভারতের ‘বিচ্ছিন্নতাবাদীদের’ দমনে তিনি সাহায্য করবেন। সেই প্রত্যাশা কড়ায় গন্ডায় পূর্ণ হওয়ার পর ভারতের এখন বড় চাওয়া হলো, তিনি যেন চীনের দিকে বেশি ঝুঁকে না পড়েন। তার জন্য যা যা করা দরকার, ভারত তা করার জন্যও প্রস্তুত। সাবেক এই পররাষ্ট্রমন্ত্রী কোনো কথাই গোপন রাখেননি। এতক্ষণ ধরে উপরের যেসব কথা বলা হলো, সেসব কথা তো তিনি অকপটে স্বীকার করেছেনই, অধিকন্তু নতুন দু-একটি ঘটনা তিনি যুক্ত করেছেন। সেই দু-একটি নতুন ঘটনার কারণেই ভারত প্রতিরক্ষা সম্পর্কে চুক্তি বা সমঝোতা স্মারক করার জন্য বাংলাদেশকে অ্যাপ্রোচ করেছে। বাংলাদেশ তাতে রাজি হয়ে প্রতিরক্ষা সম্পর্কিত চারটি সমঝোতা স্মারকে সই করেছে। ক’দিনের জন্য এই সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হলো? সমস্ত পত্র-পত্রিকায় এই মর্মে খবর বেরিয়েছিল যে, এই স্মারক স্বাক্ষরিত হচ্ছে ২৫ বছরের জন্য। তবে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব প্রিয়া রঙ্গনাথন বলেছেন, এটি ২৫ বছরের জন্য স্বাক্ষরিত হচ্ছে না। তবে এই স্মারকটি প্রতি পাঁচ বছর পর স্বয়ংক্রিয়ভাবেই নবায়ন হয়ে যাবে। অর্থাৎ একবার নবায়ন হলে স্বাক্ষরের মেয়াদ হবে ১০ বছর। দুবার হলে ১৫ বছর এবং তিনবার হলে ২০ বছর আর চারবার হলে ২৫ বছর। যে কারণে হঠাৎ করে প্রতিরক্ষা চুক্তি বা স্মারকের জন্য ভারত ব্যস্ত হয়ে পড়ে সেই কারণটি হলো, বিদেশের সাথে অর্থনৈতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে গণচীনের সরবে প্রবেশ এবং পরোক্ষভাবে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র নীতিতে তাদের অনুপ্রবেশ। তার বক্তব্য অনুযায়ী, এই সাত বছরের মধ্যে ভারতের বাংলাদেশকে দেখার দৃষ্টিভঙ্গিও বদলে গেছে আমূল। তার অন্যতম কারণ যদি হয় বাংলাদেশ-ভারত সহযোগিতার নতুন নতুন ক্ষেত্রের সম্প্রসারণ, তেমনি বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের ক্রমবর্ধমান মৈত্রীও ভারতকে একরকম বাধ্য করেছে বাংলাদেশকে বাড়তি গুরুত্ব দিতে।
এই দৃষ্টিভঙ্গির বদলটা ঠিক কী রকম, এক কথায় এর উত্তর দেন ভারতের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস এম কৃষ্ণা। রঞ্জন বসুকে তিনি বলেন, ‘তখন বাংলাদেশ ছিল শুধুই আমাদের ফ্রেন্ডলি নেবার (বন্ধুত্বপূর্ণ প্রতিবেশী)। কিন্তু এখন তারা ভেরি ভেরি ইম্পর্ট্যান্ট পার্টনার!’
কিন্তু এত বছর বাদে শেখ হাসিনার দিল্লি সফরের প্রাক্কালে কেন এটাকে ‘নতুন অধ্যায়’, ‘অসামান্য সম্পর্ক’ ইত্যাদি বিশেষণে ভূষিত করতে হচ্ছে? এর উত্তরে ভারতের ক‚টনীতিক মহলের মতো কৃষ্ণাও বলছেন, গত কয়েক বছরে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের ভেতর এমন কতগুলো সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে, কিছুকাল আগেও যা প্রায় অকল্পনীয় ছিল। সেগুলো অবশ্যই সম্পর্ককে বিশেষ মাত্রা দিয়েছে। কিন্তু গত বছর ঢাকায় চীনা প্রেসিডেন্টের সফর আর বাংলাদেশ নৌবাহিনীতে দুটি চীনা সাবমেরিনের সংযুক্তি ভারতকে বাংলাদেশ নিয়ে নতুন করে ভাবিয়েছে।
চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং বাংলাদেশকে যে ২৪ বিলিয়ন ডলার আর্থিক সহায়তার অঙ্গীকার করে গেছেন, তার সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার মতো আর্থিক সক্ষমতা এই মুহূর্তে ভারতের নেই। তা সত্তে¡ও সাধ্যের সর্বোচ্চ সীমায় গিয়ে দিল্লি পাঁচ বিলিয়ন ডলারের লাইন অব ক্রেডিট বাংলাদেশকে দিতে চলেছে। বাংলাদেশ নৌবাহিনীতে চীনের সাবমেরিন কমিশনড হওয়ার পর দিল্লি ঢাকাকে এটাও বোঝাতে চেষ্টার ত্রæটি রাখছে না যে, প্রতিরক্ষা খাতে তাদের সবচেয়ে স্বাভাবিক মিত্র হতে পারে ভারত, কখনই চীন নয়। এটা হতে পারে বাধ্যবাধকতার দিক।
এসব কারণে শেখ হাসিনা ভারতের কাছে আজ অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ, অনেক কাক্সিক্ষত এক নেতা, যার কাছে তাদের প্রত্যাশা বিপুল, আবার যাকে সহায়তার জন্য তারা বাড়তি মাইলটুকু হাঁটতেও সানন্দে রাজি। তবে তিস্তার পানি না পেয়ে প্রতিরক্ষা স্মারক স্বাক্ষরিত হওয়ায় ঢাকায় কি প্রতিক্রিয়া হয় সেটি দেখার জন্য রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল ব্যাকুল প্রতীক্ষা নিয়ে অপেক্ষা করছেন।
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।