মটর সাইকেল: নিউ নরমাল পরিস্থিতিতে (নতুন বাস্তবতায়)
মটরসাইকেল নিরাপদ, অধিক সুবিধাজনক, খরচ এবং সময় বাঁচায়। গণপরিবহনে একে অন্যের গা ঘেঁষে চলাচলে প্রতিদিন
সিনথিয়া পারভীন কাকলী : ও নদীরে... একটি কথা শুধাই শুধু তোমারে... বল কোথায় তোমার দেশ তোমার নেই কি চলার শেষ? এখনকার কোনো গীতিকার নদী নিয়ে আর এ ধরনের গান লিখবেন বলে মনে হয় না। তারা হয়তো বলবেন, গতিময় ¯্রােতস্বিনী তুমি থামলে কেন? তোমার নব যৌবনের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছে কত আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা। তুমি তোমার পূর্বের যৌবনে ফিরে এসো। নদী তখন অভিমান করে বলবে (যদি জীবিত থাকে) যাকে মেরে ফেলেছ তাকেই বুঝি দেখাচ্ছ পূর্ব যৌবনের প্রলোভন! তোমরা পারও বটে! কখন যে কাকে চাও নিজেরাও বুঝে উঠতে পার না। আর নদী যদি সত্যিই মরে যায় গীতিকারের এসব কথা তার কানে পৌঁছবেও না। নীরবে নিভৃতে বাংলাদেশের বিশাল বুক থেকে বিদায় নেবে একেকটি নদী।
বাংলা সাহিত্যের একটি বিরাট অংশ জুড়ে আছে নদী। নাটক, উপন্যাস, ছোটগল্প, কবিতা, গান প্রভৃতির উপাদান সংগ্রহের আকর এই নদী। বিশ্বের সাথে নদী আমাদের যোগসূত্র স্থাপন করে দিয়েছে। নদীকেন্দ্রীক সাহিত্য যতটা সফল হয়েছে অন্য কোনো বিষয় নিয়ে লেখা সাহিত্য অতটা সফল হয়েছে বলে মনে হয় না। বিখ্যাত উপন্যাসিক মানিক বন্দোপধ্যায়ের “পুতুল নাচের ইতিকথা”-এর মতো উপন্যাস থাকা সত্ত্বেও তিনি “পদ্মা নদীর মাঝি” লিখে ‘পদ্মা নদীর মাঝি’র স্বীকৃতি পেলেন। অদ্বৈত মল্ল বর্মনও তেমনি “তিতাস একটি নদীর নাম” লিখে পরিচিতি পেলেন জাওলার পোলা (জেলের সন্তান) হিসেবে। নদী গতিময় জীবন ধারার অধিকারী। আর নদীর সাথে বাংলার মানুষের জীবনেরও গতি সঞ্চার হয়েছে।
আজ কোথায় যেন গোলমাল হয়ে যাচ্ছে। বিখ্যাত নদীগুলো হারিয়ে ফেলছে তার নাব্যতা, তার পরিচয়। নামের সাথে জীবন ধারার কোথাও যেন কোনো মিল নেই। কপোতাক্ষ নদের কথাই ধরা যাক। মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত ফ্রান্সের ভার্সাই নগরীতে থেকেও বারবার এই নদীকে স্মরণ করেছেন। মায়ের স্থান দিয়েছেন। কপোতাক্ষ নদের জল এতটাই স্বচ্ছ ছিল যে কেউ নদী তীর থেকে তাকালে নদীর ভেতরটা পর্যন্ত দেখা যেত। তখন কপোতাক্ষ ছিল উন্মত্ত যৌবনা। প্রাণীদের মধ্যে কবুতরের চোখ সব থেকে স্বচ্ছ হয়ে থাকে। তাই কবুতরের চোখের সাথে সামাঞ্জস্য রেখে এর নাম দেয়া হয় কপোতাক্ষ। আজ কপোতাক্ষের স্বচ্ছ জল তো দূরের কথা তার জীবন নিয়েই টানাটানি শুরু হয়ে গেছে।
যারা মাইকেল মধুসূদনের বাংলাদেশকে চেনে তারা নিশ্চয় তার অমর কাব্য “কপোতাক্ষ নদকে”ও চেনে। কৌতূহলের বশবর্তী হয়ে যদি কোনো পর্যটক মাইকেলের সেই কপোতাক্ষ নদ দেখতে আসেন প্রথমেই কবির উপর অভিমান হবে তার। মন্তব্য হবে ‘কবির যত বাড়াবাড়ি! এই নদীকে নিয়ে এমন ঘটা করে লেখার কি আছে? কবির কবিত্ব নিয়েও প্রশ্ন উঠবে।’ দ্বিতীয় অভিমান হবে এই দেশের মানুষের প্রতি। হঠাৎ সম্বিত ফিরে পাবার মতো তিনি হয়তো বলে উঠবেন, ‘কবি মিথ্যা বলতে পারেন না। নদীর এই করুণ অবস্থার জন্য দায়ী মানুষ। এরা তাকে বাধ্য করেছে মুমূর্ষু হতে। এমন আরো অনেক নদী কপোতাক্ষের মা বলে পরিচিত ভৈরব, ভৈরব থেকেই উসরিত মুক্তেশ্বরী, হামকুমরা, মরিচাপা, বামনী, চিকনাই, হিসনা হারাতে বসেছে তাদের জীবন প্রদীপ। যশোরের ম্যাপে তো এখন বেত্রাবতীকে চিহ্নিত করা হয় মৃত নদী হিসেবে। আর ওই এলাকার মানুষ নদীটির নাম পর্যন্ত জানে না! তারা এটিকে জানে বিল-এড়োল বলে! আমাদের দেশের বিপুল জনগোষ্ঠীর একটা বড় অংশের জীবন-জীবিকা প্রত্যক্ষভাবে নদীর সাথে যুক্ত। নদী না থাকলে ব্যাঘাত ঘটবে এদের জীবন-জীবিকার। প্রাচীনকাল থেকেই এদেশের যাতায়াতের সবচেয়ে আরামদায়ক, আনন্দদায়ক ও সহজ মাধ্যম নদী। যা বহু বিদেশি পর্যটককে আকৃষ্ট করেছিল বাংলাদেশের প্রতি। শুধু আকৃষ্টই করেনি বিখ্যাতও করেছিল। তেমনি একজন নোবেল বিজয়ী বিশ্বকবি ররীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১)। তিনি জমিদারী তদারকির কাজে আসতেন বাংলাদেশে। পদ্মার উন্মত্ত জলরাশি ও মনোমুগ্ধকর আবহাওয়া তার দৃষ্টিভঙ্গিকে পরিবর্তন করে দিয়েছিল। বুদ্ধিদীপ্তিকে করেছিল আরো শাণিত। ভাবনার জগৎকে করেছিল বিস্তৃত ও অর্থবহুল। তারই ফল “গল্পগুচ্ছ”, “সোনার তরী”র ন্যায় বিখ্যাত গ্রন্থ। বললে অত্যুক্তি হবে না যে, তার বিশ্বকবি হওয়ার পিছনে বিরাট ভূমিকা ছিল আমাদের বিখ্যাত নদী পদ্মার। কে বলতে পারে এমন অবস্থা চলতে থাকলে পদ্মারও মৃত্যু হবে না?
বাংলাদেশের অর্থনীতি প্রধানত কৃষি নির্ভর। কৃষিকাজে সেচ থেকে শুরু করে ফসলকে বন্যার হাত থেকে রক্ষার জন্যও নদীর বিকল্প নেই। যেভাবে একের পর এক নদীর মৃত্যু হচ্ছে তাতে বাংলাদেশ মরুভূমি হতেও আর বেশিদিন লাগবে না। এখন বর্ষাকালে একটু বেশি বৃষ্টি হলেই দেখা দেয় বন্যা। এ কারণে প্রতিবছর লাখ লাখ মানুষ তাদের বসত-ভিটা হারাচ্ছে। যা দেশের অর্থনীতির উপর মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। শিশুকাল থেকেই শুনে আসছি, ঢাকা বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে অবস্থিত। এমন কেউ নেই যে এই ট্রানস্লিলেশনটি পড়েননি। নদীটিকে তাই দেখারও খুব আগ্রহ ছিল। দেখার পর আমার সব কৌতূহল নিবৃত হয়ে যায়। যে অভিজ্ঞতা হয় তা আর না বলাই ভালো। না দেখলেই হয়তো ভালো হতো। অন্তত বুড়িগঙ্গার এ দশা দেখতে হতো না। বুড়িগঙ্গা আজ সত্যিই বুড়ি হয়ে গেছে। দুর্গন্ধযুক্ত নোংরা বুড়ি। যার পাশ দিয়ে চলাচল করাই দায়। ঢাকা শহরের সকল নোংরা আবর্জনাকে নিজের বুকে আশ্রয় দিয়েও নিজের অস্তিত্ব নিয়ে সে চিন্তামুক্ত নয়। নদীকে আমাদের দেশের শিরা-উপশিরা বলা হয়। তাই শিরা-উপশিরারূপী এই নদীগুলো যদি প্রবাহিত না হয় আমরা তথা দেশ মাতৃকা সুস্থ থাকবে কী করে? এক সময় বলা হতো কুমিল্লার দুঃখ গোমতি। কারণ গোমতির বিশাল জলরাশি আশপাশের গ্রামগুলোকে ভাসিয়ে নিয়ে যেত। এ অঞ্চলের উন্নতির জন্য গোমতির অবদানও কম নয়। আজ গোমতি সত্যিই কুমিল্লার জন্য দুঃখের কারণ। তবে তার ¯্রােতের টানে কূল ভাসিয়ে নেয়ার জন্য নয়। নদী মারা যাওয়ার কারণে এ অঞ্চলের ফসল উৎপাদন সেচের অভাবে হুমকির সম্মুখে। নদী না থাকলে বাঙালির জীবন-জীবিকার সংকট সৃষ্টি হবে, ধ্বংস হবে জীববৈচিত্র্য। হ্রাস পাবে দেশের উৎপাদন ক্ষমতা। বড় শিল্প-কারখানাগুলো নদীকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠে। যেন কারখানার বর্জ্য অপসারণ করা সহজ ও উৎপদিত পণ্য-দ্রব্যাদি সহজে দূর-দূরান্তে পাঠানো যায়। এসব কারখানার কাঁচামাল আমদানিরও উৎকৃষ্ট মাধ্যম নদীপথ। এত সুবিধা সত্ত্বেও সর্বত্র চলছে নদী দখলের প্রতিযোগিতা। কে কতটুকু নদী ভরাট করে দখলে নিতে পারবে তার চলছে মহোৎসব। কিছু নদীকে দেখলে মনেই হয় না এগুলি কোনো সময় নদী ছিল। দখলের ফলে সেগুলি এখন নালাতে পরিণত হয়েছে। যা পার হতে কোনো মাধ্যমই আজ আর লাগে না। বাংলার সৌন্দর্য তার প্রাকৃতিক পরিবেশের জন্য। আর এ পরিবেশের সবচেয়ে বড় উপদান নদী। নদীকে উপেক্ষা করে বাংলাদেশের কোনো সৌন্দর্য কল্পনা করা যায় না। নদী সংরক্ষণে নদী বিষয়ক বিভিন্ন নীতি প্রণয়ন করা হলেও তার বাস্তবায়ন হচ্ছে না। নদীবিষয়ক আইনগুলো সময়োপযোগী করা দরকার। যেন কেউ নদী দখল করে পার না পেয়ে যেতে পারে। সরকার যথাযথ পদক্ষেপ নেয়ার ফলে আমরা একের পর এক জলসীমা জয় করে চলেছি। যার ফলে দেশের জলসীমানা বৃদ্ধি পাচ্ছে। শুধু জলসীমা বৃদ্ধি নয় আমাদের অভ্যন্তরীণ জলজ সম্পদকে রক্ষা করতে আরো কার্যকর ও যুগোপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। নদী খনন, নদী সংরক্ষণসহ নদীকে জীবিত রাখতে সকল প্রকার কার্যক্রম গ্রহণ করা এখনই প্রয়োজন। শুধু তাই নয় সর্বস্তরের মানুষকে এ কার্যক্রমের অংশ করতে হবে। জনগণকে নদীর উপকারিতা বিষয়ে সচেতন করতে হবে। কারণ আমাদের নদীগুলো বাঁচলেই বাংলাদেশ বাঁচবে।
লেখক : শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।