Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

মরণনেশায় ভাসছে সাধারণ মানুষ, ফাঁসছে না সন্ত্রাসীরা

আনোয়ারা উপকূলে ইয়াবার ছোবল

| প্রকাশের সময় : ৫ এপ্রিল, ২০১৭, ১২:০০ এএম

জাহেদুল হক, আনোয়ারা (চট্টগ্রাম) থেকে : উপকূল! এমনিতেই যন্ত্রণা বয়ে বেড়ায় উপক‚লের মানুষ। অব্যাহত নদীর ভাঙন, যখন-তখন জোয়ার পানির অঘোষিত প্লাবন, মাঝে মাঝে ঘূর্ণিবার্তা সাথে প্রবল বাতাসের ছোবল, এখানকার মানুষের পরাণ পৌঁছায় মস্তক কেশরে। পানির সাথে যুদ্ধ করেই উপক‚লের মানুষের টিকে থাকা। সর্বস্ব হারানো উপক‚লের মানুষ যখন দিশেহারা তখনই আনোয়ারা উপক‚লে মানবসৃষ্ট আরেক ঢেউয়ের আঘাত সর্বহারাদের অবশিষ্ট কিছুকে ভাসিয়ে নিয়ে তছনছ করে দিচ্ছে। ‘ইয়াবা’ই হচ্ছে চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপক‚লের মানুষের আরেক প্রলয়ংকরী ঘূর্ণি ঝড়ের নাম। এই মরণনেশা সবশ্রেণি, পেশা ও বয়সের মানুষকে অকালে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে অতল গহŸরে। সমাজে বাড়ছে অপরাধ প্রবণতা। খুনোখুনি, হত্যা, ধর্ষণসহ নানা অসামাজিক অপলাপ ও অপকর্ম। এদিকে, ইয়াবা ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করেছেন ভূমি প্রতিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ। তিনি বলেছেন, যেকোনো মূল্যে আনোয়ারা থেকে ইয়াবা নির্মূল করুন। ইয়াবার দায় আমি কখনো নেব না। সর্বনাশা এই ইয়াবা ব্যবসায় যারা জড়িত, হোক সে জনপ্রতিনিধি বা দলের কোনো নেতা, যতবড় শক্তিশালী হোক না কেন তাকে আইনের আওতায় আনুন। সেই সমস্ত অপরাধীর এলাকা থেকে বিতাড়িত করুুন। তিনি গত শুক্রবার দুপুরে উপজেলা পরিষদের আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উদ্দেশে এসব কথা বলেন। তিনি আরো বলেন, আমি মাদক ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করলাম। আপনারা নির্ভয়ে কাজ করুন। সব ধরনের সহযোগিতা আমি করে যাব। কোনো অবস্থাতেই এদের ছাড় দেয়া যাবে না। এলাকার আইনশৃঙ্খলা রক্ষার্থে নজরদারি আরো বাড়াতে হবে। আনোয়ারা উপজেলার চিহ্নিত উপক‚লীয় ইউনিয়ন রায়পুরসহ পার্শ্ববর্তী এলাকার বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে ঢুকছে সর্বনাশা ইয়াবা চালান। বিভিন্ন পয়েন্টে ৭টি সিন্ডিকেটের মাধ্যমে শতাধিক মাদক সন্ত্রাসী দ্বারা এই মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। প্রশাসন কিছুতেই এই অপতৎপরতা যেন থামাতে পারছে না। মাঝেসাজে প্রশাসনের অভিযানে ছোটখাটো চালান ধরা পড়লেও অগোচরেই থেকে যাচ্ছে এর মূল হোমরাচোমরারা। সর্বনাশা ইয়াবা সন্ত্রাসীদের টিকি পর্যন্ত যেন খুঁজে পাচ্ছে না প্রশাসন। প্রশাসনের নাকের ডগায় এসব চললেও তারা যেন ‘নাকের ডগা চোখে দেখতে পাচ্ছেন না’র মতো অবস্থা! ফলত এই অবৈধ মাদক ব্যবসা দিন দিন প্রসার লাভ করছে এবং বিরাণ করে দিচ্ছে ঐতিহ্যবাহী এই উপজেলার সুনাম, সুখ্যাতি। সবদিক থেকে ‘গেলো গেলো’ রব উঠলেও আমাদের প্রশাসন ব্যবস্থা এবং জনপ্রতিনিধিদের যেন করার কিছুই নেই; স্রেফ হতাশা ব্যক্ত করা ছাড়া! এই পরিস্থিতি প্রকট আকার ধারণ করছে দেখে আনোয়ারাকে মানুষ ইয়াবার স্বর্গরাজ্য বলে আখ্যায়িত করতে দ্বিধা করছে না। একাধিক সূত্রে জানা যায়, তল্পিবাহক প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে পার্শ্ববর্তী দেশ মিয়ানমার থেকে সহজ যোগাযোগ মাধ্যম হিসেবে নৌপথে আনোয়ারা উপক‚লের উঠান মাঝির ঘাট, ছিপাতলী ঘাট, গলাকাটার ঘাট, বার আউলিয়ার ঘাট, ছত্তার মাঝির ঘাট, নজুমিয়া খাল, দোভাষি বাজার ঘাট, ফকিরহাট, দক্ষিণ সরেঙ্গা ও পারকি সৈকতসহ বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে বানের পানির মতো দেদার ঢুকছে কোটি কোটি টাকার ইয়াবা চালান। বাঁধভাঙা জোয়ারের মতো ইয়াবা প্রবেশ করছে আনোয়ারার এই উপক‚লে। এখান থেকে দেশের অন্যান্য জায়গায় এই মরণনেশা ছড়িয়ে পড়ার পূর্বেই আনোয়ারার বিভিন্ন ইউনিয়নের পাড়ায় পাড়ায়, মহল্লায় মহল্লায় ছড়িয়ে পড়ছে। পাড়ার উঠতি ছেলেমেয়ে থেকে শুরু করে স্কুল, কলেজ পড়–য়া শিক্ষার্থী এবং বিভিন্ন বয়সের মানুষের হাতে হাতে নগদ পৌঁছে যাচ্ছে মরণনেশা ইয়াবা। এ নিয়ে সচেতন মহল খুবই সংকটে দিন কাটাচ্ছেন বলেও জানা গেছে। অনেকের সাথে আলাপকালে জানা যায়, এভাবে ইয়াবার ছড়াছড়ি চললে সামাজিক শৃঙ্খলা ক্রমেই দুর্বল হয়ে পড়বে। পরিবার, সমাজ কোথাও থাকবে না নিরাপত্তা আর সম্মান। সম্প্রতি আনোয়ারায় ইয়াবা ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ নিয়ে খুনোখুনিও হয়েছে। এই ব্যবসার আধিপত্য নিয়ে দিনকে দিন চলছে মারামারি, হানাহানি। সচেতন মহল মনে করছেন, প্রশাসন যদি এখনই এই ব্যবসা থামিয়ে দিতে ব্যর্থ হয়, তবে আনোয়ারা কেন, পুরো দেশবাসীর জন্য খারাপ কিছু অপেক্ষা করছে। যদিও প্রশাসন কিছু ছোট ছোট চালান ধরতে সক্ষম হলেও, কোটি কোটি টাকার এই ব্যবসার মূল হোতাদের কিছুই করতে পারছেন না। এই নিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সফলতা দাবি করলেও প্রকৃতঅর্থে মানুষের মনের ভয়-ক্ষোভ গুছাতে পারছে না। অভিযোগ রয়েছে, ইয়াবা ব্যবসার সাথে জড়িত সন্ত্রাসীদের নাম, পরিচয় জানা থাকলেও অদৃশ্য কারণে প্রশাসন তাদের কিছুই করতে পারছে না। রাজনৈতিক ব্যানারে থাকা ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের ছত্রছায়ায় এই ব্যবসা হচ্ছে বলে তাদের ব্যাপারে পদক্ষেপ নিতে প্রশাসন ভয় পাচ্ছেÑ এমনো অনেকের মন্তব্য। কথিত আছে, স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সাথেও রয়েছে ইয়াবা ব্যবসায়ীদের দহরম মহরম সম্পর্ক। প্রশাসনের যোগসাজশে যারা এই অবৈধ ব্যবসার সাথে জড়িত তাদের মধ্যে- নুর ছৈয়দ, সোলায়মান প্রকাশ মানু, আহমদ নবী, হরত আলী, মো. ইলিয়াছ, লিটন, আবদুল মজিদ, আবদুল আজিজ, পারবেছ, আনোয়ার, দিদারুল আলম, আবদুর রহিম, আবদুল মালেক, আবদুল জব্বার প্রকাশ ফোট্টিবদঅ, বø্যাকার আনোয়ার, মোজাহের, জালাল উদ্দিন শাহ, আবুল ফয়েজ, সুরুত ইব্রাহিম, মো. ইউসুফ প্রকাশ কালা মনু, আবুল কাসেম প্রকাশ আবুল হাছি, আলমগীর প্রকাশ দবল্ল্যা, তাজু, নজু, নুরুল ইসলাম মনু, আবু সালাম আবু, শেখ মোহাম্মদ, কামাল, আজম, সরওয়ার, নাছির (চেয়ারম্যান পুত্র), সুন্দর নাছির, বহদ্দার সেলিম, মোজাহের, ইয়াবা ব্যবসায়ী মানুর ভাই সেলিম ও ওসমান, সুন্দর মামুন, কুত্তা সেলিম, সেলিম, জসিম, আনোয়ার, মো. ওসমান, লেদু, এরফান, ইউসুফ, এরফান, মাহমুদুল হক, আবদুল হামিদসহ আরো শতাধিক ইয়াবা সন্ত্রাসী। এসব মাদক নিয়ন্ত্রণ সিন্ডিকেট সদস্যদের মধ্যে অনেকেই আনোয়ারা, পতেঙ্গা, বাকলিয়া, কোতোয়ালি ও কর্ণফুলী থানার মাদক নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলার চার্জশীটভুক্ত আসামি বলেও জানা গেছে। এরা আসামি হওয়া সত্তে¡ও নিরাপরাধির মতো প্রশাসনের চশমার সামনে চলাফেরা থেকে শুরু করে মাদক ব্যবসাও ঠিকঠাক চালিয়ে যাচ্ছে। এ নিয়ে সাধারণ মানুষের মনে ক্ষোভের সৃষ্টি হলেও প্রশাসন বলছে, এসব সন্ত্রাসীদের ধরতে তারা আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে। এরাই শুধু এর অর্থ একা ভোগ করে না, ভাগ দিতে হয় উপর মহলকেও। মূলত এই ব্যবসার অর্থ প্রভাবশালীর হাত ধরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য, জনপ্রতিনিধি, রাজনৈতিক মস্তানদের পকেটে যায়। সূত্র নিশ্চিত করে যে, এই ব্যবসার সাথে জড়িত ব্যক্তিরা এখন আঙুল ফুলে কলাগাছে পরিণত হয়েছে। যারা প্রশাসনকে ম্যানেজ করে সমাজ ধ্বংসের কর্মে লিপ্ত হয়েছে, আর প্রশাসনও যদি সেই কালো ঠুসি পড়ে নির্বিকার থাকে, তাহলে আনোয়ারার প্রতিটি জনপদ ধ্বংসস্ত‚পে পরিণত হবে বলে মনে করছেন সমাজের প্রত্যেক স্তরের সচেতন মহল। তারা আরো শংকা প্রকাশ করছেন, প্রশাসন যদি জনমানুষের বৃহত্তর কল্যাণকে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে, ইয়াবা ব্যবসায়ীদের অর্থে নিজেদের জীবনমান পরিচালনার সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন, তবে শেষপর্যন্ত প্রশাসনকে নির্বিকার এবং অকার্যকর হয়েই থাকতে হবে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ