হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির খড়গ : আসামের এনআরসি এবং বাংলাদেশ
কিশোর শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক দাবীর আন্দোলনে ঢাকাসহ সারাদেশে তীব্র রাজনৈতিক উত্তেজনা ও অনিশ্চয়তা দেখা যাচ্ছিল,
আফতাব চৌধুরী : মানুষসহ সমগ্র প্রাণীজগতের প্রতি প্রকৃতির অমূল্য অবদান অরণ্য। অরণ্যের ইংরেজি প্রতিশব্দ (ফরেস্ট)। শব্দটি মূল লাতিন ভাষার শব্দ ‘ফরেস’ থেকে এসেছে। এর অর্থ হচ্ছে ‘আউটসাইড’। এ ‘আউটসাইড’ শব্দটি গ্রামের সীমা নির্দেশ করে। যেখানে অনাবাদি জমি মনুষ্য বসতি অঞ্চলেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়। কাঠ ও অন্যান্য বনজ সম্পদ উৎপাদনের জন্য নির্দিষ্ট এক অঞ্চল হিসেবেও এতে সংজ্ঞায়িত করা যায়। সমগ্র বিশ্বের ভৌগোলিক আয়তনের এক-তৃতীয়াংশই বনাঞ্চল। বিভিন্ন প্রকারের উদ্ভিদ, ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কীটপতঙ্গ থেকে শুরু করে বৃহদাকার জীবজন্তুর আবাসভূমি এ বনাঞ্চলসমূহ। মানব সমাজকে অর্থনৈতিক দিক থেকে লাভবান হওয়ার ক্ষেত্রে নানাভাবে সহায়তা করা ছাড়াও তা পরিবেশ দূষণমুক্ত করে রাখে। উপরন্তু জলবায়ুর উপাদান যেমন উষ্ণতা, বর্ষণ, আর্দ্রতা ইত্যাদির ওপর প্রভাব বিস্তার করে অরণ্যগুলো আবহাওয়া তথা জলবায়ু বহু পরিমাণে মানব সমাজের অনুকূল করে তোলে। শুধু কি এটাই? অরণ্যরাজি পাহাড়ি অঞ্চলের পাদদেশে পানি প্রবাহের ধারাও নিরবচ্ছিন্নভাবে ধরে রাখে। বনাঞ্চলের উপকারিতার শেষ নেই। কিন্তু চরম দুর্ভাগ্যের কথা, প্রকৃতি প্রদত্ত এ অমূল্য সম্পদের সংকোচন ঘটছে দ্রুতহারে আমাদের দেশে।
জাতিসংঘের প্রকাশিত রিপোর্টে বলা হয়েছে, ১৯৯১ সালে বিভিন্ন কারণে এক কোটি সত্তর লক্ষ হেক্টর বনাঞ্চল ভূপৃষ্ঠ থেকে লুপ্ত হয়ে গেছে। সবুজভূমি, মরুভূমি, পাহাড়, পুকুর, হ্রদ, নদী, সাগর ইত্যাদির মতো বনাঞ্চল ও বাস্তুতন্ত্রও ধ্বংসযজ্ঞে সক্রিয় তথা প্রধান ভূমিকা নিয়েছে মানব সমাজ। বর্তমানে বিশ্ব ভূখন্ডের মাত্র ত্রিশ শতাংশে বনভূমি রয়েছে। বিশ্বে প্রতি বছর ১ কোটি হেক্টর ক্রান্তীয় অরণ্যভূমি ধ্বংস হয়।
যে কোনো দেশের ভৌগোলিক আয়তনের শতকরা ৩৩ শতাংশ বনাঞ্চল থাকা প্রয়োজন যদিও বাংলাদেশে আছে মাত্র ৭/৮ শতাংশ। এ পরিমাণ হ্রাস পাওয়াটা নিঃসন্দেহে চিন্তাজনক বিষয়। প্রতি ২৪ ঘণ্টায় দেশে প্রায় ১ লক্ষ গাছ ধ্বংস হয় বলে এক সমীক্ষায় প্রকাশ। যখন-তখন বনাঞ্চল সংহার করার ফলে অন্যান্য কুফলের সঙ্গে মরুভূমির সম্প্রসারণ ঘটছে। ১৯৫১ সাল থেকে ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত সময়কালে বিশাল বনাঞ্চল কেবল মানুষের লোভে ধ্বংস হয়েছে। চাষাবাদ, শিল্পায়ন, নগরায়ণ এ তিন কারণই মুখ্যত বনভূমি ধ্বংসের জন্য দায়ী। আর এক্ষেত্রে কৃষির জন্য সর্বাধিক হারে বনাঞ্চল ধ্বংস হচ্ছে। কৃষিকাজের সম্প্রসারণ বনভূমি ধ্বংসের জন্যও দায়ী।
দ্রুতহারে অরণ্যাঞ্চল কমে আসার কুফল মানব সমাজ ইতিমধ্যেই ভোগ করছে। আধুনিক মানব সভ্যতাকে গতি প্রদান করার ব্যাপারে উল্লেখযোগ্য অবদান রয়েছে বনভূমির। কিন্তু অরণ্যসমূহের প্রতি মানুষ যে অন্যায় আচরণ করছে তা একদিন মানব সভ্যতার প্রতি হুমকির সৃষ্টি করবে। বায়ুমন্ডলে অক্সিজেন ও কার্বন-ডাই-অক্সাইডের ভারসাম্য রক্ষায় বৃহৎ পরিমাণের সবুজ গাছ-গাছালি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে। ভূ-মন্ডলের উত্তাপ বৃদ্ধির জন্য দায়ী গ্রিন হাউস গ্যাস কার্বন-ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ বায়ুমন্ডলে বেড়ে গেছে। দ্রুতহারে বনানী ধ্বংস হয়ে যাওয়া এর অন্যতম কারণ। ভূ-মন্ডলের উত্তাপ বেড়ে যাওয়ার ফলে বিশ্বজুড়ে জলবায়ুর পরিবর্তন এবং এর ফলে প্রকৃতির বিভিন্ন পরিবর্তন বিজ্ঞানীমহলকে উদ্বিগ্ন করে তুলছে।
অরণ্য পরিবেশকে দূষণমুক্ত রাখতে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ কম করে তা নয়, অন্যভাবেও সহায়তা করে। প্রকাশিত দুটি তথ্যেই এর প্রমাণ মেলে। ২.৫ একর বিশিষ্ট একটি বনাঞ্চল বায়ুমন্ডলের প্রায় ৪ টন পরিমাণের ধুলো শোষণ করতে পারে। এ ছাড়া একটি ঘন অরণ্যভূমি বছরে প্রতি একর জমিকে গ্রাস করতে পারে এমন ০.১৬ টন সালফার-ডাই-অক্সাইড অপসারণে সমর্থ হয়। আমরা সবাই জানি, সালফার-ডাই-অক্সাইড এক ধরনের দূষিত গ্যাস। শব্দদূষণ রোধের ক্ষেত্রেও অরণ্যের ভ‚মিকা রয়েছে। গাছ শব্দের তীব্রতা ১০ থেকে ১৫ ডেসিবল কমাতে পারে।
ভূমিস্খলন রোধ, বৃষ্টির পানি ধরে রাখা, মরুভূমির বিস্তার রোধ, মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি, জলবায়ুর উপাদান নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে জলবায়ু, আবহাওয়া, মানুষ তথা অন্যান্য প্রাণীক‚লের অনুক‚লে রাখা ইত্যাদি বহু সুফল ছাড়াও ঔষধিগুণ বিশিষ্ট প্রায় ১০,০০০ উদ্ভিদ অরণ্যে পাওয়া যায়। গাছপালা নিধনের ফলে আমরা যে নিজেদের পায়ে নিজেরাই কুড়াল মারছি তা নিশ্চিত করেই বলা যায়।
অরণ্যঘেরা কোনও এলাকার বায়ু আর্দ্র অবস্থায় থাকে। অন্যদিকে জলীয়বাষ্পপূর্ণ বায়ুপ্রবাহের উষ্ণতা স^াভাবিকভাবেই শীতল অবস্থায় থাকা বনভূমির বায়ুর সংস্পর্শে কমে এবং এর ফলে বৃষ্টি হয়। এ প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ার ফলে স্থানীয়ভাবে বর্ষণের বিতরণেও অরণ্য প্রভাব ফেলে। বনাঞ্চল ধ্বংসের ফলে বৃষ্টির পরিমাণ কমে অনেক সময়ে খরা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। মরুভূমির বালিকণা, ঘূর্ণিঝড় অনেক দূর টেনে নিয়ে গিয়ে মরুভ‚মির সম্প্রসারণ ঘটায়। গাছগাছালি থাকলে মরুভ‚মির বিস্তারে বাধা পায়, কারণ বালিকণা আটকে থাকে গাছের লতাপাতায়। তা ছাড়া, বায়ুর আর্দ্রতা বাড়িয়ে মরুভূমির শুষ্ক অবস্থা সৃষ্টি হতে দেয় না। ফলে মরুভ‚মি বিস্তার লাভ করতে পারে না। অরণ্যের এ প্রতিরোধী বৈশিষ্ট্যের প্রতি দৃষ্টি রেখেই ভারতের একমাত্র মরুভ‚মি থর মরুভ‚মির লাগোয়া অঞ্চলে ৬৫০ কিলোমিটার দীর্ঘ ও ৮ কিলোমিটার চওড়া অঞ্চলে বৃক্ষরোপণ করে অরণ্যের সৃষ্টি করা হয়েছে। এটা এক বিরাট সাফল্য।
বাতাস ও পানির আঘাতে ভ‚মির ক্ষতি হয়। অরণ্য কিন্তু এ ক্ষতি থেকে ভ‚মিকে রক্ষা করতে পারে। আমাদের দেশে বছরে হাজার হাজার একর জমি বাতাস ও পানি দ্বারা ক্ষয়প্রাপ্ত হয়। অরণ্য ধ্বংস হওয়ার ফলেও ভ‚মির স্খলন দ্রুত ঘটছে। অন্যদিকে জুম চাষের জন্য দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলে বনাঞ্চল অনেকটা কমেছে। এতে ভ‚মিক্ষয়ের পরিমাণ বেড়েছে। দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে জুম চাষ নামে পরিচিত স্থানান্তরিত কৃষি পদ্ধতি বিশ্বের বিভিন্ন ক্রান্তীয় অঞ্চলে বিভিন্ন নামে প্রচলিত। জুম চাষের জন্য দেশে বছরে হাজারো হেক্টর বনাঞ্চল ধ্বংস হয় বলে এক সমীক্ষায় প্রকাশ। ক্রান্তীয় অরণ্যাঞ্চল ধ্বংসের ফলে প্রতিদিন লুপ্ত হচ্ছে মানব সমাজের প্রয়োজনীয় ১০০ ধরনের মূল্যবান বনজ সম্পদ।
বনাঞ্চল ধ্বংসের ফলে বনজ জীবজন্তুর আবাসভ‚মির অভাব ঘটছে এবং অনেক বন্য জীবজন্তু খাদ্যাভাব বা অন্যান্য কারণে মৃত্যুমুখে পতিত হওয়া ছাড়াও জনবসতিগুলোতে তারা বেরিয়ে আসার ফলে অনেক মূল্যবান মানব জীবনেরও পরিসমাপ্তি ঘটছে। হাতি, বাঘের উপদ্রবের খবরও মাঝেমধ্যে সংবাদপত্রের শিরোনামে আসে। অরণ্যভূমি ধ্বংসের অন্যতম কুফল এটা।
বনাঞ্চলের উপকারিতার প্রতি লক্ষ্য রেখে এর সংরক্ষণ তথা রক্ষণাবেক্ষণের ওপর বর্তমানে যথেষ্ট সরকারি, বেসরকারি এমনকি সামাজিক ও ব্যক্তি পর্যায়েও গুরুত্ব প্রদান করা হচ্ছে। বনানীকরণ ও পুনর্বনানীকরণের ওপরও জোর দেওয়া প্রয়োজন। সামাজিক বনানীকরণ কর্মসূচি ক’বছর আগে শুরু করেছিল সরকার। অ্যাগ্রো ফরেস্ট্রি প্রোগ্রামে এক টুকরো জমিতে চাষাবাদ, গাছ লাগানো ইত্যাদি করা হয়। এক্ষেত্রে লক্ষ্য রাখতে হবে, যাতে পতিত জমির সদ্ব্যবহার হয়। এর ফলে চাষিরা শস্য ছাড়াও পশুখাদ্য, জ্বালানি হিসেবে খড়ি, ফলমূল ও কাঠ পায়।
পর্যাপ্ত বনভূমি থাকার পরও প্রতিবেশী দেশ ভারত, মিয়ানমার, নেপাল, ভুটান, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম তাদের নিজ নিজ দেশের বনাঞ্চলকে সম্প্রসারিত করার প্রয়াস অব্যাহত রেখেছে। এ সকল দেশে সামাজিক বনানীকরণ বিভাগ অ্যাগ্রো ফরেস্ট্রি, কমিউনিটি ফরেস্ট্রি, কমার্শিয়াল ফরেস্ট্রি এবং আরবান ফরেস্ট্রিসহ বিভিন্ন কর্মসূচি হাতে নেয়া হয়েছে। অরণ্য সমূহের ওপর মানব সমাজের বিভিন্ন কারণে প্রয়োগ করা চাপ কম করাটা সামাজিক বনানীকরণের মুখ্য উদ্দেশ্য। বনাঞ্চলগুলোর নিবাসী মূল্যবান বন্যপ্রাণীগুলোর সংরক্ষণের জন্যও প্রণয়ন করা হয়েছে নানা কর্মসূচি। ভারত সম্ভবত বিশ্বের প্রথম রাষ্ট্র যেখানে ওয়াইল্ড লাইফ প্রোটেকশন অ্যাক্ট ১৯৭২ প্রণয়ন করা হয়। বিভিন্ন আইন প্রণয়ন ও কর্মসূচির মাধ্যমে সেখানে বন্যপ্রাণী রক্ষণাবেক্ষণে গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। প্রোজেক্ট টাইগারের জন্য কুড়িটি জাতীয় উদ্যান ও অভয়ারণ্য বাছাই করা হয়েছে। বন্য জন্তুগুলোর প্রাকৃতিক আবাসভ‚মি অরণ্যসমূহের সংরক্ষণে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। বন সংরক্ষণের ক্ষেত্রে জনসাধারণের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টির উদ্দেশ্যেই বছরব্যাপী বন মহোৎসবের আয়োজন করা হয়ে থাকে ভারতসহ অন্যান্য দেশে।
প্রাসঙ্গিকভাবে আমি এখানে ক’টি উদাহরণ উপস্থাপন করতে চাই, আশা করি পাঠকমহল অনুধাবন করতে সক্ষম হবেন যে, সততা, একাগ্রতা, আন্তরিকতা থাকলে যে কোনো মহৎ কাজে সাধারণ মানুষের সহযোগিতা পাওয়া যায় এবং এতে সফলতা আসে- যেমন ২০১৬ সালের ২ সেপ্টেম্বর রংপুর জেলার তৎকালীন জেলা প্রশাসক রাহাত আনোয়ারের (বর্তমান সিলেটের জেলা প্রশাসক) নেতৃত্বে ‘সবুজ তারাগঞ্জ গড়ি’ কর্ম পরিকল্পনার আওতায় ১৩৫টি রাস্তায় সকাল ৭টা থেকে ৮টার মধ্যে মাত্র ১ ঘণ্টা সময়ে আড়াই লাখ গাছের চারা রোপণ করে নতুন রেকর্ড সৃষ্টি করেছেন। উপজেলার ৫টি ইউনিয়নের ৪৫টি ওয়ার্ডের স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসার শিক্ষক-শিক্ষার্থী, জনপ্রতিনিধি, ইমাম, সাংবাদিক, রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী, কৃষকসহ বিভিন্ন পেশার ৩৫ হাজার মানুষ ৪৬০ কিলোমিটার রাস্তার উভয় পাশে আম, জাম, কাঁঠাল, পেয়ারা, আমলকী, মেহগনি, বকুল, কৃষ্ণচূড়া, রাঁধাচ‚ড়াসহ ৪০ প্রজাতির ফল, ফুল, বনজ ও ঔষধি গাছের চারা রোপণ করে। চারা গাছ রোপণের এ মহৎ কাজে যারা অংশগ্রহণ করেন তাদের প্রত্যেকেই রোপিত গাছের চারা বাঁচিয়ে রাখার প্রতিশ্রæতি প্রদান করে উপস্থিত জন সমাবেশে।
জেলা প্রশাসক রাহাত আনোয়ারের মহৎ এ উদ্যোগ সকল মহলে প্রশংসিত হয়। জেলার অনেকেই বৃক্ষ রোপণের মতো মহৎ কাজে আগ্রহী হয়ে গাছের চারা রোপণে এগিয়ে আসে এবং অনেক সরকারি-বেসরকারি সংস্থা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সামাজিক সংগঠন এমনকি ব্যক্তি পর্যায়েও অনেকেই গাছের চারা রোপণ করে তা রক্ষণাবেক্ষণের ব্যবস্থা করে। জেলা প্রশাসক রাহাত আনোয়ার তার সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে বলেন, বৃক্ষরোপণ করে রক্ষণাবেক্ষণের মাধ্যমে তা বাঁচিয়ে রাখা এবং বনাঞ্চল সৃষ্টি করা এক মহৎ কাজ। তিনি এও বলেন যে, সমাজের সকল স্তরের মানুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় যে কোনো মহৎ কাজে সফলতা আসেই। আমাদের সকলের ঐকান্তিক প্রয়াসে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে আন্তরিকতার সাথে যদি আমরা বৃক্ষরোপণ করে রক্ষণাবেক্ষণ করি তাহলে এদেশকে সবুজে সমৃদ্ধ করা কোনো কঠিন কাজ নয় এবং এটাই হবে সবচেয়ে মহৎ কাজ, যা প্রাণীক‚লের বেঁচে থাকার জন্য একান্তই প্রয়োজন।
আমাদের পার্শ্ববর্তী ছোট্ট পাহাড়ি দেশ ভুটানের দিকে তাকাই। এদেশের জনসংখ্যা মাত্র ৩ লাখের মতো। ভুটানের রাজা জিগমে খেসর পিয়াল ও রানী জেটসুন প্রেমার ঘরে জন্ম নিয়েছে প্রথম সন্তান। এ উপলক্ষে দেশের জনগণ এক ব্যতিক্রমধর্মী উদ্যোগ নিয়েছে। রাজপুত্রের জন্ম উপলক্ষে বিভিন্ন প্রজাতির বিশেষ করে ফলজ ১ লক্ষ আট হাজার গাছের চারা একদিনে রোপণ করেছে দেশের জনগণ দেশের বিভিন্ন স্থানে। গত ৫ ফেব্রুয়ারি রাজা খেসর রানী প্রেমা তাদের প্রথম সন্তান জন্ম হওয়ার ঘোষণা দেন। প্রতিটি গাছে নবজাতকের জন্য এক একটি প্রার্থনা সেঁটে দেওয়া ছিল। দীর্ঘায়ু, সুন্দর সহানুভূতির প্রতীক গাছকে বৌদ্ধ ধর্মে পবিত্র হিসেবে গণ্য করা হয়। গাছের চারা রোপণের ক্ষেত্রে ১ লক্ষ ৮ হাজার সংখ্যাটিই মানা হয়েছিল। কেননা বৌদ্ধরা ১০৮ সংখ্যাটি পবিত্র বলে মনে করে। ৮২ হাজার পরিবার ১টি করে গাছের চারা রোপণ করেছে। গাছের চারা রোপণ করে তারা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয় যে, রোপিত গাছের প্রতিটি চারা রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচর্যা করে বড় করে তুলবে। এতে ছোট দেশ ভুটান আরও সমৃদ্ধশালী হবে। এর আগের বছর এক ঘণ্টায় ৫৯ হাজার ৬৭২টি গাছের চারা রোপণ করে বিশ্ব রেকর্ড সৃষ্টি করেছিল এ ভূটানিরাই। উল্লেখ্য, ভুটান ছোট দেশ হলেও ফলজ ও বনজ সম্পদে সমৃদ্ধ। তাদের দেশের প্রতিটি মানুষই দেশপ্রেমিক, রাজাভক্ত এবং দেশের প্রচলিত আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ল্যাবি এইচ এবং বাংলাদেশের বিজ্ঞানী ড. ডাব্লিউ জামান বাংলাদেশের বন ও পরিবেশ নিয়ে এক গবেষণা করে জানিয়েছেন, দেশের সড়ক, রেলপথ, নদী, খালের দুই পাশে চা বাগানের পরিত্যক্ত ভূমি এবং টিলা পাহাড়ে পরিকল্পিতভাবে ১২০ কোটি ফলদ বৃক্ষ লাগিয়ে ১০ বছরে মাত্র ফল ও পুষ্টি ঘাটতি পূরণ করা খুবই সহজ। এতে ৫০ লক্ষ মানুষের কর্মসংস্থান হবে এই সঙ্গে ৫০-৬০ লক্ষ টন ফল বিদেশে রপ্তানি করা যাবে। পশুপাখির আগমন বাড়বে, সুন্দর হবে পরিবেশ, অক্সিজেনের সরবরাহ বৃদ্ধি পাবে, দেশ হবে সমৃদ্ধশালী। আমাদের সরকারের নীতিনির্ধারকরা এ ব্যাপারে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে আন্তরিকতার সাথে এগিয়ে আসলে এ কাজে সফলতা খুব কঠিন ব্যাপার নয়।
যে কোনো প্রকল্পের সফল রূপায়ণের জন্য জনগণের সহযোগিতা জরুরি। সে^চ্ছাসেবী সংগঠনগুলোকে জনগণের সঙ্গে হাত মিলিয়ে কাজ করতে হবে। ব্যক্তিস^ার্থ পূরণের লক্ষ্যে বনধ্বংসে লিপ্ত দুর্নীতিগ্রস্ত লোকের বিরুদ্ধে জনসাধারণের প্রতিবাদী কণ্ঠ সোচ্চার হতে হবে। সরকারকেও এ ব্যাপারে কঠোর হতে হবে। মনে রাখতে হবে, মূল্যবান একগুচ্ছ গাছ ধ্বংস করতে বেশি সময় লাগে না, কিন্তু সে গাছ গজিয়ে উঠতে অনেক সময়ের প্রয়োজন হয়।
লেখক : সাংবাদিক-কলামিস্ট। বৃক্ষ রোপণে জাতীয় পুরস্কার (১ম স্বর্ণপদক) প্রাপ্ত।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।