Inqilab Logo

সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

গণতান্ত্রিক রাজনীতি ও দুর্নীতিমুক্ত পরিবেশ জঙ্গিবাদের মূল প্রতিরোধক

উপ-সম্পাদকীয়

| প্রকাশের সময় : ২৯ মার্চ, ২০১৭, ১২:০০ এএম

জামালউদ্দিন বারী : বাংলাদেশের জাতীয় ক্রিকেট দল শ্রীলঙ্কায় তাদের শততম টেস্ট ম্যাচকে বিজয়ের মধ্য দিয়ে স্মরণীয় করে রাখার তিন দিন পর ডাম্বুলায় ২৫ মার্চ সিরিজের প্রথম ওয়ানডে ম্যাচটিও ৯০ রানের ব্যবধানে জিতে স্মরণীয় করে রাখতে সক্ষম হয়েছে। দেশে দীর্ঘদিন ধরে একটি গুমোট, হতাশাজনক রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক পরিবেশের মধ্যে দেশের তরুণ সমাজ যখন অনেকটা হাঁপিয়ে উঠেছিল, তখন ক্রিকেট বিশ্বে বাংলাদেশের চেয়ে অগ্রসর ও অভিজ্ঞ শ্রীলঙ্কার সাথে তাদের মাঠে পর পর দুটি গৌরবজনক সাফল্য দেশের ক্রিকেটপ্রেমীদের আশান্বিত, আনন্দিত-আমোদিত করেছে। বলাবাহুল্য, দেশের ক্রিকেট দলের যে কোনো আন্তর্জাতিক ম্যাচের প্রতি উৎসাহী ও সচেতন দৃষ্টি থাকে দেশের বেশির ভাগ মানুষের। স্যাটেলাইট টিভি ও ইন্টারনেটের কল্যাণে এসব ম্যাচ সরাসরি দেখার সুযোগও কেউ মিস করতে চান না। দেশের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক নানা ব্যর্থতা-হতাশার মধ্যে ক্রিকেটে একটা বিজয়ের মাইলফলক নিয়ে তরুণ প্রজন্ম ও গণমাধ্যম যখন বিভোর, কেউ কেউ এই বিজয়কে এবারের ২৬ শে মার্চে ৪৬তম স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে জাতীয় ক্রিকেট দল বা টিম টাইগার্সের অমূল্য উপহার হিসেবে বিবেচনা করেছেন। ৪৬তম স্বাধীনতা দিবস এবং ২৫ শে মার্চের গণহত্যা দিবসের প্রাক্কালে একদিকে ঢাকায় বাংলাদেশ ব্যাংকের তিরিশতলা ভবনের ১৩ ও ১৪ তলায় এক রহস্যময় অগ্নিকান্ড সংঘটিত হয়েছে। অন্যদিকে সিলেটের দক্ষিণ সুরমার শিববাড়ী এলাকায় আতিয়া মহলে চাঞ্চল্যকর জঙ্গিবিরোধী যৌথ অভিযানে নামে পুলিশ, র‌্যাব ও সেনাবাহিনীর প্যারা কমান্ডো টিমের সদস্যরা। যৌথবাহিনী এরই মধ্যে উক্ত আতিয়া মহল থেকে অন্তত ৭৮ জন বাসিন্দাকে নিরাপদে সরিয়ে আনতে সক্ষম হলেও ইতোমধ্যে পুলিশের দুজন পুলিশ কর্মকর্তা, অন্তত ৪ জন সন্দেহভাজন জঙ্গি নিহত হয়েছেন এবং র‌্যাবের গোয়েন্দা বিভাগের লে. ক. আবুল কালাম আজাদকে গুরুতর আহত অবস্থায় উন্নত চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুরে নেয়া হয়েছে। এ ছাড়া অভিযান চলাকালে আরো অন্তত অর্ধশত মানুষ আহত হয়েছেন বলে গণমাধ্যমে প্রকাশিত রিপোর্টে জানা যায়। চব্বিশ মার্চ থেকে শুরু হওয়া এই জঙ্গিবিরোধী অভিযান এই নিবন্ধ লেখা পর্যন্ত চার দিন অতিক্রম করেছে। আতিয়া মহল ভবনটিকে সন্দেহভাজন ও তালিকাভুক্ত শীর্ষ জঙ্গিরা আস্তানা হিসেবে ব্যবহার করছিল এবং পুরো ভবনটিকে ইম্প্রোভাইজড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস (আইইউডি) দিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ করে তোলা হয়েছে বলে সেনা কমান্ডোদের কাছে প্রতীয়মান হওয়ায় অভিযান চালাতে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করতে হচ্ছে। ভেতরে আটকে থাকা জঙ্গিরা শেষ পর্যন্ত বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ভবনটি উড়িয়ে দিতে পারে, এই আশঙ্কার কারণেই কবে নাগাদ অভিযান শেষ হবে গত সোমবার পর্যন্ত তা জানাতে পারেননি সংশ্লিষ্টরা। অভিযানের সময় দক্ষিণ সুরমার শিববাড়ী এলাকার কথিত জঙ্গি আস্তানার আশপাশের দুই কিলোমিটার এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করে সেখানকার স্বাভাবিক  জীবনযাত্রা নিয়ন্ত্রিত করা হচ্ছে।
দেশের মানুষ বিশেষত ফেসবুক প্রজন্মের কোটি কোটি সদস্য যখন একদিকে ক্রিকেট দলের স্মরণীয় বিজয় এবং মহান স্বাধীনতা দিবসের বৈচিত্র্যময় পোস্ট-স্ট্যাটাস নিয়ে ব্যস্ত, তখন বিদেশি গণমাধ্যমে বাংলাদেশে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ চুরিতে ব্যাংকের অভ্যন্তরের কিছু ব্যক্তির জড়িত থাকা সম্পর্কিত একটি ইনভেস্টিগেটিভ রিপোর্ট প্রকাশ করেছিল। এই রিপোর্ট প্রকাশের কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই রাতের অন্ধকারে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনলাইন ও রিজার্ভ সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ শাখায় আগুন লাগার ঘটনা নানা ধরনের সন্দেহ ও জল্পনার জন্ম দিয়েছে। ঠিক একই সময়ে সিলেটে জঙ্গি আস্তানায় অভিযান পরিচালনায় সেনা নিয়োগ এবং দুই থানার ওসি নিহত হওয়াসহ ঘটনার ভয়াবহতায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকে আগুন লাগার রহস্যজনক ঘটনাটি পাবলিক সেন্টিমেন্টে রেখাপাত করতে দেয়নি। একটি অপ্রত্যাশিত গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা আরেকটি অপেক্ষাকৃত ভয়ঙ্কর ও উদ্বেগ সৃষ্টিকারী ঘটনার নিচে চাপা পড়ে যাওয়ার নজির সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশে অনেকটা সাধারণ ও অবধারিত বিষয় হয়ে উঠেছে। কাকতালীয় অথবা ঘটনার পারস্পরিক যোগসূত্র এবং পলিটিক্যাল মোটিফ নিয়ে জনমনে উঠে আসা নানা প্রশ্ন ও সন্দেহ কখনো দূর হয় না। একটি ঘটনার নিচে আরেকটি ঘটনা ধামাচাপা পড়ে যায়। গত বছরের ফেব্রæয়ারিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনা সংঘটিত হওয়ার পরও কেউ তা জানতে পারেনি। বিদেশি পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশিত না হলে এ ঘটনাটি হয়তো দেশের মানুষ জানতেও পারত না। যাই হোক, দেশে জানাজানি ও কিছুটা হৈচৈ’র মধ্যে রিজার্ভ চুরির ঘটনা কীভাবে হয়েছিল, এর সাথে কারা জড়িত ইত্যাদি রহস্য ভেদ করতে একাধিক তদন্ত কমিটিও হয়েছিল। তদন্ত কমিটিগুলো সরকারের সংশ্লিষ্টদের কাছে তদন্ত রিপোর্টও জমা দিয়েছে। তবে অদ্যাবধি সে রিপোর্ট আলোর মুখ দেখেনি। বছর পেরিয়ে যাওয়ার পর বিদেশি মিডিয়া যখন রিপোর্ট প্রকাশ করল যে, বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ হ্যাকিংয়ের সাথে এর অভ্যন্তরের ব্যক্তিরা জড়িত ঠিক তখনই সেখানে অগ্নিকান্ড হলো। অর্থাৎ রিজার্ভ চুরির দায়ে সন্দেহভাজনরাই এই অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটিয়ে থাকতে পারে বলে সাধারণ মানুষের ধারণা। গত কয়েক দিনে সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রকাশিত নানা রকম মন্তব্য থেকে এ ধারণা পাওয়া যাচ্ছে। যথারীতি এই অগ্নিকান্ডের রহস্য ভেদ করতেও একাধিক তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে। তাৎক্ষণিকভাবে প্রকাশিত একটি রিপোর্টে ইলেক্ট্রিক ক্যাটলি থেকে অগ্নিকান্ড ঘটেছে বলে জানা গেছে। অতএব কথিত এই ইলেক্ট্রিক কেটলিটাকে একজন রোবটিক আত্মঘাতী জঙ্গি সন্ত্রাসী হিসেবে আখ্যা দেয়া যেতে পারে কি?
সরকারের পক্ষ থেকে আগেই স্বাধীনতার মাস মার্চে দেশে জঙ্গিবাদীদের তৎপরতা বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছিল। এরপর মাসের শুরু থেকেই একে একে চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডে, ঢাকার আশকোনায় র‌্যাব অফিসের অভ্যন্তরে, ঢাকা বিমানবন্দরের কাছে, খিলগাঁও র‌্যাব চেকপোস্টের কাছে সন্দেহভাজন জঙ্গিরা আত্মঘাতী হামলা চালানোর আগেই আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর গুলিতে অথবা নিজেদের বহন করা বিস্ফোরকে নিহত হয়েছে। সর্বশেষ সিলেটের দক্ষিণ সুরমার শিববাড়ী আতিয়া মহলে জঙ্গি আস্তানায় সেনা কমান্ডো অভিযানের শ্বাসরুদ্ধকর ঘটনাবলির প্রতি পুরো জাতির দৃষ্টি ও মনোযোগ নিবদ্ধ হয়েছে। গুলশানের হলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলার পর রাজধানীর কল্যাণপুরে এবং নারায়ণগঞ্জের পাইকপাড়ায় অনুরূপ জঙ্গি আস্তানায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানের শ্বাসরুদ্ধকর অভিযানের দৃশ্য জাতি দেখেছে। সেই সাথে এসব অভিযানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুলিতে আস্তানার সব জঙ্গির মৃত্যুসহ আনুষঙ্গিক ঘটনাবলীর পারস্পর্য নিয়ে যেসব অভিযোগ ও সন্দেহ গণমাধ্যম ও সোশ্যাল মিডিয়ায় উঠে এসেছে তা কখনো অপনোদন হয়নি। বিশেষত সন্দেহভাজন জঙ্গিদের প্রায় সকলেও নিহত হওয়ার কারণে এসব জঙ্গি তৎপরতার সাথে মূলত কারা জড়িত, তাদের পৃষ্ঠপোষক কারা, অস্ত্র ও বিস্ফোরক আসছে কোথা থেকে ইত্যাদি প্রশ্নের কোনো সদুত্তর পাওয়া যায়নি। অন্যদিকে সরকার এবং বিরোধী দল বরাবরই জঙ্গিবাদী তৎপরতা নিয়ে ব্লেইম গেমে লিপ্ত হচ্ছে। অন্যদিকে সেই ২০১৫ সালে ঢাকা ও রংপুরে তাবেলা সিজার ও হোসি কোনিও হত্যার পর থেকেই বাংলাদেশে বিভিন্ন নাশকতার ঘটনাকে একটি আন্তর্জাতিক চক্র আইএসের হামলা বলে প্রচার চালিয়ে যাচ্ছে। আইএসসহ আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ নিয়ে কাজ করা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সাইট ইন্টেলিজেন্স এবং আইএসের মুখপত্র বলে পরিচিত আমাক নিউজে এসব প্রায় প্রতিটি ঘটনায় আইএস সংশ্লিষ্টতার দাবি করা হয়েছে। বাংলাদেশের পুলিশ-র‌্যাব বরাবরই দেশে আইএসের নেটওয়ার্ক নেই বলে দাবি করলেও সন্দেহভাজনদের ধরে বিচারের সম্মুখীন করতে না পারায় দুই পক্ষের দাবির সত্যাসত্য কখনো প্রমাণিত হয়নি। এসব ঘটনার সাথে আইএস জড়িত থাক বা না থাক, জঙ্গিবাদী তৎপরতার প্রাথমিক লক্ষ্য অর্জনে তারা যথেষ্ট সফল। এই লক্ষ্য হচ্ছে দেশে ও জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি করা, দেশের বিনিয়োগ ও অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি করা এবং রাজনৈতিক  ব্লেইম গেমের সুযোগ সৃষ্টির মধ্য দিয়ে সামাজিক-রাজনৈতিক বিভাজন স্থায়ী রূপ দিয়ে দেশকে ভেতর থেকে দুর্বল করে রাখা। আন্তর্জাতিক পক্ষটির দাবি অনুসারে এসব নাশকতার ঘটনাকে মধ্যপ্রাচ্যের জঙ্গি সংগঠন আইএসের কাজ হিসেবে প্রমাণ করতে পারলে বাংলাদেশকে ওয়ার অন টেররিজমের সাথে সম্পৃক্ত করার লক্ষ্য অর্জিত হতে পারে। বাংলাদেশের সরকার এবং জনগণ সেই সন্ত্রাসবিরোধী বিশ্বসন্ত্রাসীদের হাতে জিম্মি হতে চায় না। তবে এ ক্ষেত্রে জনগণের সচেতন হওয়া ছাড়া আর কিছু করার না থাকলেও সরকারের দায়িত্ব বিশাল। সরকারের সবচেয়ে বড় দায়িত্ব হচ্ছে দলমত নির্বিশেষে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ রাখা এবং ঐক্যবদ্ধভাবে জঙ্গিবাদী সন্ত্রাসের আন্তর্জাতিক হুমকি মোকাবেলা করা। বিশ্বজুড়ে জঙ্গি তৎপরতার পেছনে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও ভ‚রাজনৈতিক কারণ বিদ্যমান রয়েছে। বাংলাদেশ তার বাইরে নয়। পশ্চিমা বিশ্ব সর্বাধুনিক প্রতিরক্ষা প্রযুক্তি শত শত বিলিয়ন বাজেট এবং প্রতিরক্ষা বাহিনীকে সফিসটিকেটেড ওয়েপনস সজ্জিত করেও জঙ্গিবাদ নির্মূল করতে পারছে না। শুধুমাত্র শক্তি দিয়ে এই সমস্যার সমাধান হয়তো সম্ভব নয়। এর জন্য দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মসূচি গ্রহণ করার প্রয়োজনীয়তা থাকলেও আমাদের সরকার এবং রাজনৈতিক শক্তিগুলো একদিকে সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক তৎপরতা চালিয়ে জাতিকে বিভক্ত করছে, অন্যদিকে শুধুমাত্র সরকারি বাহিনীর অ্যামুনিশন ব্যবহার করে সবকিছু নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছেন। এসব তৎপরতা দিন দিন কাউন্টার প্রোডাক্টিভ হয়ে দেখা দিচ্ছে।
জঙ্গিবাদী তৎপরতা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে দেশের রাজনীতিবিদ ও নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের অনেকে একে দেশের বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্র বলে অভিহিত করে এই সংকট নিরসনে জাতীয়ভাবে রাজনৈতিক ঐক্য গড়ে তোলার ওপর জোর দিয়েছেন। অন্যদিকে রাজনৈতিক শিবিরের দুই প্রধান শক্তি আওয়ামী লীগ ও বিএনপি জঙ্গিবাদ নিয়ে বরাবরের মতো  ব্লেইম গেমে মেতে আছে। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, বিএনপি জঙ্গিবাদের প্রধান পৃষ্ঠপোষক, আর বিএনপি বলছে সরকারই জঙ্গিবাদকে পৃষ্ঠপোষকতা করছে এবং জঙ্গি বিরোধি তৎপরতাকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করছে। দক্ষিণ সুরমার শিববাড়ী পাঠানপাড়ায় অভিযান চলাকালে আতিয়া মহল থেকে ২০০ গজ দূরে একটি আত্মঘাতী বোমা হামলায় দুই ছাত্রলীগ কর্মী, পুলিশ কর্মকর্তাসহ চারজন নিহত এবং অন্তত ৪০ জন আহত হয়েছেন বলে খবর পাওয়া যায়। দুই ছাত্রলীগ কর্মীর মধ্যে একজন দক্ষিণ সুরমার আওয়ামী লীগ নেতা আওলাদ মিয়ার ছেলে অহিদুল ইসলাম অপুর (২৫) পরিচয় পাওয়া গেলেও অন্যজনের পরিচয় তাৎক্ষণিকভাবে জানাতে পারেনি পৃুলিশ। এর মানে কি এই যে আত্মঘাতী হামলা ছাত্রলীগ চালিয়েছে? রাজনৈতিক   ব্লেইম গেমে এমন অভিযোগ আসলেও আসতে পারে তবে জঙ্গিবাদের মতো একটি জটিল সমীকরণে সরকার বা বিরোধী দলের কাছ থেকে কোনো তদন্ত ছাড়াই এমন কোনো সরলিকৃত অভিযোগ কাম্য নয়। তবে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদের দাবি হচ্ছে, দেশে জঙ্গিবাদসহ সব অপরাধের জন্ম দিচ্ছে প্রশাসনিক-অর্থনৈতিক দুর্নীতি। ব্যাংকিং চ্যানেলে জঙ্গিবাদের অর্থায়নেরও অভিযোগ তুলেছেন তিনি। স্বাধীনতা দিবসের সকালে দুর্নীতি প্রতিরোধ সপ্তাহের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনকালে দুদক চেয়ারম্যান এ বক্তব্য দেন। অন্যদিকে দেশে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের চরম অবক্ষয়, সহাবস্থানের রাজনীতির নির্বাসন এবং সর্বক্ষেত্রে একতরফা ও ভোটারবিহীন নির্বাচন বা গণতন্ত্রহীনতাকেও জঙ্গিবাদের উত্থানের অন্যতম কারণ বলে মনে করছেন রাজনীতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা। দেশবাসী এখনো জানে না কারা, কেন কীভাবে জঙ্গিবাদী সহিংসতা চালাচ্ছে। দেশ এখনো স্পষ্টত বিভাজিত। বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থেও সরকার এবং বিরোধীদলীয় জোটের মধ্যে সংলাপ-সমঝোতার মনোভাব না থাকা ও অসহিষ্ণুতার পরিবেশকে তৃতীয় একটি পক্ষ সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করে দেশকে জঙ্গিবাদের দিকে ঠেলে দিতে চাইছে কিনা সেটা সরকারকেই খুঁজে বের করতে হবে। জঙ্গিবাদ নিয়ে রাজনীতি বা  ব্লেইম গেমের বালখিল্যতা সকলকে পরিহার করতে হবে।  স্বাধীনতা দিবসে জাতীয় শিশু-কিশোর সমাবেশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিপথগামীদের সৎপথে ফিরে আসার আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, সরকার তাদের জীবন-জীবিকার জন্য সব কিছু করবে। বক্তৃতায় আরো বলেছেন, ইসলাম শান্তির ধর্ম, আত্মঘাতী হওয়া মহাপাপ, গোনাহর কাজ। শিক্ষার্থীরা যেন জঙ্গিবাদে জড়িয়ে না পড়ে সেদিকে নজর দেয়ার তাগিদ দিয়েছেন। অন্যদিকে দুদক চেয়ারম্যান বলেছেন, আমাদের সন্তানদের দুর্নীতিমুক্ত পরিবেশে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে তাদের মূল্যবোধকে জাগিয়ে তুলতে পারলে জঙ্গিবাদসহ অনেক অপরাধই নির্মূল করা সম্ভব। প্রধানমন্ত্রী এবং দুদক চেয়ারম্যানের বক্তব্যে জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাসসহ দেশের ক্রমবর্ধমান অপরাধ প্রবণতার গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক মনস্তাত্তি¡ক দিকগুলোর অনেকটাই বেরিয়ে এসেছে। যে বিষয়টি আলোচিত হয়নি, তা হচ্ছে রাজনৈতিক সমঝোতা, সহিষ্ণুতা ও সহাবস্থানের সংস্কৃতি ফিরিয়ে আনার প্রয়োজনীয়তা।
মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপ আমেরিকাসহ পশ্চিমা বিশ্ব প্রকারান্তরে নিজেদের সৃষ্ট জঙ্গিবাদী ছোবলে জজর্রিত হচ্ছে। বিশেষত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের ভুল মধ্যপ্রাচ্য নীতির কারণে সেখানে আইএসের মতো জঙ্গি গ্রুপের উত্থান ঘটেছে। লেজকাটা শেয়ালের মতো পশ্চিমারা বাংলাদেশকেও আইএস জঙ্গির হুমকির মধ্যে দেখতে চায়? নিদেনপক্ষে বাংলাদেশের স্বীকারোক্তি আদায় করতে চায়। তাহলে বাংলাদেশে তাদের হস্তক্ষেপ সামরিক উপস্থিতি সম্ভব হতে পারে বলে তারা হয়তো মনে করছে। দেশে আইএস থাক বা না থাক সরকারের জঙ্গিবিরোধী তৎপরতা সম্পর্কে ইতোমধ্যে দেশে যে ধূম্রজাল সৃষ্টি হয়েছে আগে তা খোলাশা করতে হবে। পাশাপাশি গুম, খুন ও বিচারবহিভর্‚ত হত্যাকান্ড বন্ধ করে জননিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে তুলে নেয়ার পর নিরুদ্দেশ হওয়া ব্যক্তিরাও জঙ্গিবাদী নাশকতার সন্দেহভাজন হিসেবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাথে কথিত বন্দুকযুদ্ধ অথবা আত্মঘাতী বিস্ফোরণে মারা যাওয়ার অভিযোগ উঠেছে। এসব ঘটনা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জঙ্গিবিরোধী জিরো টলারেন্স নীতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। আর বিরোধী দল বলছে, সরকার জঙ্গিবাদকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। সরকারের কোনো কোনো মন্ত্রী বলছেন, জঙ্গিবাদ নির্বাচনের পরিবেশ নস্যাৎ করতে পারে। অতএব জঙ্গিবাদ গণতন্ত্রেরও বড় শত্রু হিসেবে দেখা দিতে পারে। লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে আমাদের রাষ্ট্রীয় সংবিধান জনগণকে রাষ্ট্রের মালিক হিসেবে ঘোষণা করেছে। অবাধ, নিরপেক্ষ, সরকারি ক্ষমতা ও কালো টাকার প্রভাবমুক্ত নির্বাচনের পরিবেশ এবং প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে দেশ থেকে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা দূর করতে হবে। কারা দেশবিরোধী, কারা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি, বিপক্ষের শক্তি এসব তথ্য জনগণের অজানা নয়। এদেশের জনগণ সিদ্ধান্ত নিতে কখনো ভুল করেনি। আর রাষ্ট্রনীতি ও রাজনীতিতে শত্রæ-মিত্র কখনো চিরস্থায়ী নয়। জনগণের রায়ের প্রতি শাসক শ্রেণির আস্থাহীনতা থাকলে দেশে গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়া সম্ভব নয়।
গণতন্ত্রের মূল্যবোধ ও রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক সাম্যের স্বপ্ন নিয়ে দেশের মানুষ মুক্তিযুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করলেও স্বাধীনতার ৪৬ বছর পরেও দেশে প্রহসনের নির্বাচনের মধ্য দিয়ে গণতন্ত্রের বিপর্যয় সৃষ্টি করা হয়েছে। এর জন্য হয়তো সরকার ও বিরোধী দল উভয়েরই কম-বেশি দায় রয়েছে। তবে অপরাজনীতির সেই রন্ধ্র দিয়ে দেশে বিচারহীনতার সংস্কৃতি শক্তি অর্জন করেছে। রাষ্ট্রীয় ব্যাংকে হাজার হাজার কোটি টাকার লুটপাট, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ চুরি থেকে শুরু করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিচারবহিভূর্ত হত্যাকান্ড, হাজার হাজার রাজনৈতিক মামলায় লাখ লাখ মানুষের হয়রানির ঘটনার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ শিকার দেশের কোটি কোটি মানুষ। এসব ঘটনা দেশে বড় ধরনের সামাজিক-রাজনৈতিক অস্থিরতার জন্ম দিয়েছে। সেই সাথে ভোটের রাজনীতিতে এখনো অনিশ্চয়তা রয়ে গেছে। সকল রাজনৈতিক দলের সমান সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করে একটি গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের পরিবেশ তৈরির মধ্য দিয়েই দেশে সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ ও দুর্নীতিবিরোধী সর্বজনীন ঐক্য তৈরি হতে পারে। সামাজিক-রাজনৈতিকভাবে দেশের ঐক্যবদ্ধ জনশক্তির কাছে যে কোনো আঞ্চলিক আন্তর্জাতিক আধিপত্যবাদী ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হতে বাধ্য।
[email protected]  



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ