Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

উপকূলীয় অঞ্চলের অর্ধ কোটি মানুষের ঝুঁকির মুখে বসবাস

| প্রকাশের সময় : ২৮ মার্চ, ২০১৭, ১২:০০ এএম


বেড়িবাঁধগুলো নড়বড়ে আশ্রয়কেন্দ্র অপ্রতুল
আবু হেনা মুক্তি, খুলনা থেকে : দুর্যোগের মৌসুম শুরু হয়েছে। সেই সাথে উপকূল জুড়ে সুন্দরবন সংলগ্ন বেড়িবাঁধগুলো এখন নড়বড়ে। বিভিন্ন স্থানে ফাটল দেখা দিয়েছে। ঝড় ঝঞ্ঝা আসন্ন। অথচ অবহেলিত উপক‚লবাসীর খবর রাখে না কেউ। বড় ধরনের দুর্ঘটনা ও প্রাণহানির পর সরকার এবং বিবেকবান মানুষের টনক নড়ে ঠিকই কিন্তু ঘটনা ঘটার আগে কারোরই যেন ফিরে দেখার সময় হয় না। চৈত্র মাস থেকে মূলত ঝড়-বৃষ্টি শুরু হয়।
কালবৈশাখী শুধু বৈশাখ মাসেই হয় না বরং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে চৈত্র মাস থেকে শ্রাবণ মাস পর্যন্ত যে কোনো সময়ে বড় ধরনের দুর্যোগ ইদানিংকালে দেখা যাচ্ছে। আবহাওয়া অধিদপ্তরের একটি সূত্র মতে, চলতি চৈত্রের মাঝামাঝি সময় উপকূলীয় অঞ্চলজুড়ে কালবৈশাখীর মতো ঝড়-ঝভ্রার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। যদিও সরকারের পক্ষ থেকে ঝড়-ঝাপটা মোকাবেলায় নিজেদের কিভাবে রক্ষা করা যাবে সেসব বিষয়ে উদ্ভুদকরণ ও প্রস্তুতিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার প্রচারণা চালানো হচ্ছে। কিন্তু উপকুলীয়াঞ্চলের মানুষ এর সুফল পুরোপুরি পাচ্ছে না।
এদিকে, সুন্দরবন সংলগ্ন শ্যামনগর এলাকার দাতিনাখালী গ্রামে চুনা নদীর ওয়াপদার ভেড়িবাঁধে ৫ নম্বর পোল্ডারে আবারও ফাটল ধরেছে। প্রায় ৫শ’ ফুট এলাকায় বিচ্ছিন্নভাবে ফাটল দেখা দিয়েছে। খুলনার শেষ প্রান্ত সুন্দরবন উপকূল কালাবগী এলাকায় ভেড়িবাঁধ চরম হুমকির সম্মুখীন। বাগেরহাটের শরণখোলা ও মংলার জয়মনিতে যে কোনো মুহূর্তে বাঁধ ভেঙে প্লাবিত হতে পারে। অর্থাৎ কোনো রকম ঝড় ঝঞ্ঝা হলেই এসব এলাকাকে রক্ষা করা কঠিন হবে।
সূত্র মতে, ১৯৭০ সালে স্মরণকালের ঘূর্ণি ঝড়ের গোড়া পত্তন বলা যায়। এ সময় ঝড়ের তাÐবে প্রাণহানি ঘটলেও দুর্যোগের সময় তাদের কিছুই করার থাকে না। উপকুলীবাসী তথা খুলনাঞ্চলের জনপদের প্রায় অর্ধ কোটি মানুষ দুর্যোগের সময় ঝুঁকির মুখে বসবাস করে। উপকূলীয়বাসী রক্ষায় গত ৪৬ বছরে কোন সরকার বিশেষ কোন মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করে বাস্তবমুখী পদক্ষেপ নেয়নি। পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে বলা হয়েছে, বাজেটেতো বরাদ্দ বাড়ানো হয়নি বরং তুলনামূলক কার্যক্রম কমে গেছে। আর যা হচ্ছে তা রুটিন ওয়ার্ক বলা যায়। প্রয়োজনীয় আশ্রয় কেন্দ্র না থাকায় উপকূল বাসীদের দুর্যোগের সময় নিরাপদ স্থানে ঠাঁই নেয়ার সুযোগ থাকে না। সিডর ও আইলার মতো প্রকৃতিক দুযোর্গকে মোকাবেলা করার জন্য এখনই বাস্তবমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ প্রয়োজন বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞ মহল। তা না হলে উপকুলীয় অঞ্চলের মানুষের প্রাণহানিসহ হাজার হাজার কোটি টাকার স্থাপনা ও সহায় সম্পদ প্রতি বছরই বিনষ্ট হবে। ১৯৯২ এর পর উপকুল এলাকায় আশ্রয় কেন্দ্র নির্মাণের মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন হয়নি আজও। আগামী দিনগুলোতে সাগরে আবারও লঘুচাপ পূর্ণিমার জলোচ্ছ¡াসের আতাঙ্কে ভুগছে উপকুলবাসী। ১৯৭০ সালের ঘূর্ণিঝড়ের পর প্রাপ্ত  সাহায্যের সুষ্ঠু ব্যবহার হলে কাঙ্খিত আশ্রয় কেন্দ্র সম্ভব হতো। ৯১ এর অগ্রিম বিপদ সংকেদ প্রচারিত হলেও ঘুর্ণিঝড়ের ভয়াবহতা সম্পর্কে গনসচেতনতার অভাব ও পর্যাপ্ত আশ্রয় কেন্দ্র না থাকায় ব্যাপক প্রাণহানী ঘটেছে। দুর্যোগে জীবন ও সম্পদহানি মোকাবেলায় পরিকল্পনা নেয়া হয় ১৯৯২-৯৩ সালে।
জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির অর্থায়নে সরকারের পরিকল্পনা কমিশনের তদারকিতে এ পরিকল্পনার আওতায় কুয়েট ও বিআইডিসিএল এর সমন্বয়ে একটি বিশেষজ্ঞ টিম গঠন করা হয়। বিশেষজ্ঞ দল ১৯৯২ সালের পর থেকে ১০ বছরের মধ্যে সাড়ে ৩ হাজার আশ্রয় নির্মাণের প্রস্তাব করে। এই মহা পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয়নি। ফলে উপকূলের মানুষের মধ্যে ঝুঁকি আর কমেনি। উপকূলে দুর্যোগ আতঙ্ক বাড়ছে। দেশের উপকূলবর্তী ৯ জেলায় অন্তত ১ কোটি মানুষ বছরের সারা মৌসুমেই মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে বসবাস করছে। ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলো হচ্ছে বাগেরহাট, খুলনা, সাতক্ষীরা, পিরোজপুর, ভোলা, বরগুনা, ঝালকাঠি, বরিশাল ও পটুয়াখালী। ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর ঘূর্ণিঝড় সিডর সুন্দরবনসহ দক্ষিণ জনপদের ৯ জেলা লন্ডভন্ড হয়ে যায়। ২০০৯ সালের ২৫ শে মে আইলা দক্ষিণ জনপদসহ পশ্চিমবঙ্গে ব্যাপকভাবে আঘাত হানে । নিম্নাঞ্চলের বহু মানুষ নিরাপদ আশ্রয় নিতে পারেনি। অনেকেই পৈত্রিক ভিটা ছেড়ে যেতে চায়নি। উপকূল দুর্গম এলাকায় ঘূর্ণিঝড় আশ্রয় কেন্দ্রের সংখ্যা কম থাকায় বহু মানুষ ঠাঁই নিতে পারেনি। সিডরের আঘাতে দক্ষিণ জনপদে সরকারী হিসেব অনুযায়ী মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়ায় ৩ হাজার ৩২ জন । আইলার আঘাতে  ১৭৫ জনের মৃত্যু হয়। উপক‚লবর্তী জেলা খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, পটুয়াখালী, পিরোজপুর, বরগুনা, ভোলা, এবং চরগুলোতে কয়েক লাখ মানুষ প্রকৃতির সাথে লড়াই করে যুগের পর যুগ বেঁচে আছে। দুর্যোগ উপকুল এলাকায় মানুষের রক্ষা করার জন্য সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে আশ্রয় কেন্দ্র নির্মান করা হলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় কম।
কোস্টগার্ড এন্ড ইক্যুইটি এন্ড জান্ডিস ওয়াকিং গ্রæপের প্রকাশনায় বলা হয়, খুলনায় ৩৪টি,  সাতক্ষীরায় ৪৮টি, বাগেরহাটে ৮২টি, বরগুনায় ৭০টি, বরিশালে ৫৭টি, ভোলায় ২০৮টি, ঝালকাঠিতে ২৬টি, পটুয়াখালীতে ১৯৬টি আশ্রয় কেন্দ্র রয়েছে। প্রতিটিতে সর্বোচ্চ ১ হাজার মানুষ দুর্যোগের সময় আশ্রয় নিতে পারে। ১৯৯১ সালের সাইক্লোনের সময় উপকূলবর্তী এলাকায় ৪ হাজার আশ্রয় কেন্দ্রের প্রয়োজন ছিল। প্রতি বছর ১০ লাখের বেশি জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় সে তুলনায় আশ্রয় কেন্দ্রের সংখ্যা বাড়েনি।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ