Inqilab Logo

শুক্রবার, ২৪ মে ২০২৪, ১০ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ১৫ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

আমের ঠাসবুনন গুঁটি : স্বপ্ন দেখাচ্ছে বাম্পার ফলনের

| প্রকাশের সময় : ২৭ মার্চ, ২০১৭, ১২:০০ এএম

রেজাউল করিম রাজু : আমের ডগায় ডগায় ঠাস বুনন গুঁটি জানা দিচ্ছে এবার আমের বাম্পার ফলন হবে। আমের রাজধানী রাজশাহী অঞ্চলের চার জেলায় আমগাছগুলোয় মুকুল ঝরে গিয়ে গুঁটি তাদের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে। আবহাওয়া অনুকূল থাকায় গাছ ভরে মুকুল আসার পর এখন তা ফুটে গুঁটিতে পরিণত হয়েছে। যেসব মুকুলে গুঁটি হয়নি তা ঝুর ঝুর করে ঝরে পড়ছে। প্রবাদ আছে ‘আমের আনা মাছের পাই, তা থাকলে কে কত খায়’। অর্থাৎ গাছে যত আমের মুকুল আসে তার যদি ষোল আনার মধ্যে এক আনাও থাকে আর মাছ যে ডিম পাড়ে তার যদি পাই পয়সার সমান ফোটে তাহলে যা উৎপাদন তা অনেক। মওসুমের শুরু থেকে গাছে গাছে মুকুলের পর এখন গুঁটি দেখে প্রবাদটি এখন আম চাষীদের মুখে মুখে। যত গুঁটি এসেছে তার যদি সামান্য অংশ টিকে যায় তবে উৎপাদন ভাল হবে এমন আশা তাদের মাঝে। ভাল ফলনের বুক ভরা আশা নিয়ে আম চাষীরা বাগানে বাগানে পরিচর্যায় ব্যস্ত সময় পার করছেন। ডগায় ডগায় ঠাস বুনন গুঁটি দেখে আমচাষী আর আম রসিক সবাই আশান্বিত প্রকৃতি অনুকূল থাকলে এবার আমের লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাবে।
কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ সূত্র জানায়, প্রতি বছর আম বাগানের বিস্তৃতি ঘটছে। সাথে বাড়ছে আমের উৎপাদন। যোগ হয়েছে সনাতন পদ্ধতির বদলে আধুনিক কলাকৌশল। রাজশাহী চাঁপাইনবাবগঞ্জ নওগাঁ নাটোর জেলায় এক পরিসংখ্যানে দেখা যায় বিগত পাঁচ বছরে আমের বাগান আর উৎপাদন দুই বেড়েছে। ২০১১-১২ সালে ৪০ হাজার ৪২০ হেক্টর জমিতে আমের আবাদ করে ফলন পাওয়া যায় তিন লাখ ৮৭ হাজার মে: টন। আর প্রতি বছর অর্থাৎ ২০১৫ সালে প্রায় ৫৯ হাজার হেক্টর জমিতে আমের উৎপাদন ছিল ছয়লাখ উনচল্লিশ হাজার মে: টন। পাঁচ বছরে বাগান আর উৎপাদন দুটোই বেড়েছে। বেড়েছে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা। আম চাষীরা জানান প্রাকৃতিক নিয়ম অনুযায়ী আমগাছে একবার ভাল ফলন হলে পরের বছর কম হয়। সে হিসেবে গতবার ছিল অফ ইয়ার। এবার হয়েছে অন ইয়ার। আবহাওয়া পক্ষে থাকায় এবার ভাল মুকুল আসে। অবশ্য কৃষি বিভাগের মতে এখন অফ ইয়ার অন ইয়ার বলে কিছু নেই। আম চাষীরা এখন সচেতন। আগে তেমন পরিচর্যা আর স্প্রে দেয়া হতো না। আম চাষের কলা কৌশল ছিল গতানুগতিক। তবে এখন দিন বদলেছে। বছরজুড়ে চলছে পরিচর্যা। যার সুফলও মিলছে। কৃষি বিভাগ ফল গবেষণা কেন্দ্রের কর্মীরা তৎপর। আম চাষের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে পরামর্শ দিচ্ছেন। মওসুমের শুরু থেকেই আম চাষীরা ব্যাস্ত বাগানের পরিচর্যা নিয়ে। পোকা-মাকড়ের আক্রমণ ও বৈরী আবহাওয়া মোকাবেলার জন্য নিয়মিত কীটনাশক ব্যবহার করছেন। এখন যাতে ডগায় আটকানো গুঁটি ঝরে না পড়ে তা নিয়ে ব্যস্ত। আম গবেষণা কেন্দ্রের সিনিয়র বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. আব্দুল আলীমের পরামর্শ আমের গুঁটি টিকিয়ে রাখতে সাইপার মেটথ্রিন কীটনাশক এক মিলিমিটার এবং ম্যানকোজের জাতীয় ছত্রাকনাশক দুই লিটার পানির সাথে মিশিয়ে গাছে স্প্রে করতে হবে। কড়া রোদ্র হলে কুড়ি পনের দিন পর দু’তিনবার আম বাগানে সেচ দিতে হবে। তা না হলে খরায় গুঁটি ঝরে যাবার সম্ভাবনা রয়েছে। আম একটি যত্মশীল ফল। এটিকে যত্ম আত্তি দিয়ে উৎপাদন করতে হবে। আবার এটি খেয়াল রাখতে হবে যত্ম বা পরিচর্যার নামে কখনোই অতিরিক্ত কিছু করা না হয়। তাতে হিতে বিপরীত হতে পারে। দুর্গাপুরের আমগাছির বাগান মালিক শরীফ উদ্দিন বলেন এখন সবাই সজাগ এবার গাছে গাছে যত গুঁটি দেখা যাচ্ছে প্রতিকূল আবহাওয়া মোকাবেলা করে টিকে থাকলে বাম্পার ফলন হবার সম্ভাবনা রয়েছে। আমের রাজধানী চাঁপাইনবাবগঞ্জে বিভিন্ন এলাকা। রাজশাহীর বাঘা চারঘাটের বাগানগুলো সরেজমিন ঘোরার সময় বাগানে বাগানে আম চাষীদের ব্যস্ততা নজর এড়ায় না। গাছে গাছে ডগায় ডগায় মটর দানার মত সবুজ গুঁটি মন কাড়ে। বাগানে বাগানে চলছে স্প্রে। এমনকি বাড়িতে বাড়িতে যে দু’চারটা আমগাছ আছে তাতেও ভ্রাম্যমাণ স্প্রে কারক দল স্প্রে করে বেড়াচ্ছে। বৃহত্তর রাজশাহী অঞ্চলের মাটি আবহাওয়া ও প্রকৃতিগত কারণে ভাল রসালো সুস্বাদু আম উৎপাদনের উপযোগী। লাভ ভাল হওয়ায় অনেকে আম বাগানে আগ্রহী হয়ে উঠেছে। আর তাই দ্রুত বিস্তার ঘটছে আম বাগানের। তিন ফসলী জমিকেও রূপান্তর করা হচ্ছে আম বাগানে। বিশেষ করে ধানের জমিতে বাগান গড়ে উঠছে। নতুন বাগান মালিকরা বলছেন ধান উৎপাদন এখন লাভজনক নয়। তাই তারা ঝুঁকছেন আম বাগানের দিকে। ইতোমধ্যে অনেকে বাগানগুলোয় ভাল মানের চারা (কলম) লাগানো হয়েছে। তাতে ফল আসছে দ্রুত। স্বাদের দিক দিয়েও ভাল। পুরাতন বাগানের পাশাপাশি নতুন গড়ে ওঠা বাগানগুলোর সবই বনেদি জাতের। এখানে আড়াইশো প্রজাতির আমের কথা জানা যায়। তবে এখন ফজলী, ল্যাংড়া, গোপালভোগ, ক্ষিরসাপাতি, বোম্বাই, হিমসাগর, ক্ষুদিক্ষিরসা, বৃন্দাবনী, রানীপছন্দ, আস্বীনা, বউসোহাগী, লক্ষনভোগ। নতুন জাতের মধ্যে আম্রপালী, বৈশাখী রয়েছে। আম্রপালী প্রিয়তা পাচ্ছে। আম গবেষণা কেন্দ্র গবেষণা করছে ভালজাতের আম নিয়ে। বিশেষ করে বারোমাসী। আম বাগান বিস্তারের সাথে সাথে আম অর্থনীতিও চাঙ্গা হচ্ছে। প্রতি বছর আম বাগানগুলোয় ফলন হচ্ছে বলে বাগানের দামও বাড়ছে। বাগান বাণিজ্যে পরিবর্তন এসেছে। বিভিন্ন মেয়াদে বাগান কেনাবেচা হয়। মওসুম শুরুর আগ থেকে শেষ পর্যন্ত কয়েক দফা পর্যন্ত হাত বদল ঘটে। আবার দীর্ঘ মেয়াদী বেচাকেনা হয়। বাগান ঘোরার সময় বেশ ক’জন আমচাষী জানান এবার সাধারণ প্রক্রিয়া ছাড়াও ফ্রুট ব্যাগিং পদ্ধতিও ব্যবহার করা হবে। যা হবে একেবারে কেমিক্যাল মুক্ত। বিদেশে এর চাহিদা বেশী। আবার দামও ভাল। অনেকে আগে ভাগে অর্ডার দিচ্ছেন। তারা বলেন, আমরা আম বাগান পরিচর্যার সময় বিভিন্ন ধরনের কীটনাশক ও ওষুধ ব্যবহার করি। আর তা করি কৃষি বিশেষজ্ঞদের পরামর্শে। বাগান মালিকরা কখনো ফরমালিন ব্যবহার করে না। আবার একথাও অস্বীকার করা যাবে না যে কিছু অসাধু ব্যক্তি বাগান কিনে লোভের বশবর্তী হয়ে ভারত থেকে বিভিন্ন ধরনের হরমন ওষুধসহ মানহীন কীটনাশক গোপনে ব্যবহার করে। এতে সাময়িক কিছু লাভ হলেও বারোটা বাজছে বাগানের। দীর্ঘ মেয়াদী খারাপ প্রভাব পড়বে বাগানের উপর।
এদিকে নজরদারী করা প্রয়োজন। তাই বলে সবাইকে যেন এক কাতারে ফেলা না হয়। আম বাগান মালিক কৃষি বিভাগের কর্মী আর ফল গবেষণা কেন্দ্রের বিশেষজ্ঞদের সাথে আলাপকালে এবার সবাই ভাল উৎপাদনের আশাবাদ ব্যক্ত করেন। তবে সবকিছু নির্ভর করছে আবহাওয়ার মতিগতির উপর। এখন পর্যন্ত সব মোটামুটিভাবে অনুকূল রয়েছে। তবে চৈত্র-বৈশাখের খরতাপ আর ঝড়ো হাওয়ার গতি প্রকৃতি নির্ধারণ করে দেবে আমের উৎপাদন।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ