বিএনপির মানববন্ধন আজ, পাল্টা কর্মসূচি আওয়ামী লীগ
সারা দেশের মহানগর ও জেলা পর্যায়ে আজ মানববন্ধন করবে বিএনপি ও তার মিত্ররা। আর এ
সিলেট অফিস : সিলেট মহানগরের দক্ষিণ সুরমায় জঙ্গি আস্তানায় সেনা অভিযানের মধ্যে গতকাল শনিবার জঙ্গি হামলা হয়েছে। এতে দুই পুলিশ কর্মকর্তাসহ ছয়জন নিহত হয়েছেন। রাত দুইটায় শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত সাংবাদিক, পুলিশ, র্যাব সদস্যসহ ৫০ জন আহত হয়েছেন। তবে নিহত ব্যক্তিদের সংখ্যা বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
জঙ্গিবিরোধী ওই অভিযানের মধ্যে এই হামলার দায় স্বীকার করেছে জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট (আইএস)। এই গোষ্ঠীর কথিত বার্তা সংস্থা ‘আমাক’ এই খবর দিয়েছে বলে জানিয়েছে অনলাইনে জঙ্গিদের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণকারী যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রতিষ্ঠান সাইট ইন্টেলিজেন্স গ্রুপ।
গত বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত আড়াইটায় দক্ষিণ সুরমার শিববাড়ি এলাকার আতিয়া মহলে এই জঙ্গিবিরোধী অভিযান শুরু হয়। গতকাল ৪৮ ঘণ্টা পেরিয়ে গেলে অভিযান শেষ হয়নি। এ নিয়ে গতকালও সিলেট ছিল থমথমে। অভিযানস্থলের চারপাশে ছিল সেনা, পুলিশ ও র্যাবের কড়া পাহারা।
জঙ্গিবিরোধী এই অভিযানের মধ্যে গতকাল সন্ধ্যার দিকে আতিয়া মহলের প্রায় দেড় শ গজ দূরে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে সেনাবাহিনী। এই সম্মেলন শেষ হতে না-হতেই আতিয়া মহল থেকে প্রায় আড়াই শ গজ দূরে প্রচণ্ড শব্দে বিস্ফোরণ হয়। এর ৪০-৪৫ মিনিট পর আবারও বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যায়। দ্বিতীয় বিস্ফোরণস্থলটি ছিল প্রথম বিস্ফোরণস্থল থেকে শ খানেক গজ দূরে। এই দুটি বিস্ফোরণই ঘটে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিরাপত্তাবলয়ের মধ্যে। তবে সেখানে মাঝেমধ্যেই কিছু উৎসুক লোকজন নিরাপত্তাবলয় ভেদ করে ঢুকে পড়ছিল। তাদের ঠেকাতে দিনভরই বেগ পেতে হয়েছে পুলিশকে।
কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, এ ঘটনার কিছুক্ষণ পর ঘটনাস্থল থেকে বোমা অপসারণের সময় আবার বিস্ফোরণ হয়।
বিস্ফোরণে নিহত হন সিলেটে পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) পরিদর্শক চৌধুরী আবু মো. কয়সর, মদনমোহন কলেজের হিসাববিজ্ঞান দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ওয়াহিদুল ইসলাম অপু, সিলেটের দাড়িয়াপাড়ার বাসিন্দা শহীদুল ইসলাম।
রাত দুইটার দিকে জালালাবাদ থানার ওসি আখতার হোসেন প্রথম আলোকে জানান, ওই বিস্ফোরণের ঘটনায় জালালাবাদ থানার ওসি (তদন্ত) মনিরুল ইসলাম মারা গেছেন। তিনি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আশঙ্কাজনক অবস্থায় চিকিৎসাধীন ছিলেন। এ ছাড়া ওই ঘটনায় সিলেটের দক্ষিণ সুরমা উপজেলা ছাত্রলীগের উপপরিবেশ–বিষয়ক সম্পাদক জান্নাতুল ফাহিম নিহত হয়েছেন। তাঁর মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন সিলেট জেলা ছাত্রলীগের সহসভাপতি রাশেদুল ইসলাম।
নিহত অন্যজনের পরিচয় পাওয়া যায়নি।
আহত ব্যক্তিদের মধ্যে র্যাবের গোয়েন্দা শাখার প্রধান লে. কর্নেল আবুল কালাম আজাদের অবস্থা সংকটজনক। তাঁকে রাতেই হেলিকপ্টারে করে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) নিয়ে আসা হয়েছে। আহত ব্যক্তিদের মধ্যে আরও আছেন র্যাব সদর দপ্তরের মেজর আজাদ। রাতে তাঁকেও ঢাকায় আনা হয়।
প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেন, সন্ধ্যা সাতটার দিকে প্রথম বিস্ফোরণের পৌনে এক ঘণ্টা পর চারদিকে যখন ছোটাছুটি চলছিল, তখন আরেকটি বোমার বিস্ফোরণ ঘটে। এতে আহত হন পুলিশ ও র্যাবের কয়েকজন সদস্য। প্রথম বিস্ফারণের ঘটনাস্থলে তখন দুটি মোটরসাইকেল পড়ে ছিল। কয়েকজন রক্তাক্ত, ক্ষতবিক্ষত মানুষ, এখানে-সেখানে ছোপ ছোপ রক্ত পড়ে ছিল। বিস্ফোরণের পর আতঙ্কিত লোকজন এদিক-সেদিক ছোটাছুটি করছিলেন। আহত ব্যক্তিদের কয়েকজনকে হাত নেড়ে সাহায্য চাইতে দেখা যায়।
এ দুটি ঘটনার পর গতকাল রাত সাড়ে নয়টা পর্যন্ত সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৪৪ জন ভর্তির তথ্য জানায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। তারা জানায়, দুজনকে মৃত অবস্থায় হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে।
আতিয়া মহলের জঙ্গি অভিযান আজ তৃতীয় দিনে গড়াচ্ছে। বৃহস্পতিবার রাত আড়াইটার দিকে ভবনটি প্রথম ঘেরাও করে পুলিশ। ভবনের ২৯টি ফ্ল্যাটের একটি স্বামী-স্ত্রী পরিচয়ে ভাড়া নেওয়া জঙ্গিদের অবস্থা সম্পর্কে গতকাল এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত কিছুই জানা যায়নি। বাকি ২৮টি ফ্ল্যাটে বৃহস্পতিবার রাত থেকে নারী, শিশু, বৃদ্ধসহ ৭৮ জন বাসিন্দা আটকা পড়েছিলেন। এত মানুষ ভবনে আটকা পড়ায় চূড়ান্ত অভিযানে সময় নেয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। শুক্রবার বিকেল পৌনে চারটার দিকে অভিযান চালাতে ঢাকা থেকে সিলেটে আসে ঢাকা মহানগর পুলিশের বিশেষায়িত ইউনিট সওয়াত। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সওয়াত অভিযান চালায়নি। গতকাল সকাল আটটার দিকে সিলেটের জালালাবাদ ক্যান্টনমেন্ট থেকে প্যারা কমান্ডোদের একটি দল এসে অভিযান শুরু করে।
আটকা পড়া বাসিন্দাদের উদ্ধার অভিযানের পর দিনের বিভিন্ন সময়, বিশেষ করে দুপুরের পর থেকে আতিয়া মহল ঘিরে কখনো থেমে থেমে, কখনো একনাগাড়ে গুলি ও বিস্ফোরণের শব্দ পাওয়া যায়। সন্ধ্যার দিকে সেনাবাহিনীর কর্মকর্তারা জানান, অভিযান শেষ হয়নি, চলমান রয়েছে।
প্রথম হামলা
আটকাবস্থা থেকে উদ্ধার করা ৭৮ জনকে রাখা হয়েছিল আতিয়া মহল থেকে দুটি বাড়ির পরে একটি বাড়িতে। গতকাল সকাল থেকে দুপুরের মধ্যে সেনাবাহিনীর কমান্ডোরা তাঁদের উদ্ধার করে। পরিকল্পনা ছিল সন্ধ্যায় সংবাদ সম্মেলনের পরে সাংবাদিকদের সঙ্গে আটকাবস্থা থেকে উদ্ধার পাওয়া বাসিন্দাদের কথা বলার সুযোগ করে দেওয়া হবে। সংবাদ সম্মেলনের পরপরই বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে।
প্রত্যক্ষদর্শী একজন সাংবাদিক বলেন, সংবাদ সম্মেলনস্থল থেকে বেরিয়ে দুই থেকে তিন মিনিট পর তিনি একটি দোকানে চার্জে রাখা মুঠোফোন আনতে যাচ্ছিলেন। এ সময়ই তিনি প্রচণ্ড বিস্ফোরণের শব্দ শোনেন। প্রথমে ভেবেছিলেন, সারা দিন আতিয়া মহল থেকে যে রকম গুলি ও বিস্ফোরণের শব্দ এসেছে, এটিও বোধ হয় তেমন কিছু। এ সময়ই রক্তাক্ত হাতে একজন দোকানে এসে সিলেটের স্থানীয় ভাষায় বলেন, ‘রাস্তাত বোম মারছে, আমি আতো (হাতে) দুক (ব্যথা) পাইছি।’ তারপর তিনি ঘটনাস্থলের দিকে পা বাড়াতেই কয়েকজন সহকর্মী সাংবাদিককে উল্টো দিকে দৌড়াতে দেখেন।
আলোকচিত্র সাংবাদিক আনিস মাহমুদ বলেন, সংবাদ সম্মেলনের ছবি তুলে ৬০ থেকে ৭০ গজ হাঁটার পরই তিনি বিস্ফোরণের শব্দ পান। তিনিও ভেবেছিলেন, এটা আতিয়া মহলের অভিযানের শব্দ। কিন্তু সিলেট-ফেঞ্চুগঞ্জ সড়কের সংযোগে অন্ধকারের মধ্যে ‘বাঁচান বাঁচান’ শব্দ শুনতে পান। সেখানে দুটি মোটরসাইকেল উল্টে পড়ে ছিল। তখন ক্যামেরার ফ্ল্যাশের আলোতে তিনি কয়েকজনকে পড়ে থাকতে দেখেন। রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে থাকা লোকগুলো সাহায্যের জন্য চিৎকার করছিল। স্থানীয় কিছু লোকজন পরে তাদের তুলে হাসপাতালে নেন। এরপর সেনাবাহিনী, পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা এসে পুরো জায়গার নিয়ন্ত্রণ নেন।
দ্বিতীয় বিস্ফোরণ
প্রথম হামলার পৌনে এক ঘণ্টা পরে হতাহত ব্যক্তিদের এবং অভিযানের সার্বিক তথ্য সংগ্রহ করছিলেন কয়েকজন সাংবাদিক। পুলিশ, র্যাব ও সেনাসদস্যদের ছোটাছুটি চলছিল। আরও বোমা আছে কি না, তা খুঁজে দেখা হচ্ছিল। এ সময়ই রাত পৌনে আটটার দিকে দ্বিতীয়বার বিস্ফোরণ ঘটে। দ্বিতীয় বিস্ফোরণস্থল পূর্ব পাঠানপাড়া জামে মসজিদ মাদ্রাসা গলির মুখে। এ ঘটনাস্থলের খুব কাছে মসজিদের সামনে ছিলেন এটিএন নিউজের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক ইমরান হোসেন। তিনি বলেন, প্রথম বোমা হামলার ফুটেজ সংগ্রহ করে, অফিসে সংবাদ দিয়ে যখন তিনি গাড়িতে ওঠার জন্য পা দিয়েছেন, সে সময়ই গাড়ি থেকে ২৫-৩০ গজ দূরে প্রচণ্ড শব্দে চারদিক কাঁপিয়ে আরেকটি বিস্ফোরণ ঘটে। কয়েকজন বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট পরা পুলিশ সদস্যকে মাটিতে পড়ে থাকতে দেখেন তিনি। এরপর গাড়ির পেছনে তাঁরা আরেকটি অবিস্ফোরিত বোমাসদৃশ বস্তু দেখতে পান।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।