Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

গল্প : চরিত্র বদল

| প্রকাশের সময় : ২৬ মার্চ, ২০১৭, ১২:০০ এএম

ফরিদা হোসেন

১৯৭১-এর ডিসেম্বর মাস।
ঢাকার পুরান এলাকা পাতলা খান লেনের একটি বাড়ির ছাদে দাঁড়িয়ে ছিল নিমা-
পড়ন্ত অপরাহ্নের নরম আলো এসে পড়েছে ওর চোখে মুখে।
রুক্ষ এলো খোঁপায় সোনালী ছোঁয়া লাগছে।
চারিদিকে কেমন একটা আনন্দ হিল্লোল-।
বাড়ির সামনের দোকান পাটের দোকানী বা মোড়ে মোড়ে অবিন্যস্তভাবে দাঁড়িয়ে থাকা রিক্সাওয়ালারা আজ আর বাড়ির ছাদের দিকে দৃষ্টিপাত করছে না।
অন্যদিন হলে কোথায় কোন বাড়ির ছাদে মেয়েরা উঠেছেÑ সেদিকে ওদের চোখ থাকতোÑ।
কিন্তু আজ যেন সব কিছু অন্যরকম। পুরান এলাকার ঘিঞ্চি গলিগুলোতেও যেন হৈ হৈ রব পড়ে গেছে।
ছোট ছোট ভ্যান জীপ আর রিক্সা ভরে ভরে ফিরে আসছে যুদ্ধজয়ী মুক্তি সেনারা...। হাতে... পিঠে...কাঁধে ঝোলানো... স্টেনগান...উজ্জ্বল...প্রাণবন্ত।
রাস্তার দুধারে ছেলেবুড়োদের সেকি উল্লাস।
দুর্লভ সেই দৃশ্য...চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না।
নিমার কালিপড়া অসুস্থ চোখে মুখে এখন সেই বিজয় উল্লাসের ছোঁয়া...। বৈকালী সূর্যের রং এতো সুন্দর ...? এতো বুকে দোলা লাগানো... কই আগে তো কখনো এমন মনে হয়নি...।
নিমার পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের প্রতিনিধিত্ব করছে যেন ওর দুটি ক্লান্ত চোখÑ।
রাস্তায় বিজয় উল্লাসের এই অভূতপূর্ব আনন্দ স্রোতের দৃশ্যকে যেন বুভুক্ষুর মতো গোগ্রাসে আহরণ করছেÑ।
আজ আর নিমার একবারও খেয়াল থাকলো না যে গলির মুখের রিক্সাওয়ালা আর দোকানীরা ওর দিকে চেয়ে হাসছে কিনা। পাড়ার বখাটে ছেলেগুলোকেও নিমার আজ অসহ্য মনে হচ্ছে না।
ইচ্ছে হচ্ছে ছুটে গিয়ে রাস্তায় নেমে শরীক হয় এই বিজয় মিছিলেÑ।
নিমা কতক্ষণ এই আনন্দঘোরের মধ্যে হারিয়ে গিয়েছিল ওর খেয়াল নেই। একেবারেই ভুলে গিয়েছিল নিজের কথাÑ
নিজের অত্যাচারিত ... দংশিত ...আর দলিত জীবনের কথাÑ
হঠাৎ ওর খেয়াল হোল এই সব যুদ্ধজয়ী মুক্তিসেনাদের মতো ফিরে আসবে হাসানও। ফিরে আসবে কাঁধে অহঙ্কারী স্টেনগান নিয়ে। দুটো বলিষ্ঠ বাহু প্রসারিত করে বলবেÑ
: পরিয়ে দাও আমায় বিজয় মালা, এঁকে দাও কপালে প্রেমের চুম্বন চিহ্ন...।
হাসান যাবার সময় বলেছিলো,
: যদি জয়ী হয়ে ফিরে আসি ... আমি দেখতে চাই তোমার চোখে প্রিয় বিচ্ছেদের
অধীর ব্যাকুলতা তুমি ছুটে আসবে ছাদের ঐ কোণা থেকে... তোমার চুল উড়বে
বাতাসে ... শাড়ীর আঁচল লুটোবে মাটিতে...।
তোমার প্রসাধনহীন মসৃণ কপোল ভেসে যাবে আনন্দাশ্রæতে...
আর... তারই স্পর্শে ভিজে যাবে আমার ক্ষত-বিক্ষত বুকের মাঝ খানটা...।
পুরান ঢাকার এই বাড়িটিতে ওপরে নিচে অনেক ভাড়াটে...।
দোতলার এক কোণায় ছোট্ট দুটো কামরা নিয়ে থাকে নিমা আর ওর বৃদ্ধ অসুস্থ বাবা।
নিমা আর হাসানের কথা বলার জায়গা ছিল লোক চক্ষুর আড়ালে...।
ছাদের নির্জনতায়...।
নিমা বি. এ. পড়তো সেন্ট্রাল উইমেন্স কলেজে আর হাসান চাকুরী করতো একটা বেসরকারী ফার্মে। রাতে টিউশনি করতো।
কথা ছিল স্বাধীনতার পর ওরা বিয়ে করবে।
মুক্তিযুদ্ধে যাবার সময় হাসান নিমাকে বলেছিল অনেক কথা।
আর সবশেষে বলেছিলÑ
: যদি আর ফিরে না আসিÑ
: নিমা হাসানের মুখে হাত চাপা দিয়ে বলেছিল,
: আর কোন কথা নয়Ñ। তোমাকে যে ফিরে আসতেই হবেÑ।
বুকের ভেতরটা যেন কেমন করে উঠলো নিমারÑ।
ফিরে আসবে হাসান...।
খবর পেয়েছে পাড়ার ছেলেদের কাছ থেকে।
নিমাকে ছাদের এই কোণায় ... এই খানটায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে হবে প্রিয় মিলনের জন্যে।
অবিন্যস্ত এলো কেশ বাসÑ
প্রসাধনহীন মুখÑ
অশ্রæ প্লাবিত চোখ...
সব...সবই ঠিক আছে...।
একটু অন্যরকম রোমান্টিক স্বভাব এই হাসানের।
আর দশ জনের মতো যেন নয়...।
মাঝে মাঝে নিমা হেসে বলতোÑ
: তুমি একটা চাষা। তোমার ভালোবাসা অন্য সবার মতো নয়Ñ।
হাসান বলতোÑ
: মানুষটাও তো আর সবার মতো নয়।
তারপর দু’জনে একসাথে হেসে উঠতোÑ।
সেই হাসানÑ।
: আর সবার চেয়ে অন্যরকম হাসান, শুধু মাত্র নিমার হাসান ফিরে আসবে বিজয়ী সৈনিকের বেশে...।
নিমার মাথাটা কেমন ঝিম ঝিম করতে লাগলো। ঝাপসা হয়ে এলো দুটো চোখ।
আর দাঁড়াতে পারলো না রাস্তায় চোখ পেতে। অক্লান্ত কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো নিমাÑ।
রাস্তায় বিজয় উল্লাসের ¯েøাগান আর ছাদের কোণায়, নিমার অক্লান্ত কান্নার শব্দ মিশে একাকার হয়ে গেল-।
এরই মধ্যে সন্ধ্যা নেমেছে।
আযানের ধ্বনি দূর-দূরান্ত পর্যন্ত কেঁপে কেঁপে প্রতিধ্বনিত হতে লাগলো...।
তখনো নিমা বসে রইলো ছাদের কোণায় স্থিরÑ।
অবিচলÑ।
ওর চোখের সামনে ভেসে উঠলো সব।
যুদ্ধ চলাকালীন সময়েÑপাড়ায় তখন সাংঘাতিক গরম হাওয়া।
বাড়িঘর ছেড়ে পাড়ার প্রায় সবাই চলে গেছে অন্যত্র, নিরাপদ কোন স্থানে। নিমাদের দালানের সব ভাড়াটেরাও চলে গেছে মাস খানেক হোল। পুরো এলাকাটাই বলতে গেলে খালিÑ।
শুধু মাত্র বাবার অসুস্থতার জন্যে কোথাও যাওয়া হয়নি নিমাদেরÑ।
এই অবস্থায় নিরুপায় হয়ে নিজ বাড়িতেই... বাবাকে নিয়ে থেকে গেল নিমাÑ।
আসন্ন বিপদের কথা অনুমান করতে পেরেও নিজেকে রক্ষা করতে পারলো না সে।
পুরো পাড়াটাই খাঁ খাঁ করছে।
দু’চারটি বাড়িতে শুধু দু’একজন অথর্ব বুড়োবুড়ি রয়ে গেছে মাত্রÑ।
এরই মধ্যে একদিন রাত্রে এসে ঢুকলো হানাদার বাহিনীÑ।
অনেকগুলো বুটের শব্দ নিচ থেকে ওপর পর্যন্ত উঠে এলো।
তোলপাড় করে তুললো ওপর নিচ।
বিছানায় শুয়ে শুয়ে কাৎরাচ্ছিলেন বাবা।
নিমা লুকিয়ে ছিল ছাদের এককোণায়।
এক সময় দুমদাম করতে করতে ছাদে এসে হাজির হোল শয়তানগুলোÑ।
নিমা তখন ভয়ে প্রায় সংজ্ঞাহীন।
আল্লাহ্কে ডাকবার কথা পর্যন্ত ওর তখন মনে আসেনি।

তারপর যা হবার তাই হোল।
একে একে কয়েকজনের অত্যাচারে নিমা একেবারে মৃত প্রায়।
যখন ওর জ্ঞান হোলÑ
তখন গভীর রাত।
বাকী রাতটাও নিস্তেজ হয়ে পড়ে রইলো ছাদে...।
আর কোন ভয়-ডর যেন নিমার রইলোনা...।
অন্ধকারের রহস্যময়তাÑ
গলির মুখের কুকুরের বিলাপী কান্না... মিলিটারী ভ্যানের শব্দ... অথবা রাস্তায় বুটের শব্দ...।
আর কোন ভয়ের ভাবনা নেই নিমার। নরপশুদের অত্যাচারে ক্ষত-বিক্ষত একটি কুমারী মেয়ের নতুন করে ভয় পাবার আর কিই বা আছে ...?
নিমা যেন কাঁদতেও ভুলে গেছে...।
পরদিন সকালে নিজেকে স্বাভাবিক চেহারায় এনে বাবার মুখোমুখি হতে খুবই কষ্ট হোল ওরÑ।
বাবা জিজ্ঞেস করেছিলেন-
: হানাদাররা যখন বাড়িতে ঢুকেছিলÑতুই তখন লুকিয়েছিলি তো মা ?
নিমা স্বাভাবিক কণ্ঠে বললÑ
: হ্যাঁ বাবাÑ।
: খুব ভালো করেছিস। আমি তো অসুস্থতার জন্যে বড় বাঁচা বেঁচে গেছিÑ।
নইলে যে কি হোত।
নিমা একটা দীর্ঘশ্বাস চাপতে চেষ্টা করলোÑ অসুস্থ বাবা জানতেও পারলো না গত রাতের ঘটনার কথা।
এরপর প্রায় একমাসের ওপর হয়ে গেছে। অসুস্থ বাবার জন্যে নিজেকে নিয়ে আর কিছু ভাববার সময় পায়নি নিমা।
কনকনে শীতে বাবার শ্বাস কষ্টটা বেড়েছে। প্রতি মুহূর্তেই যাই যাই করছেন।
নিমা শুধু দিন গুনতে থাকেÑ।
কবে হবে যুদ্ধের শেষ...?
কবে আসবে স্বাধীনতা...?
কবে আসবে হাসান ...?
আর কবে হাসানের বুকে মুখ লুকিয়ে আকুল হয়ে একটু কাঁদতে পারবে নিমা ?
খবর আসছে চারদিক থেকে মুক্তিযোদ্ধারা ঘরে ফিরছে দলে দলেÑ।
নিমার প্রতীক্ষার প্রহর যেন আর কাটতে চায় নাÑ।
কিভাবে দাঁড়াবে নিমা ঐ যুদ্ধজয়ী সৈনিকের সামনে...?
কিভাবে চোখে চোখ রেখে কথা বলবে...?
হাসানের সামনে নিজেকে কিভাবে উপস্থাপন করবে নিমা...?
যে বিষাক্ত ছোবল প্রতি নিয়ত দংশন করছে ওর দেহ মনে Ñ।
নিমা ভাবতে পারে নাÑ।
জানেনা এর পরিণাম কি হবে...?
কিভাবে ওকে গ্রহণ করবে হাসান Ñ?
বাবা মাঝে মাঝে জিজ্ঞেস করেনÑ
: হাসান কবে ফিরবে বলতে পারিসÑ?
বাবার কথায় নিমার বুকের ভেতরটায় যেন কেমন করে ওঠেÑ।
বলেÑ
: সময় হলেই ফিরবে বাবা।
বাবা আবার বলেন-
: আচ্ছা কি সাংঘাতিক কাÐ বলতো ?
: কি বাবা?
: এই যে আমাদের ছেলেপুলেরা মিলে দেশটাকে স্বাধীন করে ফেললো। ভাবতে কেমন অবাক লাগেÑ। আসলে আমাদের ছেলেরা পারেনা এমন কোন কাজ নেই। না-কি বলিস ...?
নিমা দেখলো দেশপ্রেম আর গর্বিত উত্তেজনায় যেন একটু উঠে বসতে চেষ্টা করেছেনÑবাবাÑ।
চোখে মুখে দারুন আবেগের ছোঁয়া...।
নিমা বাবাকে আবার শুইয়ে দিল পরম যতেœ।
একটু হাসবার মতো মুখ করে বললÑ
: তুমি ঠিকই বলেছো বাবা...।
নিজের ঘরে যাচ্ছিল নিমা।
বাবা আবার ডাকলেনÑ।
নিমা ফিরে দাঁড়ালোÑ।
বাবা বললেনÑ
: আচ্ছা হাসান এতো দেরী করছে কেন...?
ওর কাছে যে আমার অনেক কিছু জানার ছিলÑ।
অসুস্থ না হলে আমিও নিশ্চয় যুদ্ধে ওদের সঙ্গী হতাম। না কি বলিস ?
: হ্যাঁ বাবা।
: আমার জন্যে তোরও কোথাও যাওয়া হোল না। ভাগ্যিস তোর কোন ক্ষতি হয়নিÑ
নিমা জানলায় চোখ পেতে রইলো অনিমেষ। বুকের ভেতরটায় কেমন যেন কুকড়ে কুকড়ে ব্যথা করতে লাগলো...।
কোন কথা বললো না।

বাইরে বৈকালী রোদের ঝিলিমিলি।
লোকজনের কোলাহল।
বø্যাঙ্ক ফায়ারের আনন্দ ধ্বনিÑ।
এরই মধ্যে একদিন দলবল নিয়ে ফিরে এলো হাসান।
প্রচুর হৈ চৈÑ
শোর গোল ওদের উপস্থিতিতেÑ।
নিমা কিছু বুঝতে পারার আগেই ওপরে উঠে এলো হাসান।
নিমার আর নিচে নামা হোল না।
সিঁড়ির মুখেই ওকে দু’বাহু বাড়িয়ে বুকে টেনে নিল হাসানÑ।
নিমা যেন বিশ্বাস করতে পারছিল না।
স্বপ্ন নয়তোÑ
নিমার কাঁদবার কথা ছিল।
কিন্তু তাও ভুলে গেল ঘটনার আকস্মিকতায়।
একসময় ওরা দু’জন বাবার ঘরে এসে দাঁড়ালো। বাবা শুয়েছিলেন। উঠে বসতে চেষ্টা করলেন কাত হয়ে...।
বললেনÑ
: তুমি আমার সামনে এসে বস হাসান। তোমাকে একটু দেখি। তোমাদের দেখলেও পুণ্যিÑ। যুদ্ধ করেছো। দেশ স্বাধীন করেছো। বাংলার এক একটা রতœ তোমরা...সত্যি কি আনন্দ!
বসলো হাসান।
কাঁধ থেকে একটা ব্যাগ নামিয়ে রাখলো খাটের এক পাশে। নিমাকে বললÑ
: নাও এটা একটু সাবধানে রাখো। সব তোমার জন্যে।
নিমা বললÑ
: সে না হয় রাখব।
তোমাকে খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছে। একটু বোস। আমি তোমার জন্য খাবার নিয়ে আসি।
হাসান চট করে উঠে দাঁড়িয়ে পড়লো।
বললÑ
: না না খাবার টাবারের কোন দরকার নেই। বড্ড তাড়া আছেÑ। পরে আবার আসব।
নিমা বললÑ
: কতদিন পরে এলে। এখনি যাবে?
হাসান বললÑ
: হ্যাঁ এখনি। নাও ব্যাগটা তুলে রাখো।
নিমা একটু চুপ করে থেকে বললÑ
: কি আছে এতে?
হাসানের মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠলো হাসিতে।
বলল Ñ
: সাত রাজার ধন।
নিমা অবাক হ’ল।
: মানেÑ?
: দেখতে চাওÑ?
হাসান এবার ব্যাগের মুখটা খুলে উপুড় করে ঢাললো বিছানায়।
ছড়িয়ে পড়লো অনেকগুলো সোনা আর হীরের গহনা Ñ।
নিমা আতঙ্কিত হয়ে তাকালো হাসানের দিকে।
বললÑ
: তুমিতো যুদ্ধে গিয়েছিলেÑ!
হ্যাঁÑ
: তাহলে এগুলোÑ?
হাসান দৃঢ় কণ্ঠে বললÑ
: এগুলো যুদ্ধ জয়ের পুরস্কার।
: যুদ্ধ জয়ের পুরস্কার...! সরকার দিয়েছে তোমাকে...?
হাসান গয়নাগুলো ব্যাগে ঢুকাতে ঢুকাতে বললÑ
: সরকার দেবে কেনÑ। আমি মানে আমরা নিয়েছিÑ।
: মানে Ñ!
: মানে যেখানে যত উর্দুওয়ালা ছিল সে সব শেঠদের বাড়িতে আমরা রেট করে
এগুলো পেয়েছিÑ।
নিমার সমস্ত শরীর কাঁপতে লাগলো র্থ র্থ করে...।
কম্পিত কণ্ঠে বললÑ
: লুট করেছো...?
হাসান বলল Ñ
: তা কেন,সবাই তাই করছেÑ।
এবার আর চুপ করে থাকতে পারলেন না বাবা। অসুস্থ কম্পিত কণ্ঠে গর্জন করে উঠলেনÑ
: সবাই নয়Ñতোমার মতো চরিত্রের দু’একজন করছে।
হাসান ব্যাপারটাকে সহজ করবার জন্য হাসলো একটু। বললÑ
: এতে রাগবার কি হোল চাচা। আমরা যুদ্ধ করে দেশ শত্রæমুক্ত করেছি।
এসবের ওপর আমাদের হক আছে।
: না নেইÑ। নিরীহ মানুষের আমানতের ওপর অন্যের হক থাকতে পারে না। নিমা এতোক্ষণ দেয়ালে পিঠ দিয়ে দাঁড়িয়েছিল শক্ত হয়ে...।
ও যেন নিজের চোখ কানকে কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছিল না-যে
এই সেই হাসান।
হাসান তাকালো নিমার দিকেÑ।
বললÑ।
: প্লীজ নিমা চাচাকে বোঝাও।
নিমা প্রতিউত্তরে সমস্ত ঘৃণা ছুড়ে মারলো ওর দৃষ্টিতে।
বললÑ
: তুমি লুট করেছো...! ডাকাতি করেছো, ছিঃ হাসান ... ছিঃ...।
: ডোন্ট বি সেন্টিমেন্টাল নিমা, প্লীজ, টেক ইট ইজি। নাও ব্যাগটা রাখো।
পরে কথা হবে। আজ চলিÑ।
বলে সিঁড়ি দিয়ে তাড়াতাড়ি নেমে যাচ্ছিল হাসান।
: দাঁড়াও।
ডাকলো নিমা।
এতোদিন ওর মধ্যে যে আত্মগøানি বা অপরাধবোধ ওকে কুরে কুরে খাচ্ছিল, সেই অনুভূতি যেন এক মুহূর্তেই মিলিয়ে গেল হাসানের অপরাধের কাছেÑ।
হাসান ফিরে তাকালোÑ।
: কিছু বলবে?
: নাÑ
: তাহলে পিছু ডাকলে যে?
নিমা দেয়াল ধরে নিজেকে সামলে নিল অনেক কষ্টে।
তারপর ব্যাগটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল। এটা নিয়ে যাওÑ।
: কেন?

পাপ রাখার জন্যে-এ ঘর নয়।
: নিমা।
হাসান যেন বিশ্বাস করতে পারছে না।
বুঝতে পারছে নাÑএকি রূপ নিমার ...? একি শক্তি...?
একি সেই লাস্যময়ী প্রেমিকা নিমা ?
হাসান হাসবার মতো মুখ করেÑদু’ধাপ এগিয়ে আসতে গেল ওপরে।
বললÑ
: নিমা প্লীজ-ল²ীটি আমাকে ভুল বুঝ না।
হাসানের আর ওপরে আসা হোল না।
গয়না ভর্তি ব্যাগটা ছুঁড়ে মারলো নিমা হাসানের দিকেÑ।
সমস্ত চোখে মুখে প্রচÐ ঘৃণা ছুঁড়ে বললÑ
: ছিঃ
তারপর তরতরিয়ে ওপরে উঠে দরজা বন্ধ করে দিল দড়াম করেÑ।
কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে আরো কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলো হাসান।
বার বার অনুরোধ করলো নিমাকে দরজা খোলার জন্য।
কিন্তু দরজা নিমা খোলেনি।
হাসানের একটা কথাও কানে যায়নি ওর। বিস্ময়ে ঘেন্নায় মাথাটা ওর কেমন ঝিমঝিম করছিলÑ।
কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছিল না যে দেশের জন্য যে মানুষ জীবন বাজী রেখে যুদ্ধ করেছে, সেই মানুষ আত্মসুখের জন্যে অন্যের আমানত...?
এই কি একজন মুক্তিযোদ্ধার চরিত্র...?

বাবার কোলের কাছে লুটিয়ে পড়লো নিমা, হাসান কেন এমন হয়ে গেল বাবা... কি দরকার ছিল এসব করার...?
বাবা কোন কথা বলতে পারলেন না। ক্ষত-বিক্ষত নিমার অবিন্যস্ত চুলে হাত বুলাতে লাগলেন শুধুÑ।
নিমা একসময় বললÑ
: তুমি ঠিকই বলেছিলে বাবাÑসত্যি এমন কোন কাজ নেই যা আমাদের ছেলেরা পারে না।
বাবা এবার আর নিজেকে সামলাতে পারলেন নাÑ।
ফুঁফিয়ে কেঁদে উঠলেনÑ।
বাইরে তখন প্রচÐ শোরগোলে আতশবাজী আর বø্যাঙ্ক ফায়ারের আনন্দধ্বনিÑ।
নিমা দু’হাতে কান চেপে ধরে আকুল কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন