আবার আসব
আমরা ফিরে যাচ্ছি ক্যাম্পে। আবার আসব- আসতে হবে আমাদের। আগে বাড়া- পিছু হঠা- এটাই আমাদের
অধ্যাপক হাসান আবদুল কাইয়ুম : আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধকালে বেতারে প্রায়শ বাজত : ওলী আল্লাহর বাংলাদেশ/ শহীদ গাজীর বাংলাদেশ/ রহম করো, রহম করো, রহম করো আল্লাহ।...
রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেবো, এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইন্্শাআল্লাহÑ এই দৃঢ় প্রত্যয় আমাদের ভেতর সর্বক্ষণ অনুরণিত ছিল। আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনের পটভূমি পর্যালোচনা করলে দেখা যায় এতে পীর-মাশায়েখগণের প্রেরণা প্রত্যক্ষভাবে সক্রিয় ছিল।
বাংলাদেশে ইসলামের আবির্ভাব ঘটে ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হযরত উমর ফারুক রাদি আল্লাহতায়ালা আন্্হুর খিলাফতকালের মধ্যভাগে অর্থাৎ ৬৪০ খৃস্টাব্দের দিকে। আরব্য বণিকদের দ্বারা এর পূর্বেই ইসলামের খবর বাংলাদেশে এসে পৌঁছে। ইসলামে দলে দলে মানুষ দাখিল হন।
বাংলাদেশে ইসলাম প্রচারে সুফিয়ায়ে কেরামের অবদান অবিস্মরণীয় হয়ে রয়েছে। সুফিগণ এদেশের মানুষকে মানবিক মূল্যবোধে উদ্ভাসিত করেন। ১২০১ খৃস্টাব্দে ইখতিয়ারুদ্দীন মুহম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজীর বাংলা জয়ের মধ্য দিয়ে বাংলার মানুষ সর্বপ্রথম স্বাধীনতার আস্বাদন লাভ করে। মাতৃভাষায় জ্ঞানচর্চার অধিকার লাভ করে। পীর-মাশায়েখগণ এ দেশের মানুষকে সত্যিকার জীবনের সন্ধান দেন। ৫৫৬ বছরের মুসলিম সুশাসন এদেশকে সুলতানে বাঙ্গালা বা শাহে বাঙ্গালায় উন্নীত করে এবং বাঙালিয়ান সত্তা দান করে। যখনই বাংলার স্বাধীনতার ওপর হুমকি এসেছে তখনই পীর-মাশায়েখ তা রুখে দিয়েছেন।
বাংলার স্বাধীন সুলতান গিয়াসুদ্দীন আযম শাহের ইন্তেকালের পরে সুলতানের অমাত্য দিনাজপুরের ভাতুড়িয়ার জমিদার কংশনারায়ণ গণেশ বাংলার মসনদ কৌশলে দখল করে নিলে পীরে কামিল হযরত নূর কুতুবুল আলম রহমাতুল্লাহি আলাইহি অত্যাচারী রাজাগণেশকে হটিয়ে দেবার উদ্দেশে জৌনপুরের শাসনকর্তা ইব্্রাহীম শরকীকে পত্র দেন। পত্রে তিনি বলেন : প্রায় তিনশ বছর হয়েছে বাঙ্গালায় ইসলামের শাসন ব্যবস্থা কায়েম হয়েছে। কিন্তু অতিসম্প্রতি এখানে ঈমানকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার ষড়যন্ত্র মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে, সত্য-সুন্দরের দুশমনদের কালো থাবা এ দেশটাকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে, দেশজুড়ে অন্ধকার নেমে এসেছে, মুসলিমদের জানমাল, ইজ্জত-আব্রæর ওপর মারাত্মক আঘাত এসেছে। ইসলামের যে আলোক-প্রদীপ এখানকার মানুষকে যে সত্য পথের দিশা আসছিল আজ তা হুমকির মুখে। এই মহাদুর্দিনে আপনি কেমন করে নির্বিঘেœ আপনার মসনদে আসীন থাকতে পারেন? আপনি আপনার ওই সুখের মসনদ ছেড়ে উঠে আসুন। দীনকে সংরক্ষণের জন্য আপনি অতিসত্বর এগিয়ে আসুন। আপনার তরবারি কোষবদ্ধ না রেখে কুফরের প্রজ্বলিত অগ্নিশিখা নির্বাপণে আপনি জোর কদমে অগ্রসর হোন। আপনি তো জানেন, বাঙ্গালা হচ্ছে পৃথিবীতে বেহেশত। কিন্তু সেই বেহেশতে এখন দোজখের কালো ছায়া ছেয়ে ফেলেছে। এখানে অত্যাচার, জুলুম, নিপীড়ন আর হত্যাকাÐের যে কাÐকারখানা চলছে, তা দমন করতে আপনি আসুন। আরামের মসনদে আর এক পলকও বসে থাকবেন না।
সেই দীর্ঘ জ্বালাময়ী পত্র পেয়ে ইব্্রাহীম শরকী কোনোরূপ কালক্ষেপণ না করে বিরাট বাহিনী নিয়ে বাঙ্গালার বিপন্ন স্বাধীনতাকে বিপন্ন অবস্থা থেকে উদ্ধার করার জন্য এগিয়ে এলেন। এ খবর শুনে সমূহ বিপদের আশঙ্কা করে জানে মরার ভয়ে কংশনারায়ণ গণেশ হযরত নূর কুত্বুল আলম রহমাতুল্লাহি আলাইহির দরবারে এসে ক্ষমা চাইলেন এবং তার পুত্র যদুকে মুসলিম করে নেওয়ার অনুরোধ করলেন। হযরত নূর কুতুবুল আলম (রহ.) যদুকে ইসলামে বায়’আত করলেন এবং নাম রাখলেন জালালুদ্দীন মুহম্মদ শাহ্। এ খবর পেয়ে তার বিশাল বাহিনী নিয়ে ইব্্রাহিম শরকী জৌনপুরে ফিরে গেলেন।
বাংলদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে হযরত নূর কুতুবুল আলম (রহ)-এর নাম অনন্য উজ্জ্বল্যে বিদ্যমান রয়েছে।
স্বাধীন বাংলার দিকে ভিন্ন শ্যেন দৃষ্টি পড়ে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির। তারা হিন্দু কয়েকজন প্রভাবশালী অমাত্য ও জগতশেঠদের সাথে আঁতাত করে এবং মসনদের লোভ দেখিয়ে মীর জাফরকে দলে এনে ১৭৫৭ খৃষ্টাব্দের ২৩ জুন পলাশী প্রান্তরে এক প্রহসনমূলক যুদ্ধের মাধ্যমে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজুদ্দৌলার কাছ থেকে বাংলার স্বাধীনতা সূর্য হরণ করে নেয়। স্বাধীন বাংলা, শাহে বাঙ্গালা, সুলতানে বাঙ্গালা পরাধীনতার শেকলে আবদ্ধ হয়। নানা প্রকার দমন নীতি প্রয়োগ করে মুসলিমদের ওপর অকথ্য নির্যাতন চালানো হয়। পাঁচসালা, দশসালা প্রকল্পের মাধ্যমে মুসলিমদের সর্বহারা করে দেয়া হয়, কিন্তু মুসলিমদেরকে তারা দমাতে পারেনি। মীর কাসিম, সুফি দরবেশ ফকির মজনুশাহ্, হাজী শরীয়তুল্লাহ, সৈয়দ নিসার আলী, তিতুমীর সশস্ত্র বিপ্লবের ডাক দিয়েছেন, স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। তারা স্বাধীনতা সংগ্রামের সুরম্য সড়ক নির্মাণ করতে করতে অগ্রসর হয়েছেন। ১৮৫৭ খৃস্টাব্দে সিপাহি জনতার মহাবিপ্লবের নেতৃত্বে সুফি-দরবেশ, আলেম-ওলামার ভ‚মিকার কথা সর্বজনবিদিত। পীর মুহসিনউদ্দীন দুদু মিয়া বন্দী হয়েছেন। মাওলানা কায়রাবাদীকে আন্দামানে নির্বাসিত করা হয়েছে।
তারপরের ইতিহাস নতুন কৌশলে স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস। শহীদে বালাকোট হযরত সৈয়দ আমদ বেরেলবী (রহ.)-এর খলিফা এদেশকে দারুল আমান ঘোষণা করে স্বাধীনতা সংগ্রামের গতিকে আরো জোরদার করে তোলেন। তার দোয়া গ্রহণ করে ফরিদপুরের নবাব আবদুল লতিফ শিক্ষা আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটান। ফুরফুরা শরীফের পীর মাওলানা শাহ্ সুফি আবু বকর সিদ্দিকী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি কুসংস্কারাচ্ছন্ন মুসলিমদের স্বাধীন সত্তা সজাগ করে তুললেন। তিনি বললেন, ডাইনে আমার কোরআন মজিদ, বামে হাদিস শরিফ এবং সামনে ব্রিটিশ আইন। কোরআন হাদিস পরিপন্থী কোনো আইন যদি ব্রিটিশ রাজ আমাদের ওপর চাপিয়ে দেয় তা আবু বকর মানবে না, এদেশের মুসলমানরা তা মানবে না। তিনি বাংলা ভাষায় তাসাওউফ চর্চার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। সেকালে বাংলা ভাষায় মুসলিম সম্পাদিত অধিকাংশ পত্র-পত্রিকা তার উদ্যোগে ও পৃষ্ঠপোষকতায় প্রকাশিত হয়। তার উদ্যোগে ৮০০ মসজিদ ও ১১০০ মাদরাসা প্রতিষ্ঠিত হয়।
১৯৪৭ খৃস্টাব্দের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান নামক রাষ্ট্র কায়েম হলো কিন্তু এর পূর্বাঞ্চলের পূর্ববাংলা অংশে নেমে এলো অকল্পনীয় বৈষম্য। বাংলা ভাষাকে বাদ দিয়ে উর্দুকে রাষ্ট্র ভাষা ঘোষণা করা হলো। রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটানো হলো। এই আন্দোলন নিয়ে ময়দানে অবতীর্ণ হলো তমুদ্দুন মজলিস। এর আগেই পীরে কামেল ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ সোচ্চার হয়েছিলেন। পীরে কামেল মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী গঠন করলেন আওয়ামী মুসলিম লীগ। যা পরবর্তীকালে আওয়ামী লীগ নামে শক্ত বুনিয়াদ লাভ করল। ভাষা আন্দোলন, স্বাধিকার আন্দোলন চ‚ড়ান্ত পর্যায়ে এসে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে পরিণত হলো। সমস্ত আন্দোলনে মওলানা ভাসানী ছিলেন আন্দোলনের নয়নমণি। আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর ভাষায় বলা যায় : আমাদের মিলিত সংগ্রাম/মওলানা ভাসানীর নাম।
লেখক : মুফাসসিরে কোরআন, গবেষক, সাবেক পরিচালক ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।