আবার আসব
![img_img-1720389880](https://old.dailyinqilab.com/resources/images/cache/169x169x3_1648218902_07.jpg)
আমরা ফিরে যাচ্ছি ক্যাম্পে। আবার আসব- আসতে হবে আমাদের। আগে বাড়া- পিছু হঠা- এটাই আমাদের
শেখ দরবার আলম
\ এক \
হিন্দুপ্রধান হোক কিংবা মুসলিম প্রধান হোক, ভারতীয় উপমহাদেশের কোনো দেশের স্বাধীনতাকে সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে হলে ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলমানদের প্রতিবেশী বড় সমাজের ধর্মীয় সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদ এবং ধর্মীয় সাংস্কৃতিক একজাতিতত্ত¡কে সুস্পষ্টভাবে জানতে এবং উপলব্ধি করতে হবে।
জাতীয়তাবাদ ধর্মের ভিত্তিতে হোক, বনের বা গায়ের রঙের ভিত্তিতে হোক, ভাষার ভিত্তিতে হোক, কিংবা অঞ্চল বা আঞ্চলিকতার ভিত্তিতে হোক, যে কোনো জাতীয়তাবাদী আন্দোলন দাঁড় করাতে হলে কোনো জনগোষ্ঠীকে প্রতিপক্ষ এবং শত্রæ হিসেবে শনাক্ত করতে হয়। তা না হলে কোনো জাতীয়তাবাদী আন্দোলন দাঁড় করানো যায় না। তুঙ্গে তোলা তো অনেক দূরের কথা!
প্রথমেই স্মরণ রাখা দরকার যে, কোনো জনগোষ্ঠীর লোকজন যে রকম জাতীয়তাবাদীই হন না কেন, সেই জনগোষ্ঠীর সব মানুষই যে জাতীয়তাবাদী হন এমনটাও নয়। যেমনÑ ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলমানদের প্রতিবেশী বড় সমাজের অর্থাৎ বৈদিক ব্রাহ্মণ শাসিত বর্ণ ও অধিকার ভেদাশ্রয়ী মনুসংহিতার সমাজের ধর্মীয় সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদের প্রতিপক্ষ ও শত্রæ সমাজ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে মুসলমান সমাজ। কিন্তু ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলমানদের প্রতিবেশী বড় সমাজে মনুষ্যত্ববোধে উত্তীর্ণ এমন অনেক মহৎ মানুষও আছেন, যারা জাতীয়তাবাদী নন। মুসলমানদেরকেও প্রতিপক্ষ ও শত্রæ হিসেবে দেখেন না। মানুষ হিসেবেই দেখেন। মনুষ্যত্ববোধে উত্তীর্ণ এরকম মহৎ মানুষ সব ধরনের জাতীয়তাবাদী জনগোষ্ঠীর মধ্যেই থাকেন। তারা কোনোক্রমেই প্রতিপক্ষ ও শত্রæ হিসেবে চিহ্নিত জনগোষ্ঠীর কাউকে অধিকার বঞ্চিত করে সাম্প্রদায়িক হওয়ার মতো মানসিক যোগ্যতার পরিচয় দেওয়ার মানসিক ক্ষমতা রাখেন না। প্রতিপক্ষ ও শত্রæ হিসেবে চিহ্নিত জনগোষ্ঠীর কারো জানমাল কেড়ে নিয়ে ফ্যাসিস্ট হওয়ার মানসিক যোগ্যতা তো তাদের থাকেই না। কেননা, তারা মনুষ্যত্ববোধে উত্তীর্ণ মানুষ।
আর ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলমানদের প্রতিবেশী বড় সমাজের ধর্মীয় সাংস্কৃতিক একজাতিতত্ত¡টা হলো এই যে, ভারতীয় উপমহাদেশে থাকবে কেবল হিন্দুদের ধর্মীয় সমাজের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও হিন্দুদের ধর্মীয় সংস্কৃতির পরম্পরা এবং এই পরম্পরাভিত্তিক হিন্দু জাতিসত্তার অস্তিত্ব, মুসলমান সমাজের ইতিহাস-ঐতিহ্য ও মুসলমানদের ধর্মীয় সংস্কৃতির পরম্পরা এবং এই পরম্পরাভিত্তিক মুসলিম জাতিসত্তার অস্তিত্ব ভারতীয় উপমহাদেশের কোথাও থাকতে দেয়া হবে না। ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলমানরা নিজেদেরকেও হিন্দুদের মতো একটা আলাদা ধর্মীয় সাংস্কৃতিক জাতি হিসেবে দাবি করলে সেটাকে বলা হবে একটা আপত্তিকর দ্বিজাতিতত্ত¡। সেটাকে ভিত্তিহীনভাবে সাম্প্রদায়িকতা বলেও অভিহিত করা হবে।
১৯৪৭-এর মধ্য-আগস্টের স্বাধীনতার আট বছর আগে ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দে রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবকসংঘের সরসংঘচালক (সর্বাধিনায়ক) গুরুজিমাধব সদাশিব রাও গোলওয়ালকর “উই অর আওয়ার নেশনহুড ডিফাইন্ড” শিরোনামে একটা পুস্তিকায় ৫৫ এবং ৫৬ পৃষ্ঠায় লিখেছিলেন :
“ঞযব হড়হ-ঐরহফঁ ঢ়বড়ঢ়ষবং রহ ঐরহফঁংঃধহ সঁংঃ বরঃযবৎ ধফড়ঢ়ঃ ঃযব ঐরহফঁ পঁষঃঁৎব ধহফ ষধহমঁধমব... ড়ৎ সধু ংঃধু রহ ঃযব পড়ঁহঃৎু যিড়ষষু ংঁনড়ৎফরহধঃবফ ঃড় ঃযব ঐরহফঁ হধঃরড়হ, পষধরসরহম হড়ঃযরহম, ফবংবৎারহম হড় ঢ়ৎরারষবমবং... হড়ঃ বাবহ পরঃরুবহ’ং ৎরমযঃং.”
অর্থাৎ “হিন্দুস্তানে যারা হিন্দু নন তাদেরকে অবশ্যই হিন্দুর ভাষা এবং সংস্কৃতি গ্রহণ করতে হবে। ... অথবা কিছুই দাবি না করে, সুযোগ-সুবিধার কোনো কিছুই পাওয়ার ব্যাপারে নিজেদেরকে উপযুক্ত না ভেবে, এমনকি নাগরিকত্বের অধিকারও পাওয়ার ব্যাপারে নিজেদেরকে উপযুক্ত না ভেবে দেশে হিন্দু জাতির পুরোপুরিই অধীনস্থ হয়ে থাকতে হবে।”
এখানে রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সঙ্ঘ (আরএসএস)-এর এই হিন্দু ধর্মীয় সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদ এবং হিন্দু ধর্মীয় সাংস্কৃতিক একজাতিতত্ত¡ আরোপ কামনাটা অত্যন্ত খোলাখুলিভাবে খুবই স্পষ্ট এবং চরম উগ্র। কিন্তু কৌশলে এই একই জাতীয়তাবাদ এবং একজাতিতত্ত¡ ধারণ করেছেন ডান-বাম নির্বিশেষে বৈদিক ব্রাহ্মণ শাসিত বর্ণ ও অধিকার ভেদাশ্রয়ী মুনসংহিতার সমাজের সব রাজনৈতিক সংগঠন। ফলে ১৯৪৭-এর ৩ জুনের আগে সর্বভারতীয় রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যে মুসলমানদের অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, আইনগত, শিক্ষাগত, সামাজিক ও রাজনৈতিক অধিকারের সাংবিধানিক রক্ষাকবচ ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলমানদের প্রতিবেশী বড় সমাজ দিতে সম্মত হননি। এখনকার অনেক সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য সেই ইতিহাসটার চর্চা অনেক হাতে ব্যাপকভাবে হওয়া দরকার। আমার এ বক্তব্যেও যদি ভুল কিছু থাকে তবে তারিখ-তথ্য বিশ্লেষণের মাধ্যমে এসব খÐন করার অধিকার নিশ্চয়ই সবারই থাকা উচিত এবং আছে। ভারতীয় উপমহাদেশের আমাদের প্রতিবেশী বড় সমাজের মনুষ্যত্ববোধে উত্তীর্ণ অনেক গুণীজনদের লেখায়ও এ বিষয়ে অনেক সঠিক তারিখ-তথ্য আছে। স্ট্যানলি উল্পার্টের মতো, হেক্টর বোলাইথের মতো ভারতীয় উপমহাদেশের বাইরের অনেক গুণীজনের লেখায় অনেক গুরুত্বপূর্ণ তারিখ-তথ্য আছে। প্রতিবেশী দেশের অমলেশ ত্রিপাঠীর মতো ঐতিহাসিকের লেখায়, রামমনোহর লোহিয়া এবং অতুল্য ঘোষের মতো রাজনৈতিক নেতাদের লেখায় এবং নিত্য প্রিয় ঘোষের মতো মননশীল লেখকদের লেখায় অনেক তারিখ তথ্য আছে।
\ দুই \
ভূ-রাজনৈতিক ও বাণিজ্যিক স্বার্থে একটি শক্তিশালী ভারত ব্রিটিশরা চেয়েছিল। শূদ্ররা এবং মুসলমানরা মিলে যাতে ভারতের শাসন ক্ষমতা নিজেদের হাতে নিতে না পারে সে ব্যাপারে বৈদিক ব্রাহ্মণ শাসিত বর্ণ ও অধিকার ভেদাশ্রয়ী মনুসংহিতার সমাজ খুবই সচেতন, সুসংগঠিত ও সক্রিয় ছিল। বৈদিক ব্রাহ্মণ শাসিত বর্ণ ও অধিকার ভেদাশ্রয়ী মনুসংহিতার সমাজ ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলমানদের একটা জাতি হিসেবে স্বীকার করে কোনো অধিকার দিতে চায়নি। তারা সব সময়েই চেয়েছে ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলমানরা মুসলমান সমাজের ইতিহাস-ঐতিহ্য ও ইসলামী সাংস্কৃতিক পরম্পরা এবং এই পরম্পরাভিত্তিক মুসলিম জাতিসত্তা ত্যাগ করে হিন্দু সমাজের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও হিন্দুদের ধর্মীয় সংস্কৃতির পরম্পরা এবং এই পরম্পরাভিত্তিক হিন্দু জাতিসত্তা নিজেদের বলে গ্রহণ করুন।
\ তিন \
ক্রিপ্স এবং অ্যাটলির সঙ্গে ১৯৩৮ সাল থেকে পÐিত জওহর লাল নেহেরুর কথা হচ্ছিল। পÐিত জওহর লাল নেহেরুর ফরমায়েশ মোতাবেক লড মাউন্টব্যাটেনকে ভাইসরয় করে পাঠিয়ে ছিলেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী অ্যাটলি। পÐিত জওহর লাল নেহেরু, ভি.পি. মেনন এবং কৃষ্ণ মেননের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে ১৯৪৭-এর মধ্য-আগস্টের বিভাজনের প্ল্যান পার্টিশন ভি.পি. মেননকে দিয়ে প্রণয়ন করানোর কাজটা করিয়ে নিয়েছিলেন বড়লাট লর্ড মাউন্টব্যাটেন। এসব নিয়ে ....
মূলত ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলমানদের প্রতিবেশী বড় সমাজের তরফে ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের নেতা পÐিত জওহর লাল নেহেরু যখন ১৯৪৭-এ সিমলায় ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনামলের শেষ ভাইসরয় লর্ড মাউন্ট ব্যাটেনের সঙ্গে আলোচনা করছিলেন তখন প্ল্যান পার্টিশন প্রণয়নের ব্যাপারে তাদের মধ্যে কী আলোচনা হচ্ছিল তা ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের নেতৃবৃন্দ ও মনুসংহিতার সমাজের অন্যান্য রাজনৈতিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ জানতে পারছিলেন এবং বিশেষত ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের নেতৃবৃন্দের মাধ্যমে শিখরাও জানতে পারছিলেন। কিন্তু নিখিল ভারত মুসলিম লীগ নেতারা এসব বিষয়ে কিছুই অবহিত হওয়ার সুযোগ পাননি। নিখিল ভারত মুসলিম লীগ নেতারা ১৯৪৭-এর মধ্য-আগস্টের প্ল্যান পার্টিশন সম্পর্কে আকস্মিকভাবে প্রথম অবহিত হন ১৯৪৭-এর ২ জুন সোমবার সকাল ১১টায় বড় লাট লর্ড মাউন্ট ব্যাটেনের আহŸানে অনুষ্ঠিত হিন্দু শিখ এবং মুসলমান নেতাদের মিটিংয়ে।
এই প্ল্যান পার্টিশনের ব্যাপারে হিন্দু নেতারা এবং হিন্দু নেতাদের মাধ্যমে শিখ নেতারা অনেক আগে থেকে অবহিত ছিলেন। কিন্তু কায়েদে আযম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ, কায়েদে মিল্লাত লিয়াকত আলী খান এবং আবদুর রব নিশ্তার এ বিষয়ে প্রথম অবহিত হয়েছিলেন ওই ২ জুন ১৯৪৭ তারিখ সোমবার সকাল ১১টার মিটিংয়ে। ওদেরকে নিখিল ভারত মুসলিম লীগের কাউন্সিল অধিবেশন কিংবা ওয়ার্কিং কমিটির অধিবেশন আহŸান করে এ বিষয়ে মতামত নেওয়ার কোনো সুযোগ লর্ড মাউন্ট ব্যাটেন কোনোক্রমেই দিতে চাননি। ওই দিনই রাত ১১টার মধ্যে সম্মতি দিতে বাধ্য করতে চেয়েছিলেন পÐিত জওহর লাল নেহেরুর ফরমায়েশক্রমে ব্রিটেনের মুসলিম বৈরী প্রধানমন্ত্রী অ্যাটলির নিয়োজিত মুসলিম বৈরী বড়লাট লর্ড মাউন্ট ব্যাটেন।
ওই ২ জুন ১৯৪৭ তারিখ সোমবার রাত ১১টায় বড়লাট লর্ড মাউন্ট ব্যাটেনকে কায়েদে আযম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ জানিয়েছিলেন যে, নিখিল ভারত মুসলিম লীগ নেতাদের কাউন্সিল অধিবেশন বা ওয়ার্কিং কমিটির অধিবেশন আহŸান করে এ বিষয়ে সম্মতি না নিয়ে সম্মতি তিনি জানাতে পারেন না।
জবাবে মাউন্ট ব্যাটেন অনেক হুমকি দিলেন।
কায়েদে আযম বললেন, যা হয় হোক।
শেষে মাউন্ট ব্যাটেনই আবার প্রস্তাব দিলেন যে, পরদিন ৩ জুন মঙ্গলবার সকাল ১১টায় তার আহŸানে হিন্দু, শিখ এবং মুসলিম নেতাদের যে বৈঠক হবে সেখানে তিনি বলবেন যে, এ বিষয়ে কায়েদে আযম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর সম্মতি পাওয়া গেছে। আপনি তখন কেবল নীরবে সামনের দিকে মাথাটা একটু ঝোকাবেন।
অগত্যা কায়েদ আযম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ৩ জুন ১৯৪৭ তারিখ মঙ্গলবার সকাল ১১টায় হিন্দু, শিখ ও মুসলমান নেতাদের বৈঠকে বা সভায় এভাবে এটুকু নীরব সম্মতিই কেবল দিয়েছিলেন। তা না হলে হিন্দু, শিখ, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক সরকার, ব্রিটিশ সরকার এবং ব্রিটিশ কমনওয়েলথের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হতো।
এ বিষয়ে বিস্তারিত বিবরণ আছে কলকাতার আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড থেকে প্রকাশিত ঐতিহাসিক অমলেশ ক্রিপাঠির লেখা ‘স্বাধীনতা সংগ্রামে ভারতের জাতীয় কংগ্রেস’ শিরোনামের গ্রন্থে।
অক্সফোর্ড ইউনির্ভাসিটি প্রেস থেকে প্রকাশিত ‘জিন্নাহ ক্রিয়েটার অব পাকিস্তান’ শীর্ষক গ্রন্থে ওই ৩ জুন ১৯৪৭ তারিখ মঙ্গলবার সন্ধ্যা ৬টায় অল ইন্ডিয়া রেডিওর ডোমিনিয়ন স্ট্যাটাস সম্পন্ন ভারত সৃষ্টির এবং পাকিস্তান সৃষ্টির ঘোষণা দিয়েছিলেন ভাইসরয় লর্ড মাউন্ট ব্যাটেন।
লর্ড মাউন্ট ব্যাটেনের পর প্রথমে ইংরেজিতে এবং পরে হিন্দিতে ভাষণ দিয়েছিলেন ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের সে সময়কার সভাপতি পÐিত জওহর লাল নেহেরু। ইংরেজি ও হিন্দিতে উভয় ভাষণের শেষে তিনি উচ্চারণ করেছিলেন ‘জয় হিন্দ’।
অন্যদিকে নিখিল ভারত মুসলিম লীগের সভাপতি কায়েদে আযম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ অতি সংক্ষেপে ভাষণ দিয়েছিলেন বা বক্তব্য পেশ করেছিলেন। ইংরেজিতে শেষে তিনি অনেকটা আকস্মিকভাবে উচ্চারণ করেছিলেন পাকিস্তান জিন্দাবাদ।
কায়েদে আযম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর ইংরেজি ভাষণ বা বক্তব্য উর্দুতে অনুবাদ করে পাঠ করেছিলেন আবদুর রব নিশতার।
এর পরের দিনই বড়লাট মাউন্ট ব্যাটেন সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ডমিনিয়ন স্ট্যাটাস সম্পন্ন ভারত এবং পাকিস্তান সৃষ্টি হবে ১৯৪৭ এর ১৫ আগস্ট তারিখে।
স্বাধীনতার তারিখ পাকিস্তান পেয়েছে ১৪ আগস্ট এবং ভারত পেয়েছে ১৫ আগস্ট।
চার
হেক্টর বোলাইথোর ‘জিন্নাহ : ক্রিয়েটর অব্ পাকিস্তান’ ঐতিহাসিক স্ট্যানলি উলপাটের ‘জিন্নাহ অব্ পাকিস্তান’ এবং ‘নেহরু : আ ট্রিস্ট উইথ ডেসটিনি’, ঐতিহাসিক আমলেশ ত্রিপাঠীর লেখা স্বাধীনতা ‘সংগ্রামে ভারতের জাতীয় কংগ্রেস’, ১৯৮৫-তে প্রকাশিত কলকাতার আনন্দ বাজার পত্রিকা লিমিটেডের সাপ্তাহিক ‘দেশ’ পত্রিকার কংগ্রেস শতবর্ষ সংখ্যায় সর্দার বল্লভ ভাই প্যাটেল পন্থী প্রবীণ কংগ্রেস নেতা অতুল্য ঘোষের লেখা ‘ভারত বিভাগ/ কার্য ও কারণ)’, ঢাকার খোশরোজ কিতাব মহল থেকে প্রকাশিত আবুল কালাম শামসুদ্দীনের ‘অতীত দিনের স্মৃতি’, ঢাকার নতুন সফর প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত ইব্রাহীম হোসেনের ‘ফেলে আসা দিনগুলো’ যদি কেউ পড়েন তা হলে তিনি নিশ্চিত হতে পারবেন যে, ১৯৪৭ এর মধ্য-আগস্টের বিভাজন ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলমানদের প্রতিবেশী বড় সমাজ যেভাবে চেয়েছিল ঠিক সেভাবেই হয়েছে। ১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দের ২৪ সেপ্টেম্বর বোম্বাইয়ে কায়েদে আযম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর মালাবার হিলসের বাড়িতে কায়েদে আযমকে বলা বক্তব্যে ওদিন সন্ধ্যার পর কায়েদে আযম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহকে লেখা চিঠিতে মহাত্মা মোহন দাস করমচাঁদ গান্ধী যেভাবে চেয়েছিলেন কায়েদে আযমের আপত্তি সত্তে¡ও ঠিক সেভাবেই হয়েছে। এটা ছিল মনুসংহিতার সমাজের সিদ্ধান্ত। আর এটাও জানা যাবে যে, নিখিল ভারত মুসলিম লীগের ইচ্ছার বিরুদ্ধে মুসলিমপ্রধান অবিভক্ত পাঞ্জাবি, মুসলিমপ্রধান অবিভক্ত আসাম এবং মুসলিম প্রধান অবিভক্ত বাংলা ভাগ করে ব্রিটিশ ভারতের বিশ শতাংশ জায়গা দিয়ে, ভারতীয় উপমহাদেশের দশ শতাংশ জায়গা দিয়ে ভারতীয় উপমহাদেশে অস্থায়ীভাবে একটা মুসলিম প্রধান দেশ সৃষ্টি করা হয়েছিল।
সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলমানদের রাজনৈতিক সংগঠন নিখিল ভারত মুসলিম লীগের দাবি পূর্বাপর ছিল বিভিন্ন ধর্মীয় সমাজের অর্থনৈতিক সাম্য ও সামাজিক সাম্য এবং আট সাংস্কৃতিক সহাবস্থানের নীতিতে সর্বভারতীয় রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যে মুসলমান সমাজের অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, আইনগত, শিক্ষাগত, সামাজিক ও রাজনৈতিক অধিকারের সংবিধানিক রক্ষাকবচ। এ প্রসঙ্গে ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসের ২২, ২৩ এবং ২৪ তারিখে লাহোরে অনুষ্ঠিত নিখিল ভারত মুসলিম লীগের ২৭তম অধিবেশনে ব্রিটিশ ভারতের মুসলিমপ্রধান অবিভক্ত পাঞ্জাব, মুসলিমপ্রধান অবিভক্ত আসাম, মুসলিমপ্রধান অবিভক্ত বাঙলা, সিন্ধু, বেলুচিস্থান এবং উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ নিয়ে যে একটা মুসলিমপ্রধান রাষ্ট্র সৃষ্টি করার প্রস্তাব কেন করা হয়েছিল সে প্রশ্ন অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবেই আসে। সে প্রশ্নের জবাব আছে ঐতিহাসিক অমলেশ ত্রিপাঠীর লেখা ‘স্বাধীনতা সংগ্রামে ভারতের জাতীয় কংগ্রেস’ শিরোনামে গ্রন্থে। ১৯৪৬ সালে কেবিনেট মিশন ভারতে আসার পর সে সময়কার কংগ্রেস সভাপতি মওলানা আবুল কালাম আজাদ কাউকে কিছু না বলে নিখিল ভারত মুসলিম লীগের শীর্ষ স্থানীয় নেতাদের সঙ্গে দেখা করে জানতে চেয়েছিলেন, ব্রিটিশ ভারতে একটা মুসলিমপ্রধান রাষ্ট্র সৃষ্টির প্রস্তাব তারা কেন নিয়েছিলেন। জবাবে নিখিল ভারত মুসলিম লীগের শীর্ষ স্থানীয় নেতারা বলেছিলেন, ভারতের জাতীয় কংগ্রেস ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলমানদের প্রতিবেশী বড় সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে কেন্দ্রীয় আইন সভায় যে কোনো আইন পাস করাবেন বলেন। ব্রিটিশ ভারতের মুসলিমপ্রধান প্রদেশগুলোর স্বায়ত্তশাসন ও সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে খর্ব করার আকাক্সক্ষা তারা পোষণ করেন। এরই বিরুদ্ধে চাপ সৃষ্টি করার জন্য ১৯৪০-এ লাহোরে এই প্রস্তাব তারা করেছেন। এ কথা শোনার পর মওলানা আবুল কালাম আজাদ ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের কাউকে কিছু না বলে সংবাদ সম্মেলন আহŸান করে এই কথাগুলো জানিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু ১৯৪৭ এ প্ল্যান পার্টিশন প্রণয়ন করার সময় ভি পি মেনন, কৃষ্ণ মেনন, পÐিত জওহর লাল নেহেরু এবং লর্ড মাউন্ট ব্যাটেন ওই লাহোর প্রস্তাব নিয়ে কোনো মাথা ঘামাননি।
১৯৪৭-এর মধ্য-আগস্টে বিভাজন নিখিল ভারত মুসলিম লীগ কখনই চায়নি। তবে এটাও সত্য যে, নিলিখ ভারত মুসলিম লীগের মতো রাজনৈতিক সংগঠন না থাকলে ব্রিটিশ ভারতের বিশ শতাংশ জায়গা নিয়ে, ভারতীয় উপমহাদেশের দশ শতাংশ জায়গা নিয়ে একটা মুসলিমপ্রধান রাষ্ট্র সৃষ্টি হতো না। কিন্তু সবচেয়ে বড় কথাটা হলো এই যে, ভারতীয় উপমহাদেশের এই মুসলিমপ্রধান দেশটা মনুসংহিতার সমাজ কোনো দিন স্থায়ীভাবে মেনে নেয়নি। কেননা, ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলমানদেরই তারা আলাদা জাতি হিসেবে মেনে নেয়নি। ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে তারা মুসলমানদের ইতিহাস, ঐতিহ্য, ইসলামী সংস্কৃতি এবং মুসলিম জাতিসত্তা মুছে ফেলতে চায়। এটাই বাস্তবতা। অনেক কিছু সাক্ষ্য করে আমার নিজস্ব অভিজ্ঞতা এবং পড়াশোনার ভিত্তিতে আমি এ বিষয়ে নিশ্চিত হয়েছি। অগত্যা বাধ্য হয়েই লিখলাম।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।