হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির খড়গ : আসামের এনআরসি এবং বাংলাদেশ
![img_img-1719558281](https://old.dailyinqilab.com/resources/images/cache/169x169x3_1533652697_1.gif)
কিশোর শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক দাবীর আন্দোলনে ঢাকাসহ সারাদেশে তীব্র রাজনৈতিক উত্তেজনা ও অনিশ্চয়তা দেখা যাচ্ছিল,
আফতাব চৌধুরী : ব্যারিংটন মূর একবার বলেছিলেন, বাংলাদেশী সমাজকে আধুনিক করে তুলতে না পারলে স্বাধীনতার বিকাশ অসম্ভব। সত্যিই, একমাত্র সম্পন্ন সমাজই পারে স্বাধীনতার পরবর্তী দিনগুলোতে দেশকে মানবকল্যাণের পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে। ১৯৭১ সালের অনেক আগেই অনেকে বুঝেছিলেন, এ দেশে দারিদ্র্য ও অশিক্ষার উপস্থিতিটা এত বেশি যে, স্বাধীনতার পরেই গণতন্ত্র মুক্ত নয়, বরং কঠিন সংকটে পতিত হবে।
বাংলাদেশকে বলা হয়ে থাকে, একটি উন্নয়নমুখী দেশ। আজ কি এ কথাটা সম্পূর্ণ সত্য? মনগড়া আদর্শের ছাঁচে স্বাধীনোত্তর বাংলাদেশে আমরা যে ‘গণতন্ত্র’ তৈরি করেছি তাকে কিছু উচ্চাভিলাষী ব্যক্তি শ্রদ্ধার সাথে দেখলেও। তাদের স্তোকবাক্য এখন এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, ১৬ কোটি মানুষের সিংহভাগই আজ তারই আড়ালে রয়ে গেছে।
বাংলাদেশের মত হাজারো সমস্যার দেশে অর্জিত স্বাধীনতাকে টিকিয়ে রাখাই মুশকিল। এই দেশে আজকে যে সমস্যাগুলো সবচেয়ে বড় হয়ে দেখা দিয়েছে সেগুলোর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেযোগ্য দারিদ্র্য, অশিক্ষা, দুর্নীতি, সংরক্ষণ, বিচ্ছিন্নতা, কেন্দ্রিকতা, হিংসাশ্রয়ী আন্দোলন, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি এবং বিশ্বায়ন। এই সমস্যাগুলোর যথাযথ সমাধান আজও হয়নি বরং বেড়েই চলেছে। এরা গণতন্ত্রের প্রতিবন্ধক নয়, গণতন্ত্র প্রসূত গণতন্ত্র। এই সমস্যাগুলোর ও সুযোগের পথও শুধু তৈরি করেনি, প্রশস্তই করে দিয়েছে।
গণতন্ত্র ডেমোক্রিসির অনূদিত রূপ। ‘ডেমোস’ (স্টেট)-এ বসবাসকারী জনগণ এবং ‘ক্রেটোস’ (ক্ষমতা বা শাসন) দুয়ে মিলে তৈরি হয়েছে এমন পরিধি যেখানে ‘জনশাসন’ ব্যাপারটি স্পষ্ট হয়ে যায়। তবুও এখনও গণতন্ত্র নিয়ে চলছে বাকবিতন্ডা ‘জনশাসন’ বা ‘জনক্ষমতা’ সৃষ্টি করেছে সন্দেহ। বাংলাদেশে গণতন্ত্র শুধু সন্দেহের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই, আশংকা হয়, কোনদিন না এই গণতন্ত্র দেশটাকে এবং তার সুপ্রাচীন সভ্যতা ও সংস্কৃতিকে না ধ্বংস করে দেয়।
আজকের রাজনৈতিক প্রেক্ষিতে ভাবনাটা অমূলক নয়। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে গণতন্ত্রের ছত্রছায়াতলে প্রকৃত জনগণের স্থান হয়নি। বর্ণবৈষম্যের ছবি জ্বলজ্বল করছে। নারীর সার্বিক বঞ্চনার ব্যাপারটি স্বাধীনতার পরেও পুরুষ শাসিত সমাজে আগের মতোই রয়ে গেছে বলা যায়। রয়ে গেছে শ্রেণীবৈষম্য। আসলে স্বাধীনতার পর আমাদের দেশে সিভিক কমিউনিটি গড়ে উঠেনি। উঠলে বাংলাদেশ এতদিনে ইতালির মতো গণতান্ত্রিক দেশ হয়ে উঠতে পারত। কেন তা হয়নি? গণতন্ত্র বিষয়ে বাংলাদেশের অধিকাংশ নাগরিক শিক্ষিত, আলোকপ্রাপ্ত নয়। তাই এখানে সাম্যের ভাবধারা শুধু কাগজে-কলমে রয়ে গেছে, বাস্তবায়িত হয়নি। বাংলাদেশী সমাজ যদি সত্যিই সাম্যের ভাবধারায় জারিত হত তাহলে দেশবাসী স্বাধীনতার স্বাদ কিছুটা হলেও পেত। বাংলাদেশে আজও এরূপ একটি ‘জনগোষ্ঠী’ তৈরি হল না। হলে একই সঙ্গে দেশের ও দশের মঙ্গল হত। সাধারণ মূল্যবোধ ধীরে ধীরে হারিয়ে যাওয়ায় নাগরিকের মন একে অন্যের প্রতি ক্রমশ আস্থাশূন্য হয়ে পড়ছে। আর, যে সমাজে পারস্পরিক আস্থা অনুপস্থিত সেখানে গণতন্ত্রের সম্ভাবনা সামান্যই।
অপরিসীম দারিদ্র্য আর অসম্মান নিয়ে বেঁচে আছে স্বাধীন বাংলাদেশের কোটি কোটি নাগরিক। দেশে যখন কোটিপতির সংখ্যা বেড়েই চলেছে তখন দারিদ্র্যের ভয়ানক ছবি ফুটে উঠেছে বিভিন্ন তথ্যে। দেশে এমন অনেক গ্রাম রয়েছে যেখানে হতদরিদ্রের দৈনিক আয় মাত্র ২০ টাকা। বাংলাদেশে এখনও এমন বহু দরিদ্র পরিবার রয়েছে যাদের নামমাত্র আয়ে অশেষ দুঃখ-কষ্টে পরিবার প্রতিপালন করতে হয়। বিভিন্ন অনুসন্ধানী তথ্য অনুযায়ী দেশের গ্রামাঞ্চলে পাঁচ শতাংশ এমন হতদরিদ্র জনগণ রয়েছে যাদের মাথাপিছু মাসিক আয় মাত্র ১০০০ টাকারও নিচে। এই অতিসামান্য টাকা দিয়েই তাদের প্রতিদিনের জীবন চালাতে হয়। দেশের সব প্রান্ত থেকে সাত হাজার তিনটি গ্রামের উপর চালানো এক সমীক্ষায় দারিদ্র্যের এই ভয়াবহ ছবি ফুটে উঠেছে। আসল কথা, যে উদ্দেশ্য, আদর্শ ও লক্ষ্য সামনে রেখে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করেছে, আজ যে কোন মূল্যে সেগুলোকে টিকিয়ে রাখা সম্ভব হচ্ছে না, বাস্তবায়ন তো দূরের কথা।
সর্বশেষ জনগণনা অনুযায়ী দেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটির মত। বিশাল জনসংখ্যার দেশে ‘সকলের জন্য খাদ্য’ শ্লোগানটি বাস্তবায়িত হয়নি এখনও। খাদ্য সুরক্ষা অর্ডিন্যান্স কতখানি সুফল আনবে তা জানা যাবে আগামী দিনগুলোতে। স্বাধীনতা প্রাপ্তির এত বছর পরেও প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অনেক উন্নত দেশগুলোর থেকে পিছিয়ে। তাই এই দেশে শুধু বন্যা হয় না, কৃত্রিম বন্যাও হয়। দেশে ফ্লাড কন্ট্রোল ডিপার্টমেন্ট রয়েছে বন্যা তদারকির জন্যে। সামান্য ভারী বৃষ্টি হলেই নালা-নর্দমার নোংরা পানি মহানগরের বাসিন্দাদের রান্নাঘর পর্যন্ত দখল করে নেয়। বিশ্বের একটি জনবহুল দেশের নাগরিকদের কাছে এ এক অসহনীয় যন্ত্রণা। বাংলাদেশে বন্যার সমস্যা দিন দিন ভয়াবহ হয়ে উঠেছে। উপযুক্ত নিকাশি ব্যবস্থায়ও ব্যর্থ হয়েছে দেশ। রাজনীতি, সমাজনীতি, অর্থনীতি প্রভৃতি বিষয়ে কোনো জ্ঞান নেই- এমন জনপ্রতিনিধি দেশে গণতন্ত্রকে কতদিন টিকিয়ে রাখতে পারবে সে বিষয়ে প্রশ্ন উঠেছে। উচ্চ শিক্ষিত সরকারী কর্মকর্তাকে মাঝে মাঝে ওইসব জনপ্রতিনিধিদের হাতে পড়ে কতখানি নাকাল হতে হয় তার প্রমাণ দেশে গুটিকয়েক নয়, অনেক রয়েছে।
জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে অস্বাভাবিক হারে। এই বৃদ্ধি ঘটেছে কখনো ধীরগতিতে, কখনো দ্রুতগতিতে। ময়দার দাম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বিস্কুট, পাউরুটির দাম বাড়বেই। বিদ্যুতের মাসুল বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে অনেক কিছুর দামই বেড়ে যাবে। অথচ চড়চড় করে নেমে গেছে মোবাইলের দাম, টিভি-সিডির দাম, ল্যাপটপের দাম। ভিনদেশীয় দ্রব্যসম্ভার তো এখন দেশের দোকান উপচে ফুটপাত অবধি ছড়িয়ে পড়েছে। গণতান্ত্রিক শিথিলতা ও দুর্বলতার কারণে বাংলাদেশের মতো ‘স্বাধীন’ দেশে জন্মহার কমে না বরং বেড়েই চলেছে। সুতরাং প্রকৃতির নিয়মেই টান পড়বে খাদ্যের- সে আজ না হোক, কাল। অনেক দ্রব্যের ক্ষেত্রেই নষ্ট হয়ে গেছে চাহিদা ও জোগানের ভারসাম্য।
আসলে স্বাধীন বাংলাদেশে মুদ্রাস্ফীতি রোধ করা এখনও সম্ভব হয়নি। মজুরি ও বেতন বেড়ে গেছে, কিছু মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে। দ্রব্যমূল্য যতই বৃদ্ধি পাবে, বেতন ও মজুরির সঙ্গে যোগ হবে ‘মহার্ঘ্য ভাতা’। টাকার জোগান যতই বাড়ছে দ্রব্যমূল্য ততই বৃদ্ধি পাচ্ছে। এটি দেশের পক্ষে আগামী দিনের জন্য শুভ সংকেত নয়। মূল্যবৃদ্ধি আসলে একটি অর্থনৈতিক রোগ। এই রোগে শুধু ক্রেতা ভোগে না, বিক্রেতাকেও ভুগতে হয়। কিছুদিন আগে আমরা পত্রিকার মাধ্যমে দ্রব্যমূল্য ব্যাপারে ‘সিন্ডিকেট’ নামক দুষ্টচক্রের কথা জেনেছি, জেনেছি আমাদের মাথাপিছু খাদ্যশস্যের উৎপাদন কমেছে, সরকারি গুদামঘরে জমানো খাদ্যশস্য পচে নষ্ট হয়ে গিয়েছে। স্বাধীন দেশের সরকারের কাছে জনগণ কখনোই এসব কামনা করে না। দেশে কোটি কোটি মানুষের জন্যে ‘খাদ্য সুরক্ষা’ হোক, যেমনটি হয়েছে সরকারী অর্থানুক‚ল্যে নানাবিধ প্রকল্পের বাস্তবায়ন- সড়ক উন্নয়ন ইত্যাদি। আসুন, নতুন একটা আকাশের নিচে দাঁড়াই। বোধিদীপ আবার উঠুক জ্বলে।
লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।