Inqilab Logo

রোববার, ১২ মে ২০২৪, ২৯ বৈশাখ ১৪৩১, ০৩ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

মিষ্টি পানি প্রবাহে বিপর্যয় : উপক‚লের কৃষি-মৎস্য-পশুসম্পদ হুমকির মুখে

| প্রকাশের সময় : ২৩ মার্চ, ২০১৭, ১২:০০ এএম

আবু হেনা মুক্তি : গতকাল (বুধবার) উপক‚লীয়াঞ্চলে কোনো প্রকার বিশেষ ভূমিকা ছাড়াই বিশ্ব পানি দিবস পালিত হল নিরবে নিভৃতে। খুলনাঞ্চলের নদ-নদীর বেহাল দশা এখন চরমে। আমজনতার স্বার্থে এবারও বিশেষ প্রকল্প গৃহীত হয়নি। ভারতের বন্ধু প্রতিম আখ্যায়িত এ সরকারও পানির হিস্যা বুঝে নিতে পারেনি। আগামী মাসে প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের দিকে চেয়ে আছে নদীমাতৃক এ অঞ্চলের মানুষ। তারা পানি চুক্তি বিষয়ে ইতিবাচক ফলাফল আশা করছে।
স্বাধীনতার পরে বাংলাদেশের নদ-নদীগুলো পানির হিস্যা চেয়ে শুধু কেঁদেই চলেছে। এ কান্নার যেন শেষ নেই। কেবল পেয়েছে আশ্বাস, আশার বাণী আর হতাশা। যেসব চুক্তি হয়েছে তা সবই শুভঙ্করের ফাঁকি, এমন অভিমত বিশেষজ্ঞদের। বৃহৎ নদীগুলোর স্রোত ও গভীরতা কমে যাওয়ায় এবং ফারাক্কার প্রভাবে খুলনাঞ্চলের অর্ধশত নদ-নদী ইতোমধ্যে নি®প্রাণ হয়ে গেছে। এসব নদ-নদীর গভীরতা হ্রাস পেয়েছে এবং লবণাক্ততায়ও আক্রান্ত হয়েছে। নদীগুলো আজ স্রোতহীন। গাঙ্গেয় পাবণভূমির এই বিপর্যয়ে উপক‚লের কৃষি, মৎস, পশুসম্পাদ ও নদীর সাথে সম্পৃক্ত কলকারখানা ও জলজ জীবের পরিবেশ সম্পূর্ণ বিপন্ন ও বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। জলবায়ু পরিবর্তন এবং ভারত বাংলাদেশের পানি বণ্টনে বৈষম্য থাকার কারণে আস্তে আস্তে খুলনাঞ্চলের নদীর জলধারা ক্রমান্বয়ে সঙ্কুচিত হওয়ায় এক সময় মিষ্টিপানির প্রবাহ চরমভাবে বাধাগ্রস্ত হতে থাকে। শুরু হয় এক অনাকাক্সিক্ষত বিপর্যয়। আবার ভূগর্ভস্থ পানির প্রাপ্যতায় সীমাহীন অনিশ্চয়তাও দেখা দিয়েছে ইতোমধ্যে। পানির স্তর নেমে যাচ্ছে। গভীর নদ-নদীতে পলি পড়ে পড়ে চরা হয়ে যাচ্ছে। নদীতে এখন আর আগের মত স্রোত নেই। খুলনাঞ্চলে স্টিমারগুলো বছরে সবসময় চলাচল করতে পারে না। অথচ আশায় বুক বাঁধা এ অঞ্চলের মানুষ গত ৫ বছরে কোনো বৃহৎ প্রকল্প চোখে দেখেনি। এ সরকারের প্রথম মেয়াদের দু’বছরে কয়েকটি প্রকল্প গৃহীত হলেও নাগরিক আন্দোলনের পরও এবারও নতুন কোনো প্রকল্প থাকছে না পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ে। গতকাল বিশ্ব পানি দিবসেও কোনো ঘোষণা পায়নি এ অঞ্চলের মানুষ।
বিশেষজ্ঞ সূত্রগুলো বলছে, নদী যদি কোনো কম স্র্ােত বিশিষ্ট বা স্রোতহীন সমুদ্রে পড়ে তাহলে ওই সমস্ত তলানী পলি জমতে জমতে নদী মুখ প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। কালক্রমে ওই চারামুখী সমুদ্র পানির উপর উচু হয়ে উঠে। তখন নদী বিভিন্ন শাখায় ওই চরাভূমিকে বেষ্টন করে সমুদ্রে পতিত হয়। নদী ত্রিমোহনাস্থিত ত্রিকোনাকার ওই নতুন ভূমিকে ব-দ্বীপ বা ডেল্টা বলে। কারণ ওই মাত্রাহীন ব-এর মত বা গ্রিক অক্ষর ডেল্টার মত দেখায়। এই ব’দ্বীপের আওতায় হুগলি নদী হতে পূর্ব পদ্মা নদীর সীমানা পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের সামগ্র দক্ষিণাংশ গঙ্গা-পদ্মা নদী প্রণালী বিখ্যাত ব’দ্বীপ অঞ্চল। এর দুই তৃতীয়াংশ বাংলাদেশে অবস্থিত। সূত্র মতে ভৌগলিক ও ভূতাত্তি¡ক অবস্থানগত কারণে ওই ব’দ্বীপ অঞ্চলের বৃহত্তম খুলনার নদ-নদীগুলো গঙ্গানদীর তথ্য হিমালয়ের পার্বত্য জলপ্রবাহ পায় মাথাভাঙ্গা গড়াই ইছামতী ও মধুমতী বলেশ্বরের মাধ্যমে। কিন্তু এই নদী গুলোর পানি প্রবাহ প্রধানত ফারাক্কা বাধের কারণে যে আগের মতো নেই। বরং শাখা ও উপ-নদীগুলোকে পানি সরবরাহে বদলে এরা নিজেরাই এখন অনেক স্থানের মত প্রায় মৃত ও স্রোতশূন্য অর্থৎ অস্তিত্ব সমস্যায় উপনীত। সুতরাং এগুলোর মধ্যমে গঙ্গা নদীর মিষ্ট পানি খুলনা অঞ্চলের নদ-নদীগুলো এই আর তেমন পায় না।
এই কারণে খুলনাঞ্চলের নদ-নদীগুলো এখন মৃত্যুর কোলে ঢোলে পড়েছে। নদীগুলো যেন এখন কাঁদছে। প্রবীণ ব্যক্তিরা বিখ্যাত এবং ঐতিহ্যবাহী নদ-নদীর অপমৃত্যুতে হতবাক। তারা এ অবস্থা কখনও কল্পনা করেনি। আর বিশেষজ্ঞরা বিষয়টি নিয়ে চরমভাবে উদ্বিগ্ন। অনেক নদী মরে গেছে। অনেকগুলো মৃতপ্রায়। খুলনা অঞ্চলের ছোট-বড় মোট ১৮৯টি নদীর জিওমরফিফোলজি, ইকোলজি এবং মাছ উৎপাদনের অবস্থা সম্পর্কে এক গবেষণায় দেখা গেছে, মধ্যে শতভাগ নদীরই গভীরতা কমে গেছে। ১৮০টি নদীর মাছের প্রজাতি কমে গেছে, ১৬৮টি নদীর মাছ চলাচলের রাস্তা ধ্বংস হয়েছে, ৪২টি নদী মরে গেছে, ১৭৭টি নদীতে ভাঙ্গনের তীব্রতা রয়েছে। ১৭০টি নদী ভরাট হয়ে গেছে, বিভাগের ১৮৯টি অর্থৎ শতভাগ নদীতেই লবণাক্ততা বৃদ্ধি পেয়েছে। ১৮২টি নদীর স্রোত কমে গেছে। ১৮২টি নদীর মাছ কমে গেছে ও ৩৪টি নদীর মুখ ভরাট হয়ে গেছে। সূত্র বলেছে খুলনা বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা জেলর প্রধান প্রধান নদীগুলো পরিচয়ের ক্ষেত্রে কিছু সমস্যা থাকলেও ছোট-বড় মিলিয়ে উলেখযোগ্য যে নদীগুলোর এখানে রয়েছে সেগুলো হলো- শিবসা, রূপসা, বলেশ্বর, পশুর, আড়পাঙ্গাসিয়া, খোলপেটুয়া, আগুনমুখা, ভদ্রা, আঠারোবাকী, আলাইপুর, গাসিয়াখালী, দড়াটানা, ইছামমতী, খোলপটুয়া, রায়মঙ্গল, নমুদ সমুদ্র সোনাগাঙ্গ, ভাঙ্গরাকুঙ্গ, মালঞ্চ, সাতক্ষীরা, সুতেরখালী, মারজাতী, হারিণভাঙ্গা, মহাগঙ্গ, গলাঙ্গী, হরিপুর, সোনাই বুধহাটার গাঙ্গ, ঢাকি, গলাঘেমিয়া, উজীরপুর, কাটাখাল, গুচিয়াখালী, খাল আকরার, খাল মংলা, সোলপায়ারা আগুরমুখ মহুরী মোদলাম হাডুয়াভাঙ্গা পানগুছি, মেয়ার গাং, কাজিবাছা, কাকশিয়ালি, বলেশ্বর মরাভোলা। সূত্র মতে উল্লেখিত নদীগুলোর মধ্যে একমাত্র সুন্দরবনের নদী বাদে অন্য নদীগুলোর ৮০ শতাংশই এখন কার্যত অস্তিত্বের সংকটে কাতর।
সূত্রমতে, এই নদীগুলোর মধ্যে ৮০ শতাংশই আগের মত স্রোতস্বিনী বিপুলদেহী উচ্ছল ও ক্ষিপ্রগামী নেই। জায়গায়-জয়গায় শুকিয়ে ভরাট হয়ে গেছে। অনেকগুলো আবার দেখলে বুঝবার উপায় নেই যে, একসময়ে এখানে কোনো তীব্র স্রোতবাহী নদী ছিল। আবার কোনো কোনোটা ধীরে ধীরে মজে পরিণত হয়েছে সরু খালে। অনেকগুলোর গতিপথ পরিবর্তিত বা স্থায়ীভাবে রুদ্ধ হয়ে গেছে। তবে যেসব নদী এখনও জীবিত ও গতিশীল এবং বর্ষকালে প্রচÐ বেগবান, বস্তুত সমুদ্র দক্ষিণে বলে তার অধিকাংশই উত্তর থেকে দক্ষিণদিকে প্রবাহিত। উলেখ্য বাংলাদেশে এক সময় ১ হাজার নদীর অস্তিত্ব ছিল। বর্তমানে ছোট-বড় শাখা নদী, নদী-উপনদী মিলিয়ে ৭১০টি নদী রয়েছে। তবে কোনো কোন সূত্র দাবি করে উলেখরযাগ্য নদীর সংখ্যা ৩০০ বেশি নয়। পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রকাশনায় অবশ্য ৩১০টি নদীর মধ্যে খুলনা বিভাগের নদীর সংখ্যা ১৮৯টি।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ