হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির খড়গ : আসামের এনআরসি এবং বাংলাদেশ
কিশোর শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক দাবীর আন্দোলনে ঢাকাসহ সারাদেশে তীব্র রাজনৈতিক উত্তেজনা ও অনিশ্চয়তা দেখা যাচ্ছিল,
জামালউদ্দিন বারী : ধনলিপ্সু সাম্রাজ্যবাদ এবং সামরিক শক্তির ওপর গড়ে ওঠা চলমান পুঁজিবাদী বিশ্বব্যবস্থা এখন কার্যত দুঃশাসন, দুর্ভিক্ষ ও গণহত্যার বিশ্বব্যবস্থায় পরিণত হয়েছে। বিশ্বের মুসলমানরা এখন মাৎস্যন্যায়ের এই বিশ্বব্যবস্থার আগ্রাসনের মূল টার্গেট। বিশ্বের জনসংখ্যার প্রায় এক-চতুর্থাংশ মানুষের সাংস্কৃতিক চেতনা ও ধর্মীয়-রাজনৈতিক ঐতিহ্য ও মূল্যবোধকে আধুনিক বিশ্বের মোড়লদের অনুসারীরা ভয় পায়। এই মুহূর্তে বিশ্বে অর্ধশতাধিক মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্র থাকলেও এর কোনোটিই সত্যিকার অর্থে কোরানিক অনুশাসন বা খিলাফতের অনুরূপ শাসনাধীনে চলছে না। এমনকি এসব দেশে এ ধরনের শাসন প্রবর্তনে কোনো রকম জোরালো রাজনৈতিক তৎপরতাও নেই বললেই চলে। কোনো কোনো মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্রে তথাকথিত ইসলামপন্থি রাজনীতি সক্রিয় থাকলেও তারা মূলত পশ্চিমা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে মেনে নিয়ে ভোটের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হয়েই তাদের লক্ষ্য অর্জন করতে সচেষ্ট রয়েছে। মিসরের মুসলিম ব্রাদারহুড বা তিউনিসিয়ার আন্নাহদার মতো রাজনৈতিক দলগুলো জনগণের ভোটে সরকার পরিবর্তনের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যাওয়ার পরও পশ্চিমা সমর্থিত সেনা অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে তাদের পরাভ‚ত করা হয়েছে। জনগণের ইচ্ছার বিরুদ্ধে বন্দুকের নল দিয়ে ক্ষমতা দখল বা ক্ষমতাচ্যুত করা সম্ভব হলেও এভাবে জনসমর্থন আদায় বা জনগণের মনস্তাত্তি¡ক পরিবর্তন করা সম্ভব হয় না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমারা বিশ্বকে একটি বৈষম্যহীন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অধীনে নিয়ে আসার কথা প্রচার করলেও আদতে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে সর্বজনীন রূপ দেয়ার ক্ষেত্রে তারাই এখন মূল প্রতিবন্ধক হিসেবে দেখা দিয়েছে। বিংশ শতকের শুরু থেকেই তারা তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে জনগণের ইচ্ছার বিরুদ্ধে নানা ধরনের সামরিক ও রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করছে। দেশগুলোর স্বাভাবিক সামাজিক-রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বিনষ্ট করে নিজেদের আধিপত্য বিস্তার ও অর্থনৈতিক ফায়দা হাসিলে মিথ্যা অজুহাতে যুদ্ধ ও অস্থিতিশীলতা চাপিয়ে দেয়ার কৌশল এখনো পুরোমাত্রায় সক্রিয় রয়েছে।
ইউরোপে শিল্প বিপ্লবের মধ্য দিয়ে যে নতুন অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল ঊনবিংশ শতকের শেষদিকে ইউরোপীয় সাম্রাজ্যগুলো পরস্পরের তীব্র প্রতিদ্ব›দ্বী ও প্রতিযোগী শক্তি হিসেবে আবিভর্‚ত হয়েছিল। বৃটেন, ফ্রান্স, জার্মানি, রাশিয়া, ইতালি, অস্ট্রো-হাঙ্গেরি, জাপান ও অটোমান সাম্রাজ্য ইত্যাদি পুরনো সাম্রাজ্যগুলো পরস্পরের দ্বারা হুমকির সম্মুখীন হয়ে নিজেদের মধ্যে অভ্যন্তরীণ সমঝোতা ও বিভক্তিকে চ‚ড়ান্ত করে তুলেছিল। বসনিয়ার রাস্তায় অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান যুবরাজ আর্চডিউক ফ্রান্স ফার্দিনান্দ ১৯১৪ সালের ২৮ জুন এক আততায়ীর গুলিতে নিহত হওয়ার পর অস্ট্রিয়া সার্বিয়ার সাথে যুদ্ধ ঘোষণা করার পর ইউরোপের পরাশক্তিগুলো দুই পক্ষে বিভক্ত হয়ে পরস্পরের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে হাজার বছরের মানবেতিহাসের বৃহত্তম রণসজ্জায় পরিণত করে। চার বছরের প্রথম মহাযুদ্ধে প্রায় দেড় কোটি মানুষের মৃত্যু, আড়াই কোটি মানুষ আহত এবং অন্তত চারটি সাম্রাজের পতন নিশ্চিত হয়। অক্ষশক্তির পতনের মধ্য দিয়ে রোমান সাম্রাজের অবশিষ্ট শক্তি হিসেবে ইতালি, জার্মান ও অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান সাম্রাজ্য এবং অটোমান সাম্রজ্যের শত শত বছরের ইতিহাসের পরিসমাপ্তি ঘটে। সেই সাথে এই যুদ্ধের সময় সংঘটিত রাশিয়ান বলশেভিক বিপ্লব রাশিয়ায় জারের শাসনের পরিসমাপ্তি ঘটায়। প্রথম মহাযুদ্ধে পুরনো সাম্রাজ্যগুলোর পতন ঘটিয়ে ইঙ্গ-মার্কিনের নেতৃত্বে উদ্ভ‚ত নতুন পুঁজিবাদী বিশ্বব্যবস্থার সূচনা করেছিল। তাদের নেতৃত্বে গঠিত লীগ অব সেশনস কোটি মানুষকে হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ সৃষ্টিকারী আরেকটি যুদ্ধ থেকে বিশ্বকে নিবৃত্ত করতে পারেনি। মাত্র দুই দশকের মধ্যে আগের চেয়ে বহুগুণ বড় ও ভয়াবহ দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের বিভীষিকা মানুষের সভ্যতার ধারণায় আমূল পরিবর্তন এনে দেয়। তবে কোনো যুদ্ধেই মুসলমানরা অনুঘটক বা সূচনাকারী না হলেও এসব যুদ্ধের দীর্ঘস্থায়ী কুফল চাপানো হয়েছে মুসলমানদের ওপর। ধ্বংসাত্মক মহাযুদ্ধ ও ক্রমবর্ধমান বিভক্তি-নৈরাজ্যের বিষবাষ্প বিশ্বের শত কোটি মুসলমানের শান্তি, নিরাপত্তা ও অস্তিত্বকে চ্যালেঞ্জের মুখে ঠেলে দিয়েছে। যুদ্ধ, গৃহযুদ্ধ, জাতিগত সংঘাত, জাতীয় সম্পদ ও স্বার্থের লুণ্ঠন, বাণিজ্য বৈষম্য, পানি আগ্রাসন, খাদ্য সংকট ও রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা যেন মুসলমানদের ওপর পশ্চিমাদের চাপিয়ে দেয়া বিধিলিপি হয়ে দাঁড়িয়েছে। ১৯৫৩ সালে ইরান তথা মধ্যপ্রাচ্যের প্রথম গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত মোহাম্মদ মোসাদ্দেককে ইঙ্গ-মার্কিনি গোয়েন্দাদের সাজানো ক্যু’র মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত করার মূল কারণ ছিল ইরানের তেল সম্পদকে জাতীয়করণের মাধ্যমে বৃটিশদের লুণ্ঠনের পথ বন্ধ করা। আর ২০০৬ সালে মিসরে হাজার বছরের প্রথম গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত মোহাম্মদ মুরসিকে হটিয়ে সেখানে পুনরায় সামরিক স্বৈরাচারকে ক্ষমতাসীন করার লক্ষ্যও অভিন্ন। মধ্যপ্রাচ্যের তেলসম্পদ লুণ্ঠনের পথ নিষ্কণ্টক রাখা এবং নিজেদের বশংবদ অনির্বাচিত সামরিক স্বৈরশাসনের মধ্য দিয়ে জনগণের শক্তিকে দমিয়ে রাখা। ‘রথ দেখা কলা বেচা’র মতো মধ্যপ্রাচ্যে এসব সাম্রাজ্যবাদী অপকর্মের আরেকটি অদৃশ্য লক্ষ্য হচ্ছে- অবৈধ পন্থায় গড়ে তোলা এবং সামরিক শক্তিতে টিকিয়ে রাখা জায়নবাদী রাষ্ট্র ইসরাইলের নিরাপত্তা নিশ্চিত রাখা। কারণ মধ্যপ্রাচ্যের সাধারণ জনগণ এই অস্বাভাবিক রাষ্ট্রটিকে মেনে নেয়নি, পক্ষান্তরে পশ্চিমারাও এই রাষ্ট্রের শাসক ও জনগণকে কখনো তার প্রতিবেশী আরবদের সাথে প্রতিবেশীসুলভ অভিযোজনে অংশগ্রহণ করতে উৎসাহিত করেনি।
প্রথম মহাযুদ্ধকালে ১৯১৭ সালে বৃটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী মি. আর্থার জেমস বালফোর তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ইহুদি কমিউনিটি নেতা ব্যারন ওয়াল্টার রথশিল্ডের কাছে পাঠানো চিঠিতে প্যালেস্টাইনে একটি ইহুদি রাষ্ট্র গঠনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। ১৯২২ সালে চ‚ড়ান্তভাবে অটোমান সাম্রাজ্যের পতন ঘটলে অটোমান সাম্রাজ্যকে দুই চির প্রতিদ্ব›দ্বী ইউরোপীয় পরাশক্তি বৃটেন এবং ফ্রান্স নিজের কলোনি হিসেবে ভাগ করে নেয়। প্যালেস্টাইনে একটি ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বৃটিশ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের প্রধান প্রতিবন্ধক ছিল প্যালেস্টাইনে ইহুদি জনসংখ্যা তখন শতকরা ১০ ভাগেরও কম। প্রথম মহাযুদ্ধের পর এ ধরনের যুদ্ধ আর যাতে না হয় বিশ্বসম্প্রদায় সে ধরনের একটি ব্যবস্থা হিসেবে লীগ এর নেশনস গঠন করলেও মূলত প্রথম মহাযুদ্ধেই প্রোথিত হয়েছিল দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের বীজ। সে যুদ্ধে প্রথমবারের মতো পরমাণু বোমার ব্যবহার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে অজেয় শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে সহায়ক হয়েছিল। হিটলারের ইহুদি নিধন ও বিতাড়নের মধ্য দিয়ে শুরু হওয়া দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে হিটলার মুসোলিনীর পরাজয় ইহুদি রাষ্ট্র গঠনের পক্ষে একটি রাজনৈতিক ও মনস্তাত্তি¡ক প্লাটফর্ম তৈরি করে দেয়। তবে ঘনবসতিপূর্ণ প্যালেস্টাইনে আরবদের বাড়িঘর ভেঙে দিয়ে এই রাষ্ট্র গঠনের প্রক্রিয়াটি ছিল অস্বাভাবিক, অরাজনৈতিক, অমানবিক ও হিংসাত্মক। সেই থেকে এই অস্বাভাবিক রাষ্ট্রটিকে শুধু টিকিয়ে রাখাই নয়, মধ্যপ্রাচ্যের সব আরব রাষ্ট্রকে পশ্চিমা বশংবদ রাষ্ট্র হিসেবে চিরস্থায়ী করতে ইসরাইলকে সামরিক লাঠিয়াল হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছে। জন্মের পর থেকেই অত্যাধুনিক মার্কিন সমরাস্ত্রে সজ্জিত হয়ে ইসরাইল একের পর এক প্রতিবেশী আরব রাষ্ট্রগুলোর ওপর হামলা চালিয়েছে নিজের আয়তনকে বর্ধিত করার লক্ষ্যে। ১৯৬৭ সালের যুদ্ধে পূর্ব জেরুজালেমসহ গোলান মালভ‚মি, সিরিয়া, জর্ডান এবং মিসরের বিশাল অঞ্চল দখল করে নিয়ে এসব দেশকে ইসরাইলের সাথে বশ্যতামূলক সন্ধিতে আবদ্ধ হতে চাপ সৃষ্টি করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক জায়ান্ট মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিদিন ২০ লাখ ব্যারেল জ্বালানি তেলের দানবীয় ক্ষুধা নিবারণের প্রধান উৎস মধ্যপ্রাচ্যকে তার অধীনস্থ রাখতে ইসরাইল রাষ্ট্রকে একটি মোক্ষম হাতিয়ার হিসেবে বিবেচনা করেছে মার্কিনিরা। অন্যদিকে ইসরাইলের সামরিক হুমকি মোকাবেলায় স্নায়ুযুদ্ধের আরেক প্রতিদ্ব›দ্বী রাশিয়ার তৈরি অস্ত্রের ওপর নির্ভরশীল হয়ে ওঠায় ইসরাইল মধ্যপ্রাচ্যে রাশিয়ার অস্ত্র বাণিজ্যের ক্ষেত্র প্রস্তুত করে দিয়েছিল। অর্থাৎ মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাইল রাষ্ট্র একটি কৃত্রিম সংকট হলেও এই সংকট মধ্যপ্রাচ্যের তেলসম্পদ থেকে প্রাপ্ত বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের একটি বড় অংশ পশ্চিমা ও রাশিয়ান অস্ত্র কেনায় ব্যয় করতে বাধ্য করছে। ইসরাইল জুজু ভোঁতা হয়ে যাওয়ার পরই ইসরাইল ও ইঙ্গ-মার্কিনিদের সৃষ্ট জঙ্গিবাদ ও আইএস জুজু সামনে নিয়ে আসা হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোর মধ্যে কেউ কখনো প্রতিবেশী দেশের জন্য সরাসরি হুমকি হিসেবে বিবেচিত না হলেও পশ্চিমারা ইরান-ইরাক যুদ্ধ, ইরাকের কুয়েত দখল, ইরাকের হাতে ওয়েপনস অব মাস ডেসট্রাকশন থাকা, আফগানিস্তানে আল কায়েদা নেটওয়ার্ক বা তালেবান শাসনের রিজিম চেঞ্জের ঘোষণা দিয়ে হাজার হাজার কোটি ডলারের সমরসজ্জা করেছে। ইরাক-আফগানিস্তানের হাজার বছরের সমৃদ্ধ সভ্যতা, সাজানো নগর, রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তাব্যবস্থা ধ্বংস করে, লাখ লাখ মানুষ হত্যা করা হয়েছে। সেই সাথে মার্কিন ও ন্যাটো বাহিনীর হাজার হাজার সেনা সদস্য লাশ হয়ে ও পঙ্গুত্ব নিয়ে দেশে ফিরেছে।
এসব যুদ্ধে কোনো রাষ্ট্রপক্ষই লাভবান বা রাজনৈতিকভাবে বিজয়ী না হলেও যুদ্ধ বাজেটের শত শত বিলিয়ন ডলার গেছে এমআইসি বা ওয়ার কন্ট্রাক্টর ও মিলিটারি ইন্ডাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্সের ফান্ডে এবং এমআইসির নিয়ন্ত্রণ মূলত ইহুদি ব্যাংকার ও কর্পোরেট সিন্ডিকেটের হাতে। এই শক্তির জনসংখ্যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এক শতাংশের কম হলেও এরা সেখানকার নিরানব্বই শতাংশ মানুষের চোখে ধুলা দিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে বিশ্বের সবচেয়ে আগ্রাসী সামরিক শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের তেলসম্পদের ওপর বিকল্পহীন নির্ভরতা এবং শত কোটি মুসলমান এবং মধ্যপ্রাচ্যের অন্তত ২৪টি রাষ্ট্রের স্বার্থ ও সমর্থনের চাইতে ইসরাইলের স্বার্থ ও সমর্থন এ কারণেই আমেরিকার কাছে গুরুত্বপূর্ণ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রাজনৈতিক ক্ষমতার শত পালাবদলেও ইসরাইলের সাথে তার বন্ধুত্ব সর্বদাই শর্তহীন ও অভঙ্গুর। কখনো কখনো দেখা যায় ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরে প্রেসিডেন্ট বা শাসক দলের চেয়ে বেশি সামাজিক-রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার করছে। প্রাচীন মিসরীয়, চৈনিক, অ্যাসিরিয়া, গ্রিক, রোমান, পারস্য ও অটোমান সাম্রাজ্যের ধারাবাহিকতায় বিশ্বসভ্যতার চার হাজার বছরের ইতিহাসে কোনো পরাশক্তির এমন বিস্ময়কর বা রিডিকুলাস অবস্থান দেখা যায়নি। সম্ভবত এ কারণেই মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ বিশ্ব ইতিহাসের সবচেয়ে স্বল্পস্থায়ী সাম্রাজ্য হিসেবে ইতিহাসে ঠাঁই করে নিতে চলেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর বিশ্বব্যবস্থায় কোরীয় যুদ্ধ, ভিয়েতনাম যুদ্ধ থেকে শুরু করে ইরাক, আফগানিস্তান ও সিরিয়া পর্যন্ত প্রায় প্রতিটি যুদ্ধেই মার্কিনিরা আগ্রাসী ভ‚মিকায় থাকলেও কোনো যুদ্ধেই ডিসাইসিভ বিজয় অর্জন করতে পারেনি। এভাবেই একটি পরাশক্তি পতনের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে শেষতক শুধুমাত্র ইতিহাসে ঠাঁই নেয়। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়া এবং অবিবেচনাপ্রসূত মুসলমান বিদ্বেষী ও একদেশদর্শী মার্কিন সংরক্ষণবাদী নীতি গ্রহণের মধ্য দিয়ে সাম্রজ্যবাদী পরাশক্তি হিসেবে তার ভরাডুবি নিশ্চিত করতে চলেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভুল মধ্যপ্রাচ্যনীতির কারণে যেসব দেশের জনপদগুলো ধ্বংস্তূপে পরিণত হয়েছে, দেশগুলোর কোটি কোটি মানুষ উদ্বাস্তু হয়েছে, অর্থনীতি ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ধ্বংস করা হয়েছে। অথচ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গড়ে ওঠার পেছনে এসব দেশের তেলসম্পদ এবং নাগরিকদের অবদান অনেক। এখন এসব দেশের নাগরিকদের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দরোজা বন্ধ করে দিতে চাচ্ছেন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। এ ঘটনা তখনই ঘটছে যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সিরিয়ায় বাশার আল আসাদের রিজাইম চেঞ্জের যুদ্ধে কোনো বাস্তব ফলাফল ও পরিসমাপ্তি অর্জনে ব্যর্থ হলেও তার চিরপ্রতিদ্ব›দ্বী পরাশক্তি রাশিয়ার হস্তক্ষেপে আসাদবিরোধী বিদ্রোহী ও আইএস হটিয়ে একটি বিশাল বিজয় অর্জনের পথে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। অর্থাৎ রাশিয়া যখন মধ্যপ্রাচ্যে তার শক্ত হাত বিস্তার করতে শুরু করে বিজয় ছিনিয়ে আনতে সক্ষম হচ্ছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তখন নিজের দরোজা বন্ধ করে দিতে চাইছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ তাদের এই রাষ্ট্রীয় নীতিকে সমর্থন করছে না বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে। এমনকি ৪৫তম মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বেশির ভাগ ভোটদাতার রায় ছিল ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিপক্ষে।
বিশ্বব্যবস্থায় গেমচেঞ্জারদের মধ্যে একটি প্যারাডাইম শিফ্ট লক্ষ্য করা গেলেও নীতির তেমন কোনো পরিবর্তন হচ্ছে না। বিশেষত মধ্যপ্রাচ্য এবং দক্ষিণ এশিয়ার পিছিয়ে পড়া রাষ্ট্রগুলো ভূ-রাজনীতির কৌশলগত জুয়াখেলায় শুধুমাত্র যেন হাত বদলের শিকার হচ্ছে। ইসরাইলি যুদ্ধবাজ প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সফরে গিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছ থেকে পুরনো বন্ধুত্বের নতুন নজরানা আদায় করে নিতে সক্ষম হয়েছেন। ইরানসহ ৭টি মুসলিমপ্রধান দেশের নাগরিকদের জন্য মার্কিন ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা যেন ইসরাইলি নীতিরই মার্কিন প্রতিফলন। এমনকি ফিলিস্তিন সমস্যার দ্বিরাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পুরনো প্রতিশ্রæতি থেকে সরে দাঁড়ানোর ইঙ্গিত দিয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প হোয়াইট হাউসে নেতানিয়াহুর সাথে যৌথ বিবৃতির সময়। গত সপ্তায় নেতানিয়াহু রাশিয়ায় গিয়েছিলেন অনেকগুলো নসিহত সাথে নিয়ে, এসব নসিহতের মূল সুর হচ্ছে- ইরানের সাথে সম্পর্ক ত্যাগ করে ইসরাইলের সাথে হাত মেলানো। বরাবরের মতো এবারো মস্কোতে নেতানিয়াহুকে উষ্ণ অভ্যর্থনা এবং লালগালিচা সংবর্ধনা দিলেও প্রেসিডেন্ট পুতিনের নীতি কৌশল বা সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করার মতো কোন ট্রাম্পকার্ড হয়তো নেতানিয়াহুর হাতে নেই। নেতানিয়াহু আড়াই হাজার বছর আগের পারস্য সম্রাট জারজিসের ইহুদি বিদ্বেষের সাথে তুলনা করে পারস্য সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকার বর্তমান ইরানকে ঘায়েল করতে রাশিয়ার সক্রিয় সমর্থন চাইলেও পুতিন তা অনেকটা হেসেই উড়িয়ে দিয়েছেন বলে জানা গেছে। রাশিয়ায় জন্মগ্রহণকারী সুইডিশ লেখক সাংবাদিক, ইসরাইলের জেরুজালেম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করা মধ্যপ্রাচ্য বিশেষজ্ঞ ইসরাইল শামিরের লেখা সাম্প্রতিক এক নিবন্ধে মস্কো সফরের সময় পুতিনের কাছে নেতানিয়াহুর এসব প্রস্তাবের বিশদ বিবরণ ও বিশ্লেষণ পাওয়া যায়। নেতানিয়াহুর প্রস্তাবে পুতিন সাড়া না দিলেও তিনি নেতানিয়াহুকে খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতকে জোসেফাসের যুদ্ধে ইহুদিদের পরাজয়ের ইতিহাস সংবলিত ৫০০ বছরের পুরনো একটি গ্রন্থ উপহার দেন। ইসরাইল শামিরের বিশ্লেষণ হচ্ছে- পুতিনের পক্ষ থেকে এটি একটি তাৎপর্যপূর্ণ উপহার। যোসেফাস যেভাবে দিগি¦জয়ের আতিশয্যে আকাশ ছুঁতে গিয়ে রোমানদের হাতে ইহুদি জাতির জন্য চরম পরাজয়ের গ্লানি ডেকে এনেছিলেন, বিবি নেতানিয়াহু যেন ঠিক একই রকম আকাশ ছোঁয়ার নেশায় মত্ত হয়ে পতিত হওয়ার অপেক্ষায় রয়েছেন। তবে সাম্রজ্যবাদী শক্তিগুলোর মধ্যে পালাবদল ঘটলেও মুসলমান রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে আত্মশক্তির জাগরণ ঠেকিয়ে রাখার কৌশল থেকে পশ্চিমা বা রাশিয়ান পরাশক্তির মধ্যে তেমন কোনো পার্থক্যের সম্ভাবনা এখনো দেখা যাচ্ছে না। ফিলিস্তিনি ও আরব জনগণের প্রতি ইসরাইলের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিরুদ্ধে বিশ্ব সম্প্রদায় বিভিন্ন সময় ঐক্যবদ্ধ অবস্থান গ্রহণ করলেও ইঙ্গ-মার্কিন ভেটোর কারণে তা সব সময়ই ব্যর্থ হয়েছে।
এশিয়ায় মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গা মুসলমানরা মিয়ানমার সেনাবাহিনীর হাতে দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে দমন নির্যাতনের শিকার হচ্ছে, সাম্প্রতিক কয়েক বছরে তারা এথনিক ক্লিনজিং বা গণহত্যার শিকার হয়েছে। জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশন রোহিঙ্গারদের বিশ্বের সবচেয়ে নির্যাতিত ও মানবাধিকার বঞ্চিত জাতি হিসেবে বর্ণনা করেছে। সম্প্রতি জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের ১৫টি সদস্য রাষ্ট্র রাখাইনে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর গণহত্যা ও মানবাধিকার হরণের রিপোর্ট নিয়ে আলোচনা শেষে একটি বিবৃতি প্রকাশ করতে গিয়ে রাশিয়া ও চীনের ভেটোর শিকার হয়ে তা ভন্ডুল হয়েছে। জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক কমিটি এবং রাখাইনের রোহিঙ্গা নিপীড়নবিষয়ক উপ-কমিটির রিপোর্টে মিয়ানমার বাহিনীর গণহত্যা, জাতিগত দমন-পীড়ন ও নারী ধর্ষণের তথ্যের প্রমাণ পায়। বছরের পর বছর ধরে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী রোহিঙ্গা মুসলমানদের বিরুদ্ধে জাতিগত নির্মূল অভিযান পরিচালনা করলেও চীন, রাশিয়া, আমেরিকা এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন নীরব দর্শকের ভ‚মিকা পালন করে মাঝেমধ্যে দায়সারা গোছের আহ্বান ও বিবৃতি প্রকাশ করলেও জাতিসংঘের বিভিন্ন উদ্যোগে অসহযোগিতা অথবা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে চলেছে।
পশ্চিমা সাম্রজ্যবাদী যুদ্ধের কারণে বিশ্বের অন্তত ১০টি দেশের কোটি কোটি মানুষ সাম্প্রতিক ইতিহাসের নজিরবিহীন খাদ্যাভাব, দুর্ভিক্ষ ও দারিদ্র্যের সম্মুখীন হয়েছে। সিরিয়া ও লিবিয়ার কোটি কোটি উদ্বাস্তু মানুষের নজিরবিহীন দুর্ভোগের কথা বাদ দিলেও ইয়েমেন, রুয়ান্ডা, বুরুন্ডি, ইরিত্রিয়া, সুদান, সোমালিয়া, চাদ, ইথিওপিয়া, মাদাগাস্কারসহ আরো অন্তত ২০টি দেশের প্রায় শত কোটি মানুষ চরম খাদ্য সংকটে পড়েছে। এক সময়ের খাদ্য উদ্বৃত্ত এবং অর্থনৈকিতভাবে সমৃদ্ধ দেশগুলোর লাখ লাখ শিশু সরাসরি সামরিক হামলার শিকার হওয়ার পাশাপাশি এখন দুর্ভিক্ষ, অপুষ্টির কারণে মৃত্যুর হুমকির মধ্যে পড়েছে। বিশ্বসম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে যুদ্ধ বন্ধ করার কার্যকর উদ্যোগ এবং শিশু, নারী ও সাধারণ মানুষকে খাদ্য ও পানির সংকট ও মানবিক বিপর্যয় থেকে রক্ষার কোনো উদ্যোগও দেখা যাচ্ছে না।
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।