হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির খড়গ : আসামের এনআরসি এবং বাংলাদেশ
কিশোর শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক দাবীর আন্দোলনে ঢাকাসহ সারাদেশে তীব্র রাজনৈতিক উত্তেজনা ও অনিশ্চয়তা দেখা যাচ্ছিল,
মেহেদী হাসান পলাশ : আগামী ৭ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারত সফরে যাচ্ছেন। ৮ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সাথে তার বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে। ১০ এপ্রিল তিনি দেশে ফিরবেন। প্রকাশিত খবরে জানা গেছে, ভারত সফরকালে তিনি ভারতের রাষ্ট্রপতি শ্রী প্রণব মুখার্জি আমন্ত্রণে তার বিশেষ মেহমান হয়ে রাষ্ট্রপতি ভবনে অবস্থান করবেন। ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে এই সুবিধা ইতোপূর্বে আর কোনো রাষ্ট্র বা সরকার প্রধানকে দেয়া হয়নি বলে বলা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফওে সে দেশের সরকারের প্রধান চাওয়া বাংলাদেশের সাথে একটি প্রতিরক্ষা চুক্তি সম্পন্ন করা। এ নিয়ে শুরুতে বাংলাদেশের দিক থেকে নীরবতা পালন করা হলেও ভারতীয় গণমাধ্যমে বিষয়টি নিয়ে একের পর এক রিপোর্ট আসতে থাকে। পরে বাংলাদেশের গণমাধ্যমগুলোতেও ভারতীয় সংবাদ মাধ্যমের বরাতে রিপোর্টগুলো প্রকাশ হতে শুরু করলে রাজনৈতিক মহলে আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দেয়। ইতোমধ্যে দেশের প্রধান বিরোধী দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের পক্ষ থেকে ভারতের সাথে বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা চুক্তির ব্যাপারে অসন্তোষ জানিয়ে বিভিন্ন প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করা হয়েছে। ভারতের প্রস্তাবিত এই প্রতিরক্ষা চুক্তির অন্যতম হচ্ছে ভারত থেকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর জন্য সমরাস্ত্র ক্রয়। ভারত বাংলাদেশকে এখাতে ৫০ কোটি ডলার ঋণ সহায়তার প্রস্তাব করেছে বলে খবরে জানা গেছে। এরই মধ্যে বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ৮টি বহুমুখী যুদ্ধ ক্ষমতা সম্পন্ন উন্নত প্রযুক্তির যুদ্ধবিমান ক্রয়ের জন্য আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করেছে। এদিকে বিডি মিলিটারিডটকম নামের একটি ওয়েবসাইটে প্রকাশিত সংবাদে জানা গেছে, চায়না বাংলাদেশ বিমানবাহিনীতে সংযোজিত এফ-৭ বিমানের প্রতিস্থাপন হিসাবে ১৪টি এফসি-২০ বিমান সংযোজনের প্রস্তাব দিয়েছে। এই প্রস্তাব বাংলাদেশের টেন্ডারকৃত ৮টি মাল্টিরোল বিমানের সাথে সম্পর্কিত নয়। এদিকে গত ১৫ মার্চ দৈনিক ইনকিলাবে প্রকাশিত আরেক সংবাদে দেখা গেছে, শুধু সাবমেরিন, যুদ্ধবিমানেই নয় বাংলাদেশ রাশিয়া থেকে ৫টি অত্যাধুনিক এমআই-১৭ হেলিকপ্টারও কিনতে আগ্রহী। এ বিষযে আলোচনার জন্য পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাসান মাহমুদ আলী আগামী মাসে রাশিয়া সফর করবেন। এসব প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম সংযোজন শুধু বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে উন্নতই করবে না, বরং বাংলাদেশের ক্রয় সক্ষমতাকেও বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরবে। সবকিছু মিলে বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা খাত এখন শুধু দেশে নয়, বিদেশেও আলোচিত হচ্ছে।
এদিকে বাংলাদেশ যে আটটি মাল্টিরোল কম্ব্যাট এয়ারক্রাফট (এমআরসিএ) ক্রয় করতে যাচ্ছে তা অত্যাধুনিক প্রযুক্তির হবে বলে বিভিন্ন বগ ও সাইটে প্রকাশিত তথ্যে জানা গেছে। এসব তথ্য মতে, বাংলাদেশ হয়তো রাশিয়া থেকেই এই যুদ্ধবিমানগুলো ক্রয় করতে পারে। ইতোপূর্বে ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনা প্রথমবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হয়ে রাশিয়া থেকে আটটি মিগ-২৯ ক্রয় করেছিলেন যা এখনো পর্যন্ত বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর ফ্লাগশিপ বা আইকনিক যুদ্ধাস্ত্র। প্রকাশিত এসব তথ্যে জানা যাচ্ছে, বাংলাদেশ যদি রাশিয়া থেকে এমআরসিএ যুদ্ধবিমান ক্রয় করে তবে রাশিয়ার সর্বশেষ প্রযুক্তির মিগ-৩৫, সুখোই-৩৫ এবং সুখোই-৩০ বিমানগুলোর যেকোনো একটির দিকেই তার নজর। তবে বিদ্যমান পরিস্থিতি বিবেচনায় বাংলাদেশ রাশিয়ার সু-৩০ এমকে২ বিমান ক্রয় করতে পারে বলে বøগগুলোতে বলা হয়েছে। সু-৩০ সিরিজের একটি বিমান রাশিয়ার সাথে যৌথভাবে ভারত উৎপাদন করছে ব্যাপকভাবে। তবে তা সু-৩০ এমকেআই ভার্সন। কিন্তু বাংলাদেশ কিনলে কিনতে পারে সু-৩০ এমকে ২ ভার্সন। এটা সম্পূর্ণ রাশিয়ার তৈরি সু-৩০ এমকেআই-এর উন্নত ভার্সন ও চতুর্থ প্রজন্মের বিমান। এই বিমানে সুখোই সিরিজের সর্বশেষে ভার্সন সু-৩৫ এর বেশ কিছু প্রযুক্তি সংযোজিত করে আপগ্রেড করা হয়েছে বলে জানা গেছে। এই দূরপাল্লার বিমান সংগৃহীত হলে বাংলাদেশের গভীর সমুদ্রে নিরাপত্তা দেয়া সম্ভব হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
অন্যদিকে চায়না থেকে ইতোপূর্বে ক্রয়কৃত এফ-৭ বিমান প্রতিস্থাপনের জন্য নতুন যে প্রস্তাব এসেছে তাতে যে এফসি-২০ বিমানের প্রস্তাব করা হয়েছে তা চায়নার জে-১০ বিমানের এক্সপোর্ট ভার্সন। ইতোপূর্বে বাংলাদেশ সফরে চাইনিজ বিমানবাহিনীর উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা বাংলাদেশ বিমানবাহিনী প্রধানকে এই বিমানের একটি রেপ্লিকা উপহার দিয়েছিলেন। এটি ৪.৫ প্রজন্মের বিমান বলে দাবী করা হয়েছে। এগুলোর উন্নত ভার্সন হচ্ছে জে-২০ ও এফসি-৩১। এগুলো পঞ্চম প্রজন্মের চাইনিজ স্টিলথ ফাইটার বিমান। বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর এফ-৭ বিমানের স্থলে যদি এফসি-২০ বিমান প্রতিস্থাপন করা হয় তবে তা বাংলাদেশের আকাশ প্রতিরক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন হবে বলে মনে করা হচ্ছে।
বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা খাত নিয়ে আলোচনার শুরু হয়েছে, চায়না থেকে বাংলাদেশের দুইটি সাবমেরিন ক্রয় নিয়ে। সাবমেরিন দুটি ক্রয়াদেশ দেয়ার পর থেকেই ভারতের বিভিন্ন গণমাধ্যমে বাংলাদেশের সাবমেরিন ক্রয়ের প্রয়োজনীয়তা ও উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়। প্রশ্ন তোলা হয়, প্রায় চারদিক দিয়ে ভারত বেষ্টিত বাংলাদেশ এই সাবমেরিন কাদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করবে? এ প্রশ্নের যুৎসই জবাবও দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেছেন, বাংলাদেশ কারো বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য এই সাবমেরিন ক্রয় করেনি। তবে যদি কেউ বাংলাদেশ আক্রমণ করে তবে তার সমুচিত জবাব দেয়া হবে। প্রধানমন্ত্রীর কথার বিশ্লেষণ করলে আমরা পাই যে, আক্রমণকারী যেকোনো দেশ বা শক্তির বিরুদ্ধে সমুচিত জবাব দিতে এই সাবমেরিন ক্রয় করা হয়েছে।
নভেম্বর মাসের মাঝামাঝি চায়না বাংলাদেশকে এ দুটি সাবমেরিন হস্তান্তর করে। এর পরপরই বাংলাদেশ সফরে আসেন ভারতের তৎকালীন প্রতিরক্ষা মন্ত্রী মনোহর পরিক্কর। তার সাথে আসেন সে দেশের সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনীর উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তাগণ। সে সময় গণমাধ্যমে আলোচিত হয় যে, ভারত বাংলাদেশের কাছে ওপেন স্কাই বা উন্মুক্ত আকাশ সুবিধা দাবী করেছে। বিষয়টি নিয়ে তখন অনেক বিতর্কের সৃষ্টি হয়। কিন্তু বাংলাদেশ সাহসিকতার সাথে ভারতীয় এই ভয়ানক প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছে বলে গণমাধ্যমে প্রকাশ। এরপরই সামনে আসে প্রতিরক্ষা চুক্তি। তবে বাংলাদেশ এখনই ভারতের সাথে কোনো প্রতিরক্ষা চুক্তি করতে আগ্রহী নয় বলে গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে জানা গেছে। বাংলাদেশ চাইছে প্রতিরক্ষা বিষয়ক একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করতে। তবে কি আছে সেই প্রতিরক্ষা স্মারকে সে বিষয়ে এখনো কিছু জানা যায়নি। বাংলাদেশ ও ভারত দুপক্ষের কেউই বিষয়টি নিয়ে মুখ খুলছে না।
ভারতীয় সাংবাদিক সুবীর ভৌমিকের বরাত দিয়ে বিবিসি বাংলা জানিয়েছে, ‘সামরিক ক্ষেত্রে আরো বাড়তি যোগাযোগ, প্রশিক্ষণ ইত্যাদি- এসব ব্যাপারে দুদেশের সেনাবাহিনীর মধ্যে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ স্থাপন করা সেটা একটা ব্যাপার। দুনম্বর হচ্ছে, ভারত চাইছে যে ভারতের কাছ থেকে বেশি পরিমাণে বিভিন্ন অস্ত্রশস্ত্র কেনা হোক।’ ‘বর্তমানে বাংলাদেশে বেশিরভাগ অস্ত্র চীন থেকে কেনে - ভারত সেই জায়গাতে ঢুকতে চাইছে। আর তিন নম্বর যেটা সেটা হচ্ছে, কিছু কিছু সন্ত্রাসবাদী তৎপরতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে প্রয়োজন হলে যৌথ অভিযান বা সম্মিলিত অভিযান চালানো - সেরকম একটা সুযোগ তৈরি করার একটা ব্যাপার এ চুক্তির মধ্যে ভারত রাখতে চাইছে।’ গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে উল্লেখ আছে চুক্তির মেয়াদ হবে ২৫ বছর, আর এর আওতায় বাংলাদেশকে ৫০ কোটি মার্কিন ডলার বা প্রায় চার হাজার কোটি টাকা ঋণ দেয়ারও প্রস্তাব আছে ভারতের। খবরে আরও বলা হচ্ছে দীর্ঘমেয়াদী ওই চুক্তি করতে ভারত বিশেষভাবে আগ্রহী।’ কিন্তু প্রশ্ন হলো ভারত কেন ভারত এরকম চুক্তি করতে চায় সে প্রশ্নও ভারতীয় সাংবাদিক সুবীর ভৌমিক করে করেছে বিবিসি। উত্তরে তিনি বলেছেন, ‘ভারতের একটা মূল্যায়ন হচ্ছে অন্য সব ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সাথে সম্পর্ক যেভাবে এগিয়েছে, প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রে সেভাবে এগোয়নি। এখানে ভারতের যে সমস্যাগুলো তার একটা হচ্ছে অভ্যন্তরীণ প্রতিরক্ষার সমস্যা, আর দ্বিতীয় হচ্ছে চীন।’ ‘এটা মাথায় রেখেই এ ধরনের একটা ডিফেন্স কো-অপারেশন প্যাক্ট ভারত করতে চাইছে, বিশেষ করে নর্থ-ইস্টার্ন রিজিয়নে তার কৌশলগত স্বার্থ রক্ষার জন্য।’
বিবিসির মতে, এই প্রতিরক্ষা চুক্তি বা সমঝোতা যেটা হতে চলেছে বলে খবর প্রকাশিত হচ্ছে, তার পুরোটাই ভারতের স্বার্থের অনুকূলে। ভারত বাংলাদেশকে যে ৫০ কোটি ডলারের অস্ত্র সহায়তা দিতে চাইছে সেটাও ঋণ আকারে। বাংলাদেশ সর্বাধিক অস্ত্র ক্রয় করে থাকে চায়না থেকে। এর বাইরেও যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া ও ইউরোপীয় কয়েকটি দেশ থেকে সমরাস্ত্র ক্রয় করে থাকে। সকলেই জানেন, ভারত বিশ্বের সর্বাধিক অস্ত্র আমদানীকারী দেশ। যে দেশ নিজেই বিভিন্ন দেশ থেকে অস্ত্র ক্রয় করে সে দেশ থেকে অস্ত্র ক্রয় করার আগে অনেক কিছু বিবেচনার রয়েছে। এমনিতেই কোনো দেশ অস্ত্র ক্রয় করে থাকে সে দেশের প্রতিরক্ষা নীতির আলোকে। বাংলাদেশও একটি প্রতিরক্ষা নীতি অনুসরণ করেই বিভিন্ন দেশ থেকে অস্ত্র ক্রয় করে থাকে। সে নীতির সাথে অনুগামী হলে ভারত থেকে অস্ত্র ক্রয় করা যেতেই পারে। বিশেষ করে সকলে জানেন, মিসাইল ইন্ডাস্ট্রিতে ভারত যথেষ্ট পারঙ্গমতা দেখিয়েছে। ভারতের নিজস্ব ব্র্যান্ডের বিভিন্ন পাল্লার মিসাইল রয়েছে। এদের মধ্যে অগ্নি, পৃত্থি, ব্রাহ্মোস অন্যতম। অনেকে মনে করেন, ভারত থেকে যদি ৫০ কোটি ডলারের অস্ত্র ক্রয় করতে হয় তাহলে ব্রাহ্মোস ব্র্যান্ডের এয়ার টু সারফেস মিসাইল কেনা উচিত। বাংলাদেশ যেসকল মাল্টিরোল যুদ্ধবিমান ক্রয় করতে চলেছে তাতে ব্রাহ্মোস সংযোজন করলে তা বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় দারুণ সংযোজন হতে পারে। এছাড়াও মিডিয়াম রেঞ্জের সারফেস টু সারফেস মিসাইল অগ্নি ও পৃত্থি মিসাইল ক্রয় করা যেতেই পারে। ভারত যদি ভিয়েতনামকে ব্রাহ্মোস দিতে পারে তবে প্রতিবেশী ও পরম বন্ধু বাংলাদেশকে দিতে আপত্তি থাকার কারণ থাকতে পারে না।
বাংলাদেশ যেসব দেশ থেকে অস্ত্র কেনে সেসব দেশের অনেকের সাথে প্রশিক্ষণসহ বিভিন্ন সামরিক সহায়তার সম্পর্কও রয়েছে। এদের মধ্যে একমাত্র চায়না ছাড়া অন্য কোনো দেশের সাথে বাংলাদেশে সামরিক চুক্তি নেই। বর্তমানে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ব্যাপকভাবে ভারত থেকে প্রশিক্ষণ সহায়তা লাভ করে থাকে। কিন্তু এর জন্য কোনো সামরিক চুক্তির প্রয়োজন হয়নি। একটি দেশ অন্য দেশের সাথে সামরিক চুক্তি করে থাকে সেদেশের প্রতিরক্ষা নীতির অনুসরণে। সম্ভাব্য হুমকি ও সম্ভাব্য শত্রু বিবেচনা করেই প্রতিরক্ষা চুক্তি করা হয়ে থাকে। বাংলাদেশও সে বিবেচনা ভুলে যেতে পারে না। স্বাধীনতার পর থেকেই বাংলাদেশ ‘সকলের সাথে বন্ধুত্ব, কারো সাথে বৈরিতা নয়’ পররাষ্ট্র নীতি অনুরসরণ করে এসেছে। এটি শান্তির প্রতি বাংলাদেশের কমিটমেন্টের পরিচয় বহন করে। কিন্তু এ কথার অর্থ এই নয় যে, শত্রুর সাথেও বন্ধুত্ব করতে হবে। সীমান্তের বাইরে যদি কোনো শত্রু বর্তমানে বাংলাদেশের নাও থেকে থাকে, ভবিষ্যতে হবে না এমন গ্যারান্টি কে দিতে পারবে? সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের সাসপেক্টেড এনিমি বা সম্ভাব্য শত্রু কে হতে পারে সেটি বিবেচনায় নিতে হবে। বাংলাদেশের তিন দিকে বেষ্টিত ভারতের সাথে রয়েছে ২৫৬৬ মাইল সীমান্ত এবং এককোণে মিয়ানমারের সাথে ১৭৬ মাইল সীমান্ত। এর বাইরে ২৫৭ মাইল উপকূলীয় সীমান্ত রয়েছে। এই মুহূর্তে ভারতীয় নৌবাহিনীতে দুইটি পরমাণু শক্তি চালিত সাবমেরিন ও ১৩টি ডিজেল ইলেকট্রিক চালিত সাবমেরিন রয়েছে। এ ছাড়াও আরো একটি পরমাণু শক্তি চালিত সাবমেরিন ও ৬টি ডিজেল শক্তি চালিত সাবমেরিন নির্মাণাধীন রয়েছে। তা সত্তে¡ও সম্পর্কের প্রবল মৌতাতের মধ্যে বাংলাদেশের ক্রয় করা দুটি ডিজেল সাবমেরিন নিয়ে ভারত উদ্বিগ্ন। কেন? মনুসংহিতা ভারতীয় কূটনীতির অন্যতম উৎস। এ শাস্ত্রে প্রতিবেশীকে শত্রু হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। তবে আন্তঃমহাদেশীয় ক্ষেপণাস্ত্রের যুগে শুধু প্রতিবেশীকে সাসপেক্টেড এনিমি ভেবে নিশ্চিত হওয়ার উপায় নেই।
প্রাচীন মনুসংহিতা শুধু নয় আধুনিক ভারতীয় সমর বিশারদ সুব্রামনিয়াম স্বামীর একটি উদ্ধৃতি থেকেও এর জবাব মেলে। তিনি বলেছেন, ‘its (Bangladesh) existence continues a week point in Indian security in the strategic north region. Should events in Assam and the other 'tribal' states in that region, or in neighboring Burma, cause deterioration in India's control of the area, Bangladesh proximity would be a critical factor.Õ (K Subrahmanyam Swami, Bangladesh and Indian Security). IndiaÕs security perspective- গ্রন্থে তিনি আরো বলেছেন, “This Country with it's population, size, resources and industrial output will be a dominant country in the region just as US, Soviet Union and China happen to be in their respective areas.’ সুব্রামনিয়াম স্বামীর সাথে ভারতীয় প্রতিরক্ষা বিশেষক ভবানী সেনগুপ্তার উদ্ধৃতি মিলিয়ে পড়লে আমরা একটি সম্পূর্ণ উত্তর পেতে পারি। তিনি বলেছেন, ‘ÔIndia will not tolerate any external intervention in a conflict situation in any South Asian country, If the intervention has any implicit or explicit anti-Indian implication. No South Asian government must, therefore, ask external military assistance with an anti-Indian bias from any countries.Õ (The India Doctrine- India Today, 31 August, 1983).
বাংলাদেশের সাথে ভারতের সম্পর্ক রক্ত ঋণে বাধা। স্বাধীনতা যুদ্ধের মধ্য দিয়ে এই বন্ধন সৃষ্টি হয়েছে। তবু নানা বিষয় নিয়ে মুক্তিযুদ্ধকালেই ভারতের সাথে বাংলাদেশের টানাপড়েন সৃষ্টি হয়। হয়তো সে কারণেই ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে আজ পর্যন্ত কোনো প্রতিরক্ষা চুক্তি সাক্ষরিত হয়নি। তবে ভারতের সাথে বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা চুক্তি না হলেও স্বাধীনতার প্রাক্কালে প্রবাসী সরকারের সাথে ভারতের যে ৭ দফা চুক্তি হয়েছিল তাতে প্রতিরক্ষার অনুসঙ্গ ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিল। চুক্তিটি ছিল নিম্নরূপ:
১. ভারতীয় সেনা বিশেষজ্ঞদের সরাসরি তত্ত¡াবধানে বাংলাদেশে একটি প্যারা মিলিটারী ফোর্স বা আধা সামরিক বাহিনী গঠন করতে হবে।
২. ভারতীয় সেনা বিশেষজ্ঞদের অধীনে যাবতীয় সামরিক সরঞ্জামাদি ক্রয় করতে হবে। সমস্ত সামরিক যান ও যন্ত্রপাতি ভারতের কাছ থেকেই কিনতে হবে।
৩. ভারতীয় কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণে ও তত্ত¡াবধানে স্বাধীন বাংলাদেশের যাবতীয় ব্যবসায়িক কর্মকান্ড পরিচালিত হবে।
৪. ভারতীয় পরিকল্পনাবিদগণই বাংলাদেশের উন্নয়নের ফর্মুলা ও পঞ্চ বার্ষিকী পরিকল্পনা প্রণয়ন করবেন।
৫. বাংলাদেশের সমস্ত বৈদেশিক ও কূটনৈতিক কর্মকান্ড ভারতের নির্দেশনা অনুযায়ী পরিচালিত হবে এবং তা কোনভাবেই ভারতের জাতীয় স্বার্থকে ক্ষুণœ করতে পারবে না।
৬. ভারতের অনুমোদন ছাড়া বাংলাদেশ কারো সাথে কোন চুক্তি স্বাক্ষর করতে পারবে না।
৭. এই চুক্তিটি ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার চলমান যুদ্ধের সময় ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরের আগে স্বাক্ষরিত হলো এবং চুক্তি অনুযায়ী ভারতীয় সৈন্য ভারতীয় সেনারা যে কোন সময় বাংলাদেশে প্রবেশ করে তাদের প্রতিপক্ষকে ধ্বংস করতে পারবে।
এ চুক্তির ১, ২ ও ৭ ধারা সরাসরি প্রতিরক্ষার সাথে সম্পর্কিত। তবে বাংলাদেশ ও ভারত কর্তৃপক্ষ কখনোই সরকারীভাবে এ চুক্তির কথা স্বীকার করেনি। মাসুদুল হক রচিত ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ও সিআইএ’ পুস্তকে এ চুক্তির কথা উল্লেখ রয়েছে। শোনা যায়, স্বাধীনতার পর দেশে ফিরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এ চুক্তির কথা জানতে পারে অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন। এ চুক্তিই নাকি তার ২৫ বছর মেয়াদী মৈত্রী চুক্তির প্রেক্ষাপট তৈরি করেছিল। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ ও ভারত একটি ২৫ বছর মেয়াদী চুক্তি করে- যা বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার মাত্র তিন মাসের মধ্যে ১৯৭২ সালের ১৯ মার্চ তারিখে ঢাকায় স্বাক্ষরিত হয়। ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী, সহযোগিতা ও শান্তি চুক্তি নামের এ চুক্তির ৮ ও ৯ ধারাটিও প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত। এ দুটি ধারায় বলা হয়েছিল-
অনুচ্ছেদ ৮
দুই দেশের মধ্যকার বর্তমান বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক অনুযায়ী চুক্তি সম্পাদনকারী উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন পক্ষদ্বয়ের প্রত্যেকে ন্যায় ও নিষ্ঠার সাথে ঘোষণা করছে যে, তারা একে অপরের বিরুদ্ধে পরিচলিত কোন সামরিক চুক্তিতে আবদ্ধ হবে না ব অংশ গ্রহণ করবে না। চুক্তি সম্পাদনকারী উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন পক্ষদ্বয় একে অন্যের উপর আক্রমণ থেকে ও বিরত থাকবে এবং তাদের ভূখন্ডে এমন কোন কাজ করতে দিবে না যাতে চুক্তি সম্পাদনকারী কোন পক্ষের প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রে কোন ক্ষতি হতে পারে অথবা কোন পক্ষেও নিরাপত্তার প্রতি হুমকি হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।
অনুচ্ছেদ ৯
কোন এক পক্ষের বিরুদ্ধে তৃতীয় পক্ষ সশস্ত্র সংঘর্ষে লিপ্ত হলে চুক্তি সম্পাদনকারী উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন পক্ষদ্বয়ের প্রত্যেকে এতদুল্লেখিত তৃতীয় পক্ষকে যে কোন প্রকার সাহায্যদানে বিরত থাকবে। এতদ্ব্যতীত যে কোন পক্ষ আক্রান্ত হলে অথবা আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিলে সেই আশঙ্কা দূরীভূত এবং নিজের দেশের শান্তি ও নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে যথাযথ সক্রিয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য উভয়পক্ষ জরুরি ভিত্তিতে আলাপ-আলোচনায় মিলিত হবে।
ভারতের তরফ থেকে এ চুক্তি মান্য করা হয়নি। কেননা, বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের বিচ্ছিন্নতাবাদী শান্তিবাহিনীকে ভারতের পক্ষ থেকে আশ্রয়, প্রশিক্ষণ ও সহায়তা দেয়ার অভিযোগ রয়েছে। বাংলাদেশে এই চুক্তি আওয়ামী লীগ বিরোধী রাজনীতির হাতিয়ারে পরিণত হয়। সে কারণে নবায়নযোগ্য এই চুক্তির মেয়াদ আওয়ামী লীগ শাসনামলে সমাপ্ত হলেও তারা তা নবায়ন করেনি। সে কারণে প্রধানমন্ত্রীর কাছে দেশবাসীর প্রত্যাশা জাতীয় প্রতিরক্ষার উন্নয়নে তার সদিচ্ছা ও যুগান্তকারী উদ্যোগগুলো যেনো কোনোভাবে বিতর্কের মায়াজালে ঢাকা না পড়ে সে ব্যাপারে তিনি সতর্ক থাকবেন। জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি সৃষ্টিকারী ওপেন স্কাইয়ের বেলায় তিনি যেমন আপোস করেননি, তেমনি প্রতিরক্ষা সমঝোতা ও জাতীয় স্বার্থের বেলায়ও জাতীয় নিরাপত্তা, সার্বভৌমত্ব ও মর্যাদাকে সর্বাগ্রে প্রাধান্য দেবেন এটাই জাতীয় প্রত্যাশা।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।