হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির খড়গ : আসামের এনআরসি এবং বাংলাদেশ
কিশোর শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক দাবীর আন্দোলনে ঢাকাসহ সারাদেশে তীব্র রাজনৈতিক উত্তেজনা ও অনিশ্চয়তা দেখা যাচ্ছিল,
জামালউদ্দিন বারী : বিশ্ব রাজনীতির গণচেতনায় এক ধরনের চিত্তবিক্ষেপের বিরূপ প্রভাব লক্ষ করা যাচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৪৫তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে সেই বিক্ষেপের ধারাটি অনেকটা স্পষ্ট হয়ে উঠতে দেখা যায়। গণচেতনার এই অবক্ষয় এবং মানবিকতার স্খলন ও অধঃগামিতা শুরু হয়েছিল অপরাজনীতির হাত ধরেই। একচ্ছত্র পুঁজিবাদী লুণ্ঠন এবং সর্বগ্রাসী সাম্রজ্যবাদের স্বপ্ন পুরো বিশ্বকে যুদ্ধ ও নির্মমতার বিভীষিকার মধ্যে ঠেলে দিয়েছে। সাধারণ মানুষ শুরু থেকেই সহিংসতা ও যুদ্ধবিরোধী মনোভাব পোষণ করলেও রাষ্ট্রযন্ত্র ও শাসকশ্রেণির স্বার্থে পরিচালিত নানা মাধ্যম ও নানামাত্রিক প্রচার-প্রচারণা বা মনস্তাত্তি¡ক মোটিভেশন এখন অনেকটাই সফল। রাজনীতিতে সত্যিকারের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও উদার মানবিক বিষয়গুলো অনেক আগেই নির্বাসিত করা সম্ভব হয়েছে। সত্য-মিথ্যার দ্ব›দ্ব চিরন্তন। সেই চিরন্তন দ্ব›দ্ব ভুলিয়ে মানুষকে এখন শোনানো হচ্ছে ‘ইভিল ও লেসার ইভিল’র গল্প। অর্থাৎ ক্ষমতার দ্ব›েদ্ব লিপ্ত দুই পক্ষের খারাপ দিকগুলো এখন আর ঢেকে রাখা যাচ্ছে না বিধায়, এক পক্ষকে আরেক পক্ষের চেয়ে বেশি খারাপ হিসেবে উপস্থাপন করে জনগণকে লেসার ইভিলের পক্ষে দাঁড়ানোর একটি মনস্তাত্তি¡ক প্লাটফর্ম তৈরি করে দিচ্ছে। রাষ্ট্রযন্ত্র ও রাজনীতির প্রকৃত লক্ষ্য, সংকট ও সমস্যা থেকে জনগণের দৃষ্টি ভিন্ন খাতে প্রবাহিত রাখাই এই মনস্তত্তে¡র মূল লক্ষ্য। এই লক্ষ্য অর্জন করতে গণমাধ্যমকে কাজে লাগাতে মার্কিন নীতিনির্ধারক চার্লস উইলসন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদপত্র প্রকাশকদের উদ্দেশে বলেছিলেন, “ইফ দ্য পিপল আর নট কনভিন্সড (দ্যাট দ্য ফ্রি ওয়ার্ল্ড ইজ ইন ডেঞ্জার) ইট উড বি ইম্পোসিবল ফর কংগ্রেস টু ভোট দি ভাস্ট সামস বিইং স্পেন্ট টু এভার্ট ডেঞ্জার। উইথ দ্য সাপোর্ট অব পাবলিক অপিনিয়ন, অ্যাজ মার্শাল্ড বাই দি প্রেস, উই আর অফ টু অ্যা গুড স্টার্ট। ইট ইজ আওয়ার জব- ইউর্স অ্যান্ড মাইন- টু কিপ আওয়ার পিপল কনভিন্সড দ্যাট দি ওনলি ওয়ে টু কিপ ডিজাস্টার অ্যাওয়ে ফ্রম আওয়ার শোরস ইজ টুু বিল্ড আপ আমেরিকান মাইট”। চার্লস উইলসন ছিলেন জেনারেল ইলেক্ট্রিক কোম্পানির চেয়ারম্যান, পরবর্তীতে ১৯৫০ সালে প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যানের ডিফেন্স মবিলাইজেশন বিষয়ক দফতরের প্রধান হিসেবে নিয়োগ পেয়েছিলেন তিনি। মার্কিন সাম্রজ্যবাদের অর্থনৈতিক ও সামরিক এজেন্ডাগুলো জনগণের কাছে যৌক্তিকভাবে তুলে ধরতে নিউ ওয়ার্ল্ড অর্ডারের প্রবক্তারা যথার্থভাবেই সক্ষম হয়েছিলেন। প্রচার-প্রপাগান্ডার সেই রাজনৈতিক কর্মসূচি মার্কিন সাম্রজ্যবাদের শক্তি-সামর্থ্যকে কতটা যথার্থভাবে বিকশিত করতে পেরেছে তা নিয়ে এখন বিতর্ক হতে পারে। কারণ মাত্র ৭০ বছরের মাথায় মার্কিন সাম্রজ্যবাদের আধিপত্য এখন ক্ষয়িষ্ণু ও বিগতপ্রায়। উল্লেখ্য, সফল বিপ্লবের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত সোভিয়েত সমাজতন্ত্রও ৭০ বছর টিকে থাকার পর পতনের শিকার হয়েছে আরো সিকি শতাব্দী আগেই। সে সময় থেকেই সমাজতন্ত্রের ভ্যাকুয়াম এবং পুঁজিবাদের বিষফল থেকে বিশ্বব্যবস্থাকে মুক্ত করতে তৃতীয় শক্তি হিসেবে ইসলামী অর্থনীতি ও ভুয়োদর্শনের বিস্তার ঘটতে শুরু করেছে। পক্ষান্তরে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ বিসর্জন দিয়ে মার্কিন পাওয়ার এলিটরা জনগণকে কথিত লেসার ইভিলের পক্ষে দাঁড় করিয়ে গ্রেটার ইভিলকেই ক্ষমতায় বসাচ্ছে। ওদের কাছে মার্কিন সংবিধান, ফাউন্ডিং ফাদারদের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, মানবাধিকার রক্ষায় বিশ্বের প্রধান পৃষ্ঠপোষক হওয়ার মহানুভবতা এখন নির্বাসিত। তারা দেশে দেশে যুদ্ধের বিভীষিকা ছড়িয়ে দিলেও তাদের সমরাস্ত্রে নিহত ও উদ্বাস্তু লাখ লাখ মানুষের জন্য তারা পশ্চিমের সব বর্ডার বন্ধ করে দেয়ার নির্মম তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। তবে অর্ধ শতাব্দীর বেশি সময় ধরে ক্রমাগত মগজ ধোলাইয়ের পরও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা সমাজের প্রায় অর্ধেক মানুষ সাম্রজ্যবাদীদের পরিকল্পনা অনুসারে এখনো অমানবিক বা রোবটিক পাপেটে পরিণত হয়নি। তাদের একটি বড় অংশ যে নানাভাবে বিভ্রান্ত হয়েছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এ কারণেই ডোনাল্ড ট্রাম্প মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হতে পেরেছেন। নির্বাচিত হওয়ার পর শত শত শহরে বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়েছে এবং নির্বাচনী ব্যবস্থায় বিজয়ী হয়ে আসা প্রেসিডেন্টকে মেনে না নেয়ার অগণতান্ত্রিক মনোভাবও প্রকাশ পেয়েছে।
জনগণকে দ্বিদলীয় বৃত্তে আবদ্ধ করে ফেলা সাম্রজ্যবাদী বিশ্বরাজনীতির কর্পোরেট অনুঘটকদের জন্য সুবিধাজনক বিষয়। ক্ষমতার পালাবদলকে সামনে রেখে এর মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক পক্ষগুলোর সাথে দরকষাকষি ও বোঝাপড়ায় উপনীত হওয়া অপেক্ষাকৃত সহজ। ইতিমধ্যেই রাজনীতিতে কালো টাকার মালিকদের প্রভাব বলয় শক্তিশালী করে তোলা হয়েছে। অর্থনৈতিক সমবণ্টনের আদর্শিক রাজনীতি ও সামাজিক কমিটমেন্ট নিয়ে যারা রাজনীতি করতে চান তাদেরকে জনগণের কাছে গৌণ করে ফেলার লক্ষ্যে তারা অনেকটাই সফল। দেশের অভ্যন্তরে রাজনৈতিক ও জাতিগত সংঘাত, আঞ্চলিক পেরিফেরিতে ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থদ্ব›দ্ব এবং বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক মনোপলি টিকিয়ে রাখতে নানাবিধ সংকট বাড়িয়ে তোলার প্রয়াস বেশ কার্যকর বলে প্রমাণিত হয়েছে। স্নায়ুযুদ্ধের সময়ে মার্কিন পাওয়ার এলিটদের অন্যতম মুখপাত্র হেনরি কিসিঞ্জার বলেছিলেন, “কন্ট্রোল অয়েল অ্যান্ড ইউ কন্ট্রোল নেশনস, কন্ট্রোল ফুড অ্যান্ড ইউ কন্ট্রোল দি পিপল”। তেলের পাশাপাশি অর্থনীতি, বাণিজ্য, শাসনব্যবস্থা ইত্যাদিও জাতিসমূহকে নিয়ন্ত্রণের বিষয়বস্তু হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। জনগণের ঐক্য ও আকাক্সক্ষার মধ্যে চিড় ধরিয়ে দিয়ে এসব লক্ষ্য হাসিল করা হচ্ছে। সামাজিক-সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যগত মূল্যবোধ থেকে জাতিকে বিচ্ছিন্ন করে সাম্রজ্যবাদী অর্থনৈতিক ফায়দা হাসিলের রাজনৈতিক এজেন্ডার বাস্তবায়ন এখন বিশ্বের সর্বত্রই দৃশ্যমান। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে মধ্যপ্রাচ্য বা দক্ষিণ এশিয়া কোথাও ব্যতিক্রম নেই। পশ্চিমবঙ্গের নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন তার কোনো এক আলোচনায় বলেছেন- “দুর্ভিক্ষ কেবল খাদ্যাভাবে হয় না, খাদ্যের দুর্ভিক্ষের চেয়ে বড় দুর্ভিক্ষ চিত্তের দুর্ভিক্ষ”। চেপে বসা রাষ্ট্রশক্তির বিরুদ্ধে জনচেতনার বিস্ফোরণ ছাড়া এই দুর্ভিক্ষ দূর করা সম্ভব নয়। বিশেষত তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে মানুষের রাজনৈতিক ভাগ্য নির্ধারণে কালো টাকার দৌরাত্ম্য এবং নেপথ্যে বা পর্দার অন্তরালে থাকা জাতীয়-আন্তর্জাতিক সামরিক-বেসামরিক কুশীলবরা জনগণের চিত্তের দুর্ভিক্ষকে প্রকট করে তুলছে। ধামাধরা আমলাতন্ত্র এবং রাজনীতিকের ছদ্মবেশধারী কালো টাকার মালিকরা ক্ষমতাকেন্দ্রিক অপরাজনীতির অনুঘটক হিসেবে কাজ করছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পর সম্প্রতি অনুষ্ঠিত ভারতের ৫টি অঙ্গরাজ্যের নির্বাচনী ফলাফল সাম্প্রতিক বিশ্বরাজনীতির গতিপ্রকৃতি নির্দেশ করছে। বিশেষত কালো টাকা ও পেশিশক্তির প্রাদুর্ভাব ও জনগণের চিত্তের দুর্ভিক্ষ কতটা প্রকট হতে পারে এসব নির্বাচনের ফলাফল থেকে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এ প্রসঙ্গে ভারতের অন্যতম বৃহৎ রাজ্য উত্তর প্রদেশ এবং উত্তর-পূর্ব ভারতের ক্ষুদ্র রাজ্য মনিপুরের নির্বাচনী ফলাফলকে কেস স্টাডি হিসেবে গ্রহণ করা যেতে পারে। পশ্চিম-উত্তর প্রদেশের ১১টি জেলার মধ্যে ৬টি জেলায় মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ বা ফলাফল নির্ধারণে মুখ্য ভূমিকায় থাকলেও মুসলমানরা বহুধাবিভক্ত হয়ে তাদের সে সক্ষমতা কাজে লাগাতে ব্যর্থ হয়েছে। মুসলমানদের একটি অংশ বিজেপির পক্ষে গেছে এবং বাকির স্বতন্ত্র এবং দ্বিধাবিভক্ত হয়ে অখিলেশ যাদবের সমাজবাদি পার্টি-কংগ্রেস (জোট) এবং বহেনজি মায়াবতির বহুজন সমাজবাদী পার্টির পক্ষে অবস্থান নেয়ার সুফল পেয়েছে কেন্দ্রের ক্ষমতাসীন বিজেপি। উল্লেখ্য, মুসলিম ভোট টানতে দলগুলো শতাধিক আসনে মুসলমান প্রার্থীকে মনোনয়ন দিয়েছিল। স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবেও অনেক মুসলমান প্রার্থী নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল। উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা একাট্টা হয়ে বিজেপিকে ভোট দিয়ে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিশ্চিত করেছে। কারেন্সি বাতিলের (৫০০ ও ১০০০ রুপির নোট) সিদ্ধান্ত যখন নরেন্দ্র মোদির গদিকে টলায়মান করে তুলেছিল, তখন উত্তর প্রদেশের নির্বাচনে বিশাল বিজয় মোদির গদিকে আরো মজবুত ভিত্তি দিয়েছে। যেখানে ২০১২ সালের নির্বাচনে উত্তর প্রদেশের ৪০৩টি আসনের মধ্যে বিজেপি ৪৭টি আসন পেয়েছিল এবার তারা ৩১২টি আসন পেয়ে সাড়ে ৩ দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে আবিভর্‚ত হয়েছে। এ তো গেল উত্তর প্রদেশের কথা। উত্তর-পূর্ব ভারতের ক্ষুদ্র রাজ্য মনিপুর রাজ্যের ৬০টি আসনের মধ্যে ২৭ আসনে কংগ্রেস এবং ২২টিতে বিজেপি বিজয়ী হলেও অন্য দলগুলোর সাথে সমঝোতা করে সেখানে বিজেপি সরকার গঠনের চেষ্টা করছে বলে জানা গেছে। এসব প্রাদেশিক নির্বাচনের ফলাফল বিশ্লেষণ এই নিবন্ধের লক্ষ্য নয়। বিষয় হচ্ছে মনিপুরের থুবাল আসনে আলোড়ন সৃষ্টিকারী মানবাধিকার নেত্রী ইরম চানু শর্মিলার অভাবনীয় পরাজয়। থুবাল আসনে ত্রিমুখী লড়াইয়ের সম্ভাবনার কথা বলা হচ্ছিল। সেখানে কংগ্রেস দলীয় প্রার্থী বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী ওকরাম ইবোবি সিং বিজেপি প্রার্থীর চেয়ে ১০ হ্জাারের বেশি ভোটের ব্যবধানে বিজয়ী হলেও চানু শর্মিলার প্রাপ্ত ভোট সংখ্যা লজ্জাজনক। নিরাপত্তার নামে ড্রাকোনিয়ান আইনের (আফস্পা-বা আর্মড ফোর্সেস স্পেশাল পাওয়ার অ্যাক্ট) বিরুদ্ধে রাজ্যের মানুষের মানবাধিকার রক্ষায় ১৬ বছর ধরে মরণপণ অনশনরত ইরম শর্মিলা গত আগস্ট মাসে অনশন ভেঙে এই নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। মানবাধিকারের প্রশ্নে তার ১৬ বছরের অব্যাহত আপসহীন ভ‚মিকার কারণে তাকে আয়রণ লেডি বা লৌহ মানবী খেতাবে ভ‚ষিত করেছিল জনগণ ও মিডিয়া। বিশ্বমিডিয়ায় তাকে নিয়ে অনেক প্রতিবেদন প্রকাশ হয়েছে, বিভিন্ন দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থা তাকে সম্মানজনক পুরস্কারে ভ‚ষিত করেছে। তার নীরব প্রতিবাদের আওয়াজ সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছিল। সমগ্র উত্তর-পূর্ব ভারতের মানবাধিকারের আইকনিক চরিত্রে পরিণত হয়েছিলেন ইরম শর্মিলা। সেই ইরম শর্মিলা কিনা প্রাদেশিক নির্বাচনে মাত্র ৯০টি ভোট পেয়েছেন! ইরম শর্মিলার এই ভোট নির্বাচনের পাবলিক সাইকোলজি সম্পর্কে আমাদেরকে নতুনভাবে ভাবতে বাধ্য করছে।
ভারতের উত্তর-পূর্বের সেভেন সিস্টার্স রাজ্যগুলোর বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন এবং নিরাপত্তা বাহিনীর মানবাধিকার লঙ্ঘনের সহিংস ঘটনাবলী ৬ দশক ধরে যুগপৎভাবেই চলছে। ১৯৭২ সালের ১৪ মার্চ মনিপুরের ইম্ফলে জন্মগ্রহণকারী ইরম চানু শর্মিলা ছাত্রজীবন থেকে মানবাধিকার কর্মী হিসেবে সক্রিয় রয়েছেন। একই সাথে তিনি কবি, মানবাধিকার কর্মী এবং রাজনৈতিক অ্যাক্টিভিস্ট হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন। আটান্ন সালের আফস্পা আইনের অপপ্রয়োগ করে মণিপুরে ভারতীয় সেনাবাহিনীর সদস্যরা যখন-তখন নির্বিচার হত্যা, গুম, খুন ও ধর্ষণে লিপ্ত হওয়ার অভিযোগ দীর্ঘদিনের। ২০০০ সালের ২ নভেম্বর মনিপুরের মালোম এলাকার একটি বাসস্ট্যান্ডে গাড়ির জন্য অপেক্ষারত অবস্থায় আসাম রাইফেলসের সদস্যদের গুলিতে ১০ জন নিরস্ত্র মানুষ নিহত হয়। নিহতদের মধ্যে চানু শর্মিলার একজন বন্ধু ও সাহসিকতার জন্য জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত মানবাধিকার কর্মী, ৬২ বছর বয়সী এক বৃদ্ধা ও শিশু রয়েছে। যাই হোক আধাসামরিক বাহিনীর সদস্যদের হাতে ১০ জন নিরপরাধ মানুষ নিহত হওয়ার ঘটনার কথা শুনে ইরম চানু শর্মিলা তাৎক্ষণিক বাইসাইকেল চালিয়ে ঘটনাস্থলে গিয়ে পৌঁছেন। সেখানেই তিনি সিদ্ধান্ত নেন জীবনের সর্বস্ব দিয়ে এই ধারাবাহিক হত্যাকান্ডের প্রতিবাদ জানাবেন, নিবর্তনমূলক আফস্পা আইনের বিরুদ্ধে গণপ্রতিরোধ গড়ে তোলবেন। আটাশ বছর বয়সী দীর্ঘাঙ্গি ইরম চানু শর্মিলা আমরণ অনশনের ঘোষণা দিয়ে এই আইন পরিবর্তিত না হওয়া পর্যন্ত আমৃত্যু খাদ্য গ্রহণ করবেন না, কোনো কিছু পান করবেন না, এমনকি মাথায় চিরুনি স্পর্শ বা আয়নায় মুখ না দেখারও সঙ্কল্প করেন। ২০০০ সালের ৫ নভেম্বর থেকে অনশন শুরুর ৩ দিন পর আত্মহত্যা চেষ্টার অভিযোগ এনে শর্মিলাকে গ্রেফতার করে পুলিশ। জোর করেও অনশন ভাঙতে ব্যর্থ হওয়ার পর অবস্থার অবনতি ঘটনার এক পর্যায়ে আদালতের নির্দেশে পুলিশ হেফাজতে শর্মিলার নাক দিয়ে খাদ্যনালিতে পাইপ লাগিয়ে তরল খাবার দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়। এরপর ষোল বছরে অসংখ্যবার তাকে আদালত থেকে জামিনে মুক্তি দেয়া হলেও ইন্ডিয়ান পেনাল কোড আইনের ধারায় আত্মহত্যা চেষ্টার অভিযোগে পুনরায় গ্রেফতার করা হয়েছে। বিচ্ছিন্নতাবাদ দমনের নামে প্রবর্তিত কালাকানুনের বিরুদ্ধে দেড় দশক ধরে আপসহীন অনশনে বসে চানু শর্মিলা কিছু সার্থক কবিতা রচনা করেছেন। বিশ্বের মানবাধিকার সংগঠনগুলোর সাথে নিবিড় সম্পর্ক বজায় রেখে চলেছেন। ভারতীয় মানবাধিকার সংস্থা এবং গণমাধ্যমের পাশাপাশি বিবিসি, সিএনএনসহ পশ্চিমা গণমাধ্যমের ফোকাসে মানবাধিকারের একজন বিশ্ব আইকন হয়ে উঠেছেন চানু শর্মিলা। এ সময়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শান্তি পুরস্কার এবং এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশন অ্যাওয়ার্ডসহ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অন্তত ১০টি সংস্থা তাকে পুরস্কৃত-সম্মানীত করেছে। তার কর্ম ও জীবনকে উপজীব্য করে কয়েকটি ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণামূলক গ্রন্থ রচিত হয়েছে। নাটক মঞ্চস্থ হয়েছে।
গত জুলাই মাসে আদালতে হাজিরা দিতে গিয়ে ইরম শর্মিলা হঠাৎ করেই অনশন ভঙ্গের ঘোষণা দিয়ে আসন্ন প্রাদেশিক নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে নির্বাচিত হয়ে ড্রাকোনিয়ান আইনের বিরুদ্ধে আইন পরিষদে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন। পিপলস রিসারজেন্স অ্যান্ড জাস্টিস এলায়েন্স নামের রাজনৈতিক প্লাটফর্ম থেকে শর্মিলা নির্বাচনে লড়ার সিদ্ধান্ত নেন। তবে আফস্পা বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো আশ্বাস ছাড়াই তার এই অপ্রত্যাশিত ঘোষণাকে মানবাধিকার সমর্থক ও ইরম শর্মিলার ভক্তদের হতাশ করেছে বলেই ধরে নেয়া যায়। যে বয়সে মেয়েরা বিয়ে করে সংসারী হয়, পেশাগত জীবন বেছে নেয় ইরম শর্মিলা সে সময় তার রাজ্যের মানুষের মানবাধিকারের দাবিতে আমরণ অনশনের ঘোষণা দিয়ে ভারতের উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলোর মানবাধিকার পরিস্থিতি সারা বিশ্বের সামনে তুলে ধরার উপলক্ষ হয়ে উঠেছেন। নোবেল লরেট মানবাধিকার নেতা শিরিন এবাদি শর্মিলার অনশন ও প্রতিবাদের বিষয়বস্তুকে জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলে তুলে ধরার প্রতিশ্রæতি দিয়েছিলেন, ভারতীয় দুর্নীতিবিরোধী মানবাধিকার নেতা আন্না হাজারে, সর্ব ভারতীয় তৃণমূল কংগ্রেস এবং কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষ থেকে শর্মিলার প্রতি সমর্থন জানানো হয়েছিল ২০১১ সালে। শর্মিলার প্রতি সমর্থন জানাতে গিয়ে ৩০ জন ভারতীয় নারী আসাম রাইফেলসের হেডকোয়ার্টারের সামনে উলঙ্গ হয়ে ‘ভারতীয় সেনাবাহিনী আমাদেরকে ধর্ষণ কর’ লেখা ব্যানার নিয়ে প্রতিবাদ করে পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়ে ৩ মাস কারাবরণ করেছিল। একজন সাধারণ তরুণীর মানবাধিকার কর্মী হিসেবে আপসহীন ভ‚মিকা ১৬ বছরে ‘পাবলিক সেসিসটেন্স আইকন’ হয়ে ওঠার গল্প আরো অনেক বিস্তৃত। এমন এক নিঃস্বার্থ মানবাধিকার কর্মী, কবি ও মননশীল মানুষের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হওয়া কি বোকামি? নির্বাচনে মাত্র ৯০ ভোট পাওয়ার ফলাফল বিশ্লেষণ করতে গিয়ে এমন প্রশ্ন উঠতেই পারে। তবে নির্বাচনের পর অত্যন্ত হতাশ ইরম ভবিষ্যতে আর কোনো নির্বাচনে অংশ না নেয়ার কথা ঘোষণা করেন। সেই সাথে নির্বাচনের এমন ফলাফলের জন্য পেশিশক্তি ও কালো টাকার প্রভাবকে দায়ী করেছেন। যে সময় রাজনীতি হয়ে উঠেছে জনগণের সম্পদ লুণ্ঠনের হাতিয়ার। সে সময়ে কোটি কোটি টাকা ও পেশিশক্তি ছাড়া ভোটের রাজনীতি অচল, তখন শুধুমাত্র জনগণের অধিকারের জন্য জীবন বাজি রাখার অবদানের স্বীকৃতি প্রত্যাশা করা অরণ্যে রোদন ছাড়া আর কিছুই নয়। দ্বিদলীয় বৃত্তের ভেতর জনগণ এখন লেসার ইভিল অথবা গ্রেটার ইভিলকেই বেছে নিতে বাধ্য। এমন সামাজিক-রাজনৈতিক বাস্তবতায় রাষ্ট্রের ড্রাকোনিয়ান আইন পরিবর্তনের চাইতে জনগণের মনস্তত্ত¡ পরিবর্তনে কাজ করা ও জনমত গঠন করা অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক ও প্রয়োজনীয় ইস্যু। মনিপুরের ৩০ লাখ মানুষের মধ্যে একজন ইরম চানু শর্মিলা আছেন, তার সাথে সময়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ আরো ৯০ জন সমর্থক আছেন যারা তাকে ভোট দিয়েছেন। তারা কী পারবেন ভারতের সবচেয়ে পশ্চাৎপদ অঞ্চলে এই পরিবর্তনের সূচনা করতে?
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।