Inqilab Logo

বুধবার, ০৩ জুলাই ২০২৪, ১৯ আষাঢ় ১৪৩১, ২৬ যিলহজ ১৪৪৫ হিজরী

ইট ভেঙে পরিবারের অভাব দূর

| প্রকাশের সময় : ১৩ মার্চ, ২০১৭, ১২:০০ এএম

গৌরীপুর (ময়মনসিংহ) উপজেলা সংবাদদাতা : ইট ভাঙা হচ্ছে রাস্তার পাশে। ইট ভাঙা হচ্ছে বাড়ির আঙ্গিনায়। কোথাও আবার ঘরের বারান্দা কিংবা রান্নাঘরের ভেতরেই চলছে ইট ভাঙার কাজ। বিভিন্ন বয়সী নারীরা ইট ভাঙার কাজ করছেন। কোনো স্থানে একা একা, কোনো স্থানে আবার দলবদ্ধভাবে। ময়মনসিংহের গৌরীপুর পৌরশহরের বালুয়াপাড়া গ্রামে গেলে প্রতিদিনই এই দৃশ্য চোখে পড়বে। সংসারের সব কাজ করার পাশাপাশি ইট ভেঙে পরিবারের অভাব দূর করেছেন এই গ্রামের দেড় শতাধিক নারী। নিজেরা উপার্জনক্ষম হয়ে বদলে দিয়েছেন নিজেদের জীবনযাত্রা।
কিছুদিন আগে বালুয়াপাড়া গ্রামে গিয়ে কথা হয় ইট ভাঙার কাজ করা নারীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, তাঁদের জীবন-সংগ্রামের গল্প। এক সময় আর্থ-সমাজিকভাবে পিছিয়ে থাকা এই এলাকার দারিদ্র্যপীড়িত নারীরা কিভাবে আত্মনিভর্রশীল হয়ে উঠেছেন এই বিষয় নিয়ে কথা বলতে গেলে বেরিয়ে আসে দিন বদলের নানা কথা। তাদেরই দুইজন হলেন বালুয়াপাড়া গ্রামের বাসিন্দা আব্দুছ সোবহানের মেয়ে রাবেয়া খাতুন (৩৬) ও তাঁর বোন আম্বিয়া খাতুনের (৩৪)। তাদের হাত ধরেই এখানে শুরু হয়েছিল একটি দিন বদলের গল্প। দুই বোনের সাথে কথা বলে জানা যায়, আনুমানিক ২৫ বছর আগের কথা। তখন তাঁরা কিশোরী। বাবা রিকশা চালাতেন। সারাদিন খেটে যা রোজগার করতেন তা দিয়ে পাঁচ সদস্যের পরিবারের ভরণ-পোষণ হতো না। কিছু একটা করে সংসারের অভাব দূর করার তাড়নায় একদিন ঘর থেকে বের হয়। বাড়ি থেকে তিন কিলোমিটার দূরে ছিল উপজেলার রামগোপালপুর জমিদারদের পরিত্যক্ত বাড়ি। সেই বাড়ির খসেপড়া ইট কুড়িয়ে বাড়িতে নিয়ে আসে। বেশকিছু ইট ভেঙে সুড়কি করে ময়মনসিংহে শম্ভুগঞ্জ এলাকার এক ব্যবসায়ীর কাছে বিক্রি করে। হাতে কিছু টাকা আসে। এভাবে রামগোপালপুর জমিদার বাড়ি থেকে কিছুদিন ইট কুড়িয়ে এনে জমিয়ে মাঝে মাঝে বিক্রি করে ফেরিওয়ালার কাছে। সাথে বিক্রি করার মতো আরো যা কিছু পায় তাই কুড়িয়ে আনে। রাবেয়া আর আম্বিয়ার দেখাদেখি অভাবি আরো কিছু কিশোরী জুটে যায় দলে। মাঝে মাঝে মায়েরাও যায় মেয়েদের সাথে। এভাবে চলে ৫ বছর। এরইমধ্যে বাড়ির আশপাশে ময়মনসিংহ কিশোরগঞ্জ সড়কের পাশে গড়ে উঠে কয়েকটি ইটভাটা। বালুয়া পাড়ার নারীরা ইটভাটার কাজে জড়িয়ে পড়েন। ইটভাটার ভাঙার অভিজ্ঞতার কথা মাথায় রেখে একদিন জমানো কিছু টাকা দিয়ে বাড়িতে ইট কিনে আনেন আম্বিয়া ও রাবেয়া। সেই ইট বাড়িতে বসে সুড়কি করে বিক্রি করেন। ইট বেচে চার টাকা লাভ হয়। এরপর শুরু হয় নতুন গল্পের। দুই বোন আর মা ইটভাটা থেকে ইট কিনে এনে সুড়কি করে বিক্রি করে। হাতে টাকা আসতে থাকে। দেখাদেখি বালুয়াপাড়ার অভাবি অন্য পরিবারগুলোও ইট ভেঙে সুড়কি করার কাজ শুরু করে। ২৫ বছর পর এখন ওই এলাকার প্রায় দেড় শতাধিক নারী দিনে ছয় থেকে আট ঘণ্টা ইটভাঙার কাজ করেন। বদলে গেছে অভাবি মানুষের জীবন। বর্তমানে ময়মনসিংহের গৌরীপুর উপজেলা ও আশপাশের বিভিন্ন অঞ্চলের স্থাপনা নির্মাণের জন্য বেশির ভাগ সুড়কির চাহিদা এখান থেকে মেটানো হয়। সরেজমিনে দেখা যায়, ইট ভাঙার কাজ করা নারীদের অনেকরই এখন আধা-পাকা বাড়ি রয়েছে। অনেকের ঘরে ঘরে আছে, খাট, খাবার টেবিল ও রঙিন টেলিভিশসহ নানা আসবাবপত্র। আম্বিয়া খাতুন বলেন, এই ব্যবসা শুরু করার পর অভাবের সংসারে উন্নতি হয়েছে। স্বামী-সন্তানসহ ৭ সদস্যের পরিবার নিয়ে আমরা এখন সুখি। আমার কারখানায় ১৫/১৬ নারী ইট ভাঙার কাজ করে। নারীদের সাথে আমি নিজেও এখনো ইট ভাঙি। পাশাপাশি ব্যবসার আয়ের টাকা দিয়ে অন্যান্য ব্যবসা শুরু করেছি। স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা যায়, বালুয়াপাড়ার ২০টির বেশি পরিবার সরাসারি ইট কিনে সুড়কি করে ব্যবসার কাজে যুক্ত। ইট কিনে আনা ও সুড়কি করে বিক্রির জন্য অনেকেই কিনে নিয়েছেন ট্রলি। যে পরিবারগুলো এখনো নিজেরা ব্যবসার সাথে যুক্ত হতে পারছে তাঁরা অন্যের অধীনে ইট ভাঙার কাজ করছেন। ইট ভাঙার কাজের জন্য তাঁদের ধরাবাঁধা কোনো সময় মানতে হয় না। সংসারের অন্য কাজের ফাঁকে ফাঁকে দিনে-রাতে যখন ইচ্ছা তখন ইট ভাঙে। ইট ভেঙে এক টিন (সোয়াবিন তেলের টিন) সুড়কি করলে পায় পাঁচ টাকা। বালুয়াপাড়া গ্রামের নারী-পুরুষদের সাথে কথা বলে জানা যায়, পুরুষেরা ইজিবাইক চালনো, মুদি দোকান করাসহ নানা পেশায় আছেন। সাথে পুরুষদের রোজগারের পাশাপাশি নারীদের ইট ভাঙা কাজের রোজগার এখন জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন করছে। ছেলেমেয়েরা এখন স্কুলে যায়। গ্রামের বাসিন্দা বিধবা হাজেরা বেগম (৪৫) বলেন, আমার পরিবারের লোকজন বাইরে থাকে। অবসরে আমি এখানে এসে ৮/১০ টিন ইট ভাঙি। এতে আমার ৫০ টাকার মতো আয় হয়। তাজ্জতুনন্নেছা বলেন, ২০ বছর ইট ভাইঙা সংসারের খাওন যোগাইছি। এখনো সময় পেলে ভাঙি। ইট ভাঙনের কাজ আমাদের অভাব দূর করছে। যেই এলাকার মানুষ তিন বেলা খাইতে পারত না, হেরা অহন অনেক সুখে দিন কাডায়।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ