Inqilab Logo

শক্রবার ০৯ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ কার্তিক ১৪৩১, ০৬ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

কমেছে গ্যাস সরবরাহ বেড়েছে দাম

| প্রকাশের সময় : ১২ মার্চ, ২০১৭, ১২:০০ এএম

তামাশা মনে করেন গ্রাহকরা : অদক্ষ ব্যবস্থাপনা দুর্নীতি সিস্টেম লস কমিয়ে দাম সহনীয় পর্যায়ে রাখা যেত : গভীর রাতে রান্না করছেন অনেকে : হোটেল থেকে কিনেও খাচ্ছেন কেউ কেউ
সাখাওয়াত হোসেন বাদশা : ঘরে চুলা জ্বলে না। তাতে কী, সরকার ঠিকই গ্যাসের দাম বাড়িয়েছে। গ্যাস সঙ্কটের সমাধান না করেই নতুন করে গ্যাসের দাম বাড়ানোটা গ্রাহকদের যেমন আরও একদফা হয়রানির মধ্যে ফেলে দিয়েছে, তেমনি মধ্যবিত্ত ও নি¤œ মধ্যবিত্ত আয়ের মানুষগুলোকে সংসারের সমুদয় হিসাব কাটছাঁট করে খরচের খাতকে নতুন করে সমন্বয় করতে বাধ্য করেছে। অযাচিত গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধির এই বিরূপ প্রভাবে সাধারণ গ্রাহকরা ক্রমেই ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ছেন। গ্যাসের এই মূল্যবৃদ্ধি শুধু আবাসিক খাতেই নয়; সিএনজি, বিদ্যুৎ উৎপাদন, সার কারখানা, শিল্প, বাণিজ্যিক, চা-বাগান- সব ক্ষেত্রেই দাম বেড়েছে।
খোঁজ নিয়ে দেখা গেছেÑ গ্যাসের সঙ্কট এখন আর কোনো এলাকাভিত্তিক নয়, গোটা রাজধানী জুড়েই। গ্যাসের এই ঘাটতির কোনো সুরাহা না করে দাম বাড়ানোটাকে অনেকেই গ্রাহকদের সঙ্গে তামাশা বলেই মনে করেন। তাদের মতেÑ সরকার ইচ্ছে করলেই প্রাকৃতিক গ্যাস সঞ্চালনায় অদক্ষ ব্যবস্থাপনা, দুর্নীতি, ‘সিস্টেম লস’ রোধ করে গ্যাসের মূল্য সহনীয় পর্যায়ে রাখতে পারত। কিন্তু তা না করে গ্যাসের দাম বাড়ানোর অর্থই হচ্ছে সরকার বিভিন্ন খাতের ব্যয় মিটাতে জনগণের কাঁধে গ্যাসের দাম বৃদ্ধির খগড় চাপিয়ে দিল।
এদিকে, ভোর থেকে রাত ৯-১০টা পর্যন্ত পাইপলাইনে গ্যাস থাকছে না। এ কারণে দিনে বাসা-বাড়িতে চুলা জ্বলছে না। গভীর রাত জেগে গৃহিণীদের রান্না করতে হচ্ছে। এতে অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। যারা রাত জেগে রান্না করতে পারছেন না, তাদের বাধ্য হয়ে হোটেল থেকে খাবার কিনে খেতে হচ্ছে। আবার হোটেলেও বাসি খাবার পরিবেশন করা হচ্ছে। এতে অনেকেই পেটের পীড়াসহ নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। স্কুলগামী ছেলেমেয়েদের বাসি খাবার খেয়ে স্কুলে যেতে হচ্ছে। গ্যাস সমস্যায় কেউ কেউ কেরোসিনের চুলা কিনছেন। শুধু বাসাবাড়িতেই সমস্যা হচ্ছে না, সিএনজি স্টেশনগুলোতেও গ্যাসের চাপ কমে গেছে। এতে একবার গ্যাস নিতে দীর্ঘ অপেক্ষা করতে হচ্ছে সিএনজি চালিত গাড়িগুলোর। এ কারণে পাম্পগুলোতে গাড়ির দীর্ঘ লাইন পড়ে যাচ্ছে।
গ্যাস বিতরণের সাথে জড়িত রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান তিতাস থেকে বলা হয়, চাহিদা অনুযায়ী তাদের গ্যাস সরবরাহ করছে না পেট্রোবাংলা। আবার পেট্রোবাংলা থেকে বলা হয়, তিতাসের পাইপলাইনগুলো অনেক পুরনো এবং ব্যাসে কম থাকায় বর্ধিত চাহিদা অনুযায়ী গ্যাস সরবরাহ করা যায় না। তবে, এবার তিতাস থেকে বলা হচ্ছে রাষ্ট্রীয় আরেক প্রতিষ্ঠান গ্যাস ট্রান্সমিশন কোম্পানি লিমিটেডের (জিটিসিএল) নিয়ন্ত্রণাধীন পাইপলাইনে ময়লা আসায় চাহিদা অনুযায়ী গ্যাস সরবরাহ করা যাচ্ছে না। পাইপলাইন সংস্কারের দায়িত্ব জিটিসিএলের। তারা সংস্কার কাজ চালাচ্ছে। শিগগিরই সমস্যা কেটে যাবে।
ভুক্তভোগীরা জানিয়েছেন, সাধারণ গ্রাহক পাইপলাইনে ময়লা, পাইপলাইন সরু বা পুরনো এত কিছু বোঝে না। তারা গ্যাস পাচ্ছে নাÑ এটাই বাস্তবতা। গ্যাসের এই দুর্ভোগ না মিটিয়েই সরকার আরও একদফা গ্যাসের মূল্য বাড়িয়েছে। আর এমন একটি সময়ে গ্যাসের এই দাম বাড়ানো হয়েছে যখন আবাসিক ব্যবহারকারীরা চাহিদামতো গ্যাস পাচ্ছেন না। পক্ষান্তরে গ্যাস ঘাটতিরও কোনো সুরাহা হয়নি।
এ নিয়ে হাজারীবাগের বাসিন্দা নি¤œ আয়ের রহিমা খাতুন ক্ষোভের সাথেই জানতে চেয়েছেন, ‘আমাগো ওপর জুলুম চাপাইয়া সরকারের কী লাভ?’ তার বক্তব্য হচ্ছেÑ দাম না বাড়িয়ে আমরা যতটুকু গ্যাস ব্যবহার করছি-ওই পরিমাণ গ্যাসের বিল নেয়া হোক। তিনি বলেন, বর্তমানে আমরা যে পরিমাণ গ্যাস ব্যবহার করছি তার চেয়েও বেশি বিল আমাদের কাছ থেকে আদায় করা হচ্ছে। তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে এই পরিস্থিতির নিরসন চেয়ে বলেন, গ্যাসের দাম বাড়ায় বাজারে যে বিরূপ প্রভাব পড়েছে, এতে করে তার অভাবের সংসারে আরও দুর্দশা নেমে এসেছে। এর দায় কে নেবেন?
জানা গেছে, গ্যাসের ভোগান্তি সবচেয়ে বেশি পোহাচ্ছেন মিরপুর, পল্লবী, কাফরুল, কাজীপাড়া, ইন্দিরা রোড, গ্রীন রোড, কলাবাগান, শুক্রাবাদ, কাঁঠালবাগান, মোহাম্মদপুর, রাজাবাজার, মগবাজার, মালিবাগ, তেজকুনিপাড়া, পশ্চিম রামপুরা, বাসাবো, আরামবাগ, আর কে মিশন রোড, টিকাটুলি, মিরহাজারিবাগ, যাত্রাবাড়ী, পোস্তগোলা, উত্তরা, জাফরাবাদ, লালবাগ, কেরানীগঞ্জ, যাত্রাবাড়ী, বাসাবো ও গোপীবাগের অধিবাসীরা। তিতাস গ্যাসের জরুরি নম্বরে ফোন করে প্রতিদিনই এসব এলাকার গ্রাহকরা এ সংক্রান্ত অভিযোগ করছেন।
এই পরিস্থিতি নিরসনে গ্রাহকরা তিতাস গ্যাস অফিসে ধর্না দিলে সেখান থেকে জানিয়ে দেয়া হচ্ছেÑ তাদের কিছুই করার নেই। কারণ সরকার বাসাবাড়িতে পাইপ লাইনের গ্যাস ব্যবহারকে এখন নিরুৎসাহিত করছে। এক্ষেত্রে তারা ভোগান্তি এড়াতে রান্নার কাজে সিলিন্ডারে তরলিকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলপিজি) ব্যবহারের জন্য গ্রাহকদের পরামর্শ দেন।
অপরদিকে, এলপিজি ব্যবহারের ক্ষেত্রে কোনো নীতিমালা না থাকায় এ সংক্রান্ত কোম্পানিগুলো খেয়াল খুশিমত সিলিন্ডারের দাম হাঁকাচ্ছেন।
এ ব্যাপারে বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু ইনকিলাবকে বলছেন, চাহিদার তুলনায় গ্যাসের উৎপাদন কমে যাওয়ায় এই পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে। তিনি গৃহস্থালীতে তরলিকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস এলপিজি ব্যবহারের উপরও গুরুত্বারোপ করেন।  
জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের তথ্যানুযায়ী, দেশে ১ হাজার মিলিয়ন ঘনফুটের উপরে গ্যাসের ঘাটতি রয়েছে। বর্তমানে দেশে প্রতিদিন ৩৩শ’ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের চাহিদা রয়েছে। এর বিপরীতে উৎপাদিত হচ্ছে দুই হাজার মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস। উৎপাদিত এই গ্যাসের মাত্র ১২ শতাংশ ব্যবহার হয় গৃহস্থালিতে রান্নার কাজে।
এ ব্যাপারে প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু বলেন, গ্যাস সঙ্কট নিরসনে সরকার নানা পদক্ষেপের মাধ্যমে বাসা-বাড়িতে গ্যাস ব্যবহার নিরুৎসাহিত করছে। তিনি বলেন, ২০০৯ সাল থেকে গৃহস্থালিতে নতুন করে আর গ্যাস সংযোগ দেয়া হচ্ছে না বললেই চলে। বাসা বাড়িতে নতুন গ্যাস সংযোগ না দেয়ার পাশাপাশি সিলিন্ডারে তরলিকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস আমদানির বিষয়টিও উৎসাহিত করছে সরকার।
এদিকে, গ্যাস সঙ্কট সমাধানে সরকারের ভাবনার সাথে গ্রাহকদের ভাবনা একেবারেই বিপরীত। গ্যাস সঙ্কটে ভুক্তভোগী লালবাগের বাসিন্দা মুতাহার হোসেন একেবারেই ক্ষুব্ধ। তিনি ডাবল বার্নারের একটি চুলা ব্যবহার করেন। ক্ষোভের সাথে জানান, বিলতো পুরোটাই পরিশোধ করি; অথচ গ্যাস থাকে না দিনের অর্ধেক সময় জুড়ে। বিলের ক্ষেত্রে কেন এমন হয় না যে, যতটুকু গ্যাস; সেই পরিমাণ বিল।
আর মিরপুর পল্লবীর এক গৃহিণীর ক্ষোভ হচ্ছে, আগে শীত মৌসুমে গ্যাস থাকত না। এখন সময়-অসময় বলে কিছু নেই। গ্যাস না থাকাটাই রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। এর পেছনে তিতাসের অন্য কোনো কারণ রয়েছে কীনা তাইবা কে জানে?
উল্লেখ্য, বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) গ্যাসের যে দাম বাড়িয়েছে তা ১ মার্চ থেকে কার্যকর হয়েছে। দুই ধাপে এই বর্ধিত মূল্য কার্যকর করার কথা বলা হলেও আদালতের নির্দেশনার কারণে দ্বিতীয় ধাপের বর্ধিত মূল্য ৬ মাসের জন্য স্থগিত করা হয়েছে। ১ লা জুন থেকে দ্বিতীয় দফার বিল কার্যকর হওয়ার কথা ছিল। গড়ে গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছে ২২ দশমিক ৭৩ শতাংশ। এতে করে আবাসিকে এক চুলায় গড়ে ৫০ ভাগ এবং দুই চুলায় গড়ে ৪৬ ভাগ দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। সবচেয়ে বেশি বাড়ানো হয়েছে আবাসিকের মিটার ব্যবহারকারীদের। মিটার ব্যবহারকারী গ্রাহকদের দাম বেড়েছে গড়ে ৬০ ভাগ।
গৃহস্থালি খাতে প্রথম দফায় ১ মার্চ থেকে এক চুলার মাসিক বিল ৭৫০ টাকা ও দুই চুলার ৮০০ টাকা কার্যকর করা হয়েছে। দ্বিতীয় দফার বর্ধিত বিল কার্যকর হলে দিতে হবে এক চুলার ক্ষেত্রে ৯০০ টাকা ও দুই চুলার ক্ষেত্রে ৯৫০ টাকা। এ ছাড়া সিএনজির দাম ১ মার্চ থেকে প্রতি ঘনমিটার হয়েছে ৩৮ টাকা ও ১ জুন থেকে হবে ৪০ টাকা। বিদ্যুৎ উৎপাদন, সার কারখানা, শিল্প, বাণিজ্যিক, চা-বাগান প্রভৃতি সব ক্ষেত্রেই গ্যাসের দাম বেড়েছে।
গ্যাসের দাম বাড়ানোর মাধ্যমে সরকার এই খাত থেকে বছরে ৪ হাজার ১৮৫ কোটি টাকা আয় করবে। তবে কনজ্যুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) জানায়, এমনিতেই বিতরণ কোম্পানিগুলো লাভে আছে। নতুন করে গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধির খড়গ জনগণের কাঁধে চাপানোর কারণে সরকারের লাভ আরও বাড়ল।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: গ্যাস

২৫ অক্টোবর, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ