Inqilab Logo

রোববার, ২৩ জুন ২০২৪, ০৯ আষাঢ় ১৪৩১, ১৬ যিলহজ ১৪৪৫ হিজরী

দামুড়হুদায় উর্বরতা হারাচ্ছে আবাদি জমি স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে বিশাল জনগোষ্ঠী

বাড়ছে ক্ষতিকর ফসল তামাকের আবাদ

| প্রকাশের সময় : ১২ মার্চ, ২০১৭, ১২:০০ এএম

নুরুল আলম বাকু, দামুড়হুদা (চুয়াডাঙ্গা) থেকে : বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ন্যায় বাংলাদেশেও যখন সরাকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থা একের পর এক স্থানকে ধূমপানমুক্ত (তামাকমুক্ত) ঘোষণা করতে ব্যস্ত ঠিক সেই মুহূর্তে চুয়াডাঙ্গা জেলার দামুড়হুদা উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় অবাধে জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর ফসল তামাকের আবাদ বেড়েই চলেছে। যা এ এলাকার জনস্বাস্থ্য ও কৃষির উপর হুমকিস্বরূপ। বিপুল পরিমাণ জমিতে তামাক আবাদের ফলে এলাকায় খাদ্য ঘাটতির আশঙ্কা করছেন অনেকে। একই জমিতে বারবার তামাক চাষের ফলে উর্বরাশক্তি হারিয়ে বিপুল পরিমাণ কৃষিজমি অনাবাদি হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। তামাক আবাদ বৃদ্ধির ফলে বাড়ছে নিরাপত্তাজনিত ঝুঁকি, সেইসাথে বিপন্ন হচ্ছে পরিবেশ। সূত্রে জানা গেছে, চলতি মৌসুমে দামুড়হুদা উপজেলায় বৃটিশ আমেরিকা টোবাকো, আবুল খায়ের, ঢাকা টোবাকো কোম্পানিসহ বেশ কয়েকটি কোম্পানির আওতায় বিপুল পরিমাণ জমিতে তামাকের আবাদ হয়েছে। প্রতিবারের ন্যায় এবারও তামাক কোম্পানিগুলো কৃষকদেরকে তামাক চাষে আকৃষ্ট করতে বিনামূল্যে বীজ এবং ঋণ হিসাবে স্বল্পমূল্যে সার, কীটনাশক এবং নগদ টাকা দিয়েছে। ইতোমধ্যে কোম্পানিগুলো তাদের আওতাধীন তামাকচাষিদের উৎপাদিত তামাক কেনার জন্য কার্ড সরবরাহ করেছে। ঐ কার্ড দেখিয়েই কৃষকরা স্ব স্ব কোম্পানির কাছে তামাক বিক্রি করবে। উপজেলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, উপজেলার জুড়ানপুর ও নতিপোতা ইউনিয়নেই সবচেয়ে বেশি পরিমাণ জমিতে তামাক চাষ হয়েছে। প্রতি বছরই গোপালপুর, দলিয়ারপুর, বিষ্ণুপুর, ছুটিপুর, পোতারপাড়া, ভগিরতপুর, হোগলডাঙ্গা, কালিয়াবকরি, মজলিশপুর, রামনগর, কলাবাড়ী, নাপিতখালি, বদনপুর কার্পাসডাঙ্গা ইত্যাদি গ্রামগুলোতে ব্যাপকভাবে তামাক চাষ হয়ে থাকে। তামাকচাষিদের অনেকে বলেন, আমরা জানি তামাক স্বস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। তারপরও গত কয়েক বছর ধরে ধান, পাট, সবজিসহ নানা প্রকার ফসলের আবাদ করে লোকসান হওয়ায় বাধ্য হয়েই লোকসান বাঁচাতে তামাক চাষ করি। এদিকে তামাক চাষের ফলে এলাকার কৃষিজমির উর্বরতা, জনস্বাস্থ্য, অর্থনীতি ও পরিবেশ দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতির মুখে পড়ছে। জমিতে মাত্রাতিরিক্ত পরিমাণ রাসায়নিক সার সালফার, ডিএফপি ও পটাশ, ব্যবহারের ফলে মাটি পুষ্টিশূন্য হয়ে পড়ে। একই জমিতে বার বার তামাক চাষের ফলে উর্বরাশক্তি হারিয়ে জমি অনাবাদি হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। অন্যান্য ফসলের আবাদও কমে যাচ্ছে আশঙ্কাজনক হারে। তামাক চাষের কারণে সংশ্লিষ্ট এলাকার ভবিষ্যৎ প্রজন্ম চরম স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ছে। এছাড়া তামাকপাতা শুকাতে প্রতিবছর নানা প্রজাতির হাজার হাজার মণ কাঠ পোড়ানোর ফলে উজাড় হচ্ছে বনভূমি। ফলে বিরূপ প্রভাব পড়ছে প্রাকৃতিক পরিবেশের ওপর। এ আবাদে হাতেগোনা কিছুসংখ্যক মানুষ লাভবান হলেও নানাভাবে এর ক্ষতির প্রভাব পড়ছে বিশাল জনগোষ্ঠির ওপর। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, তামাকের কারণে মুখ, গলা ও ফুসফুসের ক্যান্সার, হাঁপানি, আলসার, হৃদরোগ, যৌনক্ষমতা হ্রাস, প্যারালাইসিস, দীর্ঘস্থায়ী শ্বাসকষ্ট, যক্ষা, দাঁত ও মাড়ি বিবর্ণ, ক্ষয়প্রাপ্ত ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়, মৃত ভ্রƒণ ও অপরিণত শিশুর জন্ম নেয়ার ঝুঁকি বাড়ে। তামাকজাত দ্রব্য বিড়ি, সিগারেট, চুরুট, সাদাপাতা, জর্দা, গুল ও খৈনি সেবনের কারণে প্রতিদিন ক্যন্সার, হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, হাঁপানি, হার্ট অ্যাটাক, উচ্চ রক্তচাপসহ বিভিন্ন সংক্রামক রোগ বাড়ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য মতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে তামাক সেবনের ফলে প্রতি বছর দেশে ৫৭ হাজার মানুষ মারা যায়। পঙ্গুত্ব বরণ করছে ৩ লাখ ৮২ হাজার মানুষ। তামাকের কারণে অসুস্থ রোগীদের চিকিৎসার পেছনে শুধু সরকারের ব্যয় হচ্ছে ১১ হাজার কোটি টাকা। সে ক্ষেত্রে এ খাত থেকে সরকার রাজস্ব পাচ্ছে ৭ হাজার কোটি টাকা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গবেষণায় বলা হয়, বিড়ি সিগারেটের ধোঁয়াসহ তামাকজাত দ্রব্য ডিডিটি, কার্বন মনোক্সাইড, আর্সেনিক মিথানল, টার বা আলকাতরা, নিকোটিনসহ ৪ হাজারেরও বেশি ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ রয়েছে যার মধ্যে ৪৩টি সরাসরি ক্যান্সার সৃষ্টির সাথে জড়িত। ধূমপানের কারণে পৃথিবীতে প্রতি ৬ সেকেন্ডে ১ জন ও প্রতি বছর ৫৪ লাখ মানুষ মারা যায়। ক্যান্সার বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশে প্রতি বছর ৪০ হাজার লোক ফুসফুস ক্যন্সারে আক্রান্ত হয়। তার মধ্যে ৯০ শতাংশই তামাক ব্যবহারের কারণে হয়ে থাকে। ফুসফুসের ক্যান্সার খুব দ্রæত ছড়ায় বলে এর চিকিৎসাও বেশ কঠিন। সে কারণে এর মধ্যে ৭০ শতাংশ রোগীই বিনা চিকিৎসায় মারা যায়। বাংলাদেশে ক্যন্সার আক্রান্তদের মধ্যে ২২% রোগি ফুসফুস ক্যান্সারে আক্রান্ত যা এককভাবে সর্বোচ্চ। বাংলাদেশে প্রতিবছর ২ লক্ষাধিক মানুষ ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়। তার মধ্যে ২২% মানুষই ফুসফুস ও স্বরতন্ত্রের ক্যান্সারে অক্রান্ত হচ্ছে। শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ বিশিষ্ট চিকিৎসক ডা. মেজাবউল হক জানান, বিভিন্নভাবে তামাক ব্যবহারের ফলে ব্রঙ্কাইটিস, এ্যজমা, ক্যান্সারসহ নানা ধরনের জটিল রোগ হয়। ধূমপান ও বিভিন্নভাবে তামাক ব্যবহারে স্বাস্থের ক্ষতি সম্পর্কে অনেকে সচেতন থাকলেও তামাক চাষের ফলে কৃষক ও তার পরিবারের সদস্যদের কি পরিমাণ ক্ষতি হয় সে বিষয়ে অনেকেরই ধারণা নেই। তিনি বলেন, দীর্ঘদিন কাঁচা তামাক নাড়াচাড়া করলেও গ্রিন টোবাকো সিক্নেসি নামক এক ধরনের রোগ হয়। এ রোগের ফলে মাথাঘোরা, বমি, দুর্বলতা, মাথাব্যথা, পেটব্যথা, অনিয়মিত হৃদস্পন্দন এবং শ্বাসকষ্ট হয়। উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সুফি মোহম্মদ রফিকুজ্জামান জানান, চলতি মৌসুমে উপজেলায় ৩১৮ হেক্টর জমিতে তামাকের আবাদ হয়েছে। গতবার আবাদ হয়েছিল ২১ হেক্টর। চলতি মৌসুমে আবাদ বৃদ্ধির কারণ হিসাবে বলেন, তামাক কোম্পানিগুলো নানারকম সুযোগ-সুবিধা ও উপঢৌকন দিয়ে চাষিদেরকে তামাক চাষের জন্য আগ্রহী করে থাকে। কোম্পানিগুলো চাষিদেরকে তামাক আবাদের জন্য বীজ, রাসায়নিক সার, কীটনাশক ও নগদ টাকা দিয়ে থাকে। ফলে এ আবাদে তাদের নিজস্ব কোন পুঁজি খাটাতে হয় না। ফলে অন্যান্য ফসলের পরিবর্তে তামাক আবাদে ঝুঁকে পড়ে। এছাড়া আরোও বলেন, গত বছর বøাষ্ট রোগের আক্রমণে গমক্ষেত নষ্ট হয়ে যাওয়ায় চলতি মৌসুমের শুরুতেই চাষিদেরকে গমচাষে নিরুৎসাহিত করে ডালজাতীয় ফসলসহ বিভিন্ন ধরনের সবজি আাবাদের পরামর্শ দিয়েছি। গমের আবাদের পরিবর্তে অনেকে তামাকের আবাদ করেছে। মূলত আমরা তামাক চাষের ব্যাপারে চাষীদেরকে নিরুৎসাহিত করে থাকি।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ