হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির খড়গ : আসামের এনআরসি এবং বাংলাদেশ
কিশোর শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক দাবীর আন্দোলনে ঢাকাসহ সারাদেশে তীব্র রাজনৈতিক উত্তেজনা ও অনিশ্চয়তা দেখা যাচ্ছিল,
আফতাব চৌধুরী : মানব সভ্যতার শ্রেষ্ঠ সম্পদ বই। এই বই পড়ে মানুষ তার জ্ঞান এবং বুদ্ধিমত্তা দিয়েই এই পৃথিবীকে এতখানি উন্নত করেছে। এ উন্নয়নের ক্ষেত্রে বইয়ের ভ‚মিকা অপরিসীম। স্বাভাবিকভাবেই বইকে কেন্দ্র করে যদি কোনও উৎসব হয় বা বছরের বিশেষ কোনও দিনকে ‘বিশ্ব বই দিবস’ বা ‘গ্রন্থাগার দিবস’ হিসেবে পালন করা হয় সেখানে গ্রন্থপ্রেমী বিদ্বান মানুষরা তাদের চিন্তাকে প্রকাশ করবেন, ভবিষ্যতের জন্য গ্রন্থকে করে তুলবেন মানুষের জীবনের আলোকবাহী শক্তি হিসেবে। কীভাবে গ্রাম এবং শহরের অশিক্ষার ব্যবধানকে গ্রন্থপাঠে উৎসাহ প্রদানের মাধ্যমে দূর করা যায় সেই চেষ্টাই করা উচিত সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে।
গ্রন্থ মানুষের জীবনের চেতনাশক্তি। আর এই চেতনাকে জাগিয়ে রাখতে প্রয়োজন গ্রন্থাগার। ড. ওসমান গণী যেমন বলেছিলেন, আজ আমাদের হাসপাতালের থেকেও বড় বেশি প্রয়োজন গ্রন্থাগারের। আসলে বাঙালির জাতীয় চরিত্রকে মনুষ্যত্বে উন্নত করতে হলে প্রয়োজন চেতনার। আর এই চেতনার আগুন ধারণ করে আছে গ্রন্থ এবং গ্রন্থাগার। ওসমান গণী প্রায় সত্তর বছর আগে গ্রন্থাগারের যে অসীম প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছিলেন তা আজও সমান প্রাসঙ্গিক। বাঙালি তার এই পরামর্শ গ্রহণ করেছিল বলেই হয়ত বই বাঙালির প্রাণের সম্পদ হয়ে গেছে। ঢাকার নীলক্ষেত বিখ্যাত হয়ে আছে বইপাড়া নামে। সেখানে সারাবছর বইয়ের বাজার। আর ঢাকার বইমেলা তো এখন বাঙালির দ্বিতীয় জাতীয় উৎসবে পরিণত। তাছাড়া প্রতিটি জেলায় এবং শহরে বড় আকারে বইমেলা করে এই গ্রন্থপাঠে উৎসাহ প্রদান বই প্রেমীদের কাছে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। বাংলাদেশে গ্রন্থমেলা, গ্রন্থ প্রকাশনা ইত্যাদি বিষয় বাঙালির ঐতিহ্যকে আজও লালন করে চলেছে। বলতে গেলে সেখানে চেতনার অতিরিক্ত মাত্রাও যুক্ত হয়েছে। সে সবই শুভ লক্ষণ।
এই গ্রন্থের ভ‚গোলে আমাদের অবস্থান কোথায়, বাঙালির বসবাসের ইতিহাস যে সুপ্রাচীন সেকথা নীহাররঞ্জন রায় অনেকদিন আগে লিখে গেলেও আজও অনেক বিজ্ঞ (?) বাঙালি খবরই রাখেন না যে, ভাষার জন্য বাঙালিকে রক্ত ঝরাতে হয়েছিল, বাংলা ভাষা সাহিত্য ও সংস্কৃতির একটি কেন্দ্র এখানে গড়ে উঠেছে। তাছাড়া সরকারিভাবে আমাদের অনেকদিন আগে থেকেই অবাঙালি করে দেওয়ার চক্রান্ত চলেছে। একে তো চক্রান্তের শিকার আমরা, তার ওপর এখানকার প্রতিবাদহীন অচেতন বাঙালিরা এই বিষয়ে এত বেশি গা বাঁচিয়ে ¯্রােতে ভেসে চলেছে যে অদূর ভবিষ্যতে আমাদের আত্মপরিচয়টাই বিলুপ্ত হওয়ার পথে। সেই পথই কেবল আমরা প্রশস্ত করে চলেছি।
চিন্তাবিদরা বলে থাকেন যে, পাড়ায় পাড়ায় পাঠাগার, লাইব্রেরি স্থাপন করা হোক। তাতে আমাদের চারিত্রিক উন্নতি হবে, তৈরি হবে শিক্ষার উপযুক্ত পরিবেশ। কিন্তু একথা শুনবে কে আর কার্যকর করবে কারা? কথায় আছে, প্রয়োজন থেকেই মানুষ তার জীবনযাত্রার নতুন পন্থা আবিষ্কার করেছে। আমাদের জীবনে গ্রন্থাগারের প্রয়েজনীয়তাই আমরা অনুভব করতে পারলাম না তো পূরণ করা তো দূর অস্ত। পাড়ায় পাড়ায় নতুন করে গ্রন্থাগার স্থাপন করাতো দূরের কথা, শহরেই একটি ভাল লাইব্রেরিও আমরা বাঁচিয়ে রাখতে পারি না। বই আছে তো পাঠক নেই, পাঠক আছে তো বই নেই। এই হচ্ছে আমাদের বর্তমান অবস্থা।
দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের সুপ্রাচীন ঐতিহ্যপূর্ণ গ্রন্থাগারসমূহের সম্পদ প্রায় বিনষ্ট হয়ে গেছে। বিভিন্ন গ্রন্থাগারের অর্ধেক দুর্লভ গ্রন্থ আজ আর পাঠযোগ্য অবস্থাই নেই। জেলা গ্রন্থাগারসমূহের অবস্থা আরও করুণ। লাখ লাখ টাকা খরচ করে জেলা গ্রন্থাগারসমূহের সংস্কার হলেও গ্রন্থাগারের ভাগে তার উন্নতির জন্য সামান্য পয়সাও খরচ করা হয় না। কেন এই বৈষম্য? এ কি উদ্দেশ্য প্রণোদিত নয়? গ্রন্থাগারের প্রয়োজন কি তাহলে সরকার এবং দেশের তথাকথিত শিক্ষিত মানুষের কাছে ফুরিয়ে গেল? কোনও ভাবেই কি আমরা ফিরিয়ে আনতে পারি না পুরনো দিনেরই সেই পাঠাভ্যাস। গ্রন্থাগার ভবনের উন্নতির জন্য তাকে ভেঙে আধুনিক ব্যবস্থায় সাজানো হলেও সেখানে বিভিন্ন অফিস হিসেবে ব্যবস্থা করা হচ্ছে।
অথচ গ্রন্থগারের সঙ্গে একটি অঞ্চলের প্রকাশনা শিল্পও ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত হয়ে থাকে। পশ্চিমবঙ্গ এবং ত্রিপুরায় সরকারি সাহায্যে বহু গ্রন্থাগার স্থানীয় পুস্তকাদি ক্রয় থাকে। ফলে ত্রিপুরার মতো রাজ্যেও খুব অল্পদিনের মধ্যেই প্রকাশনা শিল্প বেশ সমীহ আদায় করার মতো স্থানে চলে গেছে। আগরতলা বইমেলায় দেখেছি প্রতিটি স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, রাজ্য সরকারের গ্রন্থাগার, এমনকি অফিসগুলো থেকেও বই কিনতে আসে। বই কেনার ক্ষেত্রে তাদের প্রথম পছন্দ হলো ত্রিপুরার প্রকাশনী, তারপর অন্যান্য স্থানের প্রকাশিত বই। কলকাতায়ও সরকার বই কেনার জন্য গ্রন্থগারগুলোকে অর্থ সাহায্যে কার্পণ্য করে না। তাছাড়া বেসরকারি উদ্যোগে গড়ে ওঠা পাঠাগারগুলো তো রয়েছে। অথচ আমাদের দেশে গ্রন্থাগার সম্পর্কে কোনও ধারণাই বাস্তবে গড়ে উঠেনি। আগে সামান্য কিছু ক্লাব বা ব্যক্তিগত উদ্যোগে গ্রন্থগার গড়ে উঠলেও আজ সেগুলোও অস্তিত্বহীন।
দেশে যত স্কুল-কলেজের গ্রন্থাগার রয়েছে সেগুলোও যদি বই কেনা এবং গ্রন্থাগার চর্চায় উৎসাহ দেখাতো তাহলে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে গ্রন্থাগারের প্রয়োজন জেগে উঠত। কিন্তু সরকারি স্কুলের যা চিত্র তাতে আমার ধারণা, গত কুড়ি বছরের মধ্যে কোনও সরকারি বিদ্যালয় নতুন কোনও বই কেনেনি। ছাত্রজীবনে আমরাও স্কুলের গ্রন্থাগার ব্যবহার করতেই পারিনি। বেশিরভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গ্রন্থাগার নেই, কোন কোন স্কুল বা কলেজে থাকলেও গ্রন্থাগারিক নেই। আবার গ্রন্থাগার থাকলেও মাকড়সার জাল আর ধুলাবালুর জন্য গ্রন্থাগারে প্রবেশ করা কঠিন হয়ে পড়ে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এসব গ্রন্থাগারে ২/৩ বা বছরের পর খোলা হয়। দেখা যায়, অনেক বই পোকা-মাকড়ে খেয়ে নষ্ট করে ফেলছে। কিছুদিন আগেও সিলেটে কোনো একটা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গিয়েছিলাম। তালাবদ্ধ গ্রন্থাগার দেখে প্রধান শিক্ষকের সঙ্গে আলাপ করলাম। বইয়ের সংখ্যা দেখলাম খুবই কম। দেখে কারণ জিজ্ঞাসা করলেই তিনি বলেন, আমরা যে বই কিনব তা রাখব কোথায়, আর পাঠকই বা কই? গ্রন্থাগারিক নেই, রক্ষণাবেক্ষণ করবে কে? তার ওপর সরকারি সাহায্যও নাকি পাওয়া যায় না। একজন প্রধান শিক্ষকের মুখে এ কথা শুনে আমি বিস্মিত হই! কারণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রধান থেকে ক্রমাগত চাপ সৃষ্টি করলে সরকার বাধ্য হবে গ্রন্থাগারের জন্য অর্থ সাহায্য প্রদান করতে। এ ব্যাপারে সরকার বা মাননীয় শিক্ষামন্ত্রীর কার্পণ্য আমরা লক্ষ্য করি না। তারা তো এসব ব্যাপারে উদার। তাছাড়া এখানে আরেকটি কথা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গ্রন্থাগারের জন্য বই কেনা হয় না, অথচ প্রতিবছর ছাত্রছাত্রীদের কাজ থেকে লাইব্রেরির জন্য ফিজ দেওয়া নেয়া হয়। তাহলে আদায়কৃত এ টাকা কোন খাতে ব্যয় করা হয়। সরকারের ওপর নির্ভর না করেও তো অনেক টাকার বই বছরে কেনা যায়। তাহলে লাইব্রেরির জন্য বই কেনা হচ্ছে না, এই অব্যবহৃত টাকার হিসাব কি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রধানগণ দিতে পারবেন? কর্তৃপক্ষের চরম গাফিলতি তা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মনোভাবের ফলেই স্কুল, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর লাইব্রেরি ব্যবস্থা আজ ভেঙে পড়েছে। ছোটবেলাতে যদি ছাত্রদের মধ্যে লাইব্রেরি ব্যবহার করা, বই পড়ার মনোভাব গড়ে না ওঠে তাহলে বড় হলে তাদের কাছ থেকে বই কেনার কথা আমরা আশা করতে পারব কি?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গ্রন্থাগার সম্পর্কে আলাদাভাবে কিছু বলার আছে। এই বিশ্ববিদ্যালয়কে যারা স্বপ্নের বিশ্ববিদ্যালয় বলেন তারা কি কোনোদিন লাইব্রেরির ভেতর ঢুকে দেখেছেন এর অবস্থা? বলতে চাইছি লাইব্রেরি ঠিকই আছে, সেখানে অসংখ্য বইও রয়েছে, কিন্তু কাজের বই আছে কটা? ছাত্রদের অভিযোগ, অপ্রয়োজনীয় বইয়ের সংখ্যা এত বেশি যে, ছাত্রদের কাজে লাইব্রেরি প্রায় কোনও সাহায্যই করতে পারছে না। এই অভিযোগ কিছু অধ্যাপকদেরও। বারবার চেষ্টা করেও তারা সিলেবাসের জন্য প্রয়োজনীয় বইগুলো লাইব্রেরি কর্তৃপক্ষকে দিয়ে কেনাতে পারেননি।
সচেতন মহলের অনুমান বিভিন্ন দেশ এবং আমাদের দেশের বড় বড় পুস্তক প্রকাশক এবং বিক্রেতাদের সঙ্গে গ্রন্থাগারিকের গোপন আঁতাত রয়েছে। তারা কমিশন নিয়ে অপ্রয়োজনীয় বইগুলো তাদের কাছ থেকে কিনে নিচ্ছেন আর আমাদের ছাত্রছত্রীরা বঞ্চিত হচ্ছে লাইব্রেরির উপযুক্ত সুবিধা থেকে। দেশে ভাল ভাল লেখক বই লিখে বিক্রি করতে পারছেন না। আগে তো দেশের ভাল এবং অভিজ্ঞ লেখকদের বই নিয়ে লাইব্রেরিকে সমৃদ্ধ করা উচিত। এতে নূতন নূতন লেখকরাও উৎসাহিত হবে। খুব কম উপাচার্যকেও এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মহোদয়গণ এ বিষয়ে দৃষ্টিপাত করে যদি এর একটা সুরাহা করতে পারেন তবে বিশ্ববিদ্যালয় এবং ছাত্রছাত্রী সবার মঙ্গল হবে।
আমরা যদি আগামীদিনের জন্য সুস্থ পরিবেশ মেধা এবং মননের বিকাশে বই এবং গ্রন্থাগারের প্রয়োজনকে অনুভব করে উপযুক্ত ব্যবস্থা এবং প্রতিকারের জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করতে প্রস্তুত হই, তাহলে তা দেশের জন্য মঙ্গলজনক হবে। বর্তমান তথ্য-প্রযুক্তির দিনেও গ্রন্থাগারের প্রয়োজনীয়তা বিন্দুমাত্র কমেনি বরং অনেক বেশি বেড়ে গেছে। এই তথ্য প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে এক একটি শহরে গ্রন্থাগারকে কেন্দ্র করে ইনফরমেশন সেন্টার গড়ে উঠতে পারে। পড়াশোনায় নতুন দিগন্ত খুলতে পারে। শিক্ষা এবং সামাজিক ক্ষেত্রে সুস্থ পরিবেশ গড়ে উঠতে পারে গ্রন্থাগার স্থাপন এবং গ্রন্থাগার চর্চার মাধ্যমে। প্রয়োজন মানসিক পরিবর্তনের। স্কুল-কলেজের গ্রন্থাগারকে পুনরুজ্জীবিত করে তোলা, পুরনো ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানো, বাংলা ও ইংরেজি ভাষাকে অগ্রাধিকার দিয়ে বই ক্রয় করা এবং নতুন নতুন গ্রন্থাগার স্থাপন করার দাবিই আমাদের সকলের।
লেখক : সাংবাদিক-কলামিস্ট।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।