পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
আহমদ আতিক : বাংলাদেশ হচ্ছে দক্ষিণ এশিয়ার চতুর্থ সামরিক শক্তিধর দেশ। এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় ৩৩ দেশের মধ্যে সামরিক শক্তিতে বাংলাদেশের অবস্থান ১৮ এবং বিশ্বের ১২৬ দেশের মধ্যে ৫৩। সামরিক শক্তির ভিত্তিতে ‘গ্লোবাল ফায়ার পাওয়ার (জিএফপি)’ নামের একটি ওয়েবসাইট মার্কিন গোয়েন্দা দফতর সিআইএ’র প্রতিবেদনের ভিত্তিতে এ তথ্য প্রকাশ করে। বিশ্বের মধ্যে ৫৩তম এবং দক্ষিণ এশিয়ার চতুর্থ সামরিক শক্তিধর হলেও ভৌগলিক অবস্থানগত কারণে বিশ্ব রাজনীতি, অর্থনীতি, সমরনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে বাংলাদেশ। পরাশক্তি আমেরিকা, রাশিয়া, পূর্বের চীন এবং প্রতিবেশী ভারত সবাই চায় বাংলাদেশকে কাছে পেতে। ‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব’ কূটনৈতিকভাবে এই কৌশল গ্রহণ করে বাংলাদেশও সবার সঙ্গে সুসম্পর্ক রেখে চলছে। চীন থেকে সাবমেরিন ক্রয়ের পর প্রধানমন্ত্রীর আসন্ন ভারত সফরে ‘সামরিক সহযোগিতার চুক্তির’ আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব দেয়া হবে এমন খবর মিডিয়ায় এসেছে। দীর্ঘদিনের বন্ধু ভারতের এমন প্রস্তাবকে এখনো ইতিবাচক চোখে দেখছে না বাংলাদেশ। যার জন্য প্রধানমন্ত্রীর দিল্লি সফর দু’দফায় পিছিয়ে যায়। এ ধরনের চুক্তির বিষয়ে দেশের অভ্যন্তরে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও ব্যক্তিত্ব অবস্থান নিয়েছেন। শুধু তাই নয় তিস্তা চুক্তির বিপরীতে ‘দুই দেশের সামরিক সহায়তা চুক্তি’র মতো প্রস্তাব বন্ধু রাষ্ট্রের কুৎসিত মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ মনে করেছেন। তবে ঝানু রাজনীতিকের মতোই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্ব রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের হাল ধরেছেন দক্ষ মাঝির মতোই। তিনি চীন ও ভারত দু’দেশের সঙ্গে ভারসাম্যমূলক সম্পর্ক রাখতে চাচ্ছেন। ঋণ নিয়ে ভারত থেকে অস্ত্র কেনার ব্যাপারে আগ্রহী নন তিনি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক সামরিক বিশেষজ্ঞ বলেছেন, ভারত যে চুক্তির প্রস্তাব দিতে চায় সে চুক্তি হবে দেশের সার্বভৌমত্বের জন্য সুদূরপ্রসারী ক্ষতিকারক। বাস্তবে এতে বাংলাদেশের কোনো লাভ বা স্বার্থ রক্ষার বাস্তব কারণ নেই। মেজর জেনারেল (অব.) রুহুল আলম চৌধুরী বলেন, এ ধরনের চুক্তি করলে ভারতের কাছে আমাদের দায়বদ্ধতা থেকে যাবে। বাংলাদেশের তিনদিকে ভারত। এক সময় তারা হয়তো প্রস্তাব দেবে বাংলাদেশে সেনাবাহিনীর প্রয়োজন নেই। শ্রীলংকা এ ধরনের চুক্তি করেছিল। তার পরিণত হয়েছে ভয়াবহ। মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহম্মদ ইব্রাহিম বলেন, ২৫ বছরের চুক্তির অভিজ্ঞতা থেকে বলছি রাজনৈতিক দূরদর্শী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এমন চুক্তি করে আমাদের সেনাবাহিনীর সর্বনাশ করবেন না। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস এ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজ (বিআইপিএসএস)-এর সভাপতি প্রতিরক্ষা এবং নিরাপত্তাবিষয়ক আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) মুনীরুজ্জামান মনে করেন, বঙ্গোপসাগর ভারত মহাসাগরের সমুদ্রসীমায় হওয়ায় বাংলাদেশ নিরাপত্তার কৌশলগত দিক দিয়ে খুবই গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে। বঙ্গোপসাগরের কারণে ভারত মহাসাগরে আমাদের গুরুত্বপূর্ণ অধিকার রয়েছে। এ অবস্থানে ভবিষ্যতে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক বিশেষ করে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান নির্ভর করবে আমরা এর সুযোগ কতটা নিতে পারব তার উপরে।
বিশ্ব রাজনীতিতে পরিবর্তনশীল কৌশলে দেশে দেশে বন্ধুত্ব ও শত্রæতা এখন স্থায়ী নয়। ভারতের বন্ধু এখন আমেরিকা, পাকিস্তানের বন্ধু চীন; বাংলাদেশের বন্ধু এখন ভারত। কয়েক বছর ধরে পূর্বাঞ্চলের দেশগুলোর মাঝে বন্ধু নিয়ে অস্থিরতা বিরাজ করছে। অর্থনীতি ও সমরনীতির মেরুকরণে একের পর এক পাল্টে যাচ্ছে এই বন্ধুত্বের রাজনীতি। এখন বন্ধু বাছাই-এর ক্ষেত্রে কাজ করছে দেশের রাজনীতি ও অর্থনীতি। ৪৫ বছরে সামরিক দিক দিয়ে বাংলাদেশ এখন বেশ শক্তিশালী। জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী মিশনে বাংলাদেশের সামরিক বাহিনী ব্যাপক প্রশংসা পাচ্ছে। সাগর, ভূপ্রকৃতি অবস্থান, নৌ ও সড়ক যোগাযোগে ইত্যাদি কারণে বাংলাদেশের দিকে এখন সবার দৃষ্টি। বাংলাদেশকে পাশে রাখতে চাইছে সবাই। নিজেদের গুরুত্ব বুঝেই কৌশলী পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে এগুচ্ছে বাংলাদেশ। বিপরীতমুখী দেশগুলোর সঙ্গে বন্ধুত্ব। একটু ভুল হলেই ঘটতে পারে বিপত্তি। আন্তর্জাতিক মহলে এখন সবাই তোয়াজ করছে উদীয়মান অর্থনীতির টাইগার বাংলাদেশকে। কৌশলগত ভূ-রাজনৈতিক অবস্থানের কারণে বিশ্বের বাঘা বাঘা সমরবিদরা নিজের করে পেতে চাইছে বাংলাদেশকে। ঐতিহাসিক সিল্ক রুটের পুনর্জীবন দিয়ে ভবিষ্যৎ বাণিজ্যের প্রসার ঘটানোর চীনা প্রকল্প ‘ওয়ান বেল্ট ও ওয়ান রোড’ কৌশলের স্থল ও নৌ অংশে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার কেন্দ্রীয় অবস্থানে রয়েছে। এছাড়া আর্থিক সক্ষমতা থাকায় অস্ত্র বিক্রেতা দেশগুলোরও নজর পড়েছে। সর্বশেষ রাশিয়া থেকে আটটি বহুমাত্রিক যুদ্ধবিমান কিনছে বাংলাদেশ। দিন দিন বাড়ছে বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা সমরাস্ত্রের ভান্ডার।
অন্যদিকে বাংলাদেশের সাথে সামরিক সহযোগিতা চুক্তিতে যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহ দীর্ঘদিনের। চীনের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক উন্নীত হয়েছে কৌশলগত পর্যায়ে। ফলে ভারতও এখন বাংলাদেশের সাথে চাইছে সামরিক কৌশলগত সম্পর্ক। রাশিয়া এখন হয়ে উঠছে বাংলাদেশের অন্যতম অস্ত্রের যোগানদাতা। ব্রিটেনসহ ইইউ দেশগুলোও বাংলাদেশের সাথে কৌশলগত সম্পর্ক বৃদ্ধিতে জোর দিচ্ছে।
শুধু চীন-ভারত নয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপও সামরিক সহযোগী হতে চাইছে। কিন্তু বাংলাদেশের কৌশলী নীতি-নির্ধারক, কূটনীতিক ও সমরবিদরাও সমানতালেই খেলে চলেছেন। সব মিলিয়ে মনে হচ্ছে যেন বাংলাদেশকে নিয়ে চলছে শক্তিধরদের বিগ গেম। একদিকে ভারত ও রাশিয়া, মাঝখানে চীন; অন্যপক্ষে আমেরিকা, বৃটেন ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন।
গত তিন বছর ধরে বিশ্বের প্রধান শক্তিসমূহ সামরিক উপকরণের উৎপাদন ও ক্রয়-বিক্রয় এবং বিভিন্ন দেশের সাথে সামরিক চুক্তি স্বাক্ষর ও রণকৌশলিক অবস্থান গ্রহণ করে চলেছে। এরই আলোকে, পৃথিবীর রাজনৈতিক-ভূগোলে বাংলাদেশের অবস্থান রণকৌশলিক গুরুত্বপূর্ণ সংশ্লিষ্ট শক্তিসমূহের কাছে তীব্রতর মাত্রায় অনুভূত হচ্ছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার ‘পিভোট’ বা ‘রিব্যালেন্সিং’ নীতি ঘোষণা করে এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে তার রণকৌশলিক অবস্থান পুনরুজ্জীবিত ও বিস্তৃত করায় তৎপর হয়েছে। ২০১২ সালেই এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে মার্কিন সামরিক উপস্থিতি বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। ঘোষণা অনুযায়ী ২০২০ সাল নাগাদ যুক্তরাষ্ট্রের মোট যুদ্ধজাহাজের ৬০ শতাংশই এ অঞ্চলে মোতায়েন করা হবে। একদিকে মার্কিন রণতরী বাড়ানোর ঘোষণা, অপরদিকে ভারতকে ঘিরে রেখে চীনের নৌ-উপস্থিতি বাড়ানোয় উদ্বিগ্ন ভারত। বাংলাদেশে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে চীনের আগ্রহ এবং বাংলাদেশের নৌবাহিনীর সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতামূলক সম্পর্ক বাড়ানোকেও ভারত ভালোভাবে নিতে পারছে না। রাশিয়ান ফেডারেশনও এশিয়াতে তার নৌশক্তি বৃদ্ধি করেছে। ভারত চাইছে তার ‘লুক ইস্ট’ রণকৌশলিক নীতির তৃতীয় সংস্করণ করে অদম্য ও সুদূরপ্রসারী হয়ে উঠতে।
বাংলাদেশ-চীন সামরিক সম্পর্ক নিয়ে টোকিওভিত্তিক অনলাইন নিউজ ম্যাগাজিন ‘দ্য ডিপ্লোম্যাট’ গত বছর ৪ ডিসেম্বর প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, ভবিষ্যতে উভয় দেশ একটি গভীর সামরিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে অঙ্গীকারবদ্ধ। হার্ডওয়্যার বিনিময় ছাড়াও সহযোগিতা বিস্তৃত করার পথেই এগিয়ে চলেছে দুই দেশ। বিশেষ করে প্রশিক্ষণ ও সামরিক সহায়তা বিনিময়ে দুই দেশের সম্পর্ক এখন উঁচু মাত্রায়। বাংলাদেশে ভারত প্রতি বছর যত প্রতিনিধি পাঠায়, চীনের গণমুক্তি ফৌজও প্রায় সমসংখ্যক প্রতিনিধি পাঠায়। প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, বাংলাদেশ সেনাপ্রধানের সফরকালে চীনের গণমুক্তি ফৌজের উপপ্রধান আশা প্রকাশ করে বলেন, কর্মকর্তাদের সফর বিনিময়, সামরিক একাডেমিগুলোর যোগাযোগ ও প্রশিক্ষণে সহযোগিতা অব্যাহত রাখবে উভয় দেশের সামরিক বাহিনী।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেনের মতে, পঁচাত্তরের পর থেকে বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের গণমুক্তি ফৌজের যে স্ট্র্যাটেজিক সম্পর্ক তৈরি হয় তা এখন নতুন মাত্রা পেয়েছে। চীন থেকে যেসব সামরিক সরঞ্জাম আনা হয় তা রক্ষণাবেক্ষণের ব্যবস্থাও বাংলাদেশে আছে এবং এগুলো কার্যকর। এছাড়া ইউরোপ-আমেরিকা থেকে সমরাস্ত্র সংগ্রহ বাংলাদেশের জন্য ব্যয়বহুল। চীনের ক্ষেত্রে তা নয়।
অন্য নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) মো. আবদুর রশীদ বলেন, বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে সম্পর্ক অনেকভাবে গড়ে উঠেছে। বর্তমানে এ সম্পর্কে চীনের কৌশলগত একটি দিক রয়েছে। তবে সামরিক ক্ষেত্রে আঞ্চলিক নিরাপত্তার বিষয়টি বিবেচনায় রেখে বাংলাদেশকে সেভাবেই এগোতে হবে।
এছাড়া বাংলাদেশ যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে গুরুত্বপূর্ণ চীন আক্রমণের জন্য। তেমনি চীনের কাছেও গুরুত্বপূর্ণ আত্মরক্ষার জন্য। আর, ভারতের কাছে বাংলাদেশ গুরুত্বপূর্ণ শুধু একটি নয়, তিনটি কারণে। প্রথমতঃ চীনের সম্ভাব্য আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষা, দ্বিতীয়তঃ চীনকে পাল্টা আক্রমণ করা; এবং তৃতীয়তঃ পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোকে ভারতীয় ফেডারেশনের মধ্যে ধরে রাখা।
চীনের ওপর উত্তর থেকে আক্রমণের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য সবচেয়ে সুবিধাজনক স্থান হচ্ছে বঙ্গোপসাগর। তাই, চীনের সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্ভাব্য যুদ্ধের ক্ষেত্র বাংলাদেশের রণকৌশলিক গুরুত্ব অপরিসীম। চীনও তার নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষার জন্য বঙ্গোপসাগরকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করে। স¤প্রতি বাংলাদেশ নৌবাহিনীর কাছে চীনের তৈরি ২টি মিং-ক্লাস সাবমেরিন সরবরাহের ফলে বিচলিত বোধ করছে ভারত। ভারতের ধারণা, চীনের সাবমেরিন ইতোমধ্যে নিয়মিত বঙ্গোপসাগরে আনাগোনা করছে। এই প্রেক্ষাপটে দুদেশের মধ্যে সামরিক সৌহার্দ্য বাড়াতে ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী মনোহর পারিকার দেশটির তিন বাহিনীর ২য় শীর্ষ কর্মকর্তাদের এবং কোস্ট গার্ডের প্রধানকে নিয়ে গত বছরের নভেম্বরে বাংলাদেশ ঘুরে যান।
যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়াভিত্তিক প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত ওয়েবসাইট ডিফেন্স নিউজ ডটকম এ নিয়ে ভারতের বেশ কয়েকজন পর্যবেক্ষকের মত প্রকাশ করে। তাদের মধ্যে ভারতের নৌবাহিনীর সাবেক অ্যাডমিরাল অরুণ প্রকাশের মতে, বাংলাদেশের কাছে সাবমেরিন বিক্রির অর্থই হচ্ছে বন্ধু দেশগুলোর সহায়তায় ভারতের চারপাশে শক্তি বাড়ানোর ক্ষেত্রে চীনের একটি কৌশল। তবে এসব বক্তব্যের সাথে একমত পোষণ করছেন না ভারতের গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চের গবেষক ভারত কর্ণাঠ। তিনি বলেন, সাবমেরিন কেনা ঢাকার অর্থনৈতিক শক্তির বহিঃপ্রকাশ। তবে খেয়াল রাখতে হবে, এর মাধ্যমে যেন বেইজিং দিল্লিকে ছাড়িয়ে না যায়।
ভারতের ন্যাশনাল মেরিটাইম ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক ও সাবেক নৌ বাহিনীর ক্যাপ্টেন গুরপ্রিত খুরানা অবশ্য বলেন, বাংলাদেশের সাথে ভারত ও মায়ানমারের সমুদ্রসীমা বিরোধ মিটে গেছে। তারপরেও বাংলাদেশ কোন ধরনের ঝুঁকির কথা মাথায় রেখে চীনের কাছ থেকে সাবমেরিন কিনে নৌবাহিনীতে যুক্ত করলো, তা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন।
জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের কূটনীতির অধ্যাপক সাওয়ারান সিং বলেন, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী বরাবরই চীন থেকে সুবিধা গ্রহণ করে থাকে। এবার সাবমেরিন যুক্ত হওয়ায় এটা বলতে বাধা নেই যে, বাংলাদেশ সামরিক দিক দিয়ে অনেক এগিয়ে গেল এবং দুই দেশের (বাংলাদেশ ও চীন) সামরিক সহযোগিতা আরো বাড়ল। বাংলাদেশের এই শক্তি দক্ষিণ এশিয়ায় দেশটিকে প্রতিযোগী করে তুলবে।
জাপানের দ্য ডিপ্লোম্যাটের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, চীনের কাছ থেকে সাবমেরিন নেয়ার পর বাংলাদেশে সাবমেরিন ঘাঁটি বানাতে হবে এবং বিষয়টি নিয়ে ভারতের উদ্বেগ রয়েছে। তবে দুই পরাক্রমশালী দেশের নিজস্ব লড়াইয়ের মাঝখানে পড়তে চায় না বাংলাদেশ।
দক্ষিণ-এশিয়াভিত্তিক বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমসহ আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমে স¤প্রতি গুঞ্জন উঠেছে, চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের স্বাক্ষরিত কয়েকটি চুক্তি এবং তাদের কাছ থেকে সাবমেরিন কেনার পর ভূরাজনৈতিক নিরাপত্তার প্রশ্নে উদ্বেগ বোধ করেছে ভারত। ওই উদ্বেগ দূর করতেই বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরে প্রতিরক্ষা চুক্তির তোড়জোড় করছে ভারত। হিন্দুস্তান টাইমসের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে দাবি করা হয়, প্রতিরক্ষা খাতে চীন-বাংলাদেশ নৈকট্য বাড়ছে। এ কারণেই বাংলাদেশের সঙ্গে প্রতিরক্ষা চুক্তির ব্যাপারে ভারত উঠেপড়ে লেগেছে বলে দাবি করে হিন্দুস্তান টাইমস।
হিন্দুস্তান টাইমস-এর প্রতিবেদনে বলা হয় ভারত এমন একটি বড় ধরনের প্রতিরক্ষা চুক্তি চাইছে যার আওতায় প্রশিক্ষণ, সামরিক সরঞ্জাম বিক্রি এবং দুই দেশের সেনাবাহিনীর মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা বৃদ্ধি পায়। বাংলাদেশের সঙ্গে সামরিক সহযোগিতার জন্য লাইন অব ক্রেডিট অর্থাৎ এলওসি (এটি এক ধরনের ঋণ, তবে অন্য ঋণের সঙ্গে এর পার্থক্য হলো এইখানে ঋণদাতা চাইলেই যখন তখন তাদের ঋণ স্থগিত/বাতিল করে দিতে পারে) হিসেবে ৫০০ মিলিয়ন ডলার পর্যন্ত দিতে ইচ্ছুক ভারত। যদি তা বাস্তবায়িত হয় তবে তা প্রতিরক্ষা খাতে ভারতের এ যাবতকালের সর্বোচ্চ ঋণ-সহযোগিতা হবে বলে উল্লেখ করেছে হিন্দুস্তান টাইমস।
এদিকে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী, উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রীসহ বিভিন্ন স্তরের সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তাদের ঢাকা সফর ছাড়াও দেশটির রাষ্ট্রদূত একাধিকবার সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে দেখা করে বৈশ্বিক সন্ত্রাসবাদ দমনে বাংলাদেশকে কারিগরি ও প্রশিক্ষণ সুবিধা দেয়ার প্রস্তাব দেন। নৌবাহিনীকে সরবরাহ করছে যুদ্ধজাহাজ। সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তাদের দেশটিতে নানান প্রশিক্ষণের সুযোগ বাড়াচ্ছে দিন দিন। তাছাড়া বাংলাদেশকে দক্ষিণ এশিয়া ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার মধ্যে সেতু বলে মনে করে যুক্তরাষ্ট্র। যার ফলে বাংলাদেশকে নিয়ে দেশটির দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার কথা শোনা যাচ্ছে। বাংলাদেশকে বেছে নেয়ার আর একটি লক্ষ্য হলো, চীনকে সামরিকভাবে মোকাবেলা করতে হলে পরে মার্কিন নৌবহরকে ভারত মহাসাগর ও বঙ্গোপসাগরে নিয়মিত টহল দিতে হবে। আর সে জন্যই বাংলাদেশের নৌবন্দরগুলোর গুরুত্ব আমেরিকার কাছে খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের নৌঘাঁটি গঠন সংক্রান্ত খবরে পেন্টাগনের ওই অঞ্চলে কর্তৃত্ব হারানোর উদ্বেগ বাড়াছে। গত বছরের মাঝামাঝি সময়ে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি ভারত সফর করেন এবং একই সময়ে দুই দেশ লজিস্টিক সাপোর্ট চুক্তি সই করে। এক দেশের সেনা, নৌ ও বিমান অপর দেশের ঘাঁটিতে রক্ষণাবেক্ষণ সুবিধা নিতে পারবে। এটি সামরিক চুক্তির কাছাকাছি হলেও ভবিষ্যৎ সামরিক বলয় তৈরিতে বেশ এগিয়ে গেল। বাংলাদেশের সাথে একই ধরনের চুক্তি করতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আগ্রহী হয়ে পড়েছে।
তবে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজ (বিআইপিএসএস)-এর সভাপতি প্রতিরক্ষা এবং নিরাপত্তাবিষয়ক আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) মুনীরুজ্জামান বলেন, মার্কিন পররাষ্ট্র নীতিতে নতুন এক বয়ান হাজির হয় ‘পার্টনারশিপ ডায়লগ’। এই অঞ্চলের সব দেশের সাথে আমেরিকা ‘পার্টনারশিপ ডায়লগ’ নামে চুক্তির জন্য তৎপর হয়ে উঠতে দেখছি আমরা। বাংলাদেশ ইতোমধ্যেই ‘পার্টনারশিপ ডায়লগ’বিষয়ক চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী। ধরনের দিক থেকে ‘পার্টনারশিপ ডায়লগ’-এর ফোকাস অর্থনৈতিক নয়, বরং স্ট্রাটেজিক, অর্থাৎ সামরিক ও রাজনৈতিক।
তিনি জানান, আগে আমেরিকার স্টেট ডিপার্টমেন্ট বা আমাদের হিসাবে যেটা ওদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, সেখানে বাংলাদেশ ডেস্ক বলে আলাদা কিছু ছিল না; ইন্ডিয়ান ডেস্কেরই অন্তর্গত ছিল বাংলাদেশ। নীতির নতুন পর্যায় বা গুরুত্বের কারণে ২০১১ সাল থেকে আলাদা করে বাংলাদেশ ডেস্ক খোলা হয়।
আমেরিকার সাথে বাংলাদেশের সামরিক কূটনীতি এখন পর্যন্ত অনেকটাই ভারসাম্যমূলক অবস্থানে আছে। উভয় দেশের মধ্যে যৌথ সামরিক মহড়া, প্রশিক্ষণের লেনদেন চলমান আছে।
এদিকে বাংলাদেশও তার সক্ষমতা বাড়াতে তৎপর। সর্বশেষ রাশিয়া থেকে অত্যাধুনিক যুদ্ধবিমান ক্রয় করেছে। কোস্ট গার্ড ইতালি থেকে পেট্রোল বোট কিনেছে। সমুদ্র সম্পদ রক্ষার জন্য আরো সামর্থ্য বৃদ্ধির প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে ‘সমুদ্র জয়’ (মার্কিন কোস্ট গার্ড-এর কাটার জার্ভিস নামে পরিচিত) নামক একটি জাহাজ এবং কোস্টগার্ডকেও কয়েকটি টহল যান সরবরাহ করেছে। ঢাকায় বাংলাদেশ-মার্কিন নিরাপত্তা সংলাপে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলা ও বঙ্গোপসাগরের নিরাপত্তা রক্ষায় বাংলাদেশকে সহযোগিতা অব্যাহত রাখবে বলে জানানো হয়। সেই সাথে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের নৌবাহিনীকে আধুনিকায়ন করতে বিভিন্ন সরঞ্জাম দিয়ে সহায়তা করতে ইচ্ছুুক বলেও সে সময় জানানো হয়।
বাংলাদেশের অপর সামরিক মিত্র এখন রাশিয়া। পরিবর্তিত বিশ্ব প্রেক্ষাপটে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মস্কো সফরের পর প্রায় দেড় বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র ও পারমাণবিক চুল্লি স্থাপন সংক্রান্ত চুক্তি রাশিয়ার সাথে সার্বিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে এক নতুন দুয়ার খুলেছে।
মেজর জেনারেল (অব.) মুনীরুজ্জামানের মতে বঙ্গোপসাগরের কারণে ভারত মহাসাগরের সমুদ্র সীমায় হওয়ায় বাংলাদেশ নিরাপত্তার কৌশলগত দিক দিয়ে খুবই গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে। আর বঙ্গোপাসাগরের কারণে ভারত মহাসাগরে আমাদের গুরুত্বপূর্ণ অধিকার রয়েছে। এ অবস্থানের কারণে ভবিষ্যতে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক বিশেষ করে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের যে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান তা নির্ভর করবে আমরা এর সুযোগ কতটা নিতে পারব তার উপরে। দু’ভাবে বাংলাদেশ এটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে- এক্সেস কন্ট্রোল অথবা এক্সেস ডিনায়াল অর্থাৎ আমরা কাউকে এ সুযোগ দিতে পারি অথবা বঞ্চিতও করতে পারি।
জেনারেল মুনীরুজ্জামান বলেন, বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের সম্পর্কের যে কৌশলগত দিক আছে, তার প্রধান বিষয় হচ্ছে, ভারত মহাসাগর এবং বঙ্গোপসাগর। বঙ্গোপসাগর এবং ভারত মহাসাগর ও বাংলাদেশের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যে সম্পর্ক বিদ্যমান রয়েছে, সে প্রেক্ষাপট বিবেচনায় পুরো বিষয়টিকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি বলেন, গভীর সমুদ্র নিয়ে একটি বড় ধরনের সমস্যা দেখা দিতে পারে। মেজর জেনারেল (অব.) রুহুল আলম চৌধুরী বলেন, ভারত নিজেই বিদেশ থেকে অস্ত্র কিনছে। তাদের থেকে আমরা কেন অস্ত্র কিনব। আমাদের সেনাবাহিনীর জন্য যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় করি তাতে অনেক আধুনিক অস্ত্র কেনার সক্ষমতা রাখি। এ ধরনের চুক্তি হলে দেশের বাংলাদেশ তাদের নিয়ন্ত্রণে চলে যাবে। মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহম্মদ ইব্রাহিম বলেন, ভারতের সঙ্গে যে ২৫ বছরের চুক্তি হয়েছিল তা প্রকাশের পর জাতি স্তম্ভিত হয়। এবার যেন সে ধরনের দেশবিরোধী চুক্তিতে যাওয়া না হয়। আমার বিশ্বাস শেখ হাসিনা রাজনৈতিক দূরদর্শী, তিনি ভারতের চুক্তির ফাঁদে পা দেবেন না।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আসন্ন ভারত সফরকালে সম্ভাব্য একটি ব্যাপক ধরনের, ২৫ বছর মেয়াদি প্রতিরক্ষা সহযোগিতা চুক্তির জন্য দিল্লির তোড়জোড় প্রসঙ্গে গতকাল আলাপকালে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ভূ-কৌশলগত বিশেষজ্ঞ অভিমত ব্যক্ত করেছেন, এটা হবে দেশের সার্বভৌমত্বের জন্য সুদূরপ্রসারী ক্ষতিকারক। বাস্তবে এতে বাংলাদেশের কোনো লাভ বা স্বার্থ রক্ষার বাস্তব কারণ নেই। ভবিষ্যতে যদি চীনের সাথে ভারতের যুদ্ধ সংঘটিত হয় তাহলে ভারত ওই ধরনের চুক্তির ফলে বাংলাদেশের উপর দিয়ে অনায়াসে সৈন্য পরিচালনা করতে পারবে। এতে করে বাংলাদেশও সেই যুদ্ধে জড়িয়ে যাবে নিঃসন্দেহে। ভারতের সাথে কোনো ধরনের প্রতিরক্ষা সহযোগিতা চুক্তি করাটাই হবে তা জাতীয় স্বার্থের প্রশ্নে প্রতিকূলে বা বিরুদ্ধে। তিনি উল্লেখ করেন, ভারতের সাথে বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা চুক্তি হলে সেখানে অপর প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমারের যুদ্ধ ঠেকানোর কোনো বিষয়ও আসছে না। কেননা মিয়ানমার আমাদের জন্য কখনও হুমকি নয়; ছিলও না। তবে তিনি বলেন, সরকার যদি বর্তমান ও ভবিষ্যতে জাতীয় স্বার্থের দিকগুলো মাথায় না রেখেই দিল্লির সাথে এ ধরনের চুক্তি সম্পাদন করে তাহলে তা তো ভিন্ন কথা। কারণ সরকার তো যে কোনো কিছু চাইলেই তা করা হয়ে যাচ্ছে। সরকার ভারতকে কিছু দিতে চাইলে যেন তা দেবেই। কিন্তু তার বিনিময়ে আমরা তিস্তার ন্যায্য পানিও পাচ্ছি না।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।