Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

প্রধানমন্ত্রীর সম্ভাব্য ভারত সফর জনগণের উদ্বেগ ও প্রত্যাশা

| প্রকাশের সময় : ৮ মার্চ, ২০১৭, ১২:০০ এএম

জামালউদ্দিন বারী : অন্তত তিন দফা পেছানোর পর এবার এপ্রিলের কোনো এক সময় প্রধানমন্ত্রীর দিল্লি সফর হতে পারে বলে শোনা যাচ্ছে। এই সফরের সূচি চূড়ান্ত করতে ইতিমধ্যে ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহে ভারতীয় পররাষ্ট্র সচিব জয়শঙ্কর ঢাকা সফর করে গেছেন। ২০১৫ সালে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফরের পর শেখ হাসিনার দিল্লি সফর আন্তরাষ্ট্রীয় সম্পর্কের একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। গত বছরের মাঝামাঝিতে এই সফরটি হওয়ার কথা থাকলেও তা সম্ভব না হওয়ার পেছনে নানামুখী স্পেকুলেশন রয়েছে। তবে শেষ পর্যন্ত ডিসেম্বরেও সফরটি আকস্মিকভাবে স্থগিত হয়ে যাওয়ার পর এ প্রসঙ্গে জল্পনার ডালপালা বেশ ভালোই শাখা-প্রশাখা মেলেছে। তিস্তাচুক্তি নিয়ে দিল্লির শীতলতা, কথিত নিরাপত্তা চুক্তি নিয়ে বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা সংশ্লিষ্টদের কথিত আপত্তি, চায়না থেকে সাবমেরিন ক্রয়ে দিল্লির অসন্তোষ এবং বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন নিয়ে কিছু মতবিরোধের কথাও নানা মাধ্যমে শোনা গেছে। বাস্তবতা যা-ই হোক, আওয়ামী লীগ ও মহাজোটের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ এবং বাংলাদেশ-ভারত দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আগামী দিল্লি সফর গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়াতে পারে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। দিল্লি সফরের সম্ভাব্য তারিখ তিন দফা পরিবর্তনের পাশাপাশি বহুপ্রত্যাশিত তিস্তার পানিচুক্তি সম্পর্কে দিল্লির নেতিবাচক প্রবণতা অব্যাহত থাকা এবং ধোঁয়াশাপূর্ণ নিরাপত্তা চুক্তির প্রচারণা ইতিমধ্যে প্রধানমন্ত্রীর দিল্লি সফর সম্পর্কে জনমনে এক ধরনের কালো ছায়া পড়েছে। নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফরে ভারতের বহুপ্রত্যাশিত ট্রানজিট-ট্রান্সশিপমেন্টসহ নানা ধরনের স্পর্শকাতর চুক্তি দিল্লির জন্য বিশাল প্রাপ্তিযোগ হলেও বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষকে হতাশ করে দিয়ে তিস্তার পানিচুক্তি স্থগিত হয়ে যায়। এর আগে কংগ্রেস সরকারের আমলে প্রধানমন্ত্রীর দিল্লি সফর এবং ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরের সময়ও বাংলাদেশের মানুষ একাগ্রচিত্তে তিস্তাচুক্তির জন্য অপেক্ষা করেছে। তখন যেমন যথাশীঘ্র তিস্তাচুক্তি হবে বলে মুলা ঝুলানো হয়েছিল, দিল্লিতে ক্ষমতার পালাবদলের পর নরেন্দ্র মোদিও একই ধরনের আশ্বাস দিয়ে ঢাকা ত্যাগ করেছিলেন। স্বাভাবিকভাবেই আমরা আশা করেছিলাম শেখ হাসিনার দিল্লি সফরে তিস্তাচুক্তিই হবে মূল দ্বিপাক্ষিক এজেন্ডা। তিস্তার পানি সংকটে যখন দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে ভয়াবহ পরিবেশগত ও অর্থনৈতিক বিপর্যয় দেখা দিতে শুরু করেছে, তখন বাংলাদেশ ও ভারতের সরকার তিস্তার পানিচুক্তির বদলে অদৃশ্য নিরাপত্তা চুক্তি নিয়েই বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়ছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে।
দুই দেশের সরকারের পক্ষ থেকে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক অনেক উচ্চতায় আসীন হয়েছে বলে দাবি করা হলেও এই সম্পর্ক যে একতরফা, একপাক্ষিকভাবে ভারতের অনুক‚লে আরো বেশি হেলে পড়েছে, তা আরো বেশি স্পষ্ট হয়ে পড়ায় বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে ভারতবিরোধী মনোভাব আগের চেয়ে প্রবল আকার ধারণ করেছে। অর্থনীতি, ভ‚-রাজনীতি, বাণিজ্য, নিরাপত্তাসহ দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের প্রতিটি ক্ষেত্রেই বাংলাদেশ যে আরো পেছনে পড়ে যাচ্ছে এখন তা ওপেন সিক্রেট। দ্বিজাতিতত্তে¡র ভিত্তিতে ভারত-পাকিস্তান ভাগ হওয়া এবং বাংলাদেশ পাকিস্তানের অংশে পরিণত হওয়ার পেছনে যে ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক রসায়ন কাজ করেছিল এখনো তা থেকে কোনো দেশই বেরিয়ে আসতে পারেনি। এ কারণেই ভারতে একটি ধর্মনিরপেক্ষ সাংবিধানিক ব্যবস্থা থাকা সত্তে¡ও হিন্দু জাতীয়তাবাদী রাজনীতি যথেষ্ট শক্তিশালী হয়ে সরকার গঠন করতে পারছে। একইভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারত সর্বতোভাবে সহযোগিতা করার পরও বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ ভারতকে আস্থাভাজন বন্ধুরাষ্ট্র হিসেবে গ্রহণ করতে পারে না। এর জন্য দেশ বিভাগের ঐতিহাসিক ঘটনাবলীর যেমন দায় আছে তেমনি দুই দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর সাম্প্রদায়িক মনোবৃত্তি বিশেষভাবে দায়ী। তবে সম্পর্কের ক্ষেত্রে পারস্পরিক আস্থাশীল অবস্থান গড়ে তুলতে প্রতিবেশী বড় দেশ এবং আঞ্চলিক পরাশক্তি হিসেবে ভারতের দায়-দায়িত্ব অনেক বেশি হলেও ভারত তার প্রভাবকে বরাবর নিজের স্বার্থে ব্যবহার করেছে। আন্তর্জাতিক নদী আইন ও কনভেনশন উপেক্ষা করে যৌথ নদীর ওপর একের পর এক বাঁধ নির্মাণ করে বাংলাদেশকে অর্থনৈতিক নিরাপত্তা ও পরিবেশগতভাবে ঝুঁকির মধ্যে ঠেলে দেয়ার ভারতীয় তৎপরতা এ দেশের মানুষ কখনই মেনে নেয়নি। কোনো দেশের মানুষই প্রতিবেশী দেশের এ ধরনের তৎপরতাকে বন্ধুসুলভ ব্যবহার হিসেবে মেনে নিতে পারে না। প্রাচ্যের জনগণ, বিশেষত মুসলমানরা পশ্চিমা ঔপনিবেশিক শাসনকে একদিনের জন্যও মেনে নিতে পারেনি। পশ্চিমা সা¤্রাজ্যবাদও মুসলমানদেরকে তাদের বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছে। আটশ বছর ধরে হিন্দু-মুসলিম সহাবস্থানের ঐতিহ্য ধারণকারী ভারতীয় উপমহাদেশেও মুসলমানবিদ্বেষী এই পশ্চিমা মনোভাব ও প্রাপাগান্ডা এখন প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে। ফারাক্কায় বাঁধ দিয়ে বাংলাদেশের বৃহত্তম নদী পদ্মাকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেয়া, তিস্তার উজানে গজলডোবা বাঁধ নির্মাণ করে তিস্তা নদী ও তিস্তা সেচ প্রকল্পকে ধ্বংস করা, আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পের নামে বাংলাদেশের সব নদীর পানি প্রবাহে বাধা সৃষ্টির মতো যেসব তৎপরতা ভারত চালাচ্ছে, সেই সাথে সীমান্তে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর হাতে বাংলাদেশের নিরস্ত্র দরিদ্র মানুষ হত্যার ঘটনাগুলোর বিষয় বিবেচনা করলে তার সাথে একমাত্র ফিলিস্তিন-ইসরাইলের তুলনা করা যেতে পারে। বিশ্বের আর কোনো আঞ্চলিক শক্তি তার প্রতিবেশী দেশের সাথে এ ধরনের আচরণ করছে কিনা আমাদের তা জানা নেই।
ভারতের সাথে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে দীর্ঘদিনের সন্দেহ ও অনাস্থার বরফ গলিয়ে বাংলাদেশ যখন মুজিব-ইন্দিরা চুক্তির আলোকে আরেকটি স্থল সীমান্ত ও ট্রানজিট চুক্তিতে স্বাক্ষর করে ভারতের জন্য বাংলাদেশের ভূ-খন্ডকে উন্মুক্ত করে দেয়ার ক‚টনৈতিক প্রক্রিয়া চলছিল, তখন বাংলাদেশ ও ভারতের নিগোসিয়েশনের পক্ষের ব্যক্তিরা বলেছিলেন, ভারতীয় ট্রানজিটের ফলে বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে ব্যাপক লাভবান হবে। কেউ কেউ আরেকটু বাড়িয়ে বলেছেন, ট্রানজিট-ট্রান্সশিপমেন্টের ট্যারিফ দিয়ে বাংলাদেশ সিঙ্গাপুর হয়ে যাবে। ট্রানজিট-ট্রান্সশিপমেন্ট এবং সমুদ্রবন্দরকে ভারতের জন্য উন্মুক্ত করে দিতে হলে অবকাঠামো খাতে বাংলাদেশকে লক্ষকোটি টাকা বিনিয়োগ করতে হবে। এসব খাতে ইতিমধ্যেই বিনিয়োগ ও উন্নয়ন কার্যক্রম শুরু হয়েছে। লক্ষকোটি টাকা বিনিয়োগের অবকাঠামো এবং রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ও রাজনৈতিকভাবে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ ট্রানজিট তথা বাণিজ্যিক করিডোর থেকে বাংলাদেশের বছরে কয়েক হাজার কোটি টাকা রাজস্বের প্রত্যাশা করা অত্যন্ত সঙ্গত নয় কি? আমাদের বন্দর, রাস্তাসহ অবকাঠামো খাত স্থলট্রানজিটের উপযোগী হওয়ার আগে, এমনকি ট্রানজিট চুক্তি সম্পাদিত হওয়ার আগেই মানবিক কারণে এবং বন্ধুত্বের নিদর্শন হিসেবে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে বিনাশুল্কে মাসে হাজার হাজার টন মালামাল পরিবহন করা হচ্ছিল। ২০১০ সাল থেকে বছরের পর বছর ধরে চলতে থাকা বিনাশুল্কের এই ট্রানজিট নিয়ে যখন মূলধারার গণমাধ্যমের পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ লেখালেখি চলছিল তখনই ট্রানজিট ফি নির্ধারণের জন্য একটি কমিশন গঠন করেছিল সরকার। বলাবাহুল্য, বাংলাদেশের ওপর দিয়ে ভারতীয় পণ্য ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে পরিবহনে অকল্পনীয় ও অযৌক্তিক নামমাত্র ট্যারিফ নির্ধারণের কারনে সোশ্যাল মিডিয়ায় লেখালেখি এখনো চলছেই। কলকাতা থেকে প্রায় ১৬০০ কিলোমিটার দুর্গম রাস্তা পেরিয়ে একট্রাক পণ্য আগরতলায় পৌঁছাতে যেখানে একটানা কমপক্ষে আট দিন সময় লাগত সেখানে ট্রানজিটের কারণে তা দুই দিনেই পৌঁছানো সম্ভব হচ্ছে। এতে প্রতি টন পণ্য পরিবহনে প্রায় ২০০ ডলার  বা প্রায় ১৬ হাজার টাকা সাশ্রয় হচ্ছে বলে জানা যায়। এ থেকে বাংলাদেশ প্রতি টনে ৮ হাজার টাকা মাশুল দাবি করলে তা অসঙ্গত হয় না। বাস্তবতা হচ্ছে, সরকার গঠিত ট্যারিফ কমিশন ট্রান্সশিপমেন্টের মাশুল টনপ্রতি ১০৫৮ টাকা প্রস্তাব করলেও কোনো অজ্ঞাত কারণে অথবা ভারতীয় পক্ষের সাথে দরকষাকষিতে অপারগতার কারণে মাত্র ১৯২ টাকা মাশুল নির্ধারণ করা হয়েছে। জনৈক ব্যক্তি সোশ্যাল মিডিয়ায় দেয়া এক পোস্টে ঢাকার একটি দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত একটি খবরের অংশবিশেষ উদ্ধৃতি হিসেবে ব্যবহার করেছেন, সেখানে আখাউড়া সীমান্তে একটি ভারতীয় পণ্যবাহী ট্রাকের ছবির ক্যাপশনে বলা হয়েছে, ‘এক রুপিতে ট্রানজিট’। পত্রিকার রিপোর্টার কলকাতা থেকে ত্রিপুরার আগরতলাগামী ট্রাকের মাশুল সম্পর্কে জানতে চাইলে ‘আখাউড়া শুল্ক বিভাগের সহকারী কমিশনার মিহির কিরণ চাকমা তাকে বলেন, দুই দেশের সরকারের পারস্পরিক সমঝোতার মাধ্যমে পরীক্ষামূলকভাবে চালানে এক রুপি মাশুল নেয়া হয়। খবরের ভাষ্য অনুসারে- আমাদের মানবিক কারণে কলকাতা থেকে আগরতলায় পণ্য পরিবহনের দূরত্ব হাজার কিলোমিটার কমে আট দিনের স্থলে ৫১ ঘণ্টায় পৌঁছে যাচ্ছে কলকাতায়, বিনিময়ে বাংলাদেশের ভাগ্যে জুটছে এক রুপি। অথচ চাতক পাখির মতো ভারতের কাছ থেকে ‘মানবিক কারণে’ও একফোঁটা তিস্তার ন্যায্য পানি পাই না। আমাদের সরকার টাকার অন্বেষণে শিক্ষার ওপর ভ্যাট বসালেও ভারতের কাছ থেকে ন্যায্য পাওনা আদায়ে ‘মানবিক’ হয়ে যায়। অথচ কিছু দিন আগেও আমাদের মন্ত্রীরা বলে বেড়াতেন, ট্রানজিট দিলে বাংলাদেশের আয় বাড়বে, দেশ সিঙ্গাপুর মালয়েশিয়ার মতো সমৃদ্ধ হয়ে যাবে।’
গত এক দশকে ভারতের রেমিটেন্স আয়ের শীর্ষ দেশে পরিণত হয়েছে বাংলাদেশ। সেই সাথে ভারতের অনুক‚লে বাণিজ্য বৈষম্য বেড়ে চলেছে। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বরাবরই বাণিজ্য বৈষম্য কমিয়ে আনার ভারতের কাছে আবেদন-নিবেদন পেশ করেও কোনো লাভ হয় না। দুই দেশের সম্পর্ক নতুন উচ্চতায় সমাসীন হওয়ার দাবি করা হলেও বাণিজ্য বৈষম্য কমিয়ে আনতে ভারতীয়রা বাংলাদেশ থেকে পণ্য আমদানি বাড়াতে শুল্ক ও অশুল্ক বাধা দূর করার নীতিগত সিদ্ধান্তের বদলে নতুন নতুন প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে দেখা যাচ্ছে। দশকের পর দশক ধরে বাংলাদেশি কাঁচা পাট ও পাটসুতার ওপর ভারতীয় পাটশিল্প অনেকাংশে নির্ভরশীল হলেও সম্প্রতি বাংলাদেশি পাটপণ্যের ওপরও এন্টি-ডাম্পিং শুল্ক বসিয়েছে ভারত। পুঁজিবাদী ও মুক্তবাজার অর্থনীতির বিশ্বে দেশগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে বাণিজ্য এবং দ্বিপক্ষীয় অর্থনৈতিক স্বার্থ গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক হিসেবে কাজ করে। যেখানে বিশ্বের একনম্বর বাণিজ্যিক-অর্থনৈতিক পরাশক্তি গণচীন বাংলাদেশের সাথে বাণিজ্যবৈষম্য কমিয়ে আনতে শতাধিক বাংলাদেশি পণ্যের শুল্কমুক্ত সুবিধা দিচ্ছে। পাশাপাশি বাংলাদেশে হাজার হাজার কোটি ডলারের বৃহত্তম বিনিয়োগ প্রস্তাব ও চুক্তি করছে সেখানে ভারত দু-এক বিলিয়ন ডলারের ঋণচুক্তি করে সে টাকায় ভারত থেকে পণ্য আমদানির শর্ত জুড়ে দিয়ে তার বাণিজ্যিক সুবিধাই শুধু নিশ্চিত করতে ব্যস্ত থাকে। ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতির কারণে সরকার যে অবস্থানই গ্রহণ করুক না কেন, পারস্পরিক সুসম্পর্কের মানদন্ড নির্ধারিত হয় দেশের সাধারণ জনগণ এবং ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের মধ্যকার রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক সম্পর্কের ওপর। পিপল টু পিপল সম্পর্ককে পাশ কাটিয়ে আঞ্চলিক সম্পর্ক ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা যায় না। রাজনীতি, অর্থনীতি, বাণিজ্য, সামরিক শক্তি অথবা আন্তর্জাতিক সম্পর্ক কোনো ক্ষেত্রেই বাংলাদেশ ভারতের প্রতিপক্ষ নয়। বাংলাদেশের মানুষ তার রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য, দেশের সার্বভৌমত্ব এবং অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নিশ্চিত দেখতে চায়। স্থলসীমান্তে বাংলাদেশের নাগরিকরা প্রতিদিনই ভারতীয় বিএসএফের বেপরোয়া গুলিতে মরছে। আন্তর্জাতিক আদালতের মাধ্যমে বাংলাদেশের নৌসীমা এবং বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের সীমানা নির্ধারিত হলেও বাংলাদেশ তার সমুদ্র সম্পদ রক্ষা করতে পারছে না। ভারত, মিয়ানমারসহ বিভিন্ন দেশের নৌদস্যুদের হাতে বাংলাদেশের সমুদ্র সম্পদ লুণ্ঠিত হচ্ছে। আমাদের বøু ইকোনমির সম্ভাবনা কাজে লাগানো যাচ্ছে না। মিয়ানমারের সাথে সমুদ্রসীমা বিরোধ মীমাংসা হওয়ার পর থেকে তারা নতুন উদ্যমে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনের কার্যক্রম শুরু করলেও বাংলাদেশ এখনো কিছুই করতে পারেনি। সমুদ্রসীমা বিরোধ নিষ্পত্তির আগে ২০০৮ সালে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় মিয়ানমারের খনিজ সম্পদ অনুসন্ধানে বাংলাদেশ নৌবাহিনী বাধা দিলে এক ধরনের সাংঘর্ষিক উত্তেজনা দেখা দিয়েছিল। এ কথা মানতেই হবে যে, দীর্ঘ সামরিক শাসনের কারণে মিয়ানমার আন্তর্জাতিকভাবে অনেকটা বিচ্ছিন্ন থাকলেও সেনা শাসকরা তাদের সামরিক বাহিনীকে শক্তিশালী করে গড়ে তুলতে কার্পণ্য করেনি। এহেন বাস্তবতায় বাংলাদেশ যদি তার সমুদ্রসীমার নিরাপত্তার জন্য চীন বা অন্য কোনো দেশের কাছ থেকে সাবমেরিন বা ফ্রিগেট সংগ্রহ করে তাহলে পারমাণবিক শক্তিধর ভারতের উদ্বিগ্ন হওয়ার কোনো দৃশ্যমান কারণ নেই। চীনের কাছ থেকে দুটি সাবমেরিন ডেলিভারি গ্রহণের পর তাৎক্ষণিকভাবে ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রীর ঢাকা সফরসহ ভারতের পক্ষ থেকে যেসব তৎপরতা ও প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে তাতে এ দেশের জনগণের মধ্যে সন্দেহ ও উদ্বিগ্নতা বেড়ে যাওয়াই স্বাভাবিক। উল্লেখ্য, বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর কোনো ভারতীয় প্রতিরক্ষামন্ত্রীর এটাই প্রথম বাংলাদেশ সফর। তিনি সেই মনোহর পারিকর, যিনি গত বছরও বাংলাদেশবিরোধী রাজনৈতিক বক্তব্য দিয়ে সংবাদ শিরোনাম হয়েছিলেন। মনোহর পারিকরের অনির্ধারিত ঢাকা সফরের পর থেকেই শেখ হাসিনার সম্ভাব্য ভারত সফরে কথিত নিরাপত্তা চুক্তির ইস্যুটিকে লাইমলাইটে নিয়ে আসা হয়েছে। তবে প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরসূচি বার বার পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে বোঝা যায় পর্দার অন্তরালে এক ধরনের দর কষাকষি চলছে। দেশে রাজনৈতিক বাস্তবতা যা-ই হোক, গত কয়েক বছরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্বের সামনে একটি রাষ্ট্রনায়োকোচিত ইমেজ তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। তবে তিস্তার পানিচুক্তি, ট্রানজিট-করিডোরে পণ্য পরিবহনে মাশুল আদায়সহ বাংলাদেশের স্বার্থের প্রশ্নে ভারতের সাথে দর কষাকষিতে বর্তমান সরকারের ব্যর্থতা অনেকটাই স্পষ্ট। প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে গত পাঁচ-সাত বছরে আমরা ভারতকে সম্ভাব্য সবকিছুই দিয়েছি। কোনো বিতর্কিত নিরাপত্তা চুক্তির বিনিময়ে নয়, দুই প্রতিবেশী রাষ্ট্রের পারস্পরিক আস্থা এবং রাষ্ট্র ও জনগণের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের কথা বিবেচনা করেই প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের এজেন্ডা নির্ধারিত হবে। এটাই জনগণের প্রত্যাশা।  
[email protected]



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ