Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সত্যলোকের সন্ধানে : আল কোরআন : তাজকেরায়ে মীলাদ নামায়ে আম্বিয়া (আ.)

প্রকাশের সময় : ২১ জানুয়ারি, ২০১৬, ১২:০০ এএম | আপডেট : ১২:০৭ এএম, ২১ জানুয়ারি, ২০১৬

এ, কে, এম, ফজলুর রহমান 

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
দুনিয়া ও আখেরাতের প্রত্যেক, নেকী, ইজ্জত ও সম্মান তার কারণেই অর্জন করা সম্ভব হয়েছে। বরং সকল নেকী ও পুণ্য মুহাম্মদ মোস্তফা (সা.)-এর মাধ্যমেই সাধিত হয়েছে এবং সকল মন্দ ও পাপ থেকে বিরত থাকার শিক্ষা তিনিই প্রদান করেছেন। আর সত্য কথাতো এই যে, এসব কিছু দানকারী আল্লাহ রাব্বুল ইজ্জতের মারেফাত তোমরা তারই বদৌলতে লাভ করেছ। সুতরাং এই মাহান সত্তার আগমন উপলক্ষে এবং আল্লাহপাকের এই ফযল ও রহমতদানের প্রেক্ষিতে বারগাহে ইলাহীতে শোকর আদায় করার এই আমল বেশি জোশ ও অনুরাগের সাথে হওয়া উচিত।
৬। জশনে মীলাদ (সা.) সর্বশ্রেষ্ঠ নেয়ামতের শোকর আদায় মাত্র
বিশ্ব জগতের স্রষ্টা মানব জাতির উপর সীমা সংখ্যাহীন অনুগ্রহ ও উপহার প্রদান করেছেন। তিনি আমাদেরকে বেশুমার নেয়ামত দান করেছেন। খানাপিনা এবং অন্যান্য সুখ ও শান্তির উপকরণাদি এবং রূপ ও সৌন্দর্য দ্বারা আমাদেরকে সমৃদ্ধশালী করেছেন। আমাদের জন্য দিন-রাতের শৃঙ্খলা বিধান করেছেন। সমুদ্র, পাহাড় ও মহাশূন্যকে আমাদের অধীনস্থ করেছেন। কিন্তু তিনি কখনও কোন নেয়ামতের প্রতিদান কামনা করেননি। এই দয়ালু ক্ষমাশীল সত্তা আমাদেরকে নিখিল বিশ্বে মর্যাদা ও সম্মানের তাজ পরিধান করিয়েছেন এবং আহসানে তাকবীম অর্থাৎ সুন্দর ছাঁচে বিন্যাস করে ফেরেশতাদের দৃষ্টিনন্দন বানিয়েছেন, আমাদেরকে মা, বাবা ভাই, বোন, স্ত্রী ও সন্তানের দ্বারা সুসম্পর্কিত এবং বন্ধনে আবদ্ধ করেছেন। মোটকথা, অন্তর জগত ও বহির্জগতের অগণিত এমন সব নেয়ামত প্রদান করছেন যা আমাদের অনুভব শক্তিরও বাইরে। কিন্তু নির্দিষ্টভাবে কোনও নেয়ামতের উপর প্রতিদান কামনা করেননি। এ জন্য যে, তিনি এতই দানশীল কেউ তাকে মানুক চাই না মানুক, সকলকেই তিনি নিজের অনুগ্রহ ভাজন করেছেন এবং কারও উপর সামান্যতম প্রতিদানও দাবি করেননি। কিন্তু এক সর্বশ্রেষ্ঠ নেয়ামত এমন ছিল যে, আল্লাহতায়ালা যখন তাকে কিবরিয়াইর পরিম-ল হতে মানুষকুলের দিকে প্রেরণ করলেন এবং সারা বিশ্বকে এই নেয়ামত দ্বারা বিভূষিত করলেন, তখন শুধু তার কথা উল্লেখই করেননি, বরং সকল নেয়ামতসমূহের মধ্য হতে শুধু তারই প্রতিদান কামনা করেছেন। আর তার প্রকাশ সাধারণ শব্দাবলীতে নয়, বরং দুটি তাকীদ ফী এবং ক্বাদ সহযোগে বয়ান করেছেন। ইরশাদ হয়েছে :
অর্থাৎ- নিশ্চয়ই আল্লাহতায়ালা মুসলমানদের উপর বড় এহসান করেছেন যে, তাদের প্রতি তাদেরই মধ্য হতে (মর্যাদাপূর্ণ) রাসূল প্রেরণ করেছেন। (সূরা আলে ইমরান : আয়াত- ১৫৪)।
এই আয়াতে মোবারক সুস্পষ্টভাবে বিশ্লেষণ করছে যে, আল্লাহ রাব্বুল ইজ্জত বলছেন, হে লোক সকল! তোমাদের উপর এটা বড়ই এহসান এবং অনুগ্রহ যে, আমি স্বীয় মাহবুবকে তোমাদেরই মধ্য হতে তোমাদের জন্য পয়দা করেছি। তোমাদের তকদীর পরিবর্তন করে দিয়েছি। বিগড়ানো অবস্থাকে শুধরে দিয়েছি, তোমাদেরকে জিল্লতি ও গোমরাহীর অতল গহ্বর হতে উদ্ধার করে সম্মান ও মর্যাদার আসনের সমাসীন করেছি। জেনে রেখ, আমার কারখানায়ে কুদরতের মধ্যে তার চেয়ে বড় নেয়ামত কিছুই নেই। যখন আমি সেই মাহবুব (সা.)-কে তোমাদের জন্য দান করেছি, যার খাতিরে বিশ্বজগতকে অনস্তিত্ব হতে অস্তিত্বে আনয়ন করেছি। বিশ্বভূবনকে নানা প্রকার ও শ্রেণীর নেয়ামতের দ্বারা মালামাল করে দিয়েছি, তখন এ পর্যায়ে জরুরি ছিল যে, আমি রাব্বুল আলামীন হয়েও এই শ্রেষ্ঠ নেয়ামতের প্রতিদান চাইব। কখনও এমন যেন না হয় যে, উম্মতে মুহাম্মদী তাকে সাধারণ নেয়ামত মনে করে তার সম্মান ও মর্যাদার প্রতি অমুখাপেক্ষিতা প্রদর্শন করে বসে এবং আমার এই শ্রেষ্ঠ অনুগ্রহের নাশোকারী করতে থাকে। বস্তুতঃ এই প্রতিদান প্রত্যাশাতেও মুসলি উম্মতের কল্যাণকে অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে এবং কুরআনুল কারীম এই সুস্পষ্ট নির্দেশের মাধ্যমে প্রত্যেক তৌহিদপন্থীকে সতর্ক করে দিয়েছেন যে, তারা যেন কখনও এই শ্রেষ্ঠ নেয়ামতের কথা ভুলে না যায়। বরং এই শ্রেষ্ঠ নেয়ামতের শোকরানা স্বরূপ আনন্দোৎসব উদযাপন করে।
৭। নেয়ামতসমূহের শোকর আদায় করা জরুরি কেন
আল্লাহতায়ালার নেয়ামতরাজি এবং তার ফযল ও করমের শোকর আদায় করা বন্দেগীর পরিচায়ক। কিন্তু কুরআনুল কারীম এ স্থলে তার একটি নতুন হেকমতের কথাও বয়ান করেছে। আল্লাহপাক ইরশাদ করেছেন :
অর্থাৎ যদি তোমরা শোকর আদায় কর, তাহলে আমি তোমারদেরকে অধিক নেয়ামতের প্রদান করব, আর যদি তোমরা নাশোকরী কর তাহলে জেনে রেখ, আমার আযাব অবশ্যই কঠিন। (সূরা ইব্রাহিম : আয়াত-৭)।
এই আয়াতে কারীমার দ্বারা বুঝা যায় যে, নেয়ামতসমূহের শোকর আদায় করা অধিক নেয়ামত লাভের পূর্বশর্ত। অর্থাৎ আল্লাহতায়ালা স্বীয় কৃতজ্ঞ বান্দাহদেরকে অধিক নেয়ামত দান করেন। কিন্তু নেয়ামতের নাশোকরী করাকে তিনি পছন্দ করেন না। এমন বান্দাহদেরকে কঠিন আযাবের ভীতি প্রদর্শন করা হয়েছে। এ্ জন্য আল্লাহপাকের অন্যান্য নেয়ামতরাজি লাভের অধিকার প্রাপ্তির জন্য হুজুর নবীয়ে আকরাম (সা.)-এর সৌভাগ্যপূর্ণ বেলাদতের সুরতে প্রাপ্ত শ্রেষ্ঠ নেয়ামতের শোকর আদায় করা অবশ্যই জরুরি।
৮। নেয়ামতের শোকর আদায় করার উত্তম তরীকা
এই আয়াতের শেষাংশে আমরা সংক্ষিপ্তভাবে নেয়ামতের শোকর আদায় করার বিভিন্ন দিক তুলে ধরব। সেগুলোর প্রমাণ এবং দলির কুরআনুল কারীমে বিদ্যমান আছে। মীলাদে মোস্তফা (সা.)-এর শোকরানা আদায়ের সময়ও এই নিয়মই পালিত হয়ে থাকে।
(ক) নেয়ামতের কথা স্মরণ করা
কুরআনুল কারিম নেয়ামতসমূহের শোকারিয়া আদায় করার একটি সুরত এই বর্ণনা করেছে যে, আল্লাহতায়ালার রহমত এবং তার নেয়ামতকে স্মরণ রাখা। যেমন পূর্ববর্তী আলোচনায় বনী ইসরাইলের প্রতি প্রদত্ত নেয়ামতের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। সূরা বাকারা হতে ইরশাদ হয়েছে :
অর্থাৎ- হে ইয়াকুবের সন্তানগণ! আমার এই নেয়ামতের কথা স্মরণ কর যা আমি তোমাদেরকে প্রদান করেছি। (সূরা বাকারাহ : আয়াত ৪৭)।
এই একই বিষয়বস্তু সূরা আলে ইমরানের এই আয়াতেও প্রাসঙ্গিকভাবে বিবৃত হয়েছে। যেখানে আল্লাহতায়ালা মানব জাতিকে হুকুম দিয়েছেন যে, তারা যেন সেই নেয়ামতকে স্মরণ করে। ইরশাদ হয়েছে : অর্থাৎ- তোমরা নিজেরা আল্লাহ প্রদত্ত এই নেয়ামতকে স্মরণ কর যখন তোমরা পরস্পর দুশমন ছিলে, তিনি তোমাদের অন্তরে প্রীতি ও ভালোবাসা পয়দা করেছেন এবং তোমরা তার প্রদত্ত নেয়ামতের ওছিলায় ভাই ভাই হয়ে গেছ। (সূরা আলে ইমরান : আয়াত ১০৩)।
হুযুর নবীয়ে আকরাম (সা.)-এর বেলাদত ও আবির্ভাবকে স্মরণ করা তার পবিত্র সুরত, সীরাত, ফাজায়েল, কামালাত ও খাসায়েস ও মুজিযাতকে স্মরণ করা আল্লাহপাকের দরবারে এই শ্রেষ্ঠ নেয়ামতের শোকরগুজারীরই একটি। এই শ্রেষ্ঠতর নেয়ামতের কথা স্মরণ করে আমরা নিজেদেরই মর্যাদাশীল করি। অন্যথায় ‘ওয়া রাফানা লাকা জিকরাকা’ আল্লাহপাকের এই ফরমান মোতাবেক তার স্মরণ প্রতিনিয়ত বুলন্দ হতেই থাকবে। প্রতিটি আগমনকারী মুহূর্ত রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সমুন্নত মর্যাদাকে বুলন্দ হতে বুলন্দতরই দেখবে। আল্লাহ পাক ঘোষণা করেছেন :
অর্থাৎ- এবং নিঃসন্দেহে (প্রত্যেক) পরবর্তী মুহূর্ত আপনার জন্য পূববর্তী হতে উত্তম (অর্থাৎ আজমত ও বুলন্দীয় পরিচায়ক) হবে। (সূরা আদ দোহা : আয়াত : ৪)।
আরও ইরশাদ হয়েছে : অর্থাৎ- আমি আপনার খাতিরে আপনার স্মরণকে (স্বীয় স্মরণের সাথে মিলিয়ে দুনিয়া ও আখেরাতের সকল স্থানে) বুলন্দ করে দিয়েছি। (সূরা ইনশিরাহ : আয়াত : ৪)।
এর দ্বারা বুঝা যায় যে, এমন যে কেউ হুজুর নবীয়ে আকরাম (সা.)-এর স্মরণ করবে এতে সে নিজেই উপকৃত হবে। আর তার মীলাদ মোবারকের সময় আল্লাহতায়ালার দরবারে শোকরানা স্বরূপ যে আনন্দ উদযাপন করবে তাও তার পাথেয় হিসেবে সঞ্চিত হবে। এই শ্রেণীর আমলকারী কারও উপর ইহসান করছে না, বরং নিজের আখেরাতের সম্বলই সংগ্রহ করছে। ইমাম আহমাদ রেজা খান (১২৭২-১৩৪০ হি.) কত সুন্দরই না বলেছেন : অর্থাৎ আপনার উপর ওয়া রাফানা লাকা জিকরাকা ছায়া বিস্তার করে রেখেছে, আপনার প্রসঙ্গ খুবই সমুন্নত এবং আপনার জিকির বা স্মরণ সর্বোচ্চ ও মহীয়ান। [(১) আহমদ রেজা খান : হাদায়েকে বখশিশ, খ--১, পৃষ্ঠা-১৮ ; (২) সূরা আদ দোহা : আয়াত ১১]
(খ) এবাদত ও বন্দেগী
আল্লাহর নেয়ামতের শোকর তাঁর এবাদত বন্দেগীর মাধ্যমেও আদায় করা যায়। নামায, রোযা, হজ, যাকাতের মতো ফরজ এবাদত ছাড়াও অন্যান্য নফল এবাদত আদায় করা আল্লাহতায়ালার নেয়ামতের শোকর আদায়ের উত্তম তরীকা। তাছাড়া সাদাকাত, খয়রাত দিয়ে গরিব, নিরাশ্রয়, এতিম লোকদের প্রতিপালন ও দেখাশোনা করেও আল্লাহর প্রদত্ত নেয়ামতের শোকর আদায় করা উত্তম কাজ।
(গ) নেয়ামতকে প্রচার করা নেয়ামতের শোকর আদায় করার একটি তরীকা এও যে, মানুষ আল্লাহ প্রদত্ত নেয়ামতের বহুলভাবে প্রচার করবে। আনন্দ উদযাপনের সাথে সাথে অন্যের সামনেও এর আলোচনা করবে। এই দিক-নির্দেশনা কোরআনুল কারীমে এভাবে বিবৃত হয়েছে : অর্থাৎ এবং স্বীয় প্রভুর নেয়ামতসমূহকে খুব প্রচার কর। (সূরা আদ দোহা : আয়াত ১১)।
পূর্ববর্তী আলোচনায় নেয়ামতের কথা স্মরণ রাখা সম্বলিত কোরআনুল কারীমের নির্দেশসূচক বিবরণ তুলে ধরা হয়েছে এবং এর মর্ম হচ্ছে নেয়ামতকে যেন অন্তরে স্মরণ রাখা হয় এবং জবানের দ্বারা যেন এর চর্চা ও প্রচার করা হয়। তবে সেই জিকির ও স্মরণ মানুষের জন্য নয় বরং আল্লাহর জন্যই হতে হবে। উল্লেখিত আয়াতে নেয়ামতকে খোলাখুলি প্রচার করার হুকুম দেয়া হয়েছে। এর মর্ম হলো-আল্লাহপাকের মাখলুকের সামনে নেয়ামতকে প্রচার করা। সুতরাং স্মরণ রাখা ও প্রচার করার মধ্যে বুনিয়াদী পার্থক্য হল এই যে, জিকির ও স্মরণ উভয়ই আল্লাহর জন্য আর প্রচার কাজটির সম্পর্ক হল মাখলুকের সাথে। অর্থাৎ মানুষের মাঝে নেয়ামতের চর্চা করা, প্রচার করা। আল কোরআনে ইরশাদ হয়েছে :
অর্থাৎ অতএব তোমরা আমাকে স্মরণ করো, আমিও তোমাদেরকে স্মরণ, করবো এবং আমার শোকর আদায় কর এবং (আমার নেয়ামতের) অস্বীকার ও কুফুরী করো না। (সূরা বাকারা : আয়াত ১৫২)।
এই আয়াতে জিকিরের দ্বারা মুরাদ হল আল্লাহকে স্মরণ করা। আর নেয়ামতকে প্রচার করার মর্ম হলো, শুধু কেবল স্মরণ রাখাকেই যথেষ্ট মনে করবে না, বরং সেই নেয়ামতকে প্রচারও করতে হবে। যেন আল্লাহর মাখলুক সে সম্পর্কে অবহিত হয় এবং মানুষের মধ্যে এর চর্চা বেশি হয়। আর আল্লাহপাকের উদ্দেশ্যেও তাই। নেয়ামতের প্রচার ও প্রসারের মধ্যে বড় হেকমত হচ্ছে এই যে, আল্লাহর নেয়ামত নাজিলের বিষয়টি যেন মাখলুক পর্যন্ত পৌঁছে যায় এবং মানুষ অধিক হারে যেন শোকর আদায়ে অংশগ্রহণ করে। সুতরাং এ পর্যায়ে শোকর এবং প্রচারের মধ্যে বড় পার্থক্য এই দাঁড়াল যে, জিকির একা একাও আদায় করা যায়। আর এর প্রচার ও প্রসারের উদ্দেশ্যে হচ্ছে বড় বড় জলসায়, মজলিসে, সম্মেলনে মাখলুকের নিকট নেয়ামতের শোকর গুজারীর বিষয়টি পৌঁছে দেয়া। এর শোকর গুজারীর জন্য সেই নেয়ামতের শান ও মর্যাদা অনুসারে বড় বড় মাহফিল ও জনসমাবেশের আয়োজন করা এবং খোলাখুলিভাবে সর্বশ্রেষ্ঠ নেয়ামতের বিষয়টি আলোচনা করা।
(ঘ) নেয়ামতের প্রচার ও প্রসার কিভাবে করবে
লক্ষণীয় দৃষ্টিকোণ হচ্ছে এই যে, মুসলিম উম্মত নিজেদের নবী ও রাসূল (সা.)-এর শুভ জন্মের মতো শ্রেষ্ঠতর নেয়ামতের শোকরগুজারী করবে, এই নেয়ামতের প্রচার ও প্রসারে আত্মনিয়োগ করবে এটাই স্বাভাবিক। তবে এই নেয়ামতের স্মরণে কখনও কখনও হুজুর (সা.)-এর নাত পাঠ করা হয়, কখনও তাঁর সৌভাগ্যপূর্ণ বেলাদতের আলোচনা হয়, কখনও তাঁর উত্তম চরিত্রের বিষয়াদি আলোচিত হয়। আবার কেউ হুজুর (সা.)-এর হুসনে সুরত এবং দিলরুবা কর্ম প্রবাহের কথা আলোচনা করে। কেউ তাঁর বিন¤্র স্বভাব ও চিত্তাকর্ষক ব্যবহারের তফসীর করে এবং এই সর্বশ্রেষ্ঠ নেয়ামতকে স্মরণ করার বিভিন্ন তরীকা ও সুরত যা নেয়ামতের স্মরণের সাথে সংযুক্ত তা আদায় করে। এ সম্পর্কে যদি সামান্যতম চিন্তাও করা হয়, তাহলে বুঝা যাবে যে সকল মাহফিলে মীলাদের সাধারণ অবস্থা এটাই। আর এ সকল বিষয়ে আলোচনাকেই মীলাদ মাহফিলে বিশেষভাবে গুরুত্ব দেয়া হয়।
এক্ষেত্রে কারও অন্তরে যদি এই খেয়াল পয়দা হয় যে, হুজুর নবীয়ে আকরাম (সা.)-এর মীলাদ মাহফিলে তাঁর জিকির ও স্মরণ কিভাবে করা যায় এবং এর সীমারেখা ও শর্তাদি কিরূপ হবে এবং অতিরঞ্জন ও অতিসংকোচনের হাত হতে বেঁচে থেকে আমরা হুজুর নবীয়ে আকরাম (সা.)-এর স্মরণে তাঁর প্রশংসা কিভাবে করব? সুতরাং এ সকল জিজ্ঞাসার উত্তর রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর প্রশংসাকারীদের অন্যতম নেতা, মহব্বতের কাফেলার অগ্রবর্তী ইমাম শরফুদ্দীন বুসেরী (৬০৮-৬৯৬ হি.) কয়েকটি কবিতায় সুস্পষ্টভাবে অত্যন্ত সুন্দরভাবে প্রদান করেছেন, যা সকল সন্দেহ-জিজ্ঞাসা ও কূটচিন্তার অবসান ঘটিয়েছে।
তিনি বলেছেন :
অর্থাৎ নাসারাগণ (খ্রিস্টানগণ) স্বীয় নবী ঈসার ব্যাপারে খোদায়ীত্বের যে সকল দাবি করেছে (এবং তাকে খোদা, খোদার বেটা ইত্যাদি বানিয়ে সীমা লঙ্ঘনকারী ও কুফুরীর সাথে সংযুক্ত করেছে) তা বর্জন কর। হুজুর (সা.)-এর প্রশংসায় এ জাতীয় ভয়ঙ্কর সীমালঙ্ঘন ও অতিরঞ্জনের হাত হতে বিমুক্ত হয়ে তোমাদের মনে যা চায় তা বল এবং পূর্ণ বিশ্বাস ও আন্তরিকতার সাথে দোজাহানের বাদশাহের প্রশংসা কর। তিনি আরও বলেছেন :
অর্থাৎ-সেই পবিত্র সত্তার বুযুর্গী ও মহত্ত্বকে প্রচার কর, প্রকাশ কর এবং যে সকল শ্রেষ্ঠত্বকে চাও, হুজুর আকরাম (সা.)-এর সাথে সংযুক্ত কর এবং বুলন্দ হতে বুলন্দতর পন্থায় তা ব্যক্ত কর। অতঃপর তিনি বলেছেন : অর্থাৎ-এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর স্মরণে তাঁর প্রশংসা ও নাত সবদিক থেকেই জায়েয এবং উত্তম। তবে আমাদের উচিত খোদাইত্বের সাথে তাঁর নবুওতকে সংযুক্ত না করা এবং আল্লাহকে আল্লাহ মেনে তাঁর হামদ করা এবং রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে সাইয়েদুল আম্বিয়া ও সাইয়্যেদুল মুরসালিন হিসেবে স্মরণ ও সম্ভাষণ করা।
(ঙ) জশনে ঈদ বা ঈদের আনন্দ
নেয়ামতের স্মরণ এবং নেয়ামতের প্রচার এবং প্রসার ছাড়াও আল্লাহর নেয়ামতসমূহ ও অনুগ্রহসমূহের উপর শোকর গুজারী প্রকাশ করার একটি তরীকা এবং সুরত এই যে, এই খুশি ও আনন্দের প্রকাশ জশন এবং ঈদের মতো করে আদায় করা। পূর্ববর্তী উম্মতগণের মধ্যেও শোকর গুজারীর ক্ষেত্রে এই পদ্ধতি বলবৎ ছিল। যার কথা পূর্ববর্তী আলোচনায় স্থান লাভ করেছে। আর ইহা হচ্ছে সুন্নাতে আম্বিয়া যে, যেদিন আল্লাহপাকের কোন খাস নেয়ামত পাওয়া যায় সেই দিনকে ঈদ হিসেবে উদযাপন করা হয়। হযরত ঈসা (আ.) আল্লাহ রাব্বুল ইজ্জতের দরবারে এই কামনা পেশ করেছিলেন :
অর্থাৎ- হে আল্লাহ, হে আমার রব! আমাদের জন্য আকাশ হতে নেয়ামতের খাঞ্ঝা নাজিল করে দিন যে, (ইহার অবতরণের দিন) আমাদের জন্য ঈদ হয়ে যায়। আমাদের পূর্ববর্তীদের জন্যও এবং আমাদের পরবর্তীদের জন্যও। এ কথা মনে রাখা দরকার যে, এই খাঞ্ঝার মতো স্বল্পমেয়াদী নেয়ামত হাসিলের জন্য হযরত ঈসা (আ.) ঈদ উদযাপন করার কথা উল্লেখ করেছেন। সুতরাং এর প্রতি লক্ষ্য রেখে খ্রিস্টানগণ আজও রোববার দিন এই নেয়ামত লাভের শোকরিয়া স্বরূপ ঈদ উদযাপন করে। খাঞ্চা অবতরণের নেয়ামতকে আমাদের নেতা আমাদের মাওলা হুজুর সরওয়ারে কায়েনাত (সা.)-এর পৃথিবীতে আগমনের সাথে তুলনা করা যায় কি? কোন সম্পর্ক আছে কি? কোথায় সেই স্বল্পমেয়াদী খাঞ্চার নেয়ামত এবং কোথায় সেই চিরস্থায়ী উভয় জাহানে অবিনশ্বর নেয়ামত, যা হুজুর রাহমাতুল্লিল আলামিনের সুরতে মানব জাতির নসিব হয়েছে। এই উভয় নেয়ামতকে পরস্পর তুলনা করার কোন সুযোগই নেই। আমাদের জন্য চিন্তার বিষয় হচ্ছে এই যে, আমরা এই অবিনশ্বর ও চিরস্থায়ী নেয়ামতের উপর যথাযথভাবে শোকর আদায় করি, নাকি করছি না। এ ক্ষেত্রে ধাঞ্চার অবতরণ এবং বেলাদতে মোস্তফা (সা.)-এর সাথে তুলনা করা আমাদের উদ্দেশ্য নয়। বরং ইতিহাসের নিরিখে একটি গুরুত্বপূর্ণ ও বিশেষ দিক নির্দেশনার প্রতি ইশারা করা হচ্ছে মাত্র। খ্রিস্টানরা এখনও পর্যন্ত রোববার দিনে খুশি ও আনন্দ উদযাপন করে চলেছে। কেননা, রোববার দিন-ই তাদের উপর খাঞ্চা নাজিল হয়েছিল। পূর্ববর্তী উম্মতগণ খাঞ্চার মতো নেয়ামতের শোকর গুজারী স্বরূপ ঈদ উদযাপন করছে। যার বিবরণ আল কুরআনে সংরক্ষিত আছে। কেননা ইহাও আল্লাহর রেজামন্দি হাসিলের একটি সুরত ও সুন্নাতে আম্বিয়া (আ.)। যখন সাধারণত মামুলী ধরনের নেয়ামতের অর্জন এবং এর নাজিলের উপর ঈদ উদযাপন করা আম্বিয়া (আ.)-এর সুন্নাত এবং আল্লাহপাকের নির্দেশ পালন বলে সাব্যস্ত হয়েছে, তাহলে মিলাদে মোস্তফা (সা.)-এর মতো সর্বশ্রেষ্ঠ নেয়ামত অর্জনের উপর কেন খুশি মানানো যাবে না? আনন্দ প্রকাশ করা যাবে না? যার ওসিলায় এই সৃষ্ট জগত অস্তিত্ব লাভ করেছে এবং সব নেয়ামত তাঁর কারণেই দান করা হয়েছে। তাঁর স্মরণে কি এই উম্মত ঈদ উদযাপন করতে পারে না? প্রাণ ভরে তার স্মরণকে উজ্জীবিত করতে পারে না? পূর্ব বর্ণিত বিস্তৃত আলোচনার নিরিখে এ কথা সুস্পষ্ট অনুধাবন করা যায় যে, মিলাদুন্নবী (সা.)-এর অনুষ্ঠান করা, আলোচনার ব্যবস্থা করা আল কুলআনের বিধান মোতাবেক বৈধ ও পুণ্যময় আমল।
এর উপর কোনরকম আপত্তি উত্থাপন করা, ওজর পেশ করা বা অনিহার ভাব প্রদর্শন করা আল কুরআনের নির্দেশের বিরোধিতা ছাড়া কিছুই নয়। তবে বর্তমানে সবচেয়ে বড় প্রয়োজন হলো, ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.)-এর জায়েয ও বৈধ অনুষ্ঠানকে বিতর্কের বিষয় হিসেবে পরিচিত্রিত না করা এবং নিজের ঈমান ও আমলের মূলে কুঠারাঘাত করে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর শান ও মানকে ক্ষুণœ না করা। যে বা যারা রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর আদর্শকে অনুসরণ করার এবং তাঁর উম্মত হওয়ার দাবি করে অথচ তার বেলাদত ও মিলাদকে অবজ্ঞার দৃষ্টিতে অবলোকন করে, তারা কতখানি ঈমানদার এ বিষয়ে চিন্তার অবকাশ আছে। এ ব্যাপারে আল্লাহপাকই ভালো জানেন। তবে ঈমানদারদের উচিত মনেপ্রাণে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর জীবনাদর্শ মোতাবেক নিজের জীবনকে পরিচালনা করা এবং নবুওতের ফয়েজ ও বরকত দ্বারা অভিসিক্ত হওয়া। আল্লাহপাক আমাদের সে তাওফিক এনায়েত করুন, এটাই একান্ত প্রার্থনা।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: সত্যলোকের সন্ধানে : আল কোরআন : তাজকেরায়ে মীলাদ নামায়ে আম্বিয়া (আ.)
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ