Inqilab Logo

রবিবার, ৩০ জুন ২০২৪, ১৬ আষাঢ় ১৪৩১, ২৩ যিলহজ ১৪৪৫ হিজরী

খুলনায় নিষিদ্ধ পারশে পোনা আহরণ চক্রের সাথে প্রশাসন একাট্টা রেট বেড়েছে মাসোহারার

| প্রকাশের সময় : ৫ মার্চ, ২০১৭, ১২:০০ এএম

আশরাফুল ইসলাম নূর, খুলনা থেকে : সুন্দরবনে নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে দেদারছে চলছে পারসে পোনা আহরণ। পারসে পোনা আহরণ চক্রের সাথে উৎকোচের বিনিময়ে একাট্টা কোস্টগার্ড, বনবিভাগ ও নৌ পুলিশ! ব্যবসায়ীরা এসব দপ্তরে নিয়মিত অর্থ দিচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। খুলনার কয়রা, পাইকগাছা, দাকোপ ও সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলার একটি সংঘবদ্ধ চক্র এ ব্যবসার সাথে জড়িত। এ সুযোগকে কাজে লাগাচ্ছে বনদস্যু সিন্ডিকেট। তাদের মাধ্যমে বনদস্যুদের খাবারসহ অন্যান্য নিত্যপণ্য পৌঁছানো হয়। সম্প্রতি এ সম্পর্কিত প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ায় রেট বেড়েছে মাসোয়ারার।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, নিরাপদ রুট দিয়ে নিষিদ্ধ পারসে পোনা আনা-নেয়ার জন্য স্থানীয় প্রশাসনকে নির্ধারিত অংকের অর্থের বিনিময়ে ম্যানেজ করতে হয় ব্যবসায়ীদের। ব্যবসায়ীদের সূত্রটি জানিয়েছে, এক টিপ মাছ আনতে নলিয়ান রেঞ্জ অফিসকে দিতে হয় ৮ হাজার টাকা। এছাড়াও হড্ডা ও আদাবেকী ফরেস্ট অফিসে দিতে হয় তিন হাজার টাকা। অন্যদিকে, দুবলা ফরেস্ট অফিসের স্টেশন কর্মকর্তা হাবিবুল্লাহ ও সেকেন্ড অফিসারকে দিতে হয় প্রতিটিপে ৩০ হাজার টাকা। দুবলার কোস্টগার্ড বিভাগকে দিতে হয় ১০ হাজার টাকা। এদিকে, আলোরকোল এবং নারকেলবাড়িয়া ফরেস্ট অফিসকে প্রতি গোন অর্থাৎ পূর্ণিমা ও অমাবশ্যায় দিতে হয় ১০ হাজার টাকা।
বনবিভাগের একাধিক সূত্র জানায়, পারসের পোনা আনা নেয়ার নিরাপদ রুট হিসেবে ব্যবসায়ীদের নিকট বিবেচিত হচ্ছে শিবসা নদী। সুন্দরবনের বঙ্গবন্ধু চর, আলোর কোল, দুবলার চর, নেরালী, কালার মাথা, মজ্জতের গোড়া, মানিকখালী, নীলবাড়ি, নারকেলবাড়িয়া, টিয়ের চর ও হিরণ পয়েন্ট নীল কোমল অভয়ারণ্য এলাকা, কালিরচর, মালঞ্চ, রায়মঙ্গল, বাইর মান্দার বাড়ি এলাকা থেকে নেট জাল দিয়ে ধরা হয় এসব পোনা। পারসে পোনা আহরণের অধিকাংশ এলাকাই অভয়ারণ্য হিসেবে বিবেচিত। গহীন বনের এসব এলাকা থেকে পোনা আহরণ করে ট্রলারের মাধ্যমে আসে শিবসা নদীতে। সেখান থেকে নলিয়ান ফরেস্ট অফিসের সামনে দিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় পাইকগাছা মোকামে। পাইকগাছা ব্রীজের নিচে দক্ষিণ পাশে প্রকাশ্যে বেচাকেনা হয় এসব পোনা। এ মোকামটি নিয়ন্ত্রণ করেন লিটন নামে এক মৎস্য ব্যবসায়ী। এছাড়াও কোবাদক ফরেস্ট অফিসের সামনে দিয়ে আড়পাঙ্গাসী এলাকা হয়ে শ্যামনগরের ঝাপালিয়া বাজারেও বিক্রি হয় পোনা। এক কেজি পোনার দাম ২ হাজার থেকে ২২শ’ টাকা। একেকটি ট্রলার একট্রিপে কমপক্ষে ৩ মণ পোনা বহন করে। প্রতিটি ট্রলার মাসে এধরনের ট্রিপ দেয় ৪টি। প্রায় ২০টি ট্রলার মাসব্যাপী এ কাজ করে থাকে। নেটজাল দিয়ে পোনা ধরার কারণে নষ্ট হয় লাখ লাখ প্রজাতির জলজ প্রাণী। বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের (পাইকগাছা লোনাপানি গবেষণা কেন্দ্র) দেয়া তথ্য মতে, একটি পারসে/চিংড়ির পোনা আহরণের বিপরীতে ১১৯ চিংড়ি, ৩১২ জুপাঙ্কটন ও ৩১ টি সাদা প্রজাতির মাছের পোনা ধ্বংস হয়। এতসব ক্ষতি শিকার করেও স্বার্থান্বেষী মহল পারসে পোনা আহরণের কাজটি করছে।
জানা গেছে, পাইকগাছা, কয়রা ও আশাশুনি এলাকার ১২ মহাজন পারসে পোনা আহরণের কাজে নিয়োজিত। এরমধ্যে কয়রা উপজেলার ৩নং কয়রা গ্রামের রজব, জাহিদুল ইসলাম, জামাল হোসেন, ফারুক হোসেন, বেদকাশী ইউনিয়নের তাজমিনুর, আমিরুল, মালেক, ২ নং কয়রা গ্রামের মোজাম, আমজাদ, বাবলু, মহিবুল্লাহ, রহমান, পাইগাছার গড়ইখালী এলাকার ওমর আলী ও কামরুল ইসলাম। পোনা আহরণের এ মৌসুমে মহাজনদের মাধ্যমে বনদুস্যদের সরবরাহ করা হয় অর্থ, খাবার ও নিত্যপণ্য। আর কাজের প্রধান সমন্বয়ক হচ্ছে কয়রার বেদকাশী ইউনিয়নের আমিরুল ইসলাম ও কয়রা ইউনিয়নের রজব গাজী।
বন বিভাগের সূত্রটি আরও জানিয়েছে, সুন্দরবনে বর্তমানে ট্রলার চলাচল সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ। এরপরও পারসে পোনা আহরণের কাজে ট্রলার ব্যবহৃত হলেও বনবিভাগসহ অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অদৃশ্য কারণে নীরব। পোনা ধরে মোকাম পর্যন্ত নিয়ে যেতে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ৬ ধাপ পার হতে হয়। এরমধ্যে রয়েছে ফরেস্ট বিভাগ, নৌ-পুলিশ, কোস্টগার্ড, র‌্যাব, স্মার্ট পেট্রোল টিম ও স্থানীয় থানা পুলিশ। তবে গত দু’মাসে এসব দপ্তরের হাতে দুটি ট্রলার ছাড়া আর কোন পারসে পোনার ট্রলার ধরা পড়েনি। জানা গেছে, সুন্দরবনে পোনা ধরার আগেই এসব দপ্তরের কর্তাব্যক্তিদের ম্যানেজ করা হয়। তবে পারসে পোনা আহরণের বিষয়টি স্বীকার করেছেন পশ্চিম সুন্দরবন বিভাগীয় কর্মকর্তা সাঈদ আলী। তিনি বলেন, পারসে পোনা আহরণ চলছে বিষয়টি আমার জানা আছে। কিন্তু এই চেয়ারে বসে সব বিষয়ে নজর দেয়া সম্ভব নয়। এ কাজে বন বিভাগের কর্মকর্তাদের জড়িত থাকার বিষয়টিও স্বীকার করে তিনি বলেন, বিভিন্ন সুযোগ নিয়ে মহাজনদের সুবিধা দেয়া হয় আমি জানি। তবে এসব প্রতিরোধ করার বিষয়ে তিনি সচেষ্ট বলে দাবি করেন।
অপরদিকে, অর্থ নেয়ার বিষয়টি অস্বীকার করে নলিয়ান রেঞ্জ অফিসের রেঞ্জার মোঃ শোয়েব খান বলেন, পারসে পোনার জেলেরা চুপিসারে বনের ভেতর দিয়ে পোনা আনা নেয়া করে। আমাদের সজাগ দৃষ্টি থাকে এদিকে। খবর পেলেই আমরা তাদের আটক করি।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ