হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির খড়গ : আসামের এনআরসি এবং বাংলাদেশ
কিশোর শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক দাবীর আন্দোলনে ঢাকাসহ সারাদেশে তীব্র রাজনৈতিক উত্তেজনা ও অনিশ্চয়তা দেখা যাচ্ছিল,
আফতাব চৌধুরী : মানুষ এবং জীবজন্তুর সৃষ্টির দিনেই এ পৃথিবীতে সূর্যের কিরণ সঠিকভাবে পড়েছিল। জীবের প্রাণস্বরূপ বায়ুও সঠিক পরিমাণে ছিল। পরবর্তীকালে মানুষের বুদ্ধিবৃত্তিই এ দুটি জিনিসের মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টি করে। সহজ ভাষায় বলতে গেলে, সভ্যতার প্রগতি এবং মানুষের প্রকৃতিকে জয় করার শক্তির সঙ্গে যন্ত্রপাতির ব্যবহার বায়ুমন্ডলকে পূর্বের ন্যায় বিশুদ্ধ রাখেনি। অর্থাৎ মানুষ প্রকৃতির ওপর হাত দিয়ে প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট করে ফেলছে এবং সঙ্গে প্রাণীর প্রাণবায়ুকে দূষিত করছে। এখন সমগ্র বিশ্বের বায়ুমন্ডল এত দূষিত যে, পূর্বের অদূষণ অবস্থা ফিরিয়ে নিয়ে আসতে মানব জাতিকে সচেষ্ট না হলে আগামী কুড়ি বছর পর আমাদের এরূপ রস- গন্ধে ভরপুর পৃথিবী বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়বে। এক পরিসংখ্যান মতে, আমেরিকার কল-কারখানাগুলো বছরে ২ লাখ টন কার্বন-ডাই-অক্সাইড, ৯ লাখ টন সালফার ডাই-অক্সাইড, ৩ লাখ টন নাইট্রোজেন অক্সাইড, ১ লাখ টন হাইড্রোকার্বন এবং ৩ লাখ টন অন্যান্য অপজাত দ্রব্য বায়ুমন্ডলে ছেড়ে দেয়। সে দেশের প্রায় ১০ কোটি মোটরগাড়ী বছরে ৬ কোটি টন কার্বন মনোক্সাইড, ১ লাখ টন সালফার ডাই-অক্সাইড, ৬ লাখ টন নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইড এবং ১২ লাখ টন অন্যান্য বিষাক্ত পদার্থ বায়ুমন্ডলে ঘুরে বেড়ায়।
কল-কারখানা থেকে নির্গত ধোঁয়া কুন্ডলীতে প্রায় ৫ হাজারের মতো বিষাক্ত পদার্থ আছে। ঢাকার বায়ুমন্ডলে এ রকম প্রায় ৬০০ ধরনের বিষাক্ত পদার্থ আছে। বিজ্ঞানীদের বিভিন্ন গবেষণার প্রতিবেদন মতে, ঢাকা এবং আশপাশ এলাকার বায়ুতে ৬ টন ধূলিকণা, ১১৫ টন সালফার অক্সাইড, ৪৫০ টন কার্বন-ডাই-অক্সাইড, ৭৫ টন নাইট্রোজেন অক্সাইড এবং ১৫০ টনের মতো হাইড্রোকার্বন মিশে আছে। এ ছাড়াও অন্যান্য আরো ধূলিকণা আছে। এতসব নিয়ে মহানগরীতে বসবাসকারী লোকদের হাত-পা-হৃৎপিন্ড ভালোভাবে কাজ করবে কি? ঢাকায় মাত্র দুই দিন চলাফেরা করে একজন বিদেশি বিজ্ঞানী পর্যটক বলেছিলেন, ঢাকা দেখে মনে হলো যে, সৃষ্টিকর্তার এ পৃথিবীতে বায়ুরও মূল্য আছে। শুধু ঢাকা কেন, সারা দেশের কোনো শহরেই বিশুদ্ধ বায়ু পাওয়ার স্থান প্রায় নেই। দেশের সব শহরের বায়ুমন্ডলে আছে বিষাক্ত কণিকা ও গ্যাস। ঢাকা মহানগরী সম্পর্কে প্রকাশিত আরো কিছু তথ্য পরিবেশ বিজ্ঞানীরা চিহ্নিত করেছেন। এখানকার বায়ুমন্ডলে সালফার ডাই অক্সাইডের পরিমাণ বহুগুণে বেশি।
বায়ু দূষণের ক্ষেত্রে চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, বগুড়া, সিলেট, বরিশালের কথাও উল্লেখযোগ্য। এসব শহর ও শহরতলিতে ছোট-বড় কল-কারখানা, ইটের ভাটা শোধনাগার ইত্যাদি আছে। এসব থেকে নির্গত কালো ধোঁয়া উপরের বায়ুকে মারাত্মকভাবে দূষিত করছে। তেল এবং প্রাকৃতিক গ্যাস কমিশনের খনন কাজ শুধু পানিকেই নয়, নিকটবর্তী বায়ুমন্ডলকেও দূষিত করছে। কোনো কোনো জায়গায় প্রাকৃতিক গ্যাস সব সময় জ্বলে থাকার ফলে বায়ুমন্ডলের উষ্ণতা বাড়ছে। এর ফলে কৃষিকাজে বিঘœ ঘটছে। বাতাসে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ বাড়ছে। এদিকে বিভিন্ন স্থানে প্রতিষ্ঠিত সার কারখানার সালফার এবং এমোনিয়া মিশে বাতাসকে দূষিত করছে।
বাংলাদেশের বায়ুমন্ডল দূষিত হওয়ার অন্যতম কারণ হলো ক্রমাগত বনাঞ্চল উজাড়। অস্বাভাবিক হারে জনসংখ্যা বৃদ্ধি, সচেতনতার অভাব এবং বনাঞ্চল সৃষ্টির ব্যাপারে আন্তরিকতা ও দেশপ্রেমের অভাব। এছাড়া আইন প্রয়োগে কঠোরতা অবলম্বন না করা এবং লাগামহীন দুর্নীতিই বনাঞ্চল উজাড়ের মূল কারণ। বনাঞ্চল সঙ্কুচিত হওয়ার ফলে বায়ুমন্ডলে ধূলিকণার সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং এর ফলে বৃষ্টিপাত হ্রাস পাচ্ছে। এ ছাড়া অরণ্যরাজি ধ্বংসের ফলে মাটির স্বাভাবিক গঠন প্রকৃতিতে ব্যাঘাত সৃষ্টির ফলে বায়ুমন্ডলে অধিক কার্বন-ডাই-অক্সাইড মিশ্রিত হচ্ছে।
বায়ুমন্ডলে অনিষ্টকারী আরও দুটি উপাদান হলো রাসায়নিক সার এবং কীটনাশক দ্রব্য। পৃথিবীতে রাসায়নিক সারের উৎপাদন প্রতিবছর বেড়েই চলছে। ফলে বায়ুমন্ডলের নাইট্রোজেন যৌগের পরিমাণ অতিমাত্রায় বৃদ্ধি পাচ্ছে। ডিডিটি এবং অন্যান্য কীটনাশক দ্রব্য পানি ও বাতাসকে বিষাক্ত করছে। এ দ্রব্যগুলো অপরিকল্পিতভাবে কৃষিক্ষেত্রে প্রয়োগের ফলে বায়ু দূষিত হয় এবং ফলে জীবজগৎ অসুস্থ হয়ে পড়ে। এসব প্রয়োগের ফলে পৃথিবীর প্রাকৃতিক ভারসাম্য হারিয়ে এক বিরাট বিপদ ডেকে আনতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা মত প্রকাশ করছেন। বিষাক্ত কীটনাশক দূষণের অংশবিশেষ আমাদের খাদ্য, পানি এবং শ্বাস-প্রশ্বাসের সময় বাতাসের সঙ্গে মিশে আজকাল নানা ধরনের অশনাক্ত রোগ দেখা দিচ্ছে। ক্যান্সার, হাঁপানি এবং হৃদযন্ত্রের বেশির ভাগ রোগ ব্রঙ্কাইটিস, মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণও এ রোগের মধ্যে পড়ে।
মানুষ শক্তির বিকল্প উৎস সন্ধানের অনেক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সচরাচর ব্যবহৃত শক্তির উৎস অর্থাৎ কয়লা, প্রেট্রোলিয়াম এবং প্রাকৃতিক গ্যাসই পৃথিবীর শিল্প উদ্যোগগুলো চালাচ্ছে। এগুলোকে জীবাশ্ম ইন্ধন বলে। এগুলোর পরিমাণ অতি সীমিত, একদিন সব শেষ হয়ে যেতে পারে। এ ধরনের ইন্ধনের ব্যবহার ক্রমশ বেড়ে চলেছে। এটাকে জ্বালালে কল-কারখানা চালানোর শক্তি পাওয়া যায়। এর ফলে উৎপাদন বৃদ্ধি পায় কিন্তু অন্য একটা সমস্যারও সৃষ্টি করে। সমস্যাটি হলো, জীবাশ্ম ইন্ধন পুড়লে কার্বন-ডাই-অক্সাইড নির্গত হয় আর তা বাতাসের সঙ্গে মিশ্রিত হয়ে বাতাসে এর পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়ে বায়ুম-লের ক্ষতিসাধন করে। এখন বায়ুমন্ডলে পূর্বের তুলনায় ০.২ শতাংশ কার্বন-ডাই-অক্সাইড বেশি পাওয়া যাচ্ছে। পৃথিবীর আদি অবস্থায় যে পরিমাণ কার্বন-ডাই-অক্সাইড ছিল এখন তার তুলনায় শতকরা ১৫ ভাগ বেশি। যদি বর্তমান হারে কয়লা, পেট্রোলিয়াম ইত্যাদি জ্বলতে থাকে তাহলে কুড়ি বছরের মধ্যে এর পরিমাণ দ্বিগুণ হবে বলে বিশেষজ্ঞদের অভিমত। বায়ুমন্ডলের আরেকটি প্রদূষণ অত্যন্ত মারাত্মক। এখন সে বিষয়ে আসা যাক। আজকের যুগটি ইলেকট্রনিক্সের যুগ যদিও একাধারে পারমাণবিক যুগও। পরমাণু থেকে শক্তি জোগানোর জন্য এবং কোনো কোনো দেশে মারণাস্ত্র তৈরির উদ্দেশ্যে যে সকল কেন্দ্র আছে সে কেন্দ্রগুলো রেডিও অ্যাকটিভ ছাড়ছে না বলে ঘোষণা করলে এ বিষয়ে পাওয়া কিছু তথ্য বিজ্ঞানীদের চিন্তিত করে তুলেছে। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, পারমাণবিক প্রকল্পগুলো বায়ুমন্ডলে বিষাক্ত কণিকা সঞ্চিত করছে। এর ফল অতি বিষময়। অপরিচিত রোগ, বংশানুক্রমিক বিকলাঙ্গ অবস্থা এর সুদূর প্রসারী পরিণাম হতে পারে। আজকাল উন্নত দেশসমূহের কল-কারখানাগুলোর গঠন প্রকৃতি এমনভাবে সঙ্কোচন করা হয়েছে এবং শিল্পপতিরা পরিবেশ বিশুদ্ধতার উপর এত জোর দিচ্ছে যে, এসব কারখানা থেকে অতি ন্যূনতম পরিমাণ দুষিত পদার্থ জলবায়ুতে মিশতে পারে। এ কাজের জন্য একটি নতুন কারিগরি বিদ্যার উদ্ভব হয়েছে। এর নাম ENVIRONMENTAL ENGINEERING’S। এ ব্যবস্থাটি শিল্প পরিচালনায় অন্তর্ভুক্ত। এটা অত্যন্ত প্রশংসনীয় প্রতিকার ব্যবস্থা। এ পদ্ধতি হলো বাতাস এবং পানিতে মিশ্রিত হতে পারে এসব দূষিত জিনিসগুলো ধরে রাখার উপায় উদ্ভাবন এবং রাসায়নিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পুনর্ব্যবহার করা যায় এমন জিনিসে রূপান্তর করা। এ ব্যবস্থা দেশ-বিদেশে প্রয়োগ করা হচ্ছে। এটাকে বৈজ্ঞানিক ভাষায় ‘ক্যামিক্যাল রিসাইকিং’ বলে। বিকল্প ব্যবস্থা হলো কয়লা, পেট্রোল ইত্যাদি জ্বালানির পরিবর্তে সৌরশক্তি, পানিশক্তি, বাতাসশক্তি ইত্যাদিকে শক্তি হিসাবে কল-কারখানায় প্রয়োগ। এক্ষেত্রে ব্যবহার অতিসীমিত; তবে অনুসন্ধান চলছে। এ ছাড়া কীটনাশক দ্রব্যের উৎপাদন এবং ব্যবহার কমাতে হবে আর তা করতে হলে সুপ্রজনন বিদ্যার গবেষণার মাধ্যমে কীটপতঙ্গের আক্রমণমুক্ত শস্য উদ্ভাবন করতে হবে। এর একটা পন্থা হচ্ছে হুল দিয়ে হুল তোলা। কিছু সংখ্যক কীটপতঙ্গ নিয়ন্ত্রিত অবস্থায় থাকে এ রকম গবেষণার মাধ্যমে কীটপতঙ্গ দিয়ে কীটপতঙ্গ ধ্বংস করার জৈবিক উদ্ভাবনের পন্থা আবিষ্কার করতে হবে। আনন্দের কথা, বিশ্বজুড়ে এ দুটি বিষয় নিয়ে যথেষ্ট প্রচেষ্টা চলছে। অবশ্য সব থেকে প্রধান কাজ হলো, সরকারের পক্ষ থেকে জনগণের মধ্যে সামাজিক চেতনা জাগ্রত করে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করা এবং বনজ সম্পদকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করা। এ ব্যাপারে অবশ্য জাতিসংঘের মাধ্যমে প্রচেষ্টা চলছে। বাংলাদেশে বনানীকরণের জন্য যে কাজকর্ম চলছে তা আশানুরূপ নয়। এটাকে আরো জোরদার করতে হবে। পরিবেশ সুরক্ষার ব্যাপারে সরকারকে তৎপর এবং আইন প্রয়োগে কঠোর হতে হবে। সৃষ্টি করতে হবে সচেতনতা সকল মানুষের মধ্যে। সবশেষে এটাই বলা যায়, মানব জাতির মধ্যে যদি সুবিবেচনা জাগ্রত হয় এবং দেশ তথা শিল্পোদ্যোগসমূহ যদি বায়ুর প্রদূষণ রোধ করার ব্যবস্থাদি ঐকান্তিকভাবে হাতে নেয়, তাহলে আমরা দেখব, একদিন বিশুদ্ধ বায়ুমন্ডল এবং শক্তিমত্তা সূর্য এ ধরণীকে অধিক মনোরম করে তুলছে।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট। বৃক্ষরোপণে জাতীয় পুরস্কার (১ম স্বর্ণপদক) প্রাপ্ত।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।